ঈশ্বর শান্ত। তাই তাঁকে দেখতে মন চাইলে শান্ত-সমাহিত হয়ে তাঁর দিকে এগোতে হবে। তোমার হৃদয়-মন যদি শান্তভাব ধরে, তবে তাতে সহজেই সেই শান্তিসমুদ্রের ছায়া পড়বে। আর, যদি তোমার হৃদয়ে অশান্তি থাকে, তবে বাইরের প্রকৃতিতে যতই শান্তিবায়ু ভগবানের শরীর থেকে সুগন্ধ আনুক, তা তুমি অনুভব করতেই পারবে না। আমরা যদি নিজেদের মনকে অশান্তিতে ডুবিয়ে রাখি, তবে চারিদিকে কেবল অশান্তিরই বিভীষিকা দেখতে থাকব।
ঈশ্বর মঙ্গল। তিনি কেবল শান্তভাবে দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে নেই৷ তিনি জগতের প্রতি পরমাণুতে, কালের প্রতিমুহূর্তে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে নিরন্তর মঙ্গলসাধন করছেন। যখন সমস্ত প্রাণী ঘুমেতে অচেতন থাকে, তখনও সেই জাগ্রত পুরুষ অনিমেষ নয়নে সকলের মঙ্গল নিয়ে ভাবেন এবং নিজের শান্ত মহিমাতে অবস্থিত থেকে জগতের হিতসাধন করেন।
তাঁর মঙ্গলভাবের পরিচয় চারিদিকেই ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। কোনো দিকে দেখিয়ে বলা যাবে না যে, এই দিকে তাঁর মঙ্গলহাতের পরিচয় পাই, কেননা সব দিকেই তা রয়েছে। মানুষসৃষ্টির অনেক আগেই মানুষের শরীররক্ষার উপযোগী কয়লা, জল, ফলমূল প্রভৃতির সংস্থান করে দিয়েছেন তিনি। আমাদের শরীরের মধ্যে এমন এক ক্ষুধাবৃত্তি ঢুকিয়ে দিলেন যে, তারই ফলে আমাদের বুদ্ধি, বোধ, বিবেক প্রভৃতি মনের বৃত্তি ফুটে উঠল। আবার সেই বুদ্ধির সাহায্যে কাজ করতে করতে আত্মা জাগ্রত হয়ে সেই প্রাণের উৎস পরমাত্মার দিকে ছুটতে চায়। তাঁর মঙ্গলভাবের পরিচয় সমস্ত জীবন ধরে লিখলেও শেষ করা যাবে না।
কবে কোন যুগযুগান্তর পরে মানুষেরা রেঁধে খাবে, রেলগাড়ি চালাবে, জাহাজ চালাবে, নানা রকম কলকারখানা চালাবে, তার জন্য দয়াময় পরমেশ্বর কোটি কোটি বছর আগে থেকেই পাথুরে কয়লার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তোমরা বোধ হয় পড়েছ, সেই কোটি কোটি বছর আগের গাছগুলোই কয়লা হয়ে গেছে। গাছগুলো জল ও উত্তাপের মধ্যে তীব্রভাবে চাপা পড়ে থেকে থেকে একেবারে কালো রং ধারণ করে শক্ত-জমাটবাঁধা হয়ে গেছে। কোটি কোটি বছর পরে আমরা সেই জমাটবাঁধা গাছ ভেঙে অনায়াসে নানা কাজে লাগাতে পারছি।
যে বিশ্বেশ্বর মহাদেব একটা সূর্যকে প্রতিষ্ঠিত করে এই পঞ্চভূতাত্মক পৃথিবীসৃষ্টির উপায় করলেন এবং সেই পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাতের মানুষ আসার ব্যবস্থা করলেন; এবং যিনি সেই মানুষকে তাঁকে জানার অধিকার দিলেন, সেই দেবতা মঙ্গলময় নয় তো আর কোন দেবতা মঙ্গলময়? তিনি একটি ধ্রুবতারাকে আকাশে রেখে দিয়ে জ্যোতির্বিদ্যার কতই-না উন্নতিসাধনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আকাশে, পৃথিবীতে, পাতালে সব জায়গাতেই তাঁর মঙ্গলহাতের প্রসারণ দেখতে পাবে। কোন যুগে হিমালয় পর্বত উঠল, আর আজ আমরা সেই হিমালয় থেকে প্রবাহিত নদীগুলি অবলম্বন করে বেঁচে আছি, জগতের উন্নতিসাধনে নিযুক্ত রয়েছি। এই নদীগুলি অবলম্বন করে শতশত পুণ্যযশা ঋষিমুনি আমাদের সেই প্রাণের উৎসের কথা দার্শনিক ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে বর্ণনা করে গেছেন এবং সেই পুণ্যকথাসমূহ আলোচনা করে আজও আমরা আনন্দ অনুভব করছি এবং জীবনকে ধন্য বোধ করছি, তা ভাবলে বিস্ময়ে ও শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।
