কাব্যলক্ষ্মী, তোমাকে… (শেষ পর্ব)

 
আমি হয়তো ওই আকাশের চাঁদেরই মতো, কিন্তু আমার নিজেকে তোমার আকাশের পাখি মনে হয়। এত বিশাল এক আকাশ তুমি আমাকে দিয়েছ, যেখানে এই জীবনের প্রতিটা মুহূর্তেও যদি তোমার আকাশে বিচরণ করেই কাটিয়ে দিই, তা হলেও হয়তো এর বিশালতার সবটা আমার দেখা হবে না। আমার মন জানে, আমার হৃদয়ের বিশুদ্ধ আকুতি কেবলই তোমাকে ঘিরে। কী দিয়ে ভরাব তোমার ওই আকাশের বিস্তীর্ণ ক্যানভাস, সে আমি নিজেও জানি না। হয়তো ওসব না জানলেও নিজের জায়গাটুকু, তোমার কাছ থেকে নিজের জগতটুকু ঠিক ঠিক বাগিয়ে নেব, দেখে নিয়ো! তুমি তো জানো, আমি চুরি করতে আসিনি, এসেছি অর্জন করতে। চাঁদটা তোমার ঠিকই থাকবে, শুধু আমি নেব তোমার আকাশটা। তোমার লেখাগুলি আমি সব সময়ই পড়ি। কী করে যে তোমার মনের মতো হয়ে উঠি, এটা আমাকে ভাবায়। তুমি যে বল, তোমার আর আমার চিন্তার মাঝে অনেক অনেক মিল, আসলে তোমার মনের মতো হতে আমার বিশেষ কিছু করতে হয়নি। তোমার লেখনি, তোমার চিন্তাগুলি ঠিক আমার ভেতরটা যেভাবে টেনে আনে, আমিও তোমার হতে থাকি ঠিক সেভাবেই। কাউকে ভালোবেসে ফেললে, যদি তার কিছুটাও ভালোবাসা তার কাছ থেকে পাওয়া যায়, তবে আপনাআপনিই তার মনের মতোই একটা মানুষ হয়ে যাওয়া যায়। তার সব কিছুই তো তখন ভালো লাগে, ফলে সে ভালোলাগা থেকেই নিজেকে তার মনের মতো করেই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে, সে তাগিদ থেকে কিছুতেই বেরোনো যায় না। এ এক আশ্চর্য রহস্য, এ এক অচ্ছেদ্য মায়াজাল।


একদিন বলেছিলাম না, আমার পুরোটাই আসলে তুমি? আমি যখন তোমার হয়ে উঠি, তখন আমার ভেতরে যে জয়ের সৌধ তৈরি হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে, সেটি ধীরে ধীরে আরও উঁচু হতে থাকে। নিজেকে তার ভালোবাসার মানুষের কাছে সমার্পিত করতে পারাই ভালোবাসার আসল ঐশ্বর্য। আর নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত করতে পারলেই মানুষ বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। হয়তো সে পাওয়ায় পুরনো নিজেকে আর পাওয়া যায় না, কিন্তু নিজের ঊর্ধ্বে উঠে যে প্রাপ্তি, সে প্রাপ্তির চাইতে বড়ো প্রাপ্তি আর কিছু কী হতে পারে? কারও কাব্যলক্ষ্মী হতে গেলে এই পরিশুদ্ধতাই তাকে সেই আসনে বসায়। যে লক্ষ্মীর বসবাস আর আশ্রয় আমাদের এই মনে, সে যে কেবল হৃদয়ের পরিশুদ্ধতাটুকুই খোঁজে! তোমার ‘অস্পষ্ট জার্নাল’ সিরিজের সবগুলি লেখাই আমাকে ভীষণ টানে। ওখানের আটটা সিরিজই আমার নোটে রাখা। যখন কোনও কারণে মন অশান্ত হয়ে যেত, ওগুলি পড়তাম অনেক আগে থেকেই। তোমার ‘রমণীয় সুরবিষাদ’র লেখাটাও অনেক বার পড়েছি। ভাস্কর চক্রবর্তীর লেখাগুলি তুমি পছন্দ কর, জানি, বিশেষ করে ‘শয়নযান’টা পড়তে বলেছ, কিন্তু ওঁর লেখা পড়া হয়নি কখনও। কেবল তোমার কোনও এক লেখায় ওঁর কবিতার দুটি লাইন পড়েছিলাম--- ‘রক্তে বিষ মিশে আছে, প্রিয়তমা, এখন জীবন যায়, আস্তে, চলে যায়।’ আহা, জীবনের কী এক মসৃণ মোলায়েম ইন্দ্রজাল!...এটুকুই জানি ওঁর লেখা কবিতার।


তোমার ‘অস্পষ্ট জার্নাল’ সিরিজের লেখাগুলি পড়লে মাথায় কেবল একটি কথা আসে, কারও হৃদয় ঠিক কতটা পরিশুদ্ধ হলে, এমন একটা লেখা লিখে ফেলা যায়! কিছু কিছু লেখা যে স্রেফ লেখালেখির চর্চা থেকে নয়, বরং মনের পরিশুদ্ধতা থেকেই আসে, সে কি আমার চেয়ে তুমিই ভালো জানো না? আসলে স্রষ্টার সাথে যোগাযোগ বলতে কী বোঝায়, এর অর্থ কী, প্রার্থনার অর্থ কী, এ প্রশ্নগুলি সব উত্তরই আমি তোমার ওই লেখাটি পড়েই জেনেছি। প্রার্থনার অর্থই হচ্ছে, তোমার ভেতরের ‘তুমি’র সাথে যোগাযোগের একটা উপায়, আর এই প্রার্থনা যে যত নিখুঁতভাবে ভাবে করতে পারে, সে তত সুখী, সে তত সফল এবং সে তত বড়ো একজন মানুষ। সেই মানুষ তত বেশি শান্তিতে থাকতে পারে, তত বেশি সুন্দর সৃষ্টি করতে পারে, যে তার ইবাদতটা ঠিকভাবে করতে পারে। ইবাদতটা ঠিকঠাক করতে জানা অনেক বড়ো একটা ব্যাপার। একজন ব্যাটসম্যান যখন খেলতে নামে, তখন তার সম্পূর্ণ মনোযোগ তার সেই বলের উপরেই থাকে, যে ব্যাটসম্যান যত ভালো করে বলের দিকে মনোযোগ দিতে পারে, সে তত ভালো ব্যাটসম্যান। তখন তার কাছে ওই বলটাই তার স্রষ্টা। তখন তার হৃদয় ও আত্মা,---তার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক,---দুটোই একসাথে করে ওই বলের উপরেই মনোযোগ দিতে হবে। তখন তার পৃথিবীর সবচাইতে প্রিয় যে মানুষটা, সেই মানুষটার কথাও মনে আনা যাবে না। কারও জন্ম বা কারও মৃত্যু তাকে ওই সময়টাতে বিচলিত না করুক। যদি সে ওই মুহূর্তে অন্য কোনও কিছুই মাথায় আনে, তা হলে সে খেলতে পারবে না, সে চার-ছক্কা মারতে পারবে না। যে যত ভালো ব্যাটসম্যান, সে তত ভালো বল বোঝে। এই বল বোঝার কাজটাই তার জন্য ইবাদত।


