এই বৃষ্টিযাপন, এই আশ্রয়

 
জানো, আমাদের এখানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে!
তোমার বৃষ্টি ভালো লাগে?
বৃষ্টিতে ভিজে কখনও আমচুরি করেছ?
বৃষ্টিতে ভেজার সময় নেচেছ কখনও মাতাল হয়ে?


…দেখো, আমার কাণ্ড দেখো! কী এক পাগল আমি! তুমি নেই, অথচ আমি কথা বলেই যাচ্ছি তো বলেই যাচ্ছি!
থাক, বলতে থাকি! আমার এমন করতে ভালোই লাগে। তুমি সামনে নেই, আমায় বকার কেউ নেই, তাই এই ফাঁকে আমি বকছিও খুব! আমি বকছিই তো বকছি…ভালো লাগছে, মজা পাচ্ছি!
আচ্ছা, বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়ে কখনও পিছলে পড়ে ব্যথা পেয়েছ?
কদমগাছে চড়েছ তুমি? ফুল নিতে গিয়ে ধপাস করে পুকুরে গিয়েছ পড়ে?
জলের অনেক গভীরটাতে চলেও গেছ? মানে আমি হাবুডুবু খাওয়ার কথা বলছি গো, সত্যিকারের হাবুডুবু!
আচ্ছা, এসব যখন পড়বে তুমি, তোমার খুব হাসি পাবে, না? পাক না পেলে! হাসি পেলে তুমি খুব হাসতে থেকো!
বৃষ্টিতে ভেজার সময় ভেজাউঠোনে স্কেটিং করেছ? করে দেখো, ভালোই কিন্তু লাগে!
এই শোনো না, আমি এখন একটু ছাদে যাব, ফিরে এলে পরে, আবার কথা হবে।


…এলাম গো, স্যার! আছ তুমি? নেই, না? বেশ ভালো! থাকতে তোমায় হবেও না!
বৃষ্টির দিনে পুঁটিমাছের পেছন পেছন সাঁতার কাটতে কেমন লাগে, জানো?
বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো মাছের মুখের উপরে পড়লে ওরা কেমন করে, কখনও দেখেছ?
বৃষ্টিতে ভেজার সময় সুপারিগাছের পাতার উপরে বসে গাড়ি চড়েছ?
বৃষ্টির সময় পিচ্ছিল পথে খুব জোরে দৌড়ে পালাতে গিয়ে পায়ের তালু ছিঁড়েছ কখনও?
ভেজাশরীরে জামা লেপটে গেছে, তখন আবার তুলে লেপটে-দেওয়ার খেলাটা তুমি খেলেছ নাকি?
ঘাসেভর্তি মাঠে নাচতে গিয়ে রাজহাঁসের তাড়া খেয়ে বৃষ্টি-জমানো জলের ভেতর ধপ্‌ করে পড়ে দেখেছ?


বৃষ্টির বড় একটা ফোঁটা এসে তোমার ঠোঁটের উপর পড়েছে কখনও?...তখন ঠোঁটটা তোমার একটু হালকা নড়েছে, ব্যথা একটু পেয়েছ বলে রাগ করে সেই একফোঁটা বৃষ্টিটুকু নিয়েছ খেয়ে?
বৃষ্টির সময় ভীষণ কাছের কাউকে চাইছ বলে অভিমানে খুব সামনের ওই পুকুরটাতে পড়া বৃষ্টিজলে দারুণ জোরে আঘাত করে দেখেছ তখন কেমন লাগে?
বৃষ্টির ওই জলটা পিঠে গড়িয়ে পড়ছে, ঠিক তখনই শিহরিত হয়ে ভেবেছ কখনও, হয়তো কেউ এসে ছুঁয়ে দিয়েছে, বোকার মতন পেছনফিরে তাকিয়েছ তাকে দেখবে বলে?
মনে হয়েছে হঠাৎ…বৃষ্টিফোঁটা সারাশরীরে মেখে আছ…যেন ঠিক প্রিয় কারও ছোঁয়ার মতো?
হালকা একটুখানি ঠান্ডা হাওয়া ভেজাশরীরে পিছলে গিয়ে শরীরটাকে ধাক্কা অমন মেরেছে নাকি? রোমাঞ্চ আরও বেড়েছে সেই ধাক্কা খেয়ে? লজ্জা পেয়েছ অগোচরেই? ধরেছ নাকি নিজেকেই তখন জড়িয়ে দুহাত?


যখন খুব জোরে শব্দ করে একটা বাজ পড়েছে দূরে কোথাও, তখন চমকে উঠে পুরো একটা দিগন্তজুড়ে অনেকগুলো রাজহাঁসের ঠিক মাঝখানটাতে নিজেকে একলা দেখে বোকা হয়ে গেছ খুব?
যখন বৃষ্টি ঝরে বেহালাসুরে, তখন লাগে না বলো পাগল পাগল? উপরের ঠোঁটে-পড়া জল জিভের তালুতে খেতে খেতে ওঠ না হেসে এই ভেবে যে, যাকে ভেবে এমন সুখে চলেছ ভেসে, আসলে সে তোমারই তো নয়!
পেছনে এলিয়ে-পড়া ভেজাচুলগুলো একপাশে এনে নগ্নপিঠে যখন বৃষ্টির ফোঁটা গড়ায় কোমর অবধি, তখন ওই দুটি চোখ বন্ধ করে একটাশ্বাসে ভেজাহাওয়ার ছোঁয়া নিয়েছ?


