এক্সপেক্টেশন

কখনওই কাউকে আপনার নিজের প্রত্যাশা এবং স্বপ্নের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবেন না। প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই নিজস্ব কিছু ভাবনা এবং সুখের জায়গা থাকে। সেগুলি আপনার সাথে মিলবে না, এবং এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতি প্রত্যেকটা প্রাণীকেই নিজের মতো করে একটা সুখের জগত তৈরি করতে শিখিয়ে দেয়। সে জগতটাতে বাঁচতে পারাতেই সকল স্বাচ্ছন্দ্য। দিনের শেষে সবাইই মিলিয়ে নেয়, সে কতটুকু নিজের মতো করে নিজের স্বপ্নের জীবনটাতে বাঁচতে পেরেছে। যদি না পারে, তবে সে খুব কষ্ট পায়, যেটা সে কাউকেই দেখাতে পারে না। বেঁচে থাকাটা তখন তার কাছে স্রেফ একটা অভ্যস্ততা ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনার কাছে কিন্তু ওই ব্যাপারটা অতোটা চোখে পড়বে না। কারণ, আপনি আপনার স্বপ্নের মতো করে ওকে বাঁচতে বাধ্য করেছেন। মজার ব্যাপার হল, আপনি বিশ্বাস করে বসে আছেন, ওর ভালর জন্যই আপনি সেটা করছেন, কারণ, আপনি জানেন, ও ওরকম করে বাঁচলে ও ভালো থাকবে। আপনি ভাবছেন, ও যা ভাবে, ও যা করে, সেসব ভুল। আচ্ছা, আপনি কীকরে জানলেন, ও ভুল? আপনি আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতা কিংবা আশেপাশের পৃথিবী থেকে শুনে, ধার করে, বুঝে সবার ব্যাপারেই একটা গৎবাঁধা রায় দিয়ে ফেলতে পারেন না। যা আপনার জন্য ভাল, তা সবার জন্যই ভাল হতেই হবে কেন? অন্য কারওর জীবনে বেঁচে দেখেছেন কি কখনও ওর মতো করে? অন্য কাউকে নিয়ে ভাবতে হয় ওর মতো করে, আপনার মতো করে নয়।

রাস্তার ডাস্টবিনের পাশে যে কুকুরটা শুয়ে আছে, কোনও এক অসীম মমত্ববোধে ও যাতে আরও ভালভাবে ঘুমাতে পারে, সেজন্যে ওকে ধরে ঘরের এসি’তে নিয়ে আসবেন না, প্লিজ। বিশ্বাস করুন, ও সেখানেই পরম সুখে আছে। কারওর সুখের সমীকরণ আপনি ঠিক করে দিতে পারেন না। কারণ, আপনি কখনওই ওর জীবনটাতে বেঁচে দেখেননি, ওটাতে কেমন করে বাঁচলে ভাল লাগে। আপনার প্রতি ভালোবাসা কিংবা দায়বদ্ধতার এক অদৃশ্য দেয়াল ভাঙতে পারে না বলে আপনি দিনের পর দিন একটা মানুষকে আপনার প্রত্যাশামাফিক বাঁচতে বাধ্য করতে পারেন না। It’s a crime! আপনি ওকে সুখের ঠিকানা ঠিক করে দিচ্ছেন আপনার মতো করে, ওর মতো করে না। এতে আসলে আপনি আপনার নিজের সুখের ঠিকানাটাই ওকে কষ্ট দিয়ে ওর জীবনের বিনিময়ে খুঁজে নিলেন। বুকের ভেতরে যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে আপনার চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তটাই ও মেনে নেয় আর দিনের পর দিন স্রেফ বেঁচে থাকে খাদ্যগ্রহণ করে বলে।

