কুকুর-মন

কেউ ছেড়ে যেতে চাইলে তাকে যেতে দিন; যে থাকতে চায়, তার যত্ন নিন। যদি এমন হয়, থাকতে চাওয়ার মানুষটা আপনার পছন্দের নয়, তবে নিজের সাথে বাঁচতে শিখুন।

কিছু মানুষ থাকে, যাদের সাথে মিশতে আপনি পছন্দ করেন না। আপনি নিজেও কারও কারও চোখে সেই কিছু মানুষের দলে। এটা মেনে নিন। নিজের বেলায় আপনি যে-দর্শনে চলছেন, আপনার পছন্দের মানুষের বেলায় একই যাপন মেনে নিতে আপনার এত অসুবিধে হচ্ছে কেন?

বিরক্ত করার চাইতে বরং উপেক্ষিত হ‌ওয়া অধিক সম্মানের। উপেক্ষিত হবার চাইতে বরং উপেক্ষা করার সুযোগটুকুও না দেওয়া অধিক স্বস্তির। মন বেহায়া হলে হোক, আপনি বেহায়া না হলেই তো হলো, তাই না? আপনি, আপনার মন, আপনার বুদ্ধি ভিন্ন তিনটি সত্তা। মন ও বুদ্ধির বস হয়ে উঠুন; তাহলে দেখবেন, সব ঠিকঠাক।

মানুষকে বড়োজোর বেঁধে রাখা যায়, কিন্তু ধরে রাখা যায় না। আপনার ওপর থেকে কারও মন উঠে গেলে তাকে আর কিছু দিয়েই ধরে রাখতে পারবেন না। আপনি যার যাপন‌ই নন, তাকে ভুল করেও আপনার জীবন বানিয়ে বসবেন না।

মানুষের মন কুকুরের মতন। অপ্রিয় প্রভুর সাথে রাজপ্রাসাদে থাকার চেয়ে বরং প্রিয় প্রভুর সাথে ভাঙা রাস্তায় থাকাতেই তার স্বাচ্ছন্দ্য। মন যা চায় না, ধনও তাকে রাখতে পারে না।

যে আপনার সাথে থাকতে চায়, তাকে বসার জন্য ছোট্ট একটুকরো পিঁড়ি দিলেও সে থেকে যাবার জায়গা ঠিকই বানিয়ে নেবে। আর যে থাকতে চায় না, তাকে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে দিলেও তার দমবন্ধ হয়ে আসবে এবং সে জানলা খুলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে হাঁসফাঁস করবে। দেবতাও প্রাসাদের ভোগী হতে চান না, প্রসাদের ভক্ত পেতে চান।

মানুষের মন খুব কঠিন জিনিস। যেতে না দিয়ে তাকে আটকে রাখলে স্রেফ সাপের খোলসের মতন একটা খোলসই পাবেন, যার ভেতরে আদতে মানুষটিই নেই, কিছু রক্তমাংস ছাড়া আর কিছুই নেই। মন রাখতে না পারলে জোর করে মানুষ রেখেও কী লাভ!

যেতে দিন তাকে, যে পালাতে ব্যস্ত। পোষমানা পাখি উড়তে জানলেও উড়ে যায় না, খাঁচার দরজা খোলা রাখলেও সে পালায় না। মানুষ পাখির মতন—পোষ না মানলে খাঁচায় আটকে রাখলেও তার মন থাকে আকাশের দিকে।

যে সম্পর্কের বাঁধন গলার টুটি চেপে ধরে, যে পরিচয়ের সিল মগজে ক্যানসার ধরায়, তেমন সম্পর্ক কিংবা পরিচয় বরং নষ্ট করে দেওয়াই বুদ্ধিমত্তা। মানুষ অবশ্য বুদ্ধিমত্তার চাইতে আবেগকে বেশি প্রাধান্য দেয়; আর দেয় বলেই মরে। কেউ মরে বার্ধক্যে, কেউবা মরে আবেগে।

দু-জন মানুষ সম্পর্কের দড়িতে ঝুলে প্রতিটি মুহূর্তে মরে মরে এক-শো বছর বাঁচার চেয়ে বরং পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে দু-জন আলাদা হয়ে মুক্ত পাখির মতন দু-চারটা দিন শান্তিতে বাঁচাটা সুখের। মানুষ বদলায়। এই বদলে যাওয়াটা মানতে না পারলে ভাবনা বদলানো ছাড়া আর কোনো উপায় সত্যিই নেই। হয় বদলাবেন, নয় পস্তাবেন।

তাকেও বাঁচতে দিন, নিজেও বাঁচুন। দুই-চার-দশ বছর কম বাঁচুন, তবুও যে-কটা দিন বাঁচছেন, সে-কটা দিন যেন সত্যি সত্যি বেঁচেই মরতে পারেন। আয়ু তো নিজে নিজেই ফুরোয়, ওতে কীসের কৃতিত্ব? বাঁচতে যে হয় নিজেকেই!

অশান্তিতে হাজার বছর বাঁচার চেয়ে বরং শান্তিতে দু-চার বছর বাঁচুন।