অনেক সময় কোনও খেলোয়াড় যখন ছক্কা মারার পর উপরের দিকে তাকায়, তখন তার অর্থ হচ্ছে, সে তখন প্রার্থনা করে তার স্রষ্টার কাছে, কেননা তার বিশ্বাস যে স্রষ্টা উপরে আছেন। আবার কেউ যদি বিশ্বাস করে একটা ঘড়ির দিকেও তাকায়, তা হলেও সেই একই ফল পাবে। স্রষ্টার অবস্থান তো মানুষের হৃদয়ে, তাই সেই হৃদয়টাকেই জাগানোর উদ্দেশ্যে মানুষ যেখানেই স্রষ্টা আছেন বলে বিশ্বাস করে নেয়, এবং যখন সেখানে নিজের মনকে, নিজের আত্মাকে নিয়ে যায়, তখন তার মনের ভেতরের ‘আমি’টা জেগে ওঠে, তার একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব তার দেহে, তার মানসিকতায়, তার ভাবনায় পড়ে, ফলে মানুষ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। কাজটা যে যত ভালোভাবে করতে পারে, সে তত ভালো খেলোয়াড়। পুরো ব্যাপারটাই সম্পূর্ণই বিশ্বাসের। ব্যাটসম্যান তার স্রষ্টাকে বিশ্বাস করে যেদিকেই তাকায়, সেদিকেই তার স্রষ্টার অধিষ্ঠান তৈরি হয়ে যায়। বিশ্বাসটা আসলে কোন দিকে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। পারফর্ম করাটাই এখানে মুখ্য, কোন দিকে তাকাচ্ছে, সেটা নয়। যখন, যেই মুহূর্তে একটা মানুষ কোনও এক দিকে বিশ্বাস করে সেদিকে তাকায়, সেই মুহূর্তেই তার হৃদয় প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে শুরু করে। ভেতর থেকে জবাব পাঠানো শুরু হয় যে সে এখন স্রষ্টার সাথে সংযুক্ত হয়েছে। এমন একটা সিগনাল পেয়ে তখন সে খুশি হয়, তার মধ্যে একটা আত্নবিশ্বাস জেগে ওঠে। আর ওই আত্নবিশ্বাসটুকুর জন্যই সে পরের বলে আবার ছক্কা মারতে পারে। স্রষ্টা মূলত তার হৃদয়েই বাস করেন, তার ভেতরের ‘আমি’র জাগরণ মানেই স্রষ্টার কৃপালাভ। যে যত ভালো করে তার নিজের ভেতরটাকে জাগাতে পারে, সে তত ভালো থাকে, স্বস্তিতে থাকে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে পারে। স্রষ্টার সাথে সংযোগস্থাপনের জন্য এই সহজ বিষয়টা বুঝতে না পেরে একেই পুঁজি করে আমরা পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করি। হায়, কী এক মূর্খতা! অথচ সব পথেরই মূলকথা একটাই---স্রষ্টার সাথে সংযোগস্থাপন। আমাদের বাহ্যিক সব কিছুই মানুষের তৈরি, আর মৌলিক সব কিছুই কেবল স্রষ্টার সাথে সংযুক্তির মাধ্যমেই ঘটে। স্রষ্টা মানেই কিন্তু ভেতরের মানুষটা। হৃদয় যখন কথা বলে, তখন সেটাই স্রষ্টার আলাপ। এই কাজটা যে যত ভালোভাবে করতে পারে, সে তত বড়ো বিশ্বাসী, সে তত বড়ো ভক্ত।


আমার সপ্তপদী ভালোবাসায়,
সে জানে না কতটা তার বিচরণ।
আমার প্রতিটি অলিগলিতে
তার উপস্থিতি আমাকে কতটা কাঁপায়,
তার কিছুই কি তার জানা আছে?
তোমার ভালোবাসা, তোমার গুরুত্ব আমাকে আমার সব অলিখিত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়, যেগুলি বহুকাল আমাকে ভেতরে ভেতরে পুড়িয়েছে। এখন আমার কাছে কেউ সেই সমস্যাগুলি নিয়ে এলে ওগুলি আমাকে আর আগের মতো ভাবায় না। ক্ষতটা না থাকুক, কিন্তু ক্ষতের দাগটা চোখে পড়তেই সেই ঘটনাগুলি মনে পড়ে যায়। এজন্যই ওরা আমার কাছে তাদের ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান চাইতে এলে তখন সেই পুরনো দিনগুলির কথা মনে আসে, আর আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে আমার মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হয় যে আমার জীবনে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ রয়ে গেছে। যতদিন কেউ তাদের সমস্যা নিয়ে না আসে অথবা তেমন কোনও কিছু আমার সামনে না ঘটে, ততদিন আমি সব কিছু ভুলে থাকি। আবার যখন ওরা আসতে থাকে ওদের সমস্যাগুলি নিয়ে, যখন ভাবতে থাকি যে কীভাবে এর একটা সমাধান বের করা যায়, তখন আমার অতীত যেন আমার দিকে আবারও নানান প্রশ্ন ছুড়তে থাকে। কিন্তু বিয়ে ডিভোর্স এসব নিয়ে আমার এত কথা বলতে ভালো লাগে না। এসবকে পুরনো মনে হয়। যদিও কিছু জিনিস আমাকে ভেতরে ভেতরে কিছুটা হলেও চিন্তিত করে রাখে, আর সে বিষয়গুলি এই যে, আমি যাদেরকে নতুন করে জীবন শুরু করতে অথবা পেছনের সব কিছু ভুলে আবারও শুরু করতে বলি, আসলে আমি কাজটা ঠিক করছি কি না। আমার কাজগুলি নিয়ে নিজের ভেতরে একটা ভয় কাজ করতে থাকে, আমি কোথাও কোনও ভুল করছি না তো? আমি ওদের ক্ষতি করছি না তো সাহায্যের নামে?


