এসো, ঈশ্বরকে জানি (শেষ ভাগ)

ঈশ্বর অদ্বিতীয়; তিনি দ্বৈতরহিত। তাঁর দ্বিতীয় বা সমান আর কেউ নেই। জগতচরাচরের প্রত্যেক অণু-পরমাণুতে তিনি ওতপ্রোত হয়ে আছেন। সুতরাং এই ভাবে অন্য কারও জগতচরাচরে ওতপ্রোত হয়ে থাকার অবকাশই নেই। তোমরা পড়েছ, দুইটি বৃত্ত ভিন্ন পরিমাণ স্থান অধিকার করলে তাদের মধ্যে একটা বড়ো এবং একটা ছোটো হবেই; কিন্তু যদি সেই দুইটি বৃত্ত সমান স্থান অধিকার করে, তাহলে তারা উভয়েই এক ও অভিন্ন হবে। যদি অন্য কেউ অনন্ত জগতের একটি অণুও বাদ দিয়ে বাকি অংশে ওতপ্রোত থাকেন, তবে তিনি আমাদের ঈশ্বরের চেয়ে ছোটো হবেন, কারণ আমাদের ঈশ্বর জগতের একটিও অণু বাদ না দিয়ে ওতপ্রোত আছেন।




আর তাঁর চেয়ে বেশি করে কেউই জগতে ওতপ্রোত থাকতে পারেন না, কারণ তিনি অনন্ত জগতে অনন্তকাল ধরে ওতপ্রোত আছেন—এমন একটাও স্থান নেই, যেখানে তিনি নেই এবং এমন একটা মুহূর্তও নেই, যখন তিনি নেই বা ছিলেন না বা থাকবেন না। আমরা আগেই বলে এসেছি, তিনি আছেন, তাই স্থান আছে। তিনিই এই অনন্ত স্থানের স্রষ্টা। এই অনন্ত স্থান একই, এর কোনো দ্বিতীয় নেই। আমরা খণ্ড খণ্ড স্থান বা আকাশ কল্পনা করে নিলেও স্থান একই। সুতরাং সেই স্থানের স্রষ্টা—যাঁর দৃষ্টিতে সেই বিরাট স্থানের অস্তিত্ব, তিনিও কাজেই অদ্বিতীয়। সকল জিনিসে যেভাবে তাপশক্তি বা বিদ্যুৎশক্তি ওতপ্রোত হয়ে থাকে, সেই ভাব থেকে আমরা জগতে ঈশ্বরের ওতপ্রোত থাকার কিছুটা আভাস পাই৷




ঈশ্বর যেমন স্থানে অদ্বিতীয়, সেরকম তিনি কালেতেও অদ্বিতীয়। অনাদি অনন্তকাল ব্যাপ্ত করে এই সুমহান পুরুষ থাকতে পারেন, অন্য কারও সেভাবে থাকার অবকাশই নেই। যদি অন্য কেউ একটিও মুহূর্ত বাদ দিয়ে অনন্তকালের বাকি অংশে ওতপ্রোত থাকতেন, তাহলে তিনি ঈশ্বরের চেয়ে ছোটো হতেন, কারণ ঈশ্বর কালের একটা মুহূর্তও বাদ না দিয়ে আছেন। কাজেই তাঁর চেয়ে বেশি করে কেউ কালকে ব্যাপ্ত করে থাকতে পারেন না। তিনি আছেন, তাই কাল আছে। তিনিই এই অনন্তকালের স্রষ্টা। আমরা খণ্ড খণ্ড কাল কল্পনা করে নিলেও, কালকে ঘণ্টা-দিন প্রভৃতিতে ভাগ করে নিলেও কাল একই। সুতরাং সেই কালের স্রষ্টা—যাঁর দৃষ্টিতে সেই বিরাট কালের অস্তিত্ব—তিনিও কাজেই অদ্বিতীয়।




পরমেশ্বর সকল স্থানের প্রতি অণু-পরমাণুর এবং সকল কালের প্রতিমুহূর্তের প্রতিটি ঘটনা জানছেন৷ যখন সেই স্থান ও কাল অদ্বিতীয়, তখন ঈশ্বর জ্ঞানেতেও অদ্বিতীয়। স্থান ও কালের যখন স্রষ্টাই তিনি, তখন একথা বলা যেতেই পারে না যে, স্থান ও কালের এতটুকুও অংশ তাঁর জ্ঞানকে অতিক্রম করতে পারে। যখন কোনো কিছুই তাঁর জ্ঞানকে অতিক্রম করতে পারে না, তখন তাঁকে অতিক্রম করে আর কিছুই জানার বিষয় নেই। তাঁকে অতিক্রম করে কোনো কিছু জানার বিষয় থাকলে সেই বিষয়টুকু তাঁর জ্ঞানের অতিরিক্ত থাকত—কিন্তু সেটা একেবারেই অসম্ভব।




ঈশ্বর আনন্দেও অদ্বিতীয়; তিনি আনন্দরূপ। তাঁর মধ্যে নিরানন্দের কণামাত্রও থাকতে পারে না। আমাদের স্বরচিত প্রভৃতি সীমার কারণেই আমাদের আনন্দে বাধা আসে। কিন্তু ঈশ্বর যখন অনন্ত, তাতে যখন কোনো রকমেরই সীমার সম্ভাবনা নেই, তখন তাতে নিরানন্দ আসারও কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি অখণ্ড বিরাট আনন্দরূপ।




