কাঁদাবেই যদি

ক্লেশ আর গেল না। যাবেও না তুমি তেমন করে দেখা না দিলে। তুমি নিশ্চয়ই কিছু আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছ। যে দেখাটা দিলে আমার সকল দুঃখ দূরে যায়, তা তুমি দিচ্ছ না। আর তুমি না দিলে তা আমার পাবারও জো নেই। আর কোন অধিকারেই-বা দেখতে চাইব? দেখাই দিচ্ছ না, অথচ আমায় ভালোবাসছ, আমার ভালো চাইছ। এ এক বিষম সমস্যা!




ভালোবাসো, ভালো চাও, অথচ দেখা দিচ্ছ না কেন? দেবার আগে কাঁদাতে চাও, বুঝেছি। সেই দুর্লভ জিনিসটা অত সহজে দিতে চাও না। সহজে পেলে বুঝি আদর হবে না? বেশ, কাঁদতে রাজি আছি। কিন্তু কাঁদবার শক্তি আমার কোথায়? কাঁদাতে যদি চাও, তবে কাঁদবার শক্তি দাও। আমি বুঝছিলাম যে, আমার কান্না যথেষ্ট হয়নি, চাওয়া যথেষ্ট হয়নি, অথচ বড়ো বড়ো কথা বলছি। আবার বুঝি চাও যে ব্যাকুল প্রার্থনা থেকে আরম্ভ করি?




আমি ওতে খুব রাজি। আমার জ্ঞানের অহংকার, সাধনের অহংকার তুমি চূর্ণ করে দাও, আমি সমস্ত‌ই তোমার কৃপার ফল বলে দেখি। আমার সাধন যে তোমার কৃপাই, তোমার কৃপাছাড়া আর কিছু নয়, তা-ও তুমি অনেক দিন বুঝিয়েছ, কিন্তু সে বোঝাটা ঠিক হৃদয়ের সাথে হয়নি। আজ তুমি আমাকে বোঝালে, যে দর্শন আমি চাই, সে দর্শন তুমি আমাকে খুব না কাঁদিয়ে দেবে না।




তোমার কৃপা তবে হয়নি, এ কথা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে স্বীকার করতে হচ্ছে। তোমার কৃপা হয়নি, তাই তুমি এখনই আমাকে সে দেখা দিতে রাজি নও। কঠোর কান্না না কাঁদলে, খুব করে না কাঁদলে... রাজি নও দেখা দিতে, এ কথা আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে। কতটা কাঁদলে দেখা দেবে, তা জানিনে; আমি কাঁদতে রাজি, এ-ই জানি। কান্না আমার কাছে তেমন কষ্টকরও হবে না। সে ভয়ের দিন, নিরাশার দিন, সব‌ই তো গেছে। দেখা যে দাও, তা তো দেখিয়েছ। দেখা দিতে যে চাও, তা-ও বুঝিয়েছ। অতটা বুঝিয়েছ যে, দেখা দেবার জন্যেই আমাকে এমন করে সৃষ্টি করেছ।




একলা তো থাকতে পারতেই, থাকোনি। দেখবার লোক হবে, তোমাকে দেখতে চাইবে, দেখবার জন্যে ব্যস্ত হবে, ব্যস্ত হলে দেখা দেবে, ক্রমশ একসময় বেশি দেবে, একটা প্রেমের কাণ্ড ঘটাবে... এসব ভেবে, এসব বুঝেই তো সৃষ্টি করেছ ও করছ। তাই তো যখন আমার দেখবার ইচ্ছে একটুও হয়নি, দেখবার শক্তিও হয়নি, ‘আমি’ বলতে যা বুঝছি এখন, তা যখন আদতেই হয়নি, তখনই দেখা দেবে বলে ঠিক করে রেখেছ। আমার ব্যস্ততার চাইতে তোমার ব্যস্ততা ঢের বেশি। অতটা জেনে আমার আর কাঁদতে আপত্তি কী? আমার এক কান্নাতে যদি সহস্র কান্না বারণ হয়, তবে কান্নাই আমার সম্বল হোক, সর্বস্ব হোক।