এসো, ঈশ্বরকে জানি (প্রথম ভাগ)

ঈশ্বরকে নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে, তৃপ্ত হ‌ই; এর কারণ, প্রতিবারই কাজটা করতে গিয়ে নিজের ভেতরের ‘আমি’র সাথে আমাকে বেশ কিছু আলাপ সেরে নিতে হয়। এই লেখাটি লিখছি মূলত ছোটোদের জন্য, ঈশ্বর নিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন মতামত শুনে শুনে যাদের মধ্যে অনেক ধরনের প্রশ্ন ও দ্বিধার জন্ম হয় প্রায়ই।




প্রথমেই ধরে নাও, ঈশ্বর আছেন। যদি ধরে নিতে না পারো, তবে এই লেখাটা পড়া এখনই বন্ধ করে দিলে ভালো হয়। যা নেই, তা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার কোনো মানে নেই। আমার দিক থেকে যদি বলি, তবে বলব, ঈশ্বর আছেন এবং তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন, একথা মাথায় রেখেই আমি তোমাদের সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।




সুখে-দুঃখে সবসময়ই ঈশ্বরকে ডাকতে হয়, তাঁকে ভালো করে ডাকলে সকল বিষয়েই ভালো হয়। এমন উপদেশ আমরা অসংখ্য বার পেয়েছি। তোমরা ধ্রুবের গল্প, প্রহলাদের গল্প এবং বিভিন্ন সাধুর অনেক কথা নিশ্চয়ই পড়েছ ও শুনেছ। সেই সমস্ত গল্প ও কথা পড়ে ও শুনে তোমাদেরও ছোট্ট মনে নিশ্চয়ই একবার-না-একবার এই ইচ্ছেটা জেগেছে যে, তোমরাও যেন ওঁদের মতো করে ঈশ্বরকে ডাকতে পারো। ছোটোবেলায় সবাই মহৎ হতে চায়, এবং এতে দোষের কিছু নেই। বড়ো হবার পর সেই ইচ্ছেটা বাঁচিয়ে রাখলে জীবন অনেক সুন্দর হতো।




এখন কথা হচ্ছে, সাধুদের কথা পড়ে বা শুনে একবার মাত্র ঈশ্বরকে ডাকার কিংবা তাঁকে কাছে পাবার ইচ্ছে হলে তো চলবে না। তাঁকে ভালো করে জানতে হবে এবং জেনে সবসময়ই সকল কাজে তাঁকে ডাকতে হবে, তবেই তো তিনি তোমার কাছে আসবেন, আর তোমরাও ভক্ত-সাধুদের মতো হতে পারবে। তাঁকে না জানলে তোমরা কেমন করে তাঁকে সকল কাজে ডাকবে? ডাকার মতো করে না ডাকলে তিনি কখনোই আসেন না। ভক্তের হৃদয়ই ঈশ্বরের ঘর।




এখন এটা বুঝলে যে, আগে ঈশ্বরকে জানতে হবে। কিন্তু তাকে জানতে গেলেই সবার আগে জানতে হবে, তিনি আছেন। বিশেষ ব্যবস্থায় বিশেষ উপায়ে চলে তোমরা তাঁকে অনুভব করতে পারবে, দেখতেও পাবে। তাঁকে তোমরা দেখতে পাও না বটে, কিন্তু আমার কথাগুলি ভালো করে ধরে গেলেই বুঝতে পারবে, ঈশ্বর আছেন। খুব সহজ করেই বলার চেষ্টা করছি।




দেখো, এই পৃথিবীতে আমরা সকল জিনিস সকল অঙ্গ দিয়ে জানতে পারি না। এই যে গাছে, আকাশে, ফলে, ফুলে, পশু-পাখি’তে কত রকমের রং দেখা যায়, সেই রং দেখতে গেলে আমাদের চোখ খুলে রাখতে হয়। চোখ বন্ধ করলে রং দেখতে পাই না—কান দিয়ে রং দেখা যায় না। ঠিক একইভাবে, কান দিয়ে গান শোনা যায়, কিন্তু চোখ দিয়ে কোনো শব্দই শোনা যায় না। হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়, অনুভব করা যায়, কিন্তু শব্দ শোনা বা রং দেখা যায় না।




যে-অঙ্গ যে-কাজের জন্য তৈরি হয়েছে, সেই অঙ্গ দ্বারা সেই কাজটিই হয়। এক অঙ্গের দ্বারা অন্য অঙ্গের কাজ করা যায় না। ঈশ্বরকে জানতে গেলে এই চামড়ার শরীরের সাহায্যে জানতে পারবে না। তোমাদের যে-বুদ্ধি বা বোধ আছে, তা দিয়েই ঈশ্বরকে জানার পথে চলে তাঁকে জানতে হবে। বুদ্ধি বা বোধই ঈশ্বরকে জানার অঙ্গ। এর সঙ্গে চামড়ার অঙ্গের কোনো সম্বন্ধ নেই।




