কাউকে জাজ করা নিয়ে

প্রথম পরিচয়েই বা বিনা পরিচয়েই কেউ আপনাকে জাজ করে ফেলেছেন? কিংবা পরিচয়‌ই হলো না, কেউ হয়তো আপনার সম্পর্কে শুনেছেন ও ভেবেছেন, আর তাতেই অনুমানের উপর ভিত্তি করে তিনি আপনাকে জাজ করে ফেলেছেন!

মন খারাপ হয় কেউ ওরকম করলে? বিরক্ত লাগে? বিব্রত হন?

আপনাকে প্রথমদেখায় ভেবেছিলাম, আপনার খুব অহংকার!
আপনাকে দেখে মনে হয়, আপনি খুব ভারিক্কি স্বভাবের; কিন্তু আপনি যে এত মজার মানুষ, না মিশলে বুঝতেই পারতাম না!
সবাই বলে, আপনি অনেক নাকউঁচা মানুষ, কিন্তু এখন তো দেখছি, আপনি একদমই সহজ মাটির মানুষ!

উপরের কথাগুলো শুনেছেন তো নিজের সম্পর্কে, তাই না?
আমরা সবাই কমবেশি কথাগুলো শুনেছি। লোকের একটা স্বভাব: অন্যকে জাজ করা—বুঝে হোক, অর্ধেক বুঝে হোক, না বুঝেই হোক—জাজ করতে খুবই পছন্দ করেন, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক।

জাজ আমরা সবাই-ই করি—সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে। আপনি অন্যকে জাজ করছেন, কিংবা অন্য কেউ আপনাকে জাজ করছেন, দুই ক্ষেত্রেই জাজমেন্টটা করা হচ্ছে কিছু মতামত, অনুমান, অনুভূতি এবং কখনো কখনো তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে। আমরা প্রতিদিন‌ই এমন শতশত জাজমেন্ট করি।

জাজমেন্ট মাত্রেই খারাপ, তা কিন্তু নয়। ইতিবাচকভাবে যখন কার‌ও সম্পর্কে মতামত দিই, তখন তাতে তাঁর কোনো ক্ষতি হয় না।

জাজমেন্ট তখনই বড়ো একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, যখন আমরা কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ না পেয়েও স্রেফ অনুমান, পক্ষপাতদুষ্ট মতামত এবং রিপুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কারও সম্পর্কে অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর এবং অসত্য জাজমেন্ট দিই এবং তা ছড়াই।
হয়েছে আপনার সাথে এরকম?

প্রায় সময়ই দেখা যায়, লোকে আমাদের ভুল বুঝেই নানান কথাবার্তা বলতে ও ছড়াতে থাকে। কেউ আমাদের না বুঝুক, ক্ষতি নেই, কিন্তু ভুল বুঝলে খুব বাজে অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন খুব মন খারাপ হয়, অস্থিরতা কাজ করে, নিজেকে খুব অসহায় লাগে। আবার কিছু লোক আমাদের সম্পর্কে না জেনেই ভুলভাল ভেবে বসে থাকেন। ওরকম বাজেভাবে জাজড হলে আবেগতাড়িত হয়ে তখন কেউ কেউ এমন অঘটন ঘটিয়ে বসেন, যা তাঁর নিজের এবং তাঁর চারপাশের মানুষের জন্য ক্ষতিকর।

কারও সাথে খুব ভালো আচরণ করলাম, আর তিনি আমাকে সহজলভ্য ভেবে বসলেন।

কারও উপকার করার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলাম, আর তিনি আমাকে সস্তা ভেবে বসলেন।

আমার অপছন্দের বিষয়টি নিয়ে কাউকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আর উনি ভেবে নিলেন, আমি খুব অসহিষ্ণু।

হয়তো কেউ আমার কাছ থেকে এমন কিছু চাইলেন, যা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, এবং যখন‌ই তাঁকে এটা বলতে গেলাম, তখন তিনি ভেবে নিলেন, আমার অনেক দম্ভ।

আরও বিশ্রী ব্যাপার, কারও সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি, আলাপ হয়নি, তবু আমাকে নিয়ে একগাদা জাজমেন্ট তাঁর মাথায় গিজগিজ করছে। তাঁর ধারণা, তিনি আমাকে নিয়ে যা যা ভাবেন, তার কিছুই ভুল নয়।
আহা, মানুষ পারেও!

কিছু লোক আপনার সম্পর্কে সামান্য জানেন। আর ওটুকু দিয়েই ওঁরা আপনার পুরোটা নিয়ে কথা বলেন। হয় কী, জানেন? ওঁরা আপনার সম্পর্কে যেটুকু জানেন, তা ওঁদের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি তৈরি করে। হয়তো এমনও হতে পারে, আপনার অস্তিত্বের ওই খানিকটা অংশ ওঁদের অস্তিত্বের পুরোটা নাড়িয়ে দেয়। আপনাকে কীরকম জানি সহ্য করতে হয় ওঁদের, যদিও চাইলেই ওঁরা আপনাকে সহজে ইগনোর করতে পারতেন!
 