কোনো কোনো ঘটনায় কখনো কখনো ঈশ্বরের শান্ত ও মঙ্গলভাবের উপর কারও কারও সন্দেহ আসে। ভূমিকম্প হলো, আমার বাড়িঘর পড়ে গেল, আমার স্ত্রী-পুত্র মরে গেল। আমি ভাবলাম, যে-ঈশ্বর এমন প্রলয়ের ব্যবস্থা করেছেন, তাঁর শান্ত ভাবই-বা কোথায়, আর তাঁর মঙ্গল ভাবই-বা কীসের? প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হলো, অনাবৃষ্টি হলো, দুর্ভিক্ষ হলো, কত লোক অনাহারে মরে গেল, আমরা সেইসব ঘটনাকে অমঙ্গল বলে উল্লেখ করি।
এই সকল ঘটনা আমাদের চোখে আপাতত অমঙ্গল বলে বোধ হলেও এগুলি যে তাঁরই মঙ্গলহাতের পরিচয়, তাতে সন্দেহ নেই। ভেবে দেখো, সেই কোটি কোটি বছর আগে কত গাছপালা জন্মেছিল। তারপর সেগুলি জলে ডুবে পাথুরে কয়লা হলো এবং সেই কয়লা দিয়ে আমরা আজ কত কাজ করছি! এখন সেই গাছপালাগুলি যদি বলে, তাদেরকে জলে ডুবিয়ে কয়লায় পরিণত করা ঈশ্বরের অমঙ্গল-ভাবেরই পরিচয়, তাহলে সে-কথায় তোমরা কি হেসে উঠবে না? তোমরা যে কেরোসিন তেল ব্যবহার করো, সেটা কী জানো? বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, কোটি কোটি বছর আগে যে জানোয়ারগুলো জলে ডুবে গিয়েছিল, তাদের চর্বি উত্তাপ ও জলের চাপে পড়ে তেলের আকার ধরেছে। এখন সেই জানোয়ারগুলো যদি বলে, তাদের জলে ডুবে যাওয়া ঈশ্বরের অমঙ্গল-ভাবের পরিচয়, তাহলে তোমাদের হাসি পাবে না কি?
তোমরা আজ কোটি কোটি বছর পরে ঈশ্বরের মহিমা অনুভব করে সেই সকল ঘটনায় তাঁরই মঙ্গলহাতের পরিচয় পাওয়া যায় বলে আনন্দিত হচ্ছ। সেই রকম আজ আমরা আত্মীয়স্বজনের মৃত্যু প্রভৃতি যে-সকল ঘটনাকে অমঙ্গল মনে করে মুহ্যমান হচ্ছি, হয়তো কোটি কোটি বছর পরে যে উন্নত মানুষ জগতসংসারে বিচরণ করবে, সেই উন্নত মানুষ এই সকল ঘটনার মধ্যে ঈশ্বরের মঙ্গলভাব অনুভব করে তাঁরই জয়জয়কার করবে।
ঈশ্বর সত্যস্বরূপ, জ্ঞানরূপ, অনন্তস্বরূপ এবং আনন্দময়। এটা কি সম্ভব যে, তিনি সমস্তই জেনে-শুনেও অমঙ্গল পাঠিয়েছেন? যদি তিনি অমঙ্গল পাঠিয়েই থাকেন, তবে আমাদের নিস্তার কোথায়? আমরা মৃত্যুকেই সবচেয়ে অমঙ্গলজনক মনে করি। কিন্তু মৃত্যু কি সত্যিই অমঙ্গলজনক? ধরো, পৃথিবীতে মৃত্যু নেই। তাহলে মানুষেরা চরম বৃদ্ধত্ব লাভ করলে গিয়ে দাঁড়াবে কোথায়? খেতে পারে না, কাজ করতে পারে না, অথচ অসুস্থতা সহ্য করে বেঁচে থাকতে হবে—ওরকম বেঁচে থাকা কী যে ভয়ানক! এজন্য বৃদ্ধরা নিজেই প্রাণভরে প্রার্থনা করে, তারা যেন ইহলোক থেকে তাড়াতাড়ি সরে যায়। সংসারে মৃত্যু না থাকলে হয়তো সকলেই বলত, ঈশ্বর কীরকম নিষ্ঠুর যে, এরকম কষ্টের মধ্যে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখেন!
