এক লালপরীর নীলজীবন/ প্রথম অংশ

সময়টা ২০১৪। আমি কারিতাস-এ জয়েন করেছি চার মাস। নতুন চাকরি। চাকরির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে সান্ধ্য এমবিএ কোর্সটা করছি। মনে আশা, এমবিএ’টা করা থাকলে ভবিষ্যতে প্রমোশনের সময় কাজে লাগবে। তখন আমার পৃথিবী বলতে ভূরি ভূরি বই, অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা আর কবিতালেখা---কখনওবা টুকটাক গদ্য। এইসব নিয়েই আমার দিন, আমার রাত, আমার ছকবদ্ধ জগত। ছোটবেলা থেকেই আমি বেশ সীমাবদ্ধ জায়গার মধ্যে থেকে বাঁধারুটিনে বড় হয়েছি। বই পড়ো, খাওয়া-দাওয়া করো, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার পড়তে বসো। এইটুকুই হচ্ছে আমার গোটা পৃথিবী। ঠিক এই গৎবাঁধা পৃথিবীটার বাইরে আমি তেমন একটা যাইনি কখনও। আসলে, যাইনি মানে, যেতে হয়নি।




অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পর যে সময়টা বেঁচে যেত, ওই সময়টাতে আমি বই পড়তাম, মুভি দেখতাম, মিউজিক শুনতাম। মন চাইলে লিখেও ফেলতাম কিছু একটা। আমার কাছে, পৃথিবীর মানেই ছিল ওইটুকু। তাই পৃথিবীর পথে চলতে গিয়ে অত অলিগলি আমার হাঁটা হয়নি, দেখা হয়নি, ফলে চেনাও হয়নি।




থাকতাম আইবিএ’র হোস্টেলে। গ্রিনরোডে। রুম নম্বর ২০৩। সবাই মজা করে বলত, আমি নাকি দুই সতীনের ঘরে থাকি! বন্ধুবান্ধবরা যখন ক্লাস শেষ করে সবাই মিলে আড্ডা, খেলাধুলা, ঘোরাফেরা, প্রেমিকা নিয়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসে বাদাম-খাওয়া এসব নিয়েই থাকত, আমি তখন ভাবতাম, ঠিক এই বইটা শেষ করে আর একটা বই ধরি, কিংবা লিখে ফেলি কিছু একটা। লিখতে বড় আনন্দ হতো। কিংবা ল্যাপটপের সামনে বসে যেতাম হার্ডডিস্কে বহু দিন ধরে না দেখে ফেলেরাখা কোনও ক্লাসিক মুভি। আমার পৃথিবীটা ছিল খুব ছোট---বই, সিনেমা, মিউজিক, লেখালেখি। ভীষণ ঘরকুনো মানুষ ছিলাম, নিজেকে ঘরের মধ্যেই আটকে রাখতাম। এ-ই তো আমি!




আমার বন্ধু জয়ন্ত। খুব প্রাণবন্ত, চঞ্চল, দুষ্টু আর চরম ফাজিল প্রকৃতির। জীবনটাকে সে রঙিন হিসেবেই দেখে, আমার মতো বইয়ের চোখে দেখে না। পৃথিবীর অনেক অলিগলি, রাস্তার মোড় তার ভারি চেনা। স্বভাবে বহির্মুখী, আমার ঠিক উল্টো। আমার রুমের চার রুম পরের রুমে থাকত। দুইশো আট।




একদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। জানালার পাশে আধশোয়া অবস্থায় সমরেশ মজুমদারের ‘মনের মতো মন’-এ ডুবে আছি। রুমের দরজা তেমন একটা বন্ধ করা থাকত না। বন্ধু জয়ন্ত পেছন থেকে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে কেমন জানি দুষ্টুমির ছলে বলতে লাগল, বন্ধু, দুনিয়াটা তো শুধু বইয়ের ভেতর বন্দি করে রাখলে চলবে না, একটু বেরিয়ে দ্যাখ, কোথায় কী আছে, কোন বাগানে কোন ফুল ফোটে, কোন রাস্তার মোড়ে কোন বটগাছটা ঠায় দাঁড়িয়ে, কোন গলিতে কোন নিশান ওড়ে! ওর মুখে অমন ভাষা শুনে আমি কিছুটা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কীরে, তোর পেট খারাপ? এমন করছিস কেন? কী বলতে চাস, বলে ফেল ঝটপট! ঝামেলা করিস না, কাজের কথাটা বলে এখান থেকে একটু দূর হ! বইটা সেইরকম, দোস্তো! পড়ছি, জ্বালাবি না!