চোখ খুললেই কলকলিয়ে ঝরনা হাসির চলছে বয়ে, আর চিৎকার করে বলছ তুমি…
এই বৃষ্টি! তুই আছিসই তো…
আমার এই দুঠোঁটে মেখে থাকার জন্যে, আমার ভেজাগায়ে জড়িয়ে থাকার জন্যে, আমার পিঠ গড়িয়ে কোমর ছোঁয়ার জন্যে, অজান্তেই চোখদুটো বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে, চোখের পাতায় জমতে জমতে ভারী হয়ে অশ্রু হয়ে ঝরার জন্যে…
কদম গাছে উঠে ফুলপাড়ার সাহস দেবার জন্যে, নিচের দিকে না তাকিয়ে ধপ্‌ করে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে জলের গভীরে চলে যাবার জন্যে, পা ছিঁড়ে গেছে বলেই কান্না না এসে দুষ্টুমির হাসি চলে আসার জন্যে…
পুঁটিমাছের মুখে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে ফেলে খুব পাজি হয়েছি আমি---এমন ভেবে হেসে কুটিকুটি হওয়ার জন্যে, ভেজাশাড়িতে নাচতে গিয়ে গায়ে শাড়িপেঁচিয়ে রাজহাঁসগুলোর মাঝখানে পড়ে যাওয়ার জন্যে, আর উঠেই অমনি এলোথেলো দৌড় দেবার জন্যে…!
…কখনও হয়েছে এমন?


জানো, আমার এক ব্যক্তিগত বৃষ্টি আছে, তার স্পর্শকাতর ফোঁটাগুলো আছে, একটু শীতল অনুভূতি আছে।
একান্তই নিজের একটা ঝমঝম শব্দ আছে যা শুনলেই কোমর দুলে ওঠে…মনে হয়, আমার ভেতর কেউ যেন চাইছে, তার ভেজাকোমরটা বাতাসে একটু নড়ে উঠুক, এবার সে একটু নাচুক!


শাপলা দেখে পুকুরে ঝাঁপ মেরে সাঁতার কাটতে কাটতে কিছু দূরে গিয়ে গায়ে ঘোলাসবুজ লতার কিছু রঙ মাখিয়ে, নির্বিষ ভেজাসাপের এঁকেবেঁকে-চলা দেহটা দেখে, হঠাৎ ভয়ে তড়িঘড়ি করে উল্টোসাঁতরে, জলটল খেয়ে কোনওমতে তীরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে…
সেই শাপলার দিকে ক্ষিপ্তচোখে তাকিয়ে থাকা, আর মনে মনে বলা…আচ্ছা, ঠিক আছে! আমিও দেখে নেব’খন! এত দূরে গিয়ে ফোটার কী আছে, বলো তো ভায়া? নিজেকে ভারি সুন্দর ভাবো, না? হ্যাঁ, নাহয় সুন্দরই তুমি, তাই বলে করলে এমন আমার সাথে! পরেরবার যখন উপড়ে আনব মাটির গভীর থেকে, তখন টের পাবে ঠিক কেমনটা লাগে! হাসছ তো খুব! নাও, হেসে নাও! তখন তো খুব কাঁদতে হবে!
…এই জীবনে হয়েছে এমন?


বৃষ্টি, তুই আছিস তো, বল? মাঝে মাঝে আসবি এমনি করে আমার কাছে? আর কারও কাছে যাসনে যেন! তোর শিহরণ এক আমিই পাব! তুই কেবলই আমার হবি! তার বদলে তোর লাগবে কী, বল? যা চা’বি চা, দেবো তার সবই!
তুই এলে তোর সাথে সকাল থেকে সারাদিনটাই মাঠেঘাটে প্রেম করব, বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি খাব! রেগেটেগে মা বলবে, তোর ফেরার সময় হলো তবে এতক্ষণে! ভিজেটিজে কী হয়েছিস! হয়েছিস তো এক হুলোবেড়াল! এবার যদি জ্বর আসে তো রাখব ফেলেই, মাথায় দেখিস ঢালব না জল! এই দেখো কাণ্ড! ভিজে ভিজে রাঙা ঠোঁটদুটো তোর কালচে হলো! তুই যদি ফের ভিজেছিস, তোর গরমদুধটা তখন বেড়াল খাবে!
বৃষ্টি, তুই ভাবিস না রে! মায়েরা তো অমনই বলে! বকলে বকুক, আমি শুধুই দেখব আকাশ! তুই চলে যাবি, তোর চলে-যাওয়াটা দেখব তখন। তোর দিকে তাকিয়ে রবো, মনে মনে বলব ঠিকই, বকা খেলে হয় কি কিছু? তুই আবার এলে আমি শুনবই তো না মায়ের বারণ! আমি আবার পরব শাড়ি, দাঁড়াব গিয়ে রাজহাঁসের ওই দলটার মাঝখানে ঠিক!


বৃষ্টি, তুই আসিস রে ফের!
ভেজাশাড়ির এক একটা ধাপ খুলব যখন, তোকে মনে পড়বে ভীষণ!
শিহরণে কাঁপব আবার নতুন করে!
শাড়িবদলে লজ্জামুখে দ্রুতপায়ে বাইরে যাব ব্যালকনিতে!
জানালার ভেজাগ্রিলটা ধরে তোর গন্ধ নেব!
ঝরিস রে তুই ইচ্ছেমতন, তোর শেষফোঁটাটা পাতার গায়ে কেমনে গড়ায়, দেখব তখন দুচোখ ভরে!
সন্ধে হলে আলো-আঁধারে ডাকব তোকে ঘরের মাঝে…
তোর সাথে খেলতে খেলতে রাত্রি এলে তোকে বিদায় দিয়ে বলব হেসে,
বৃষ্টি আমার, এই একটাজন্ম আমারই থাকিস! বৃষ্টি রে, তুই ভালো থাকিস, আর আমায় ভালো রাখিস!