কিছু কথা তোমাকে আজ বলতে ইচ্ছে করছে। আমার বিচ্ছেদের ঘটনাটা কেন জানি আজও আমি মেনে নিতে পারি না, জানো? কেন জানি মনে হয়, আমি তো কারও ক্ষতি করিনি কখনও, তা হলে আমার সাথে কেন এমন হবে? সব সময় খুব সাধারণ, নির্ঝঞ্ঝাট একটা সাদামাটা জীবন চেয়ে এসেছি আমি। তা হলে আমার জীবনটাই কেন এমন এলোমেলো হবে? এর কোনও উত্তর আজও পাইনি। তবে কিছু প্রশ্নের উত্তর আজ আমি পেয়েছি। ওরা যখন একটা সম্পর্কের বিচ্ছেদের জন্য আমার কাছে সাহায্য চাইত, তখন আমি কল্পনা করে নিতাম, সমস্যাগুলি আমার, সুতরাং এখন নিজে সেই অবস্থানে আছি, এটা মাথায় রেখেই সমাধান করতে হবে। আমি আসলে ভাঙনের ঘোরবিরোধী ছিলাম। কোনও কিছু অযথাই ভেঙে যাবে, সম্পর্কগুলিকে এতটা সস্তা কখনও ভাবিনি। আমার মনে হতো, সব সময়ই মনে হতো, একটা সম্পর্ককে অবশ্যই অন্য পাঁচটা মূল্যবান বিষয়ের মতোই দেখতে হবে। আমি সব সময়ই সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছি, কারণ এই পৃথিবীতে মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে সম্পর্কগুলিকে টিকিয়ে রাখতে হবে এবং যত্নে রাখতে হবে। হয়তো সেটা একা কারও পক্ষে সম্ভব না, কিন্তু কাউকে না কাউকে ধরে রাখতেই হবে, মানুষ যদিও শেষমেষ ধাক্কা খেয়েই শেখে। এসব কিছু কারণেই বিচ্ছেদ আমার বরাবরই অপছন্দের ছিল, আর এজন্যেই হয়তো স্রষ্টা আমাকে এমনই এক পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছেন। যে যা সহ্য করতে পারে না, তার সাথে তেমন কিছুই বেশি হয়, তাকে তা-ই সহ্য করতে হয়।


না, আমি বিচ্ছেদকে কখনও ভয় পাইনি, কেবল গুরুত্ব দিয়েছি। ওরা যখনই আমার কাছে ওদের ব্যক্তিগত-জীবনের, ওদের দাম্পত্যজীবনের সমস্যাগুলি খুলে বলত, তখন প্রথমেই আমার যেটা মনে আসত সেটা হচ্ছে, এই মানুষগুলি এদের একেবারে ভেতরের কথাগুলি, যা কেবলই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে থাকার কথা, সেগুলি কেন আমার কাছে খুলে বলছে? ঠিক যেন জনসম্মুখে বস্ত্রহরণের মতোই দেখতে বিষয়গুলি। একে অপরের উপর ঠিক কতটা অসম্মান আর অশ্রদ্ধা পুষে রাখলে এমনটা করা যায়, সেটা কিছুটা হলেও আমার জানা আছে। তবে যতই ক্ষোভ থাকুক না কেন, এমনটা না করাই উচিত, কেননা এসবের মধ্যে দিয়ে দুজনের বিষয়েই অনেক নোংরাকথা উঠে আসে, যেগুলি অন্য কেউ না জানলে, অন্য কাউকেই না জানালেও সত্যিই কিছু ক্ষতি হয় না। প্রত্যেকটা মানুষেরই উচিত একে অপরের দোষ যতটা সম্ভব ঢেকে রাখা। দুটো মানুষ পরস্পরের সাথে থাকতে পারছে না। ওরা দুজন দুই রকমের, দুই ভাবনার। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, সে বিচারে না গিয়ে যদি ধরে নিই, দুটোই ঠিক,---কেননা যার যার ভাবনা তার তার জীবনের পুঁজি,---তখন মনে হয়, হয়তো দুজনই দুজনের জায়গায় দাঁড়িয়ে ঠিক, তবে তারা একে অন্যের ভাবনাটাকে সহজভাবে নিতে পারছে না। সেক্ষেত্রে তারা নাহয় আলাদাই হয়ে যাক, তবু পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধটুকু থাকুক। আর যা-ই হোক, দুজন তো একসাথে কাটিয়েছে একসময়, সেই সময়টাতে কি একটাও মুহূর্ত ছিল না যখন দুজনের দুজনকে ভালো লেগেছে? সে ভালোলাগাটুকুর কি কোনও দামই নেই? হ্যাঁ, ওরা আলাদা হয়ে যাচ্ছে, ভালো কথা, তার মানে কি এটাই যে এখন দুজনকে দুজনের শত্রু হয়ে যেতেই হবে? ওরা তো নিজেরা ভালোথাকার জন্যই আলাদা হচ্ছে, তাই না? তো থাকুক না দুজন দুজনকে সহনশীলতার সীমায় রেখে! এতে করে আর যা-ই হোক, অন্তত একজন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি সম্মানটুকু বজায় থাকে।