এবার আবার এক রহস্যময় হাসি! কেমন একটা লোভাতুর চোখে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, চল, আজকে তোকে একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাব। তোকে আজকে মানুষ করে দিই! অনেক ভালো লাগবে তোর।




জয়ন্ত আমার কলেজলাইফের বন্ধু। একটা ব্যাংকে আছে এখন। সে এমন ফাজলামো প্রায়ই করে থাকে। আমি তার কথা তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে তার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে আবার বইয়ের মধ্যে চোখ ডুবিয়ে দিলাম। ওর দিকে সল্টেড ক্যাশুনাটের প্যাকেটটা ছুড়ে দিয়ে বললাম, ঝামেলা না করে খেয়ে বিদেয় হ! ওই টবের পাশে আপেল আছে, খেতে ইচ্ছে করলে খা। দেখলাম, বন্ধু বাদাম চিবোতে চিবোতে আলতোভাবে আমার পিঠ চাপড়াতে লাগল আর ধরাগলায় নিচুস্বরে বলতে শুরু করল, আরে ব্যাটা, চল না! আজকে তোকে একটা নতুন পৃথিবী দেখাব। প্রমিজ, তোর ভালো লাগবে!




এবার খানিকটা বিরক্তই হলাম। বললাম, বন্ধু, দুনিয়াটা দেখার অত শখ আমার নেই, সময় হলে দুনিয়া নিজেই নিজেকে দেখাবে আমার কাছে! তুই চাস তো তুই দেখ, আরও দেখ! তবুও এখান থেকে যা, আমাকে নিয়ে টানাটানি করিস না! আমার পড়া হলে বইটা নিয়ে যাস, পড়িস, ভালো লাগবে।...এটা শুনে বইয়ের উপর থেকে আমার হাতটা সরিয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে টেনে ধরে জয়ন্ত বলল, যা, রেডি হয়ে নে, আজকে তোকে খুব সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাব, তোর সব বইয়ের চেয়েও সুন্দর জায়গা, রহস্যময় এক জগত। চল না ব্যাটা! শালা, এরকম অমানুষ অবস্থায় মরে গিয়ে কী লাভ? আর হ্যাঁ, বেশ কিছু টাকা নিস সাথে।




এবার আমার আগ্রহটা একটু বাড়ল। দেখিই না, বন্ধু আমায় কোথায় নিয়ে যায়! রেডি হলাম। বই বন্ধ করে টেবিলে রেখে আমি চললাম বন্ধুর হাত ধরে। জানি না ঠিক, বন্ধু আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তবে এইটুকু বুঝতে পারছিলাম, আমরা এমন কোথাও যাচ্ছি যেখানে আমি কখনও যাইনি। দুজন মিলে রিকশায় উঠলাম। বইয়ের টেবিল থেকে উঠে এলেও আমার মনটা আটকে আছে স্বপ্নাশিসের ক্রিকেটব্যাটে। রিকশা আমাদের টেনে নিয়ে চলল সেই অজানা পৃথিবীতে। জয়ন্তকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি? সে কিছুই বলে না, শুধু বলে, আরে ব্যাটা, দেখ না তুই! চলতে চলতে রিকশা এসে থামল ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডের ৪ নম্বর ব্লকের ১৪ নম্বর বাড়ির সামনে। রিকশা থেকে নামলাম, লিফটে উঠে জয়ন্ত ৬ চাপল। সিক্স-বি নম্বর ফ্ল্যাট। কলিংবেল দিতেই রবিন নামের আনুমানিক চল্লিশোর্ধ্ব একজন ভদ্রলোক দরজা খুলে আমাদের ভেতরে ডাকলেন। বুঝলাম, এঁর সাথেই জয়ন্ত ফোনে কথা বলেছিল রিকশায় আসতে আসতে। বেতের ফার্নিচার দিয়ে ফ্ল্যাটটা সাজানো। রুচি আর পারিপাট্যের ছোঁয়া চারিদিকে। ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখলাম অক্ষয় কুমার শক্তি কাপুরকে নির্দয়ভাবে ঘুসি মারছে তো মেরেই যাচ্ছে! ঘুসিতে ঘুসিতে নাকমুখ ফেটে রক্তটক্ত বের হয়ে একাকার অবস্থা! ৩২ ইঞ্চি টিভিতে জি-সিনেমা চলছে। ঢিসুম ঢাসুম!




দেখলাম, জয়ন্ত এবার দুষ্টু দুষ্টু হাসছে। আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না। রবিন সাহেব আমাদের সাথে হাত মিলালেন। আমাকে দেখিয়ে জয়ন্ত বলল, হ্যাঁ, ও-ই রকিব। ওর কথাই বলেছিলাম আপনাকে। রবিন সাহেব খুব অমায়িক, ভদ্র, বিনয়ী। উচ্চতায় সাড়ে পাঁচ ফুটের একটু বেশি, গায়ের রং মেঘবর্ণ, মুখে বসন্তের দাগ আছে, চোখ দুটো কেমন জানি কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে, মেহেদি-করা কাঁচাপাকা চুল। বন্ধুর কানেকানে জিজ্ঞেস করলাম, বন্ধু ঠিক কী কারণে আমরা এখানে এলাম, একটু বুঝিয়ে বল তো! উত্তর পেলাম, ‘আরে, দেখ না তুই!’ এদিকে নাস্তা এসেছে। লেমনজুস, কেক, আপেল, চিপস।




