এসো, ঈশ্বরকে জানি (ষষ্ঠ ভাগ)

প্রাণের এই মহাসমুদ্র কোথা থেকে এল? জলে-স্থলে-আকাশে সকল স্থানেই দেখি, প্রাণ ছড়িয়ে আছে। এত প্রাণ কোথা থেকে আসে? একটা আশ্চৰ্য ব্যাপার লক্ষ করি, সকল প্রাণীরই প্রাণনকাজের প্রণালী মূলত এক। প্রাণধারণ করতে মন চাইলে আমাকে বাতাস, জল প্রভৃতি নানান উপকরণ ও উপায়ের সাহায্য নিতে হবে, আমাকে খেতে হবে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ফেলতে হবে। অন্যান্য ছোটো-বড়ো জীবজন্তুকেও বাঁচতে গেলে সেই একই উপায়ে বাঁচতে হবে। আবার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুকেও সেই একই উপায়ে বাঁচতে হবে। এমনকী, গাছপালা পর্যন্ত তাদের উপযুক্ত আহারের জন্য মাটি-জল, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য বাতাস-উত্তাপ প্রভৃতি না পেলে বাঁচতেই পারে না। এই যে জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ, গাছপালা প্রভৃতি প্রাণবিশিষ্ট বস্তুর মধ্যে প্রাণনকাজের একটি অভিন্ন প্রণালীই কাজ করছে, প্রাণের একটা মূল কারণ না থাকলে কি এরকম একই নিয়ম সব জায়গায় সুন্দররূপে কাজ করতে পারত? এই প্রাণের মূল কারণ সেই অদ্বিতীয় মহাপ্রাণ পরমেশ্বর বলেই একই প্রণালী একই নিয়ম সকলেরই ভেতরে কাজ করছে।




প্রাণের বিনাশ বা মৃত্যু নেই৷ যে-মহাপ্রাণ থেকে সেই প্রাণ এসেছে, সেই মহাপ্রাণ যে-সকল রকমে মৃত্যুর অতীত, সে-কথা আমরা আগেই বলেছি। সেই মহাপ্রাণকে মৃত্যু স্পর্শ করতে পারলে জগতে অসংখ্য প্রাণের কাজ কি চলতে পারত? তোমার একটা দমের ঘড়ি আছে। তুমি বেঁচে আছ, ঘড়িতে দম দাও, তাই ঘড়িটা নিয়মিত চলে। তুমি মরে গেলে যদি আর কেউই সেই ঘড়িতে দম না দেয়, তাহলে ঘড়িটা আর চলবে না। ঠিক তেমনি মহাপ্রাণের অভাব হলে প্রাণ থাকবে কীভাবে?




প্রাণ যে আপনাআপনি আসেনি, বরং সেই মহাপ্রাণ থেকে এসেছে, একটা কথা ভেবে দেখলে সে-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। তোমরা পড়েছ যে, শূন্যকে কোনো সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে বা ভাগ করলে গুণফল বা ভাগফল শূন্যই হয়। এর অর্থ এই যে, যদি কোনো জিনিস না থাকে, তবে সেই শূন্য থেকে কোনো জিনিস তৈরি হতে পারে না অথবা সেই শূন্য থেকে কোনো কিছু বেরিয়ে আসতেও পারে না। যেখানে প্রাণ নেই, অর্থাৎ প্রাণশূন্য, সেখানে যতই যা-ই উত্তাপ, জল প্রভৃতি দেওয়া হোক না কেন, তার ফলে শূন্যই পাওয়া যাবে, অর্থাৎ প্রাণের কোনো পরিচয়‌ই পাওয়া যাবে না।




এই যে আমরা মাংস খাই, মাছ খাই, ডাল-ভাত খাই, এ-সকলে যদি প্রাণ না থাকত, তাহলে কি আমরা ও-সকল জিনিস খেয়ে বাঁচতে পারতাম? এমন দেখা গেছে, শত-সহস্র বছর আগের তোলা ধান উপযুক্ত মাটি-জল-বাতাস পেয়ে রীতিমতো শস্যদান করেছে। তোমরা তো মনে করতে, সেই ধানটুকু বহুকাল আগে মরেই গিয়েছিল। কিন্তু তা নয়। তাতে প্রাণ ছিল বলেই তা থেকে আবার শস্যরূপ নতুন প্রাণ বেরোল। ধান, যব, ভুট্টা প্রভৃতির প্রাণ এত কঠোর যে, সেগুলিকে খুব সেদ্ধ করলেও তা থেকে প্রাণ সম্পূর্ণ বেরোয় না। তাতে যতটুকু প্রাণ থাকে, সেইটুকুই আমাদের প্রাণধারণের উপযুক্ত। তাদের অবশিষ্ট প্রাণ জল, হাওয়া, আলো প্রভৃতির সঙ্গে থেকে অন্য আকার-প্রকার ধারণ করে।