একটুখানি স্থির হয়ে ভেবে দেখলেই, তোমাদের ভেতরে যে-বুদ্ধি আছে, সেই বুদ্ধিই বলে দেবে, ঈশ্বর আছেন। ধরো, একটা পাত্রে কিছু লবণ আছে, সেই লবণের উপর কিছুটা জল পড়ে গেল। তখন তোমরা লবণটুকু আর দেখতে পাবে না। কিন্তু দেখতে পাচ্ছ না বলেই কি লবণটুকু সেই পাত্রে নেই? নিশ্চয়ই আছে। তোমরা যদি সেই লবণগোলা জলের একটুখানি মুখে দাও, তাহলেই জানতে পারবে, সেই জলের ভেতরে লবণ আছে।




আবার যদি সেই লবণটুকু চামড়ার চোখে দেখতে চাও, তাহলে তার জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। রৌদ্রে পাত্রটা রেখে জলটুকু শুকিয়ে ফেলো, তখন লবণটুকু চামড়ার চোখে দেখতে পাবে। ঠিক একইভাবে তোমার বুদ্ধিই জানিয়ে দেবে, ঈশ্বর আছেন। কিন্তু যদি সেই বুদ্ধিতে ঈশ্বরকে খুব স্পষ্টভাবে দেখতে চাও, তাহলে তার জন্য বিশেষ পদ্ধতির দরকার হবে। বাইরে থেকে দেখে ঈশ্বরের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না, যেমনি টের পাওনি লবণের অস্তিত্ব।




ধরো, তোমার একটা বাড়ি আছে। সেখানে তুমি না থাকলেও তোমার চাকর-দাসীরা তোমার হুকুমমতো কাজ করে যাচ্ছে। একদিন আমি যদি সেই বাড়িতে গিয়ে দেখি, চাকর-দাসীদের প্রত্যেকে নিজ নিজ নির্দিষ্ট কাজ করে যাচ্ছে, তাহলে আমি নিশ্চয়ই বুদ্ধিতে বুঝে নেব, সেই বাড়ির একজন কর্তা আছেন, যাঁর কথামতো চাকর-দাসীরা নিয়মিত কাজ করছে। রেলগাড়ি, ট্রামগাড়ি প্রভৃতিকে চলতে দেখলে মনে হয়, সেগুলি যেন আপনাআপনি চলছে। কিন্তু বাস্তবিক ঘটনা কি তা-ই? একজন চালক চালায়, তবেই সেগুলি চলে। কেউ না চালালে চলে কি কিছু? হয়তো চালককে চোখে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তা বলে কি চালক নেই? জানতে চাইলে একটু ভাবতে হয়।




যখন দেখি, এই পৃথিবীর সকলই কেমন ঠিকঠাক চলছে, তখনই বুদ্ধি বলে দেয়, এই নিয়ম করে সকলকে চালাবার একজন চালক আছেন। এই যে সূর্য প্রতিদিন ঠিক সময়ে উঠছে, আবার ঠিক সময়েই ডুবে চাঁদের উদয় হচ্ছে, এই যে পূর্ণচাঁদের ওঠানামার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত প্রভৃতি ঋতু যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে জগতে কেমন সুখশান্তি দিচ্ছে, এসব কী করে হচ্ছে? বর্ষাকালে বৃষ্টির জল পেয়ে গাছপালা বাড়তে থাকে, আবার শরতের ওম পেয়ে ধান ও বিভিন্ন শস্য পাকতে আরম্ভ হয়; আবার বসন্তকালের বাতাস পেয়ে গাছপালা আনন্দে-পুলকে নতুন নতুন সবুজ পাতার জন্ম দেয়। এই যে জগতের সকল কাজই নিয়ম না ভেঙে অবিরত হয়ে যাচ্ছে, একজন কর্তা ও নিয়ন্তা না থাকলে কি সকল কাজ এমন নির্বিঘ্নে চলতে পারত?