এবার রাজ্যের সব রহস্য ভেঙে জয়ন্ত বলল, এখানে পরী আছে রে ব্যাটা, পরী! তুই পরীর সাথে সময় কাটাবি, সুখ নিবি, মজা করবি, পয়সা দিবি। বুঝলাম, এই ফ্ল্যাটে পতিতাবৃত্তি চলে। কোথায় এসেছি বুঝতে পেরে লজ্জায় কুণ্ঠায় আমার পুরো দুনিয়াটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে! খানিক বাদে এদিক ওদিক চোখ হাঁটাচ্ছি। দেখার চেষ্টা করছি, এই রাজ্যে কারা থাকে। আসলেই কী হচ্ছে এখানে! দেখলাম, ফ্ল্যাটে তিনটা বেডরুম। পাশাপাশি। প্রথম যে রুমটা আছে, রবিন সাহেব আর জয়ন্তসহ ওটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে খাটের উপর তিনটা মেয়ে বসে আছে। ওদের চোখেমুখে হাসি। সেই হাসি অনেকটাই আরোপিত। ওরা আমাদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। ওদের মধ্যে একজন মাথানিচু করে বসে ছিল, ওর দিকেই আমার চোখ আগে গিয়েছিল। বাকি দুইজন অপেক্ষাকৃত সাবলীল। রুমটা অতটা গোছানো নয়। মনে হলো, কেবল ড্রয়িং-রুমটাই পরিপাটি।




একটা ব্যাপার চোখে পড়ল। সেই বাসায় জয়ন্ত বেশ স্বাভাবিক, তার মধ্যে কোনও ইতস্ততবোধ নেই। ওখানে যারা ছিল, ওদেরকেও সে চেনে, খুব হেসে হেসে কথা বলছে ওদের সাথে। রুমগুলিও চেনে মনে হলো। বুঝলাম, সে এখানে নিয়মিতই আসে। আমি সংকোচে আর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, এ আমি কোথায় এলাম? এখন যদি পুলিশ আসে? যদি ওরা আমাদের ব্ল্যাকমেইল করে? যদি এখানে গোপন-ক্যামেরা লাগানো থাকে? আরও কী কী জানি মাথায় আসছিল। আমি তাকিয়ে আছি ফ্লোরের দিকে, টাইলস গুনছি খুব মন দিয়ে যাতে কোনও ভুল না হয়…যেন ওখানেই সব রহস্যের উত্তর আছে, সব সমস্যার সমাধান আছে!




আমি রবিন সাহেবকে ইতোমধ্যে রবিন ভাই ডাকতে শুরু করেছি। ওই ফ্ল্যাটে একজন বয়স্কা মহিলা আছেন, উনি ঘরের টুকিটাকি কাজকর্ম করছেন। জয়ন্তের কাছে এসে একগাল হেসে বললেন, ‘বাবা, আজকে আমাকে একশো টাকা দিয়ে যেতে হবে কিন্তু! গতদিন পঞ্চাশ দেন নাই ভুলে।’ একটা অল্পবয়সি ছেলে আছে, সে নানান ফরমায়েস খাটছে। রবিন ভাই আমার কাছে এলেন। আমাকে দেখে একটু বুঝতে পারলেন বোধহয় কী এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে আমার ভেতর। বললেন, ভাইরে, এই দুনিয়ার সবকিছুরই একটা ফার্স্টটাইম আছে। আপনি আগে করেন নাই, এখন করবেন, অসুবিধা কী? এটা করলে তো আর মরে যাবেন না, তাই না? আজকের পর থেকে দেখবেন, একধরনের কনফিডেন্স গ্রো করবে আপনার মধ্যে। আর এত ভয় পেতে হবে না, আপনার প্রাইভেসি হ্যাম্পারড হবে না। সিকিউরিটি নিয়েও কোনও সমস্যা নাই। আপনি নির্ভয়ে এনজয় করেন। এত লজ্জার তো কিছু নাই। আগে পরে তো এটা করবেনই, তাই না? কিছু মনে করবেন না, আমরা তো বন্ধুর মতোই…ফ্রাঙ্কলি বলি, এই দুনিয়ায়, লাইট অফ করলে সব পুরুষই শুয়োরের বাচ্চা! যতক্ষণ আলো, পুরুষ ততক্ষণই ভালো। মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক রাখতে পারে যে পুরুষ, সে হয় মহাপুরুষ, নয় হিজড়া। অভিজ্ঞতা থেকে বললাম আরকি! অনেক দেখলাম তো, ভাই!




বুঝলাম, লোকটা এই লাইনের দালাল। রবিন ভাই বলতে লাগলেন, ভাই, আমি এ লাইনে এসেছি অনেক বছর। আমি হচ্ছি মাগির দালাল। আমার ক্লায়েন্টদের কেউ কেউ আমাকে মোহাব্বত করে ডাকে এমডি স্যার! এটাই আমার কোডনেম! বুঝেন নাই ব্যাপারটা? হা হা হা! এ ব্যবসা আমার আদিব্যবসা। এটা থেকেই আমার অনেকগুলো ব্যবসার সূত্রপাত। আমার একটা পেট্রোলপাম্পে শেয়ার আছে, একটা রেস্টুরেন্ট আছে, আর শেয়ার মার্কেটে কিছু টাকা আছে। এই তো! আল্লাহ্‌ ভালোই রেখেছে! কোনও অভাব নাই, তবে একসময় ছিল। অনেক অভাব ছিল, বুঝলেন? শুধু পাউরুটি আর জল খেয়ে কতদিন যে থেকেছি!