সে-সকল সেদ্ধ জিনিস আমরা যখন খেয়ে প্রাণধারণ করি, তখন তার অর্থ এই যে, আমরা সে-সকল জিনিস থেকে আমাদের প্রাণধারণের উপযুক্ত পরিমাণে প্রাণ বের করে নিই এবং সেই প্রাণে মাংসপেশির বল, শরীরের রক্ত প্রভৃতি নানা আকার প্রদান করি এবং তার বাকি অংশ নানা উপায়ে শরীর থেকে বের করে ফেলি। অন্যান্য জীবজন্তু কাঁচা জিনিসই খেয়ে নিজ নিজ শরীর-পোষণের উপযুক্ত প্রাণাংশ গ্রহণ করে বাকি অংশ বের করে ফেলে। এই সকল দৃষ্টান্ত থেকেও কিছুটা বুঝতে পারবে, এখানে যে-প্রাণ দেখছি, সেই প্রাণের মৃত্যু নেই, কিন্তু তার আকার-প্রকারের বদল হতে পারে।




এখন ভেবে দেখো, একসময়ে এই পৃথিবী ছিলই না। সূর্য এখন যা আছে, গোড়ায় তার চেয়ে ছোটো ছিল। সেই উত্তপ্ত সূর্যের চারপাশের ধুলো ও গ্যাসের মিশ্রণের ঘর্ষণের ফলে জন্ম হলো পৃথিবীর। যে-সময়ে এই পৃথিবী সূর্য থেকে বেরিয়ে এসেছিল, সেই সময়ে এটি এত উত্তপ্ত ছিল যে, এতে কোনো প্রকারের প্রাণ জন্মাতেই পারেনি। সেই পৃথিবী ক্রমে শীতল হলো, প্রাণরক্ষার উপযুক্ত হলো এবং ক্রমে তাতে বৃক্ষলতা প্রভৃতি প্রাণের উৎপত্তি হলো। এটা কি কখনো সম্ভব যে, এই প্রাণ আপনাআপনি এল? যে-প্রাণের খেলা নিয়মে নিয়মে ছন্দে ছন্দে চলছে, সেই প্রাণ কি হঠাৎ আপনাআপনি আসতে পারে? আগেই বলে এসেছি, শূন্য থেকে শূন্যই আসে। সূর্যে প্রাণের বীজ না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণ আসত কী করে? আর, এই প্রাণের মূল বীজ কি সূর্যেই আপনাআপনি আসতে পারে?




মনে করো, খাতায় একটা অঙ্ক করা আছে। তোমরা কি এটা ভাবতেও পারো যে, সেই অঙ্কটা আপনাআপনি করা হিসেবে পড়ে আছে, কেউই সেই অঙ্কটা করে রাখেনি? সূর্যে যে প্রাণের বীজ নিহিত আছে, তা নিশ্চয়ই সেই মহাপ্রাণ পরমেশ্বরই সূর্যে নিশ্চিত করে দিয়েছেন। তাঁর ইচ্ছেতেই প্রাণ এসেছে, প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে, তাঁকে মৃত্যু স্পর্শ করলে প্রাণ থাকত কী করে? তাঁর পরিবর্তনেরও কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি মৃত্যুর অতীত হয়ে জগতচরাচরে ওতপ্রোতভাবে থেকে প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন। এ জগতে খেলা করে যত কিছু প্রাণ, তার সব‌ই সেই ঈশ্বরেরই দান।




ঈশ্বর আনন্দস্বরূপ। সুতরাং তিনি মৃত্যুর অতীত৷ সুখের অভাবেই আমাদের নিরানন্দ আসে। আমি মৃত্যুর অতীত সুখ চাই; সুখ না পেলেই কষ্ট হয় এবং কষ্ট এলেই নিরানন্দ‌ আসে। তুমি মায়ের আদর চাও, মায়ের আদর পেলে তোমার সুখ হয়, মায়ের আদর না পেলে দুঃখ ও নিরানন্দ আসে। কিন্তু এই পৃথিবীতে যত রকমের সুখ আছে, সেগুলির মধ্যে বেঁচে থাকাই সকল সুখের মূল, কারণ বেঁচে না থাকলে কোনো প্রকার সুখেরই আস্বাদ পাবার সম্ভাবনা নেই। আর, সকল দুঃখের মধ্যে মৃত্যুই চরম দুঃখ এবং সকল দুঃখের মূলাধার, কারণ মৃত্যুর পর সকল সুখেরই ইতি ঘটবে। কিন্তু যিনি চিরসত্য এবং চিরআনন্দ, তাঁর বেলাতে মৃত্যু কোথায়? মৃত্যু তাঁকে কীভাবে স্পর্শ করবে? তিনি আনন্দময়, তাঁর কাছে নিরানন্দের কণামাত্রও পৌঁছোতে পারে না।