আমি চাইতাম, যদি বিচ্ছেদ হয়েই যায়, তারপরও যেন তাদের কারওই একে অপরের উপরে কোনও হিংসাত্মক মনোভাব না থাকে, অথবা তারা যেন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে না ওঠে। কেননা দিনশেষে আমরা সবাই মানুষ এবং আমাদেরই ভুল হয়, হবে, সে আমরা যতই সতর্ক থাকি না কেন। অন্যের ভুলটা দেখার সময় আমরা প্রায়ই নিজের ভুলের প্রতি উদাসীন হয়ে থাকি। অন্যের গালের কাটাদাগটা আগে চোখে পড়ে, নিজের গালে যে এত এত গর্ত, তার কথা কয়জনের মনে থাকে তখন? কখনও কখনও তাদের কেউ কেউ আমাকে দূর থেকে দেখেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলত, আবার কেউ কেউ আসত পরামর্শের জন্যে। আমি কাউকে কখনও ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত দিইনি অথবা নিজের মতো করে একটা রায় দিয়ে দিইনি, কেননা আমি জানতাম, যদি আমি ভুল করি, তা হলে এই মানুষগুলিকে এর ফল ভোগ করতে হবে এবং সাথে আমাকেও। কাউকে সৎপরামর্শ দিতে না পারলে চুপ করে থাকা বা ‘আমি এটা নিয়ে জানি না।’ বলে দেওয়াই ভালো, ভুলভাল পরামর্শ দিয়ে তাকে বিপদগ্রস্ত করা বা ঝামেলায় ফেলে দেওয়া একধরনের পাপ।


আমি কেবল তারা কোন অবস্থানে আছে, তাদের সেই অবস্থান থেকে কোনও ভুল হচ্ছে কি না, সেক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় তাদের কতটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, সেগুলিই দেখাবার চেষ্টা করেছি, কেননা আমরা চাইলেও পৃথিবীর সব কিছু অথবা বাহ্যিক তেমন কোনও কিছুই নিয়ন্ত্রণ-করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার এও মনে হতো, এত সহজ একটা বিষয়ে অন্যের কাছে সমাধান চাওয়ার কোনও কারণই হয় না। তবে ওরা কেন আমার কাছে এল? পরক্ষণেই ভাবি, আমরা যখন আসলে কোনও সমস্যায় পড়ি, অথবা কঠিন কোনও সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাই, আমাদের মন, আমাদের মস্তিষ্ক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তখন অস্থির আর অশান্ত থাকে। তখন সহজ একটা বিষয়ও আমাদের চোখে ভীষণ কঠিন মনে হয়। এজন্যই আমরা তখন নিজেদের সমস্যার সমাধানের জন্যে অন্যের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াই। আমরা তাদের কাছেই যাই, যারা ইতোমধ্যেই সেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন এবং সমাধানও বের করেছেন। এটাই আসলে সঠিক পদক্ষেপ। যে যে-ই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়, সে-ই পরিস্থিতি সম্পর্কে তার চেয়ে ভালো আর কে-ই বা জানে? তারপরও ভয় হতো যখন কেউ দশটাবছরের সংসার ছেড়ে চলে আসত। তখন মনে হতো এমন কী হলো যে দশটাবছর বয়ে বেড়াবার পরেও তাদের মনে হলো, তারা আর পারছে না অথবা যে আমার সামনে এসেছে সে আর পারছে না? আসলে মানুষের নানান রকমের দুঃখ থাকে।


একপক্ষ থেকে কারও কথা শুনে অন্যপক্ষকে বিচার করার মতো মানুষ আমি নই, যদিও সব সময় দুপক্ষই আমার কাছে আসত না। তারপরও তাদের সম্পর্কগুলি কোনও না কোনওভাবে টিকিয়ে দেওয়া যায় কি না, সব সময় সে চেষ্টাই আমি করেছি। যখনই ব্যর্থ হয়েছি, তখন আবার আমার কাজগুলিকে পুনর্বিবেচনা করেছি যে আমার কোথাও ভুল হয়েছে কি না। সবশেষে যখন দেখেছি, এর চাইতে বেশি আমার আর কিছুই করার ছিল না, কেননা সম্পর্কগুলিকে শেষপর্যন্ত টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাই আমি করেছি। তারপরও নিজের মাঝে একটা দ্বিধা কাজ করত এই ভেবে যে আমি কি কেবলই ভেঙেই চলেছি অথবা আমি কেবলই ভাঙতে পারি? কিছুই কি জোড়া লাগাতে পারি না? যদিও আমি জানতাম যেখানে আমাদের কারওই কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না, সেটা স্রষ্টার ইশারাতেই হয়। তারপর তুমি যখন আমাকে বললে, আমি কিচ্ছু ভুল করিনি, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি এবং এটাই আমার কাজ, আমি কেবল এটুকুই করতে পারি, বাকিটা অবশ্যই স্রষ্টা দেখবেন, তখন নিজের ভেতর একটা ভীষণ স্বস্তি কাজ করছিল এই ভেবে যে, আমি ভুল ছিলাম না। আমি সঠিক পথই ধরেছিলাম।


সেদিনের তোমার সেই কথাগুলি শোনার পর থেকে নিজের উপর থেকে অনেক বড়ো একটা বোঝা নেমে গিয়েছিল। এতদিন যে একটা চাপা-অপরাধবোধ আর নিজের প্রতি নিজেরই একটা ধিক্কার জন্মেছিল এই ভেবে যে আমি কেবলই ভাঙতে জানি, কিছুই জোড়া লাগাতে জানি না, সে বোঝাটা ক্রমেই আজ আমার শক্তি হয়েছে। বরং তুমি যখন বলেছ, একটা সম্পর্ক যখন আসলে ভেঙে যায়, তখন যা হয়, তা হচ্ছে, অনেক চেষ্টার পরই আসলে মানুষ বাধ্য হয় অহেতুক ভুল চেষ্টা থেকে সরে আসতে, আর সেটাই হওয়া উচিত। যে মানুষটা দশটা বছরের চেষ্টার পর এসে আমার কাছে আসছে নতুন একটা জীবনের আশা নিয়ে, নতুন করে বাঁচার আশা নিয়ে, সেই মানুষটা তো বিগত দশটা বছর সে সম্পর্কটা মেরামতের চেষ্টাই করে এসেছে এবং তাতে যখন আর নতুন কোনও সমাধানই সে পাচ্ছে না, তখনই তো সে আসে আমার কাছে। এদিকে আমার মনে হয়েছে, ইস্‌, কত কষ্টই না আমি ওদের দিয়েছি প্রথম প্রথম, যখন ওদের দিয়ে সম্পর্কটাকে বারেবারে একই জায়গায় ফেরত পাঠিয়েছি আর চেষ্টা করিয়েছি। এটা আসলে ঠিক নয়। জোর করে কিছু হয় না। যদি জোর করে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা হয়, তবে সেখান থেকে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। আসলে সেসময় আসলে আমার মনে হতো, ওরা কেউই তো আমি নিজে যে অবস্থায় যে পরিস্থিতিতে বিচ্ছেদে গিয়েছিলাম, সে অবস্থায় নেই, তা হলে আমি কী করে ওদের হুটহাট একটা কিছু করতে বলি? অনেক ক্ষেত্রেই আমি নিরপেক্ষ ছিলাম। আমি কখনও কারও উপর কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিইনি, কারণ আমি জানি, তার জীবনটা তাকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে, আমি হয়তো কেবল সম্ভাব্য পথগুলি দেখাতে পারি।