তিনি আবার খানিকটা আনমনা হলেন। দেখে মনে হলো, অনেক পুরনো কথা ওঁর মাথার ভেতর ঘুরছে। জিজ্ঞেস করলাম, এই লাইনে আপনি এসেছেন কীভাবে? ঔদাসীন্য থেকে ফিরে এসে তিনি বলতে লাগলেন, একটাসময় পকেটে দুইটাকাও ছিল না। ভার্সিটিতে পড়তাম তখন। থার্ডইয়ারে পড়ি মনে হয়। ঘুরতে ঘুরতে এক বড় ভাইয়ের সাথে পরিচয়। লোকটা ভালোই, আমাকে মাঝেমধ্যে টাকাপয়সা দেন, চানখার পুলে বিরিয়ানি খাওয়ান। তখন আমি ভাই গরীবমানুষ, যে আমাকে টাকা দেয় সে-ই আমার জন্য ভালো। তবে আমি একসময় বুঝতে পারলাম, তার চরিত্র বিশেষ সুবিধার না, তবে হাতে টাকাপয়সা আছে ভালোই। হাতে টাকা আছে যার, তার চরিত্র ভালো হলেই কী, আর খারাপ হলেই-বা কী! চরিত্রবান ফকির হওয়ার চেয়ে চরিত্রহীন আমির হওয়া অনেক অনেক ভালো। কারণ কথা তো একই, ওই ফকিরকে তো আমিরের কাছেই হাত পাততে হয়। কোনও পরনির্ভরশীল ফইন্নির বাচ্চা আমার সামনে চরিত্রের ফুটানি মারলে ওকে ধরে আমার থাবড়াতে মন চায়!




যা-ই হোক, ওই লোকটা কিন্তু মানুষ হিসেবে ফার্স্টক্লাস ছিল। মন ভালো, দিলখোলা টাইপ বান্দা। কেউ কোনও বিপদে পড়লে আর কেউ আসুক না আসুক, কবির ভাই ঠিকই এসে হাজির! ভাই, প্রতিমাসেই গরীব লোকজনকে টাকাপয়সা দিতেন উনি। তো একদিন সেই ভাই আমাকে এই লাইনে আসার অফার দেন। মানুষটা ভালো, ভালোমানুষের সাথে নরকে গেলেও ভালো। রাজি হয়ে গেলাম। ওঁর সাথে থাকতে থাকতে লাইনটা আমি শিখে গেলাম। কোনও বিনিয়োগ নাই, কেবল সাহস লাগে আর নির্লজ্জ হতে হয়। কামাইও বেশ ভালো। পৃথিবীর কারও কথাতেই কিছু মনে করা যাবে না, আর কাউকেই বিশ্বাস করা যাবে না। এই ব্যবসার এই দুইটা হলো মূলমন্ত্র। আর একটা কথা। একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে এই লাইনে এসে। এই জগতের নাইনটি এইট পয়েন্ট ফাইভ পার্সেন্ট পুরুষমানুষের চরিত্র বলতে কিছুই নাই। বাকিরা বেশিরভাগই ভীতুর ডিম! যাদের দেখলে পরিপাটি ভদ্রলোক মনে হয়, তাদের জায়গামতো ছেড়ে দেন, দেখবেন তাদের আসল চেহারা। আলোতে মানুষ চেনা যায় না, মানুষ চিনতে হয় অন্ধকারে। হা হা হা…




পরবর্তীতে আমি নিজেই ব্যবসাটা শুরু করলাম। একটা ছোটখাটো বাসা ভাড়া নিলাম। ওই বাসার ভাড়া যা, আমার জন্য ভাড়া তার চেয়ে বারোশো টাকা বেশি। আবার কেয়ারটেকার ও দারোয়ানকে বাড়তি টাকা দিতে হতো। আমার ফ্ল্যাটে যতজন গেস্ট আসত প্রতিজন হিসেবে পঞ্চাশ টাকা করে ওদের দিয়ে দিতে হতো। আমার নাম আর ফ্ল্যাট নাম্বার বললে রেজিস্টার খাতায় এন্ট্রিকরা লাগত না। এখন আসেন মেয়ে জোগাড় করার কাহিনি কী ছিল, সেখানে। আপনি তো আমার কম্পিটিটর না, আপনাকে বললে অসুবিধা নাই। ওই বড় ভাইয়ের সাথে থেকে থেকে কিছু মেয়ের লিংক আমি আগেই জানতাম। ওদের বেশিরভাগই গরীব, কিছু আছে গরীব না কিন্তু বাড়তি টাকার জন্য কাজটা করে। সেই টাকা দিয়ে বিভিন্ন টাইপের শখ পূরণ করে। ভাইরে, ঢাকা-চিটাগাং জার্নি করে প্লেনে, ১০-১২ হাজার টাকার নিচে ড্রেস পরে না, কসমেটিকস ইউজ করে ম্যাক কোম্পানির। ভেবে দেখেন, ভালোই কিন্তু! কারও সাথে প্রেমের নামে দিনের পর দিন ফ্রিতে থেকে এর পর ব্রেকাপ হয়ে যাবার পর কষ্ট পাওয়ার চাইতে বরং এই লাইনে থেকে একই কাজটাই করে টাকা কামাই করে সুখেথাকা ভালো না? কীসের ভালোবাসা-টালোবাসা? সবই তো ফ্রিতে খাওয়ার ধান্দা! আমি তো মেয়েদের বলি, প্রেমের নামে কাউকে ফ্রিতে দেওয়ার চাইতে বরং টাকার বিনিময়ে দাও, সেটা অনেক ভালো। দুনিয়ায় প্রেম হয়ই তো ব্রেকআপ হওয়ার জন্য। এক জনের সাথে একশো বার শোয়া আর একশো জনের সাথে এক এক বার করে শোয়া, একই তো কাহিনি! প্রথমটাতে না টিকলে তো পুরাই লস, আর দ্বিতীয়টাতে টিকাটিকির কোনও ব্যাপার নাই…পুরাটাই লাভ! অবশ্য, এটা আমার পার্সোনাল অবজারভেশন।