ঈশ্বর জ্ঞানস্বরূপ, সুতরাং তিনি মৃত্যুর অতীত। তিনি সমস্ত অতীতকাল, বর্তমানকাল এবং ভবিষ্যৎকাল সম্পূর্ণরূপে জানছেন। সূর্য থেকে এই পৃথিবীতে যেভাবে প্রাণ আসার সম্ভাবনা ছিল; কেবল এই পৃথিবীতে কেন, সমস্ত জগতচরাচরে যেখানে যেভাবে প্রাণের খেলা চলছে ও চলবে, তিনি তার সমস্তই জানেন। তিনি সেই প্রত্যেক প্রাণবিন্দুর আদি-মধ্য-অন্ত সকলই জানছেন। তিনি যদি মৃত্যুর অতীত না হতেন, তাহলে প্রত্যেক প্রাণবিন্দুর ভূতভবিষ্যৎ ও বর্তমান জানতে পারতেন না। তাঁর মৃত্যু হলে তিনি নিশ্চয়ই সেই মৃত্যুর পরবর্তীকালের কোনো কথাই জানতে পারতেন না। ঈশ্বরই অনন্ত সত্য, ঈশ্বরই অনন্ত জ্ঞান এবং ঈশ্বরই অমৃতানন্দ।




ঈশ্বর শান্তির আধার। তাঁর শান্তিসমুদ্র অতি গভীর। অন্তরে-বাইরে তাঁর সেই গভীর শান্ত ভাব ছড়িয়ে আছে, চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করলেই সব জায়গায় সেই শান্তিভাবের পরিচয় পাবে। খুব ভোরে নদীকূলে কোনো সুপ্রশস্ত বালুচরের উপর বসে থাকো। দূরে গ্রামের ভেতর দু-একটি পাখি দু-একবার ঘুমঘোরে ডেকে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ভালো লাগবে শুনতে। একসময় দেখবে, ক্রমেই, ধীরে, অতি ধীরে সূর্য নিজের প্রশান্ত মূর্তি প্রকাশ করতে করতে উদিত হচ্ছে। আহা, সেই সময়কার প্রকৃতির শান্তমূর্তি কেমন সহজেই ঈশ্বরের শান্তভাবের পরিচয় দেয়!




গ্রীষ্মকালের দুপুরে বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে একটা গাছের নিচে বসে থাকো। দেখবে, তোমার সামনে দূরে মাঠের সূক্ষ্ণ ধূলিরাশি খুব পাতলা ধোঁয়ার মতো ক্রমাগত কাঁপতে কাঁপতে আকাশে উঠছে; গরু, মানুষ বা কোনো জীবজন্তু মাঠে খেলা করছে না; মানুষেরা হয় ঘরে অথবা গাছের তলায় শুয়ে সুখে ঘুমোচ্ছে; গরুগুলো গাছের তলায় শুয়ে জাবর কাটছে; পাখিগুলো গাছের পাতার ছায়াতে বসে দোর্দণ্ড রৌদ্রের প্রতাপ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করছে। সেই সময়ে ঈশ্বরের গভীর শান্তভাবের পরিচয় বড়ো স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে।




সন্ধ্যাকালে কোনো পাহাড়ের উপর নির্জনে বসে থাকো। দেখবে, রাখাল ধীরে ধীরে গরুগুলোকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। পাখিগুলো ক্রমেই বাসায় ফিরে এসে দু-একবার ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে পড়ল। ধীরে অতি নিঃশব্দ পদক্ষেপে সন্ধে পৃথিবীর মুখটা নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে ফেলল। সুনীল আকাশে দু-একটা করে তারা ফুটে উঠতে লাগল। কী গভীর শান্তভাব! শান্তিসমুদ্রের কী সুন্দর পরিচয়! পূর্ণিমারাত্রে জ্যোৎস্নাধবলিত আকাশের দিকেই চেয়ে দেখো, অথবা অমানিশার আকাশের অন্ধকারের ভেতরেই প্রবেশ করো, সেই একই গভীর শান্তভাবের পরিচয় পাবে। প্রকৃতির এই শান্তভাব সেই শান্তিসমুদ্রেরই প্রশান্তভাবের ছায়ামাত্র।