আমি জানতাম, আমিও হয়তো ভুল হতে পারি। কিন্তু আজ আমার সত্যি ভালো লাগে যখন দেখি, ওরা আগের চাইতে ভালো আছে। ওরা যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, ওদের ভালোথাকাই আমি চেয়েছিলাম। আসলে এসব ক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে অবস্থান নেওয়াই উচিত। ওরা যেমনটা আশা করে, যা শুনতে চায়, ওদের সেটাই বলা উচিত। ওরা আসলে জানে ওদের কী করা উচিত। ওরা আমার কাছে আসে কেবল ওদের মনের কথাটি আমার মুখ থেকে শুনতে, আর কিছু নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরনো জায়গায় ফিরে না যাওয়াই ভালো। কেন? কারণ আসলে একটা ডিভোর্স যখন হয়, এমন একটা সম্পর্ক যখন ভাঙে, তখন আসলে অনেক যন্ত্রণা থেকেই তা হয়। পুরনো জায়গায় ফিরে গিয়ে সুখী হয়েছে, এরকম খুব কমই হয়েছে। বরং নতুন কোনও জায়গায় অন্য আর একজন মানুষের সাথে ভালো আছে, সুখী হয়েছে, এমনটা দেখা গেছে অনেক। পুরনো জায়গায় ফিরে গিয়ে সুখী হয়েছে, এরকম আসলে হয় না। কেননা সে তো দিনের পর দিন চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তারপর সেখান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে আমার দুঘন্টা অথবা দুদিন কাউন্সেলিংয়ের পরও যদি তাকে আবারও সেই পুরনো জায়গায় ফিরে যেতে হয়, তা হলে সে তো এর আগেও দুবছর-চারবছর ধরে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েই এসেছে আমার কাছে, তাই না? তো, এসেছে কেন? শেষমেশ সেই একই সমাধানের উদ্দেশ্যে?


পেছনে ফিরে গেলেই বরং অনেক কিছু চুপচাপ সহ্য করে নিতে হয়। মুখবুজে সহ্য করে যেতে হয়, অনেক কিছুই না চাইতেও গিলে ফেলতে হয়। এমন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত দেওয়ার অর্থই হচ্ছে, মানুষটাকে মানসিকভাবে মেরে ফেলা। মানুষের প্রথম কাজই হচ্ছে সুখেথাকা, আনন্দেথাকা। মানুষ যেকোনও মুহূর্তে মরে যেতে পারে, আর মরে যাবার পর সেই মানুষটা বেঁচে থাকার দিনগুলিতে সুখে ছিল, না কি কষ্টে ছিল, এসব কেউ খোঁজ রাখে না। এটা নিয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনও মানুষের কোনও রকম মাথাব্যথাও থাকে না, কারও কিচ্ছু এসে যায় না অন্যের সুখে থাকায় অথবা কষ্টে থাকায়। কেবল সেই ব্যক্তিটিই নিজে দুঃখী ছিল, এছাড়া আর কিছুই না। তার যত অপ্রাপ্তি, সবই নিজের সাথে। আর যদি তার কোনও প্রাপ্তি থেকেও থাকে, তা হলে সেগুলি তার একার নয়, কেননা প্রাপ্তিকে ভাগ করা যায় এবং ভাগ করা হয়। নিজের প্রাপ্তি কেউ একা ভোগ করতে পারে না। কিন্তু যন্ত্রণা ও অপ্রাপ্তি কেবলই নিজের। দুঃখ কেবলই নিজের, সুখগুলিকে ভাগাভাগি করা যায়। মানুষের অর্জনকে ভোগ করার সময় পাশে অনেককেই পাওয়া যায় না চাইতেও, কিন্তু ব্যর্থতা সম্পূর্ণ একার ও তা নিজেকেই ভোগ করতে হয়, তা সে যত কষ্টই হোক না কেন।