কিছু মেয়ে আছে পড়াশোনা করে, সেমিস্টার-ফি ও হাতখরচ নিজেকে চালাতে হয়, পরিবারকেও দেখতে হয়। আবার কিছু মেয়ে আছে কোথাও কোনও চাকরি পাচ্ছে না, কিন্তু পরিবারটা চালানোর আর কেউ নেই। এই ধরনের অনেক মেয়েই আছে যারা এই পার্টটাইম পেশায় নিয়োজিত। অনেক স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির মেয়ে আছে এই লাইনে। ওদের টাকার দরকার, ওরা কারও কাছে হাত পাতছে না, নিজের রূপ ও যৌবন বেচছে। অনেক সম্মানের কিন্তু, ভেবে দেখেন। যে সমাজ আপনাকে বড় বড় কথা শোনায়, আপনি বিপদে পড়লে সে সমাজ এক টাকা দিয়েও আপনাকে সাহায্য করবে না। আমি ওরকম মেয়েদের খুঁজে খুঁজে বের করতাম। অনেকে আবার স্বেচ্ছায় আমাকে খুঁজে বের করত। এক মেয়ের কাছ থেকে অন্য মেয়েদের লিংক পাওয়া যায়। আবার গেস্টদের কাছ থেকেও অনেক মেয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। মেয়েরা অনেক খুশি হয় ওদের ভালো ভালো ধনী দিলদরিয়া ক্লায়েন্ট ধরে দিলে। কিছু মেয়ে আছে, যারা জাস্ট এনজয় করার জন্য এটা করে। গেস্টের চেহারা ফিগার পছন্দ না হলে কোটি টাকা দিলেও ওঁর সাথে শোবে না। অনেক মডেল, অনেক অ্যাকট্রেস আছে এই লাইনে, আমার খোঁজেই আছে! তবে ওদের রেট অনেক বেশি, ওরা যেখানে সেখানে কাজ করেও না, ওদের ভালো সিকিউরড জায়গায় নিয়ে যেতে হয়। এমনি নরমাল মেয়ে জোগাড় করা কোনও ব্যাপার না, তবে সুন্দরী অল্প বয়সি মেয়ে জোগাড় করা সহজ নয়। যাক, ওভাবেই আমার এ ব্যবসায় আসা।




বুঝলাম, শ্রদ্ধেয় এমডি স্যার রবিন ভাই ভারি ‘মানবিক’ মানুষ। অনেক মেয়েকে হেল্প করছেন, নানা দিক বিচারে।




রবিন ভাই মেয়ে তিনটিকে ড্রয়িং-রুমে ডাকলেন। ওরা আসার ঠিক আগে আমাদের মনে সাহস দিলেন, ‘ভাই, জয়ন্তদা তো জানেন আমার ব্যাপারে। প্রশাসনের অনেক উচ্চপর্যায়ের লোকের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। আমি ছোট মানুষ হলেও সব ম্যানেজ করে ফেলতে পারি। পুলিশও কোনও ব্যাপার না, পুলিশের অনেক বড় বড় অফিসার আমার রেগুলার ক্লায়েন্ট।’ ওরা এল। আমাদের ঠিক বিপরীত দিকের সোফায় মেয়ে তিনটি বসল। ওদের মধ্যে একজনের চোখ আমাদের দিকে নয়, সে মোবাইলে ব্যস্ত, হয়তো মেসেঞ্জারে চ্যাটিং করছে। কী দেখে জানি একটু একটু হাসছে। এই মেয়েটিই রুমে মাথানিচু করে বসেথাকা সেই মেয়ে। আমার খুব কাছে এসে রবিন ভাই ওকেই দেখিয়ে আমার কানে কানে বললেন, ভাইয়া, এই মেয়েটা এই লাইনে নতুন, একদম ফ্রেশ। এটাকে নেন, মাত্র দেড়-দুই মাস আগে এসেছে। মজা পাবেন, সার্ভিসও খুব ভালো। অনেক ভদ্র মেয়ে, কোনও ক্লায়েন্টের কমপ্লেইন নাই ওর ব্যাপারে। রেগুলার না, খুবই কম প্রোগ্রাম করে, ভালো পড়াশোনাও জানে। আমি রবিন ভাইয়ের কথা ঝিম মেরে শুনে যাচ্ছি। উনি আমার হাতে দুইটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন, আপনি চাইলে প্যাকেট ইউজ নাও করতে পারেন, সমস্যা হবে না। একদম ফ্রেশ তো, তাই কোনও ঝামেলা নাই, তবে ইউজ করলে ভালো। ডিমান্ড একটু বেশি, দেখছেনই তো কচি, লম্বা, স্লিম, সুন্দরী। উনি এইসব কথা বলছেন মেয়ে তিনটির সামনেই। মেয়েগুলিকে দেখে মনে হচ্ছে, এই কথাগুলি ওদের জন্য অভিনব নয়।




