পৃথিবীতে আমাদের সকলেরই মধ্যে এই যে 'আমি' 'আমি' ভাব সবসময়ই জন্ম নেয়—আমি করি, আমি ভালো, এগুলি আমার, আমি বুঝি, ইত্যাদি—এই 'আমি'র প্রকৃত স্বরূপের অপরোক্ষ জ্ঞানকেই উপনিষদ 'পরাবিদ্যা' বলেন। উপনিষদের বিভিন্ন জায়গায় এই অপরোক্ষ জ্ঞান বিবৃত হয়েছে। অপরোক্ষ জ্ঞান বা শেষ ধাপের জ্ঞানের আধার হওয়ার কারণেই উপনিষদকে বেদান্ত বলে। 'বেদ' অর্থ 'জ্ঞান' এবং 'অন্ত' অর্থ 'শেষ' বা 'সমাপ্তি'; সুতরাং উপনিষদই জ্ঞানের শেষ বা সমাপ্তি বলে এটি বেদান্ত। এখানে এই 'জ্ঞান' শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর কারণ, এই 'আমি'র প্রকৃত স্বরূপটিই সমস্ত জ্ঞানের মূলকেন্দ্র বলে, এর অপরোক্ষ জ্ঞান উৎপন্ন হলে তখন সেই 'এক বিজ্ঞানেই সর্ববিজ্ঞান' সিদ্ধ হয়।
এখানে দুইটি বিষয় পরিষ্কার করে বলা দরকার।
'অপরোক্ষ' শব্দটি 'প্রত্যক্ষ' শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যাবে না। অপরোক্ষ আর প্রত্যক্ষ এক জিনিস নয়। 'পরোক্ষ' অনুভূতি হয়ে 'অপরোক্ষ' অনুভূতিতে পৌঁছোতে হয়। সরাসরি দেখে (অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নিয়ে দেখে, শুনে, শুঁকে, স্বাদ বা স্পর্শ নিয়ে) যা বোঝা যায়, তা প্রত্যক্ষ অনুভূতি। প্রত্যক্ষ থেকে বুদ্ধির সাহায্যে পরোক্ষ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। তারপর এই ব্রহ্মকে আত্মায় বা চৈতন্যে অধিষ্ঠিত করলে অপরোক্ষ জ্ঞান বা অনুভূতির জন্ম হয়। প্রত্যক্ষ অনুভূতি সরাসরি উৎপন্ন হলেও অপরোক্ষ অনুভূতির উৎপত্তি ঘটে পরোক্ষ অনুভূতির হাত ধরেই। জীবনে প্রথম বারের মতো চোখ বেঁধে সাপের আকৃতির দড়ি স্পর্শ করলে মনে হবে, এটি সাপের মতন কিছু-একটা। এর নাম প্রত্যক্ষ জ্ঞান। সাপের বৈশিষ্ট্য ও দড়ির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানার পর বুঝব, দড়ি কী কারণে সাপ নয়। এর নাম পরোক্ষ জ্ঞান। পরবর্তীতে চোখ বেঁধে রাখলেও দড়ি আর সাপ আলাদা করে চিনতে কোনো সমস্যা হবে না। এর নাম অপরোক্ষ জ্ঞান।
'বিজ্ঞান' অর্থ বিশেষ জ্ঞান। কীরকম বিশেষ জ্ঞান? পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের যে-কোনোটির বা একাধিকের সাহায্যে যে-জ্ঞান আমরা লাভ করি, তা যখন বুদ্ধির সাহায্যে মনের মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞানের বিকাশ ঘটায়, তখন মন বিশেষ জ্ঞান বা বিজ্ঞানের অনুভূতি লাভ করে। এর সাথে কোনো বিষয়ের উপর সম্যক ধারণা তৈরি হবার প্রক্রিয়াটি জড়িত। বিশেষ জ্ঞানই আত্মজ্ঞান হিসেবে সমাদৃত। এই জ্ঞানের উদ্ভব হলে পরে মন বিজ্ঞান হয়ে ওঠে।
কার্যতও দেখা যায়, জগদ্বিষয়ক সমস্ত জ্ঞান পরিপূর্ণভাবে থাকা সত্ত্বেও জ্ঞানের ক্ষুধা মেটে না বা নিরাকাঙ্ক্ষও (আকাঙ্ক্ষাশূন্য) হওয়া যায় না; কিন্তু এই 'আমি'র প্রকৃত স্বরূপের অপরোক্ষ জ্ঞানলাভ হলে আর কোনো কিছুরই আকাঙ্ক্ষা থাকে না—তখন তিনি একেবারেই, গীতায় উল্লিখিত 'ন কাঙ্ক্ষতি' হন, অর্থাৎ ঈপ্সিত বস্তু না পেলেও বিমর্ষ হন না। আবার প্রয়োজন বা পুরুষার্থের (ধর্ম, অর্থ, কাম বা সুখ ও মোক্ষ বা মুক্তি) দিক দিয়েও এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ, কেননা প্রকৃতির বা আকাঙ্ক্ষার দাসত্ব হতে মুক্ত হওয়া অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ আর কী আছে? তাই ঋষিগণ জড়জগতের সমুদয় জ্ঞান-বিজ্ঞান-রহস্য সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত হয়ে, এই 'আমি'র প্রকৃত স্বরূপের অপরোক্ষ জ্ঞানকেই বিদ্যার মধ্যে 'পরা' অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছেন।
আবার এই 'আমি'র প্রকৃত স্বরূপটি কোনো ইন্দ্রিয় দ্বারা জানা যায় না বলে এর ব্যাপ্তি বা সম্বন্ধ-জ্ঞানের অভাবহেতু এই স্বরূপ প্রত্যক্ষ প্রমাণ এবং অনুমানেরও অবিষয় (এ নিয়ে অনুমান করা যায় না, এর কোনো সর্বজনগ্রহণীয় প্রমাণ দেওয়াও সম্ভব নয়)। সুতরাং এটা 'ঔপনিষদং' বা উপনিষদ-উৎপন্ন, অর্থাৎ কেবল উপনিষদ শ্রবণেই এই অপরোক্ষ জ্ঞানলাভ হয়। তাই এই পরাবিদ্যাকে 'শ্রুতিবিদ্যা'ও বলে এবং উপনিষদকে 'শ্রুতি' বলে। যদিও পূর্বে শ্রবণপরম্পরায় রক্ষিত হতো বলে সমগ্র বেদকেই শ্রুতি বলা হয়, কিন্তু যে-শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়টির অপরোক্ষ জ্ঞান সেই শাস্ত্রের শ্রবণেই হয়, সেই শাস্ত্রই যথার্থ 'শ্ৰুতি' বলে শ্রুতির মুখ্য অর্থ উপনিষদই। অবশ্য শ্রবণ হতে পরোক্ষ জ্ঞান হয় বললে আর কোনো কথাই থাকে না; কিন্তু অপরোক্ষ জ্ঞান হয় বললে অনেক কথাই এসে পড়ে। অপরোক্ষ জ্ঞানের সৃষ্টি বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। অতএব আগে এই বিষয়টিই দেখা যাক।
বাহ্য প্রত্যক্ষ: আমাদের পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে প্রকারের প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয়, তাকেই বলা হয় বাহ্য প্রত্যক্ষ। পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয় দ্বারা এরূপ প্রত্যক্ষ সম্পন্ন হয়ে থাকে। ন্যায় দার্শনিকগণ বাহ্য প্রত্যক্ষকে আরও একটিবিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে বিভক্ত করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি হল স্পষ্টতার বা স্বচ্ছতার দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে বাহ্য প্রত্যক্ষ হল তিন প্রকারের—নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ, সবিকল্প প্রত্যক্ষ এবং প্রত্যভিজ্ঞা।
কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হওয়ামাত্রই বিশেষণবর্জিত যে-জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাকেই বলে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ। যেমন, এটা একটা বস্তু। যে-প্রত্যক্ষে বস্তুর বিশেষণ বা ধর্মের জ্ঞান হয়, তাকে বলে সবিকল্প প্রত্যক্ষ। যেমন, এটা একটা সাদা বস্তু। পূর্বপরিচিত কোনো বস্তুকে পরে দেখে, পূর্বপরিচিত বস্তুরূপেই যখন প্রত্যক্ষ করা হয়, তখন তাকে বলা হয় প্রত্যভিজ্ঞা। যেমন, এই সেই গুরুদত্ত, যাকে আমি দিল্লিতে দেখেছিলাম।