একজন ডাক্তারের কাছে যখন রোগীরা যায়, তখন রোগ সারাতে যতটা যায়, তার চেয়ে বেশি এটা শুনতে যায় যে, আপনি ভালো হয়ে যাবেন। সেই একই মানুষ যখন ডাক্তার ছাড়া তার অন্য কোনও কাছের মানুষের সাথে কথা বলে, তখন সেই মানুষটার কাছে কিন্তু সে ওই কথাটা শুনতে চায় না যেটি সে ডাক্তারের কাছে থেকে শুনতে চায়। সে তখন তার সেই কাছের মানুষটার কাছে সহমর্মিতা চায়, একটু নির্ভার আশ্রয় চায়। কারণ তার কাছের মানুষটা ডাক্তার না, আর সেটা সে জানে। এজন্যই আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন কথা আশা করি। আমি জানি, আমার কাছে যারা আসে, তারা আমার কাছ থেকে যা শুনতে চায়, আমি তাদের সে কথা শোনাই, সে সাহসটাই দিই, যা তাদের ওই মুহূর্তে দরকার। আমার কাছে এসেও যদি তারা সেই পুরনো অবস্থাতেই ফিরে যায়, তা হলে তো আমার কাছে আসার প্রয়োজন ছিল না, কেননা তারা ইতোমধ্যেই সে চেষ্টা করে ফেলেছে এবং উপায়ান্তর না দেখেই আমার কাছে এসেছে। ধরলাম, সে নাহয় আমার কথা শুনে তার ভুলগুলি শুধরে ফেলল। সে নিজেকে বদলেই ফেলল সম্পর্কের স্বার্থে। কিন্তু অপরপক্ষ তো আমার কথা শোনেনি, সুতরাং সেই পক্ষ কিন্তু তার জায়গা থেকে একটুও নড়বে না। সে আগের মতোই থেকে যাবে এবং আগের ভুলগুলির পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। বরং সে যদি নমনীয় হয়, তা হলে বিপরীত ব্যক্তিটি তাকে আরও পেয়ে বসবে। দুজনকে, দুইপক্ষকে একসাথে বসিয়ে এমন ঝামেলা মেটানো কখনও কখনও সম্ভব। কিন্তু কোনও একপক্ষকে শুধরে দিয়ে একটা সম্পর্ক ঠিক করা যায় না, এটা অসম্ভব। বরং যদি আমি তাদের দুজনকেই কথাগুলি শোনাতে পারি, তা হলে হয়তো তাদের বাকি জীবনটুকু সুন্দর হবে, সুখে কাটবে, তা-ও যদি ওরা আমার কথাগুলি মেনে নেয় বা মেনে নেওয়ার মতো মনে করে আরকি! একইসাথে তারা মানসিকভাবে অনেক শক্তি অর্জন করবে, যেটা আমি ওরকম করে না বললে তারা পারবে না। তারা নিজেরা নিজেদের জন্য যা করতে পারবে, তা অন্য কারও পক্ষে তাদের জন্য করা অসম্ভব। আমি যদি সেই মানুষটাকে বা মানুষ দুজনকে কিছুটা সাহস, কিছুটা শান্তি দিতে পারি, তা হলেই প্রকৃতপক্ষে আমি সঠিক কাজটি করছি।


কখনও কখনও এটা ভেবেও মন খারাপ হয় যে, কতজনকে আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। কোনও সাহায্য করিনি। আমি যদি তাদের সাথে কিছু কথা বলতাম, হয়তো তারা ভালো থাকতো, হয়তো তাদের জীবনটাও আগের চাইতে একটু ভালো হতো। কিন্তু আমি যে এ-ও দেখেছি, অনেকেই বিয়েটাকে একটা ছেলেখেলা হিসেবেই ধরে নেয়। সম্পর্কগুলিকে যেনতেনভাবে ব্যবহার করতে থাকে। বিয়ে একটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা আমি আমার জীবন থেকে শিখেছি। সেটা অবশ্যই, আমার অভিভাবক যাঁরা ছিলেন, তাঁদের শেখাবার দায়িত্ব ছিল, কেননা এ বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। প্রতিটা সম্পর্কেই যে একটা সম্মান একটা শ্রদ্ধাবোধ রাখা উচিত এবং থাকা উচিত, এটা আমি আমার পরিবার থেকে শিখিনি। শিখেছি নিজে নিজে। বিয়ে কেবলই একটা সম্পর্ক নয়, এটা বাকি জীবনটা স্বস্তিতে কাটাবার প্রশ্ন, কিছু প্রিয় মানুষকে নিয়ে কাটাবার প্রশ্ন, যেখানে সব চাহিদা পূরণ না হলেও সম্পর্কগুলি সুস্থ থাকে, একে অপরকে নিয়ে ভাবে, একে অপরের সমব্যথী হয়ে ওঠে। দারিদ্র্য, নানান সীমাবদ্ধতা, কষ্ট নিয়েও সুখী হওয়া যায় যদি পারস্পরিক বোঝাপড়াটা ঠিকঠাক থাকে। আমাদের মিলেমিশে আর ভাগ করে থাকতে হবে কেবলই নিজেদের প্রয়োজনে। অন্যের প্রয়োজনে নয়। এটা বোঝাবার দায়িত্ব ছিল আমাদের অভিভাবকদের, যাঁরা একদিন হলেও আমাদের আগে পৃথিবীতে এসেছেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরাই কী এক ছায়ার পেছনে ছুটে চলেছেন, এতটাই যে, তাঁদের সবচাইতে মূল্যবান যেসব জিনিস, সেগুলিই ভিত্তিহীন ও মূল্যহীন হয়ে পড়ছে এবং তারা হয়তো সব হারিয়ে ফেলার আগ পর্যন্ত সেটা কখনওই টের পাবেন না।


আমরা দিনরাত পরিশ্রম করছি নিজেদের জন্য, নিজের কাছের মানুষদের একটু ভালো রাখার জন্য আর কিছুটা পার্থিব সুখ এনে দেবার লোভে। অথচ এসবের ভিড়ে সেই মানুষগুলিকেই ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি নিজের অজান্তেই। আমরা জোর করছি, অন্যদেরকে আমরা নিজেদের মনের মতো হতে জোর করে চলেছি। নিজের ধ্যানধারণা প্রতিনিয়তই আমরা আমাদের কাছের মানুষ, আমাদের আশেপাশের মানুষগুলিকে মেনে চলার জন্য বাধ্য করছি, নয়তো চাপিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু সব সহ্যেরই একটা সীমা আছে আর যখন কোনও কিছু তার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন সেটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে বাধ্য, পাল্টাজবাব দিতে বাধ্য। আমরা ভাবছি, আমাদের দোষ কোথায়! এটা ভাবতে আমাদের ভালো লাগছে। আমরা যতদিন নিজেদের নির্দোষ ভাবতেই থাকব, ততদিন আমাদের সাথে এর চাইতে ভালো কিছু আর কী আর হতে পারে? যাদের উপর আমরা আমাদের সিদ্ধান্তগুলি জোর করে চাপিয়ে দিই, তাদের মধ্যে যারা বাধ্য হয়ে সেগুলি মেনে নেয়, তারাও একদিন ঠিকই জেগে ওঠে, তারাও একদিন নিজেদের সিদ্ধান্তগুলি নিজেরা নিতে শেখে। আমরা কি ভেবে দেখি কখনও যে নিজেদের অপরাধী-মুখটা আমরা কী করে লুকাই তাদের কাছ থেকে? তাদের ঘৃণার, তাদের ধিক্কারের থুতু একদিন ঠিকই আমাদের মুখে এসেই পড়ে। তাদের আমরা যে কষ্টের মধ্যে ঠেলে দিয়েছি, সেখানে থাকতে বাধ্য করেছি দিনের পর দিন কোনও কারণ ছাড়াই, কেবলই নিজেদের জেদ বা ইচ্ছে পূরণ করার জন্য, সেই একই কষ্ট যদি কখনও নিজেদেরও ঘাড়ে বহন করে চলতে হয়, সেইদিনটা আসার আগ পর্যন্ত আমরা কয়জন বুঝি এটা? আমরা আসলেই আমাদের কর্মের ফলই ভোগ করি।