আমি চোখ তুলে মেয়েটার দিকে সরাসরি তাকালাম। মেয়েটা স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে ছড়িয়ে আছে মৃদুহাসি। জয়ন্ত আর রবিন ভাই দেখতে পাচ্ছে একটা কলগার্ল, আর আমি দেখতে পাচ্ছি অনেক গল্পজমানো, অনেক কথামাখানো, অনেক যন্ত্রণাছড়ানো বড় বড় দুটো টানাচোখ। ওই চোখ অনেক কথাই বলে যাচ্ছে নিঃশব্দে, বিনাবাক্যব্যয়ে। মেয়েটার গোলগাল চেহারা, স্লিম ফিগার, কাঁচা হলুদরাঙা গায়ের রং, বেশ লম্বা। সত্যি বলতে কী, দেখেই ভালো লেগেছে। এই মেয়েকে নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ওকে বারোয়ারি সম্পত্তি হিসেবে মানতে ইচ্ছে করে না। এই অভদ্রপল্লীতে সুন্দরী হওয়াটাই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। দ্বিতীয় যোগ্যতা হলো, একজন নারীর শরীরে যা থাকে, তা পরিপূর্ণভাবে থাকা। সে শরীরে পুরুষের ক্ষুধা-মেটানোর সকল উপাদান থাকতে হবে।




রবিন ভাই মেয়েগুলিকে ইশারায় রুমে চলে যেতে বললেন। ওরা তিনজনই প্রথম রুমটায় ফিরে গেল। আমি রবিন ভাইকে একটু দূরে যেতে অনুরোধ করলাম। উনি বারান্দায় গিয়ে কার সাথে যেন মোবাইলে কথা বলতে লাগলেন। জয়ন্ত আমার কাছে এসে বলল, বন্ধু, ওই যে সুন্দরী মেয়েটা দেখলি, আজ ওটা তোর ভাগে থাক, আমি নীলজামাটাকে নিই। আমি ওর হাত চেপে ধরে বললাম, দোস্ত, আজকে আমাকে ছেড়ে দে। আমি আসলেই পারব না, মন সায় দিচ্ছে না। তুই ওই মেয়েকেই নিয়ে রুম ঢোক, আমি এখানে ওয়েট করছি। প্লিজ! ‘ধুউর ব্যাটা! এনজয়!’ বলেই আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে খুশিমনে ফুরফুরে মেজাজে শিস দিতে দিতে বাকি দুইজনের একজনের কোমর ধরে জড়িয়ে নিয়ে একটা রুমে ঢুকে গেল। রবিন ভাই ফিরে এসে আমাকে (ওঁর ভাষায়) ‘ভিআইপি রুম’টাতে নিয়ে গেলেন। বললেন, ভাই, আপনার পকেটে ওই দুইটা প্যাকেট আছে না? আরও লাগলে বলবেন, ওকে বললেও হবে, আমি দরজার নিচ দিয়ে প্যাকেট দিয়ে দিব। তবে ফার্স্ট-টাইম তো, দুইটাতেই হয়ে যাওয়ার কথা। তবু বাই-চান্স বলে একটা ব্যাপার আছে। আমি রোবটের মতো রবিন ভাইয়ের কথাগুলি শুনে গেলাম, কেবল এদিক ওদিক মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে ওঁর কথায় সায় দিয়ে যাচ্ছিলাম।