কেন ওরকম হয়, তা ওঁরা নিজেরাই জানেন না। তখন ওঁরা আপনাকে জাজ করে বসেন। জাজ করলে বোধ হয় দুর্বল প্রকৃতির লোকের কষ্ট কমে।

সত্য এভাবেই বিকৃত হয়। সত্যকে দেখতে হয় সত্যের চোখের লেন্সে, নিজের চোখের লেন্সে নয়। সাপেক্ষ সত্য সবসময়ই আমাদের ভুল জায়গায় নিয়ে যায়। সার্বভৌমিক সত্যের চেহারা দেখতে পায় না বা চায় না যে, সে-ই অন্যকে জাজ করে। জাজমেন্টাল লোকেদের বন্ধুরাও জাজমেন্টাল। তাই জাজমেন্টাল হয়ে বাঁচতে ওঁদের তেমন কোনো অসুবিধে হয় না।

যাঁরা আপনাকে ভুল বোঝেন, তাঁরা আপনার কিছু-একটা নিয়ে বিরক্ত বা বিব্রত। সেই 'কিছু-একটা' হয়তো তাঁদের রুচির বা মতের সাথে যায় না, আর এ কারণেই তাঁরা আপনাকে নিয়ে এলোমেলো ও অনুমাননির্ভর কথা ছড়িয়ে দেবেন। ওঁদের ওতেই যত আনন্দ। ওরকম কাউকে দেখলে তাঁর কাছ থেকে দ্রুত পালান।

লোকে আপনাকে ভুল বুঝতে চায় ঈর্ষান্বিত হয়ে। ঈর্ষাপরায়ণ মানুষ অনেকসময় নিজেই তাঁর চরিত্রের এই দিকটি বুঝতে পারেন না। তিনি তখন নিজের মনগড়া বিভিন্ন যুক্তির সাহায্যে এই ঈর্ষাকে জিইয়ে রাখতে চান। এ ধরনের ঈর্ষা দুর্বলচিত্তের মানুষের খুব স্বাভাবিক একটা বৈশিষ্ট্য। ওঁরা কার‌ও ভালো কিছু সহ্য করতে পারেন না। এমন লোকের পাল্লায় পড়লে দেখবেন, তেমন কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই খামখেয়ালি অনুমানের ভিত্তিতে তিনি আপনাকে জাজ করছেন, ভুল বুঝছেন এবং তাঁর অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। আপনি যত‌ই তাঁর প্রতি ভালোবাসা দেখান না কেন, তিনি ওই অবস্থানেই ফিরে যাবেন বারবার। তাঁর কাছে আপনি ভালো হয়েও লাভ নেই, এমন ঈর্ষা থেকে সরে আসতে তিনি পারবেন‌ই না। এদিকে আবার আপনি চাইলেও তাঁর মতো হতে পারবেন না, কেননা লোকের পেছনে লাগার স্বভাব‌টাই আপনার নেই। অগত্যা, এক্ষেত্রে এমন টক্সিক লোকের কাছ থেকে চুপচাপ সরে গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।

নিজের একটা মতামত থাকবে, পছন্দ-অপছন্দ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিবেকসম্পন্ন মানুষ কখনোই কারও সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনেই কথা বলবেন না। কিছু লোককে দেখবেন, যাঁরা নিজের নীতিনৈতিকতা নিয়ে নিজ থেকে বিভিন্ন কৌশলে বলতে থাকেন এবং নিজেকে সবসময় জাহির করেন। এঁরা ভয়ংকর ধরনের প্রাণী। এঁদের ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। এঁরা বাইরে এক, ভেতরে আরেক। কারও ভেতরের চেহারা আমরা কেউ দেখতে পাই না। এঁরা গায়ে পড়ে নিজের সততার ফেরি করে বেড়ান, কেননা নির্বোধেরা এই সহজ কৌশলটি ধরতে পারে না। তাঁর ব্যাপারে সাবধান থাকুন, যিনি নিজের আমলনামা অপ্রয়োজনীয় জায়গায় উপস্থাপন করেন এবং অন্যের আমলনামা নিয়ে অহেতুক গবেষণা করেন।

একেকটা মানুষের জীবন একেক রকমের। তাই একেকটা মানুষ একেক রকমের। অন্যের পরিস্থিতি ও জীবনযাপন সম্পর্কে না জেনে নিজের জায়গা থেকে তাঁকে জাজ করার লোভ সামলাতে না পারলে কখনোই ভালো মানুষ হ‌ওয়া যায় না।

আপনাকে যখন কেউ ভুল বোঝেন, তখন চুপচাপ তাঁকে অগ্রাহ্য করাই ভালো। এমন অবস্থায় নিজের প্রকৃত অবস্থান ও প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে খুব ইচ্ছে করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তুলে ধরে আসলে কোনো লাভ নেই। অহেতুক সময় নষ্ট হবে, পণ্ডশ্রম হবে, মন খারাপ হবে। তার চেয়ে বরং পথ বদলে ফেলুন। ভালো পথ অনেক, কেবল সময়মতো খুঁজে নিতে হয়।

লোকে বললে বলুক। বলতে দিন। বললেই তো আর হয়ে যায় না। ওঁরা কী বলেন, তা দিয়ে ওঁদেরকে চেনা যায়, আপনাকে নয়। হাতে করার মতন কাজ না থাকলে আপনার পেছনে লাগবে না তো আর কী করবে? বেচারা!