প্রিয় কাব্যলক্ষ্মী, তুমি যখন বল, আমি ভালো কবিতা লিখি অথবা বল, আমি অনেক লক্ষ্মী, তখন আমি কাকে বোঝাই, আমার যা-কিছু আছে, যা-কিছু তোমাকে আমার কাছে আনে, তার সবটাই কেবলই তোমার তৈরি! আমি আসলে তেমন কিছু শিখিনি, অথবা যা-কিছু আমি শিখেছলাম, সেগুলি কিছু ভুলেভরা ডায়রি ছাড়া আর কিছুই নয়। সেগুলি আমি পুড়িয়ে ফেলেছি, যদিও জীবনের শিক্ষাগুলিকে পুড়িয়ে ফেলা যায় না, যা প্রতিদিন এক একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা শিখি। তারপরও আমি চাইনি তোমার কাছে ভালো হতে, চাই না তোমার পছন্দের হতেও, কিন্তু আমার যা-কিছু ভুল, যা-কিছু আমার অযত্নে-গড়া, তুমি এসে যখন সেগুলি শুধরে দাও, তখন মনে হয়, আজ এতদিন পর আমি আমার নিজের কাউকে পেয়েছি, যার কাছে আমার সব কিছুর গুরুত্ব আছে। আমার ভালো, আমরা মন্দ, তার সবটা হয়তো শুধরে ফেলা যাবে না, কিন্তু আমাকে আমার মতো করে গ্রহণ করার মতো কেউ কখনও ছিল না। আমি যার কাছেই যেতাম, সেই কেবল আমার ভুলগুলি নখ উঁচিয়ে ধরিয়ে দিত। তখন আমার কেবলই মনে হতো, আমি কি কেবলই ভুলেভরা যাচ্ছেতাই একটা মানুষ? আমি কি কিছুই শিখিনি? আমার ভেতরে ভালো বলে কিছুই কি নেই? ওরা কখনও আমার ভেতরে যায়নি। আমিই যেতে দিইনি কাউকে, কারণ আমি মনে করি, যার আমার সবটা ধারণ করার ক্ষমতা নেই, তার আমার সম্পর্কে কিছুই জানার কোনও অধিকারও নেই।


ডিভোর্স নিয়ে আমার বিশেষ কোনও মাথাব্যথা নেই, কেননা ওটা আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক আর পুরনো একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যদিও তুমি বলেছিলে, ওসব বিষয় সব সময় প্রাসঙ্গিক। আজ থেকে একহাজার বছর আগে যখন কেউ কাউকে ছেড়ে চলে যেত, তখন তার যেরকম অনুভূতি হতো, আজ এখনও ওরকম অনুভূতি হয় এবং ভবিষ্যতেও আজ থেকে একহাজার বছর পরে ঠিক তেমন অনুভূতিই হবে। এগুলি কখনও পুরনো হয় না, এগুলি চিরন্তন। মানুষের ভেতর তার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার প্রতিনিয়তই যে ভয়টা কাজ করে, এই হারিয়ে যাবার অথবা হারিয়ে ফেলবার ভয়টা সবার ভেতরেই কাজ করে, আগেও করত, সামনেও করবে। এই অনুভূতিগুলি চিরন্তন। মানুষে মানুষে কখনও রকমফের হয় না। তুমিই আমাকে শিখিয়েছ, যে সমস্যাগুলি অর্থ দিয়ে সমাধান করা যায় না, সেগুলির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের একটু সাহস দিলেই চলে। একটু সাহসদেখানো, নতুন করে জীবন শুরু করার স্বপ্নদেখানো। আহা, এইটুকুই-বা কয়জন করে? মানুষ বড়ো ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে, তার চাইতে বড়ো কথা, মানুষ বড়ো মনুষ্যত্বহীন হয়ে পড়ছে।


সবার পরিস্থিতি আসলে এক রকম হয় না। সবার মানসিক শক্তি, সক্ষমতাও একরকম নয়। সেক্ষেত্রে আমি হয়তো আমার অভিজ্ঞতাটুকু শেয়ার করতে পারি, কিন্তু সেগুলিকে কীভাবে তাদের নিজেদের জীবনে কাজে লাগাবে, সেটা আমি বলে দিতে পারি না। সেই কাজগুলি অবশ্যই তাদেরকেই করতে হবে। কেননা আমার নিজের বেলায় সেই কাজটার প্রতি আমার যতটা আন্তরিকতা, যতটা স্রষ্টার উপর বিশ্বাস ছিল, ঠিক ততটা প্রার্থনা, ততটা আন্তরিক সদিচ্ছাই মানুষকে তার কঠিন মুহূর্তগুলি পার করতে সাহায্য করে। আমি তখন বারেবারে প্রার্থনা করেছি, স্রষ্টাকে ডেকেছি, এর অর্থ হচ্ছে, মূলত আমি নিজের ভেতরটাকে জাগিয়েছি। ক্রমাগত প্রার্থনা করার মধ্য দিয়ে আমি নিজেকে তৈরি করে নিয়েছি সেই পরিস্থিতিটা সামাল দেওয়ার উপযুক্ত করে। নিজের হৃদয়কে জাগিয়ে তোলার জন্য এর চাইতে সহজ কোনও রাস্তা আমার চোখের সামনে ছিল না, কেননা এই রাস্তাটিতে আমি জন্ম থেকেই হেঁটে চলেছি, তাই এটা আমার সুপরিচিত ও পরীক্ষিত। আমি সৃষ্টিকর্তার বিষয়টাকে এমন করে দেখি যে, আমি যত বেশি প্রার্থনা করব, আমার ভেতরটা তত বেশি জেগে উঠবে। ভেতরটা জেগে উঠলে আমার মধ্যে একধরনের শক্তি ও আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে, যা আমার চেষ্টায় সরাসরি প্রভাব ফেলবে। আর আমার চেষ্টার একটা ফল আমি দেখতে পাব। ওই ফলটাকে পেতে হলে আমাকে বেশি বেশি চেষ্টা করতে হবে, বেশি বেশি প্রার্থনা করতে হবে, বেশি বেশি নিজেকে স্রষ্টার কাছে পুরোপুরি সমর্পণ করতে হবে।