কে কখন কীভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে, কেউই বলতে পারে না। মৃত্যুর আগে নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার সবারই আছে। একটা মানুষ যদি আপনার জন্য, শুধু আপনার মুখে হাসি ফোটাবার জন্য, আপনাকে মুখের উপরে ‘না’ বলতে পারে না বলে আপনার বেঁধে-দেয়া পৃথিবীটাতে বেঁচে থাকে, আর আপনি মনেমনে খুশি হয়ে ওঠেন এই ভেবে যে, ও তো ভাল আছে, এইভাবে করেই তো মানুষ ভাল থাকে; তবে আমি বলবো, আপনি একটা স্বার্থপর মানুষ ছাড়া আর কিছুই নন। আপনি ওকে যে সুখের পৃথিবীতে বাঁচতে বাধ্য করতে চাইছেন, সেটা আপনার নিজের ভাবনায় গড়া সুখের পৃথিবী, ওর নয়। একেকটা মানুষের সুখের পৃথিবীর চেহারা একেকরকমের। এবং, সেগুলির কোনওটাকেই ভুল বলে দেয়ার অধিকার আপনাকে দেয়া হয়নি, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই পৃথিবী আপনার পৃথিবীটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে না। আপনার পৃথিবীটা সুন্দর, তাই বলে ওর পৃথিবীটা অসুন্দর হবে কেন? কেন ওর পৃথিবীটাকে আপনার পৃথিবীর মতো করেই সাজাতে হবে? আপনাকে তো আর ওটাতে থাকতে হচ্ছে না, ওকে থাকতে হচ্ছে। কেন ওকে জোর করে আপনার ভাবনায় গড়া একটা ছকে ওর নিজের জীবনটাকে বেঁধে ফেলতে বাধ্য করছেন? যদি সেটা করেন, এবং সেই ছকেই ও ওর জীবনটা টেনেহিঁচড়ে যায়, তবে আমি বলবো, আপনি ওর ভেতরটাকে খুব নির্দয়ভাবে হত্যা করে ফেলেছেন। ও মৃত্যুর আগে সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকতে পারেনি। এর জন্য আপনি, আপনি এবং শুধুই আপনি দায়ী! প্লিজ ওর মৃত্যুর পর ওর জন্য কষ্ট পেয়ে কাঁদবেন না। আপনার এই কান্না অত্যন্ত বিশ্রী ও অর্থহীন। ও যখন বেঁচে ছিল, তখন আপনি ওর কথা ভাবেননি, ওর জন্য কাঁদেননি। মৃত মানুষ কান্নার শব্দ শুনতে পায় না, চোখের জল দেখতে পায় না। আশেপাশের সবাই ভাববে, আহা! ও বেঁচে থাকতে আপনি ওর কথা কত ভাবতেন, ওর মৃত্যুর পরেও আপনি ওর শোকে মুহ্যমান। কিন্তু আর কেউ না জানুক, বিধাতা তো জানেন, আপনার নিজস্ব ছকের অসহ্য সুখের ব্যাকরণে জীবনটা কাটাতে গিয়ে ও কতটা মরে বেঁচেছে! ও এখন একজন সুখী মৃত মানুষ যে আপনার হাত থেকে বাঁচতে পেরে সুখে ঘুমিয়ে আছে। আপনার চোখের অর্থহীন জলের আলপনায় ওর ঘুমটাকে বিষাদমাখা করে দেবেন না, প্লিজ!

