একটুখানি জল পেলে

মানুষ একসময় শান্ত নদীর মতন ধীর হয়ে যায়, প্রকাণ্ড বটগাছের মতন স্থির হয়ে যায়।

তুফানের মতন অস্থির-চঞ্চল যে মানুষটি সারাপাড়া দাপিয়ে বেড়াত, একদিন সে মানুষটিও ধীরে বহমান গভীর নদীর মতন ধীর হয়ে যায়। এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ানো অশান্ত মানুষটিও একদিন গাছের মতন স্থির হয়ে যায়।

সময় মানুষকে বদলে দেয়। সময় যেতে যেতে, বড়ো হতে হতে মানুষের অক্ষত হৃদয়টায় একটা একটা করে ক্ষতের দাগ পড়তে শুরু করে। শেষমেশ, অক্ষত হৃদয় বলে আর কিছু থাকে না এ পৃথিবীতে।

সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি কথা রাখবে বলেও কথা রাখবে না; খুব কাছের বলে জানতাম যাদের, তাদের কেউ কেউ সাপের মতন ছোবল মেরে বসবে; বিশ্বস্ত মানুষগুলো, যত বড়ো বড়ো বিশ্বাস, সেগুলোর সবকটা কাচের প্লেটের মতন টুকটুক করে ভেঙে ফেলবে, দু-এক জন রক্তের সম্পর্কের মানুষ জানোয়ারের মতন হিংস্রমুখটা দেখিয়ে দেবে সময় এলেই!...তারপর?

তারপর মানুষ ধীরে ধীরে বিশ্বাস হারাতে শুরু করবে, ভালোবাসতে পারার শক্তি হারাবে, আশেপাশের সবার উপরই ভরসা হারাতে থাকবে। হারাতে হারাতে মানুষ বুঝতে শিখে যায়, এই দুনিয়ায় কেউ কারও নয়। মানুষ হারালেই পরে শেখে।

এরপর সুখ হারাতে হারাতে মানুষ একসময় রক্ত-মাংসের তৈরি, অথচ ভেতর থেকে প্রাণহীন একটা কঙ্কাল হয়ে যায়। তখন সে চাইলেই আর তুফানের মতন দুরন্ত হতে পারে না, কৌতুক শুনেও তার মধ্যে আর হাসির উদ্রেক হয় না, প্রচণ্ড উত্তেজনায়ও সে আর ছটফট করে না। নিথর প্রাণওয়ালা পুতুলের মতন কেবলই একটা ধান-ভানা ঢেঁকি হয়ে যায়, যার কাজই শুধু দায়িত্বপালন করা।

আদতে দুঃখ মানুষকে শক্ত করে দেয়, দুঃস্বপ্ন মানুষকে শান্ত করে দেয়।

এতকিছুর ভিড়েও, কেউ কেউ আগ্নেয়গিরির মতন হঠাৎ জ্বলে ওঠে, তেজস্বী সূর্যের মতন জেগে ওঠে…যখন দেখে, সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাবার পরও একটি ঘাসফুল এখনও সুবাস ছড়ায়; যখন বোঝে, এত অবিশ্বাস, ভরসাহীনতার ভিড়েও কেউ একজন তাকে সত্যিই ভালোবাসে, কপালে সেই চুমুটা খায়, যে চুমুতে নিছকই যৌনতা নেই; কেউ একজন তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে, যে চেপে ধরায় কোনও স্বার্থ বা হিসেব নেই…হ্যাঁ, মানুষ তখনই হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে আবারও দপ্‌ করে জ্বলে ওঠে।

একটুখানি জল পেলে মরুভূমির বুক চিরেও বৃক্ষ উঁকি দেয়, যত্ন পেলে সেই বৃক্ষ ফুলও ফোটায়।