যখন কোনও কিছুর উপর আর কোনও প্রকার নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তখন সেটা পুরোপুরি স্রষ্টার কাছে সমর্পণ করাই আসল কাজ। যদি আমরা ওই বিষয়গুলি স্রষ্টার উপর ছেড়ে না দিয়ে বরং অযথা বেশি চিন্তিত থাকি, তা হলে বিষয়গুলি আমাদের উপর আরও বাজেভাবে চড়ে বসবে, অথচ যখনই আমরা বিষয়গুলি সম্পূর্ণ স্রষ্টার উপর ছেড়ে দিই, তখন যে ব্যাপারটা ঘটে, সেটা হচ্ছে, আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে এই সিগন্যাল পাঠাচ্ছি যে, আমরা ওই বিষয়টি নিয়ে আর চিন্তিত হব না। আমাদের মস্তিষ্ক কোনও ধর্ম বোঝে না, সেটি কেবলই আমাদের পাঠানো সিগনালটা বোঝে ও সে অনুযায়ী কাজ করে। সুতরাং কোনও বিশ্বাস নিয়ে যখনই আমরা কোনও কিছু পুরোপুরি স্রষ্টার কাছে সমর্পণ করি, ভাবি, স্রষ্টা এবার যা খুশি করুন, তখন এর অর্থ হচ্ছে, আমাদের মস্তিষ্ক এই মেসেজটা পেয়ে যায় যে সে এখন এটা নিয়ে আর কোনও দুশ্চিন্তা করবে না। আমাদের মস্তিষ্ক তখন ধীরে ধীরে ওই বিষয়টা নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা করা বন্ধ করে দেয়, আর যখনই আমাদের মস্তিষ্ক কোনও বিষয় দুশ্চিন্তা করা বন্ধ করে দেয়, তখন সেটা দ্রুত ইতিবাচক ফল দিতে থাকে।


‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করলে অনেককে বলতে শুনি, ‘আলহামদুল্লিলাহ, ভালো আছি।’ কিংবা ‘ভগবানের কৃপায় ভালো আছি।’ কিংবা এই ধরনের কোনও স্বস্তিদায়ক কথা। এর অর্থ আসলে কী? আমি এটা বলার মানে কি আমি আসলেই ভালো আছি? তা সব সময় না-ও হতে পারে। যারা ওরকম করে বলে, তাদের জীবনটা যে আমাদের জীবনের চাইতে সুখী বা সহজ, তা কিন্তু নয়। আমি যখন ওটা বলি, তখন এর অর্থ হলো, ঠিক সে মুহূর্তে আমি নিজের ব্রেইনকে এই সিগনালটা পাঠাচ্ছি যে আমি বর্তমানে যে অবস্থায়ই থাকি না, তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি স্রষ্টার উপর ছেড়ে দিলাম। ব্রেইন তখন ধরে নেয়, এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকার কোনও দরকার নেই। যা করার, তিনিই করবেন। তখন আমরা বাড়তি কিছু শক্তি পাই মনের মধ্যে, কিছু শান্তিও একইসাথে চলে আসে। এই যে আত্মার জাগরণ, আত্মার দুশ্চিন্তামুক্তি, আত্মার পরিশুদ্ধি---এটাই বড়ো কথা, এটাই ধর্মের মূলকাজ, এটাই ধর্মাচরণের প্রাপ্তি। যারা এরকম করে ভাবছে না, তাদের অনেকের চাইতে, স্রেফ এইটুকু বিশ্বাস, আমাকে অনেক ভালো রাখতে পারে, যদিও প্রকৃত অবস্থা বা পরিস্থিতি একই থেকে যাচ্ছে। আমাদের যাবতীয় দুঃখের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি প্রায়ই ঘটে আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরে। সেখান থেকে বের হয়ে বাঁচার টেকনিকগুলি একবার শিখে নিতে পারলে এবং সেগুলির নিয়মিত চর্চা করলে জীবনে অনেক ধরনের প্রশান্তি পাওয়া যায়। ভয় বা উদ্বেগ কমিয়ে বাঁচতে পারলে বাঁচাটা অনেক সহজ হয়ে ওঠে।


আসলে আমাদের জীবনটা প্রতিনিয়তই আমাদের নতুন করে বাঁচার, নতুন কিছু ভাবার সুযোগ দেয়। আমরা নিজেরাই মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন খুঁজতে থাকি। প্রতিনিয়তই কিছু দ্বিধা্‌, কিছু সংকোচ আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় এক একটা অলীকস্বপ্নের পেছনে, আর তখন সেই স্বপ্নের পিছু ছুটতে ছুটতে আমরা আমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্যই হারিয়ে ফেলি। আমাদের জীবনটা কি কেবল কোনও গন্তব্যের দিকে ছুটে চলে, না কি জীবনটা কেবলই একটা দীর্ঘপথ, যেটাতে আমৃত্যু কেবল চলতেই হয়? যেটাই হোক না, জীবনের মানে আমি যা বুঝি, তা হলো, যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন সামনের দিকে যেতে হবে। এমন নয় যে, সব সময়ই জয়ের মুকুট পরেই আমরা চলব, ব্যর্থতা থাকবে, লজ্জা থাকবে, কান্না থাকবে। তবে জয় পরাজয় যা-ই আসুক না কেন, থেমে যাওয়া যাবে না, নিজেকে ভেতর থেকে ধাক্কাটা মেরে যেতেই হবে আমৃত্যুই। এখানে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থেমে যাবার কোনও অপশন নেই। কেবল মৃত্যুই পারে সব কিছু থামিয়ে দিতে।