যে-জ্ঞানবলে আমি নিজের অস্তিত্বে দৃঢ় ও নিঃসংশয় থেকে নিজেকে 'আমি' বলে জানছি, এই জ্ঞানই এই 'আমি'র উপনিষদমান্য প্রকৃত স্বরূপ বলে 'আমি'র প্রকৃত স্বরূপের এই জ্ঞানটিই যথার্থ অপরোক্ষ এবং নির্বিকল্পকও (যোগাবস্থায় বিশ্বচৈতন্যবোধ ঈশ্বরচৈতন্যবোধে জ্ঞানের প্রথম আলোরূপে পরিপূর্ণতালাভ) বটে; আর যা-কিছু 'আমি' এই 'আমি'র কর্তৃত্বে এবং ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, ইত্যাদি সহায়কের মাধ্যমে জানি, তার সবই পরোক্ষ এবং সবিকল্পক (নির্বিকল্পকের পরের ধাপ, যা কোনো বস্তু সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়) জ্ঞান। এর কারণ, 'আমি' শব্দটি স্ববোধক, অর্থাৎ নিজের প্রতি ব্যবহারযোগ্য। সুতরাং নিজেকে নিজের জানা না থাকলে কেউই 'আমি'কে 'আমি' বলে ব্যবহার করতে পারে না। উল্লেখ্য, 'শ্রবণ' মানে নিছকই শোনা নয়, বরং শুনে যথার্থভাবে বোঝার জন্য সব রকমের চেষ্টা করা।
এখন এই অবস্থায় যখন অন্য কোনো কিছুরই জ্ঞান হয় না, তখন অবশ্য এই জ্ঞান নিজেকেই 'আমি' বলে। নিজেকে 'আমি' হিসেবে ঘোষণা করার জন্য অধিকতর কোনো জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। অতএব এই জ্ঞানটিই 'আমি'র প্রকৃত স্বরূপ। আর একমাত্র জ্ঞানই নিজের অস্তিত্বে ও প্রকাশে অন্যের অপেক্ষা করে না বলে, 'আমি'র প্রকৃত স্বরূপের এই জ্ঞানই যথার্থ অপরোক্ষ জ্ঞান। কারণ জ্ঞাতা স্বয়ং যা জানে, তা-ই অপরোক্ষ এবং অপর কর্তৃক যা জানে, তা-ই পরোক্ষ জ্ঞান। আবার এটা নির্বিকল্পকও বটে, কেননা এখানে সবিকল্পক জ্ঞানের কোন লক্ষণই নেই—এখানে 'আমি'র অস্তিত্ব বোঝা গেলেও প্রকৃতি স্পষ্ট করে বোঝা যায় না। গভীর ও সূক্ষ্ম অনুভূতিকালে অন্তর্বাহ সমুদয় জ্ঞেয়-বস্তু ত্যাগ করলে কেবল যেটুকু জ্ঞান অবশিষ্ট থাকে, সেই জ্ঞানটি তখন এই 'আমি'র সঙ্গে অভিন্ন হয়েই অনুভূত হয়, এই দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।
জ্ঞান আর সত্তার মধ্যে যেমনি কোনো ভেদ নেই—দুই-ই এক; ঠিক তেমনি 'আমি'র প্রকৃত স্বরূপের জ্ঞান এবং 'আমি'র মধ্যে জ্ঞাতা-জ্ঞেয় ভেদরূপ কোনো ভেদ নেই। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে যেখানে ভেদ থাকে, কেবল সেখানেই সবিকল্পক জ্ঞানের লক্ষণ উৎপন্ন হয়। বাস্তবিক জ্ঞানই ব্রহ্ম; দেহমধ্যস্থ জ্ঞান বা ব্রহ্ম 'আমি' হয়ে 'প্রত্যগাত্মা' বা 'পরমেশ্বর' নামে অভিহিত হন। তাই 'বাশিষ্ঠযোগ' গ্রন্থে বলা হয়েছে, "দেহে ও জীবে অনুপ্রবিষ্ট চিৎ পরমায়ুকাল পর্যন্ত স্বীয় প্রভাকে অহংভাবাদি দ্বারা ব্যক্ত করেন।" এখানে 'পরমায়ুকাল' শব্দের অর্থ 'মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত' বুঝতে হবে, কেননা মুক্তি না হওয়া অবধি অধ্যাস (একটি সত্তার গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে অন্য সত্তার উপর চাপিয়ে দেওয়া) যাবার নয়।