ঈশ্বর শান্তভাবেও অদ্বিতীয়। যখন তিনি আনন্দে অদ্বিতীয়, যখন তাতে বিন্দুমাত্রও নিরানন্দ আসার সম্ভাবনা নেই, তখন তাতে অশান্তি আসারও কোনো কারণ নেই। নিরানন্দ এলেই অশান্তি আসতে পারে এবং অশান্তি এলেই নিরানন্দ আসতে পারে। তিনি শান্ত—তাঁর শান্তিসমুদ্র অতি গভীর।




ঈশ্বর অনন্ত, সুতরাং অদ্বিতীয়। তাঁর কেউ দ্বিতীয় থাকলে তিনি সীমাবদ্ধ হতেন—সেই দ্বিতীয় পুরুষই তাঁর সীমা হতেন—সুতরাং তিনি অনন্ত অদ্বিতীয় হতে পারতেন না।




ঈশ্বর অনন্ত এবং অদ্বিতীয় বলেই তিনি অপ্রতিম। তাঁর প্রতিমা অথবা মূর্তি হতে পারে কি না, এই বিষয়ে অনেক তর্ক হয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে অনেক তর্ক চলবেও। আমাদের সেসকল তর্কে নামার কোনো প্রয়োজনই নেই, কিন্তু সহজ জ্ঞানে কী জানতে পারি, সেইটুকু বুঝে নেব। ঈশ্বর যদি অনন্ত ও অদ্বিতীয় হলেন, তখন কোন জিনিসকে তাঁর প্রতিমা বলে উল্লেখ করব? যে-জিনিসকে প্রতিমা বলব, তা-ই তো সান্ত হবে, অনন্ত তো হতেই পারবে না, তখন সেই জিনিসকে সেই অনন্ত পুরুষের প্রতিমা বলব কী করে?




যখন তাঁর প্রতিমা হতে পারে না, তখন কোনো মানুষ বা অন্য কিছু তাঁর পূর্ণাবতারও হতে পারে না। কেউ পূর্ণ অবতার হলেই তো তাঁকে অনন্ত হতে হবে, কিন্তু জগতের সকল বস্তু, সকল জীবজন্তই সান্ত। ঋষিরা স্পষ্ট করে বলে গেছেন যে তাঁর কোনো প্রতিমা নেই—ন তস্য প্রতিমা অস্তি।




এখন কথা হচ্ছে, তাঁর প্রতিমা হতে পারে না বলে কি আমরা তাঁর পূজা করতে পারব না? তা নয়। প্রকৃতিতে তাঁর যে মহিমা ছড়িয়ে আছে, প্রাচীন ঋষিদের মত ভগভদ্‌ভক্ত মানুষেরা ঈশ্বর বিষয়ে যেসকল চমৎকার কথা বলে গেছেন, সেই মহিমা, ঋষিবাক্য প্রভৃতি অবলম্বন করে তাঁর পূজা করব এবং জীবনকে সার্থক করব। সান্ত প্রতিমায় অনন্ত ঈশ্বরের কোনো বৈশিষ্ট্য বা গুণের অধিষ্ঠান করার মধ্য দিয়ে অনন্তের পথে চলার উপাসনাই প্রতিমাপূজার মূল দর্শন। এক বারেই অনন্তের মধ্যে অবগাহন করার কাজটি সকলের জন্য সহজসাধ্য নয় বলেই প্রতিমার মাঝে তাঁদের চৈতন্যের উদ্‌বোধন অত্যন্ত জরুরি।




ঈশ্বরকে কেমন করে পূজা করব? ভয় পেয়ো না। তিনি আমাদের পিতা-মাতা-বন্ধু, আমাদের সব কিছুই তিনি; তিনি তোমাদের এই যে সঙ্গে সঙ্গেই আছেন। প্রত্যেক মুহূর্তে, জীবনের প্রত্যেক ঘটনায়, সকল স্থানে, সকল অবস্থায় তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন জেনো। তাঁকে হৃদয়ে দেখে, তাঁকে তোমাদের জীবনসঙ্গী জেনে সকল কাজ করলে দেখবে, তোমাদের দুঃখ-দারিদ্র্য, কষ্ট-নিরানন্দ সকলই দূর হয়ে যাবে।




থামতে মন চায় না। ইচ্ছে হয়, আরও লিখি। যে ঈশ্বরের বাস নিজের হৃদয়ের গভীরে, তাঁকে নিয়ে বলা কি আর শেষ হয়? এই ঈশ্বর নিয়ে —যার যতটা ভাব, তার ততটা লাভ। তাঁকে আত্মায় অনুভব করতে না পারলে, ভগবদ্‌চেতনায় নিজেকে জাগাতে না পারলে যত যা-ই কিছু করি না কেন, সব‌ই নিরর্থক মনে হবে। মৃত্যুর আগেই তাই ঈশ্বরের চরণে নিজেকে সমর্পণ করে শান্তির পথে হাঁটতে হয়। যে যত আগে এই যাত্রা শুরু করতে পারে, তার জীবনযাপন তত আগেই আনন্দময় হয়ে যায়। ঈশ্বরে সমর্পণ, অমৃতে নিমজ্জন।