আমি রুমে ঢোকার মিনিট তিনেকের মধ্যে মেয়েটা দরজায় নক করে ‘আসছি আমি!’ বলে দরজা ঠেলে রুমে ঢুকল। ওর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে ‘হ্যালো!’ বললেও এবার আমি প্রায় ঘামতেই শুরু করলাম। সে কী লজ্জা সে কী লজ্জা! দেখলাম, বেশ সাজানো-গোছানো সুন্দর একটা বেডরুম। এসি রুম, সেখানে বড় এলইডি টিভি, সাজানো খাট, খাটের উপর টিস্যুবক্স, নতুন তোয়ালে। বাথরুমে গেলাম। ওখানে নতুন সাবান, শ্যাম্পু, শাওয়ার জেল, লিকুইড সোপ, ওয়ানটাইম ব্রাশ, টুথপেস্ট, টয়লেট টিস্যু। সবই আছে ঠিকঠাক। রুমে এয়ার-ফ্রেশনার আছে, গুড নাইটের মশার লিকুইড ভ্যাপারাইজার-প্লাগ লাগানো আছে সকেটে। আমি খাটের এক কোনায় গিয়ে বসলাম গুটিসুটি হয়ে। আমাকে দেখতে লাগছে নবপরিণীতা বধূর মতো। পাশেরাখা চাদরটা বুকে টেনে নিলাম। এদিকে ওদিকে, মেয়েটার দিকে, কোনও দিকে না থাকিয়ে, আমি ঠায় একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি সামনে-রাখা টিভিটার দিকে। টিভি-রিমোর্ট আমার হাতে। আমি অ্যানিমেল প্ল্যানেট চ্যানেলটা দেখছি খুব আগ্রহভরে। এই চ্যানেল আমি জীবনেও দেখি না, কিন্তু আজকে দেখতে খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, অ্যানিমেল প্ল্যানেট না দেখে আমি এতদিন বেঁচে ছিলাম কী করে! হাতির পাল দৌড়ে দৌড়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন। ওরা কোথায় যায়? কেন যায়? দৌড়ে দৌড়েই-বা কেন যায়? হেঁটে হেঁটে গেলে কী সমস্যা? এত দৌড়াদৌড়ির কী আছে? আশ্চর্য!




আড়চোখে খেয়াল করলাম, মেয়েটা মোবাইলে বোধহয় ফেসবুকিং করছে আর আমার দিকে মাঝেমধ্যে তাকাচ্ছে। শীতকাল, এসি বন্ধ, ফ্যান চলছে, আমার সারাশরীরে বিন্দুবিন্দু ঘাম। সে সোফা থেকে উঠে এসে খাটে আমার পাশঘেঁষে বসল। আমি সরে গিয়ে তার কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে বসে টিভির দিকে মনোযোগ বাড়ালাম। এখন একটা বাঘ কিছু হরিণের পিছনে দৌড়াচ্ছে, ওদের মধ্যে একটাকে বাঘ ধরে ফেলল। পুরোই রক্তারক্তি অবস্থা! আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম, বাঘ কীভাবে হরিণকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়, এটা আমি আগে দেখলাম না কেন? আজব, অতি আজব!...মেয়েটা হয়তো ভাবছে, আমি এই রুমে এসেইছি কেবল টিভি দেখতে। আমার বাসার টিভিটা নষ্ট হয়ে গেছে, তাই এসেছি। আমি ওকে পেছনে রেখে অন্যদিকে ঘুরে টিভি দেখেছি অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে। মজার ব্যাপার হলো, আমি এমন একটা মানুষ যে কিনা টিভি দেখেই না। আজকে সেই আমার মধ্যেই টিভিদেখার নেশা চেপেছে!




হঠাৎ আমার সাধের টিভিদেখায় ছেদ দিয়ে মেয়েটা বলে উঠল, হ্যালো মিস্টার! আমি যেন ধ্যানভাঙার মতো করে চমকে উঠে কিছুটা তোতলাতে তোতলাতে সাথে সাথেই বলে উঠলাম, হাই! উত্তরটা দিয়েই আবার টিভির দিকে তাকিয়ে আছি। এভাবে প্রায় ১০-১৫ মিনিট চলে গেল। সে তিনটা গান শুনে ফেলল। দুইটা আতিফ আসলামের, একটা সনু নিগমের। নিজেকে পুরাই বলদ বলদ লাগছিল। আমি আসলে ঠিক কী কথা বলব, কীভাবে শুরু করব, তার কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এসময় নীরবতাই ভালো। টিভিতে এখন চলছে সিএনএন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের কী একটা স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কী একটা জানি বাদীরা রাস্তায় নেমে এসেছে। ওরা খুব চিৎকার করছে। আমার প্রেসিডেন্টের জন্য মায়া হলো। আহা, বেচারা!




মেয়েটাই আবার নীরবতা ভাঙল। খুব কনফিডেন্ট টোনে বলল, স্যার, আমি কি জামা খুলব? আপনার কি কোনও স্পেশাল ডিমান্ড আছে?...ওর কথা শুনে আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম যেন! মেয়েটার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললাম, থামো! কিচ্ছু করতে হবে না। টিভি দেখো! আসো, আমরা টিভি দেখি, কেমন?