তোমরা পড়েছ, মাথার উপরে আকাশে ছোটো ছোটো হীরার টুকরোর মতো যে-সকল নক্ষত্র ও তারা দেখা যায়, ওদের প্রত্যেকটিই এক-একটা পৃথিবীর সমান বড়ো—কোনো কোনোটা আবার পৃথিবীর চেয়েও অনেক বড়ো। আকাশে যে-তারাগুলি দেখা যায়, তা গোনা যায় না। আবার এই তারাগুলি ছাড়া আরও অনেক তারা আছে, যেগুলি আমরা এখনও দেখতেই পাই না। ওরা এত দূরে যে, ওগুলি থেকে আলো এসে পৃথিবীতে এখনও পৌঁছতেই পারেনি। কোনো বস্তু থেকে আলো চোখে না এলে সেটি দেখা যায় না।




এই পৃথিবীতে এবং এতগুলি গণনার অতীত গ্রহ-নক্ষত্র-তারা'তে সকল কাজই নিয়মে চলছে। যে মহান পুরুষের নিয়মে, যাঁর আদেশে এদের মধ্যে নিয়ম কাজ করছে, তিনিই ঈশ্বর। তিনি নিশ্চয়ই আছেন; তিনি যদি না থাকেন, তবে আর কীই-বা আছে? তিনি আছেন, তাই নিয়ম কাজ করছে, তাই আমরা আছি, তাই আমরা বেঁচে আছি। তাঁর অস্তিত্ব নিজের অন্তরে উপলব্ধি করতে হয়।




আমাদের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সবচেয়ে বেশি বলেই তাঁর একটি নাম সত্য। তুমি আছ, আমি আছি, এইসব গাছপালা আছে, বাড়িঘর আছে, সেজন্য এ সকলই সত্য। যা আছে, তা-ই সত্য। কিন্তু তুমি আমি মরে গেলে আমরা কি এখানে থাকি? এই গাছপালা পুড়ে গেলে আর কি গাছপালা থাকে? এই বাড়িঘর ভূমিকম্পে চুরমার হয়ে গেলে কি আর বাড়িঘর থাকে? না, থাকে না। এ কারণে তুমি, আমি, গাছপালা, বাড়িঘর যতক্ষণ যেখানে আছি বা থাকব, ততক্ষণ সেখানে এর সবই সত্য। মনে রেখো, ঈশ্বর আমাদের চেয়ে ঢের বেশি করে আছেন; বলতে কী, তিনি সকল সময়ে এবং সকল স্থানে একইভাবে আছেন, তাই তিনি সবচেয়ে বেশি সত্য, অর্থাৎ এই সত্যের আর লোপ হয় না। এর নাম চৈতন্য, আত্মা বা ব্রহ্ম।




ঈশ্বর যদি চিরকাল সকল স্থানে সমানভাবে না থাকতেন, তাহলে সূর্য, চন্দ্র প্রভৃতি থেকে শুরু করে এই পৃথিবীর ধুলো পর্যন্ত সকল‌ই চিরকাল কি নিজেদের কাজ করে যেতে পারত? কে তাদেরকে সমানভাবে চালিয়ে নিতে পারত? ঈশ্বর চিরসত্যরূপে আছেন, তাই তিনিই এদেরকে চিরকাল সমানভাবে চালাচ্ছেন। তাই বলা যায়, ঈশ্বর মহান চিরস্থায়ী সত্য, আর বাকি সব ছোটোখাটো বা কিছু সময়ের সত্য। সেই মহান সত্য আছেন বলেই আমরাও সত্য হয়েছি। সেই মহান সত্যেরই ছায়াতে আমরা সত্যরূপে জেগে আছি।




সেই ঈশ্বরের অস্তিত্বরূপ মহান সত্যের ভাব নিয়ে যা যা ঘটনা হয় বা যা-কিছু আছে, তাকেই আমরা সত্য বলি এবং সে-সকল সম্পর্কে যা-কিছু বলা যায়, তাকেই আমরা সত্যকথা বলি। যা হয়নি, তা হয়েছে বললে সে-কথাকে আমরা মিথ্যাকথা বলি। মিথ্যা কাজ করলে বা মিথ্যাকথা বললে এজন্য আমরা ঈশ্বর তথা নিজের আত্মার কাছ থেকে দূরে গিয়ে পড়ি। মানুষের হৃদয়ে যে-ঈশ্বরের অধিষ্ঠান, সেখানে মিথ্যার কোনো স্থান নেই।




এতক্ষণে তোমরা বোধ হয় বুঝতে পেরেছ, ঈশ্বর সত্যস্বরূপ, এবং তোমাদের তাঁর কাছে যেতে ইচ্ছে করলে, তোমরা তাঁকে দেখতে চাইলে, সকল সময়ে ও সকল অবস্থায় সত্য কাজ করতে হবে এবং সত্য কথা বলতে হবে। সত্য কী? তোমাদের বিবেক যা করতে দেয় না, তা ঈশ্বরের‌ই বারণ, তাই তা না বলা এবং না করাই সত্য। সত্য পথে চললে জীবন সত্য হবে।
Content Protection by DMCA.com