যদি বলো, মানুষ বুড়ো না হয়ে বরাবর বেঁচে থাক, তবে তার ফল কী হতে পারে, এক বারও কি ভেবে দেখেছ? ভেবে দেখো, প্রত্যেকটা মানুষ অনন্তকাল ধরে একই স্থানে খেটে চলেছে, কোনো বিশ্রাম নেই; তার এখানে যা-কিছু জানার ছিল সব জেনে গেছে। তারপর সে কী করবে? এখনই যদি আমরা কোনো বিষয় কিছুকাল ধরে দেখি, কোনো জিনিস কিছুকাল ধরে খাই বা ব্যবহার করি, তাহলে আমাদের তাতে অরুচি হয়। আর অনন্তকাল ধরে একই জিনিস ব্যবহার করলে, একই বিষয় নিয়ে থাকলে যে কী কষ্ট হতো, তা বলে বোঝানো যাবে না।
আগে দেখে এসেছি, ঈশ্বরের রাজ্যে একই নিয়ম সকল স্থানেই কাজ করে। তুমি কেবল মানুষকে প্রাণের একটা বিশেষ নিয়মে বাঁধলে চলবে না। যদি মৃত্যু উঠিয়ে দিতে চাও, তবে সমস্ত প্রাণরাজ্য থেকে তাকে তাড়াতে হবে। সমস্ত প্রাণরাজ্য থেকে যদি মৃত্যু চলে যেত, তাহলে ভেবে দেখো, একই গাছ, একই ফল, একই জীবজন্তু, সকলেই বুড়ো থুরথুরে হয়ে বিচরণ করছে, অথচ তাদের মৃত্যু নেই। কী ভয়ানক অবস্থা! তাহলে কোনো প্রকারের ফলমূল কিংবা কোনো জিনিস খাওয়াই চলত না। খাবে কী করে? সবাইকেই যে বেঁচে থাকতে দিতে হবে!
এখন বলতে পারো, অল্প বয়সে মৃত্যু কি তবে অমঙ্গলজনক নয়? একথা ঠিক, আমরা কখনোই বুঝতে পারি না যে, অমুক লোক জগতের জন্য খুব ভালো কাজ করছিল, তার অল্প বয়সে হঠাৎ মৃত্যু হলো কেন? কিন্তু তাই বলে তার জন্য ঈশ্বরের মঙ্গলভাবে সন্দেহ করা উচিত নয়। আমাদের জানা উচিত, মঙ্গলময় ঈশ্বর যখন মৃত্যু পাঠিয়েছেন, তখন তাতে নিশ্চয়ই মঙ্গল রয়েছে। আগেই বলে এসেছি, একই নিয়ম প্রাণরাজ্যের সব জায়গায় কাজ করবে! ফলের দৃষ্টান্ত ধরেই দেখা যাক। অল্পবয়সে মৃত্যু থাকবে না, কারণ সেটা অমঙ্গলজনক, এই নিয়ম কাজ করলে কাঁচা ফল পেড়ে খাওয়া অসম্ভব হতো। কাঁচা ফল খাওয়া সময়ে সময়ে শরীর রক্ষার জন্য দরকার হয়। যদি কাঁচা ফল খেতে না পাওয়া যেত, তাহলে কি অবস্থা হতো এক বার ভেবে দেখো।
ধরো, তুমি একটা কাঁচা পেঁপে পেড়ে খেলে। তোমার শরীর ভালো হলো, তুমি সংসারের কাজে ভালো করে মন দিতে পারলে। তুমি ভাবলে, তুমি একটা ভালো কাজ করেছ, তোমার আত্মীয়েরাও তা-ই ভাবল। কিন্তু পেঁপে গাছটা কি ভাবতে পারে না যে, তার কী সর্বনাশ হলো! তার একটি কাঁচা ফল চলে গেল! পেঁপে গাছটিরও অবশ্যই কাঁদার অধিকার আছে। ঠিক সেরকম তোমার-আমার আত্মীয়ের মৃত্যুতে আমাদের কাঁদার অধিকার আছে, কিন্তু সেই আত্মীয় যেখানে কাজের জন্য অন্য আকারে তবে একই আত্মায় উপস্থিত হবেন, সেখানকার লোকেদের আনন্দ করারও অধিকার আছে। একের মৃত্যু, অন্যের জন্ম—একেই বলে আত্মার অবিনশ্বরতা।
মৃত্যুর অর্থ বিনাশ নয়, শক্তি ও অবস্থার রূপান্তর মাত্র। তাহলে এটুকু আমরা ধরতে পারি যে, ইহলোকে যার মৃত্যু হলো, তার পুরোপুরি বিনাশ হলো না, লোকান্তরে সেই ব্যক্তি অন্য আকার ধারণ করে জন্মগ্রহণ করবে। ফল প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য যেমন অন্যান্য জীবজন্তুর ভেতরে প্রবেশ করে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করে, উন্নত জীবেরা সেরূপ করবে না, কারণ তারা ধীরে ধীরে নিজেদের ব্যক্তিগত বিশেষত্ব পেয়ে গেছে।
আমরা জানি, সূর্য-চন্দ্র পৃথিবীর এক দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলে অন্য দিকে উঠতে থাকে—এক দিকের পক্ষে তাদের একপ্রকার মৃত্যু ঘটলেও অন্য দিকের পক্ষে তারা নতুন জন্মগ্রহণ করল। এ থেকে ঈশ্বর যেন দেখিয়ে দিচ্ছেন, মৃত্যু আর কিছুই নয়—কেবল এক স্থান থেকে চলে গিয়ে আর-এক স্থানে উদয়। যদি এই সূর্য-চন্দ্র অনন্তকাল একই দিকে থাকত, তাইলে ভেবে দেখো, কী কষ্টই-না হতো! চিরকাল আলোতে থাকতেও ভালো লাগে না, চিরকাল অন্ধকারে থাকতেও ভালো লাগে না; ওরকম অবস্থা জীবনধারণ করার জন্যও অনুপযোগী।