যতদিন বেঁচে আছে, সবাইকেই নিজের মতো করে বাঁচার সুযোগ দেয়া উচিত। নাহলে মৃত্যুর আগে একটা আফসোস বুকের মধ্যে রয়ে যাবে—-যতদিন বেঁচে ছিলাম, নিজের মতো করে বাঁচতে পারলাম না। আপনি যাদের কথায় প্রভাবিত হয়ে কাউকে ওর নিজের মতো করে বাঁচতে দিচ্ছেন না, একটু ভাবুনতো, ওর এই মৃত্যুর আগের আফসোসগুলিতে ওদের আদৌ কিছু এসে যায় কি না? আফসোসগুলি হয়তো আপনি কোনওদিনই জানতে পারবেন না। জানতে পারলে, একটুখানিও অনুভব করতে পারলে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতেন! প্রত্যেকটা জীবকেই তার নিজের মতো করে বাঁচতে দেয়া উচিত। কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল, মানুষ, যা-ই হোক না কেন। সবার সবকিছু খেতে ইচ্ছে করে না, সবার সব জায়গায় যেতে ইচ্ছে করে না, সবার সব কাজ করতে ইচ্ছে করে না। সবারই সেরা হতে ইচ্ছে করে না। সেরা হওয়ার ধকল নিয়ে জীবনটাকে বিষিয়ে ফেলতে কেন সবাইই চাইবে? কেউ-কেউ কিছুই হতে চায় না, অমলকান্তির মতো স্রেফ রোদ্দুর হতে চায়। ওই ঝলমলে রোদ্দুর হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দেবে। একটুখানি কাটিয়ে দিক না ওরকম হয়ে! জীবনটা ছোটো তো! যে যেখানটাতে সুখ খুঁজে পায়, সবকিছুর পরেও ওখানেই থেকে যেতে চায় শেষ পর্যন্ত। এটাই স্বাভাবিক, এর ব্যত্যয় আশা করাটাই বাতুলতা। ও পাগল আর আপনি পাগল নন? ভাল কথা। থাকুক না ও ওর মতো করে ওর সকল পাগলামো নিয়ে! কে জানে, আপনার সুস্থতাই হয়তো ওর চোখে পাগলামো। ওরকম বিশ্বাসের পেছনে ওর হাজারটা যুক্তিও আছে। কিন্তু ও তো আর সেসব যুক্তির ভারে আপনার জীবনটাকে ভারাক্রান্ত করে দিচ্ছে না। তবে আপনি কেন ওরকম করছেন? এ পৃথিবীতে পাগল নয় কে? সব পাগলেরই একটা নিজস্ব রাজ্য আছে। সে রাজ্যে সে পাগল নয়, রাজা। এক রাজা আরেক রাজার রাজ্যে কেন থাকবে বেহায়ার মতন? পৃথিবীর সকল পাগল সুখে থাকুক যে যার মতো করে নিজেদের যত্তোসব সব অর্থহীন পাগলামো নিয়ে।

‘ইচ্ছে করা উচিত’ বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। আজকের দিনটা যে কারওরই শেষ দিন হতে পারে। এই দিনটাতে যদি ও ওর মতো করে বাঁচতে না পারে আপনার স্বপ্নপূরণের জন্য, সে দায় কি আপনার নয়? মানুষ সবই বোঝে, তবে দেরিতে বোঝে। আমাদের স্কুলের এক স্যার ছিলেন, হরিসাধন দত্ত। ইংরেজি ভাষায় উনার মতন পণ্ডিত ব্যক্তি আমি অতো একটা দেখিনি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় উনি আমাদের প্রায়ই বলতেন, “ওডা, বুইজ্ঝস না, মাছে ন চিনে জাল, আর মাইনষ্যে ন চিনে কাল।” (মাছ যেমন জালের অস্তিত্ব টের পায় না, মানুষও তেমনি কালের খেলা বুঝতে পারে না।) একইসময়ের একইরকমের পরিবেশে একেকজন একেকরকমভাবে বাঁচে। আপনার ভালথাকাটা বৃষ্টি নিয়ে, আমার ভালথাকাটা রোদ্দুর নিয়ে, আর ওরটা? বৃষ্টি, কিংবা রোদ্দুর যা-ই হোক না কেন, ও ভাল থাকে। আপনি কোন অধিকারে বলে বসেন, “শুধু বৃষ্টি নিয়ে থাকাই ভালথাকা! বাকি সব বাজে ফালতু ভুয়া!” ওরকম একটা মনগড়া ভাবনায় আপনার বসবাস হলে আপনি সত্যিসত্যিই একটা যত্তোসব টাইপের মানুষ! আপনি সত্যিই জানেন না, আপনি আপনার ভালথাকার নিজস্ব সমীকরণগুলির ফাঁদে ফেলে নিজের অজান্তেই কারওর-কারওর ভালথাকাটাকে গলাটিপে হত্যা করছেন! হ্যাঁ, আপনি খুনি, আপনি খুনি, আপনি খুনি!

পৃথিবীর সবচাইতে জরাজীর্ণ শব্দ হচ্ছে: এক্সপেক্টেশন। এটা যে মুহূর্তেই একটা মানুষের মধ্যে জন্মাতে শুরু করে, সেই মুহূর্ত থেকেই সে বার্ধক্যে প্রবেশ করে। এক্সপেক্টেশন ব্যাপারটা ততক্ষণই ভালো, যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা অন্যকারওর জীবনটাকে বিষিয়ে না তুলছে, কিংবা ওকে আপনার মতো করে ভাবতে বাধ্য না করছে। মানুষ বৃদ্ধ হয় বয়সের ভারে নয়, অন্যের কাছ থেকে প্রত্যাশার ভারে।