দেখলাম, ভারি মিষ্টি চেহারা, বয়স কতই-বা হবে…এই বিশ বা একুশ বোধহয়…গালের বামদিকে একটা তিল আছে, চোখে গাঢ় করে কাজল দেওয়া, হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক-মাখা ঠোঁটদুটো সরু…যেন সদ্যপ্রস্ফুটিত কোনও গোলাপের পাপড়ি। মেয়েটার সোনাঝরা চোখদুটো টিপটিপ করে আমার দিকে বারবার দৃষ্টি ছুড়ছে। প্রায় কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত লম্বা চুলগুলি স্লো করে-ছাড়া ফ্যানের বাতাসে এদিক ওদিক উড়ছে। সামনের কাটা চুলগুলো তার চোখে-নাকে-গালে এসে ছুঁয়ে দিয়ে দিয়ে সরে যাচ্ছে। কাঁচাহলুদের মতো গায়ে যেন রাজ্যের রঙের ধুম পড়েছে। গলায় একটা ঘিয়ারঙের পুঁতির কি মুক্তোর মালা। হাতে সোনালী রঙের একটা ব্রেসলেট। কপালের ঠিক মাঝখানটায় লালবিন্দুর কালোটিপ। কালোরঙের একরঙা একটা পাতলা জর্জেটের শাড়ি পরে আছে, বড়গলার রেডকালারের ব্লাউজ। কালোশাড়িতে মোড়ানো সাপের মতন চিকন শরীরটায় যেন হরেক রঙের খেলা দেখতে পাচ্ছি। ওকে দেখাচ্ছে একটা প্রজাপতির মতন, যেন দুটো পাখা লাগিয়ে দিলেই এই বুঝি সে উড়ে যাবে দূরের কোনও এক ফুলবাগানে। মেয়েটা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে, ঠোঁট কামড়াচ্ছে, তার চোখেমুখে কিছুটা বিরক্তি।




এদিকে আমার মুগ্ধতা ক্রমেই বাড়ছে। এই প্রথম এতটা ভালো করে খেয়াল করলাম মেয়েটাকে। এই রূপ, এই চোখ, এই গাল, এই ঠোঁট, এই অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে যেন বাগানে সদ্যফোটা কৃষ্ণচূড়া ফুল। ভাবছি, এই মেয়েটাও কেন এখানে! ওকেও কেন এখানে আসতে হলো! আমি সমানে ঘামছি। উঠে গিয়ে ফ্যানটা বন্ধ করে টেম্পারেচার ২৭-এ দিয়ে আমি এসি ছেড়ে দিলাম।




আমার এই মুগ্ধহবার রেশটা কাটিয়ে মেয়েটা কথা বলে উঠল। ‘স্যার, প্রায় ৪০ মিনিট হয়ে যাচ্ছে, আপনি আপনার কাজ শুরু করতে পারেন।’ বলেই ব্যস্ত হয়ে ওর শাড়ির আঁচলটা বুক থেকে টেনে ফেলে দিয়ে ব্লাউজের বোতাম খুলতে লাগল। ‘স্যার, এই লাইনে নতুন নাকি? দেখুন, এই জায়গায় এত লজ্জা পেলে চলে না। এসব লজ্জা আর ভদ্রতা এখান থেকে বের হয়ে যাবার পর দেখানোর জন্য পকেটে জমা রাখেন। এখানে লজ্জা না পাওয়াই নিয়ম, এখানে অভদ্র হওয়াই সাধারণ ভদ্রতা। এখানে লাজুক লাজুক ভদ্রলোকরা আসে মুখোশ খুলে মুখে ফিরে আসতে। বুঝতে পারছেন তো, না? আমার ফিগার ভালোই, দেখুন, আপনার ভালো লাগবে।’




আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মেয়েটার উপর থেকে চোখ সরিয়ে ঘরের কোনায় দৃষ্টিনিক্ষেপ করে লজ্জায় হতভম্ব হয়ে তাকে ব্লাউজটা না খুলতে অনুরোধ করলাম। সে থামল। অর্ধেকখোলা বুকের উপর শাড়ির আঁচল টেনে দিল। দেখলাম, এবার পৃথিবীর সকল বিস্ময় চোখে মেখে সে আমার দিকে বিস্ফারিত-দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ‘মানে কী? আপনি কী করতে চান? প্রোগ্রাম করবেন না আমার সাথে? আমাকে পছন্দ হয়নি? অন্য কাউকে পাঠাব?’




আমি চকলেটখোর মানুষ। পকেটে চকলেট থাকেই। পকেট থেকে স্নিকারস বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘নাও, স্নিকারস খাও।’ আমার দেওয়া চকলেটটা হাত বাড়িয়ে অনেকটা কেড়ে নিয়ে সামনের কার্পেটে রাগে বিরক্তিতে ছুড়ে মেরে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সে আমার একটু কাছে এসে বলতে লাগল, ‘আরে, আপনি ফাজলামো করেন আমার সাথে? আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড হই? না কি পরের বার ফ্রিতে খাওয়ার ধান্দা করেন? আপনি কি এখানে প্রেম করতে এসেছেন, না কি আমার সময় নষ্ট করতে এসেছেন? লাইনে আসেন, ভাই। আমি কিন্তু খুব ভালো খেলোয়াড়। খেলেন, ভালো লাগবে। খেলে বিদেয় হন। খেলা শেষ, খোদা হাফেজ! ব্যস্‌! ঢং কম করেন। কয় শট মারবেন, মারেন। সেক্সুয়াল প্রবলেম থাকলে জড়াজড়ি ধরাধরিও করতে পারেন। নো প্রবলেম। তবে হিসাব কিন্তু আউট হওয়া নিয়ে। একবার আউট মানেই এক শট শেষ! আপনি ছাড়াও আমার আরও গেস্ট আছে। অন্য জায়গায় যেতে হবে। একটু পর রবিন ভাই মিসডকল দেবেন। আপনার কাজ শুরু করুন। যা করতে এসেছেন, তা করুন।’