এখানে কিন্তু জ্ঞাতা নিজেকে নিজেই জানছে বলে 'কর্মকর্তৃবিরোধ' নেই। জ্ঞাতা নিজেকে 'আমি' বলে যে জানছে, তার কারণ 'অনাদি অধ্যাস' বা নিজের সত্তা নিজেরই উপর আরোপিত হবার অবস্থা। সুতরাং অন্য বস্তু জানার সময় ওই বস্তুর আকারে অন্তঃকরণের একটা পরিণাম, অর্থাৎ বৃত্তিরূপ ক্রিয়ার আবশ্যকতা থাকায় এবং ওই ক্রিয়ার কর্তৃত্ব ও কর্মত্ব একস্থানে থাকে না বলে কর্মকর্তৃবিরোধ ক্রিয়া মাত্রেই সম্ভব। আবার ব্রহ্মে বৃত্তি স্বীকারেও গৌরবদোষ আছে, কারণ বৃত্তি অর্থ পরিণাম এবং পরিণাম ক্রিয়ারই ফল। ব্রহ্মে 'আমি' বৃত্তি কোনোরূপ পরিণাম অর্থাৎ ক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন নয়। এর কারণ, ব্রহ্মে 'আমি'র অধ্যাসটি যখন অনাদি, তখন এখানে বৃত্তিরূপ পরিণামের, অর্থাৎ ক্রিয়ার সাক্ষী কোথায়? দৃগ্, দৃশ্য ও বিবেক তিনটিই 'আমি' বিধায়, এখানে কর্তৃত্ব ও কর্মত্ব এবং এ দুইয়ের অধ্যাস একটি বিন্দুতেই পরিণামস্বরূপ মিলিত হয়।
আমি বা আত্মা বাদে অন্য যে-কোনো বস্তু সম্পর্কে জানার সময় অন্তঃকরণ সেই বস্তুর আকারে পরিণত হলে ওই বস্তুটি সম্পর্কিত জ্ঞান এই 'আমি'র হয় বলে এখানে বৃত্তি ও ব্যাপ্তি দুই-ই থাকায়, 'আমি'র নিজ স্বরূপের অপরোক্ষ জ্ঞানে এ সবের কোনো প্রয়োজন নেই। তাই এখানে কোনো সংশয় নেই, কোনো প্রশ্ন নেই—এই জ্ঞানটি সবসময় নিজ থেকেই অপরোক্ষ।
এখন 'আমি'র এই স্বতঃঅপরোক্ষ স্বরূপের ব্রহ্মত্ব-প্রতিপাদক 'অয়মাত্মা ব্রহ্ম' (আমার আত্মা ব্রহ্মের আধারে অবস্থিত), 'অহং ব্রহ্মাস্মি' (আমিই ব্রহ্ম, বা আমি পরম), 'তত্ত্বমসি' (দুটি ভিন্ন প্রকারবিশিষ্ট বা গুণবিশিষ্ট ব্রহ্মের অভেদ তথা 'আমি'তে প্রতিপাদন)...এসব উপনিষদবাক্য শুনে ও অনুভব করে যদি আত্মার বা ব্রহ্মের পরোক্ষ জ্ঞান হয়, তবে বশিষ্ঠের—"জন্মান্ধ ব্যক্তির কেবল উপদেশের উপর নির্ভর করে যে-জ্ঞান, তা জ্ঞানই নয়, কেননা প্রত্যক্ষ বস্তুকে পরোক্ষ হিসেবে জানলে তাকে তো ভ্ৰান্তিই বলতে হয়।"—এই উক্তিই এখানে যথেষ্ট।
'তত্ত্বমসি' প্রভৃতি উপনিষদবাক্য শ্রবণে ব্রহ্মের যে অপরোক্ষ জ্ঞান হয়, তা 'পঞ্চদশী'র ভাষ্যকার—"তখন ত্বং (তুমি) পদার্থ দ্বারা জীবের অব্রহ্মত্ব এবং তৎ (এটা, সেটা, এইভাবে বা এভাবে) পদার্থ দ্বারা ব্রহ্মের পরোক্ষত্ব নিবারিত হয়।"—এই বাক্যে বিশেষ চতুরতা অবলম্বন করে বলেছেন। বাস্তবিকই, উপনিষদের—"এই আমিই ব্রহ্ম।", "এই অহং নামে যা অভিহিত হচ্ছেন, এই অহংই পরমাত্মা—যিনি নিত্য 'আমি'তে সবসময়ই বর্তমান।", "আমাদের ভেতরে যেটা 'আমি' 'আমি' করছে, তা-ই ব্রহ্ম।"—এসব বাক্যে অতি সুস্পষ্টভাবে এই 'আমি'র স্বতঃঅপরোক্ষ স্বরূপকেই ব্ৰহ্ম বলা সত্ত্বেও, 'মৃদিতকষায়' (রাগ, দ্বেষ ইত্যাদি দোষের নাম কষায়; জ্ঞান, বৈরাগ্য, ইত্যাদি অভ্যাসরূপ ক্ষার-জলে তা মৃদিত বা ক্ষালিত হয়ে থাকে) হতে না পারার জন্যই হোক, অথবা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক, গ্রহীতার গ্রহণ-ধারণের অক্ষমতার জন্য কি দাতারও ক্ষমতার অভাব স্বীকার করতে হবে?
ছান্দোগ্যোপনিষদে বর্ণিত উদ্দালক ঋষির পুত্র শ্বেতকেতুর বিনা 'লক্ষণা'তে (বাক্যের মুখ্য অর্থকে পরিত্যাগ না করে কিংবা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিত্যাগ করে তাৎপর্য অনুধাবনপূর্বক গৌণ অর্থ গ্রহণকে বলে লক্ষণা।) 'তত্ত্বমসি' মহাবাক্য শ্রবণে ব্রহ্মের অপরোক্ষ জ্ঞান হয়েছিল; এখন 'লক্ষণা'তেও অপরোক্ষ জ্ঞান লক্ষ্যহারা! অতএব, একমাত্র উপনিষদ শুনলেই এর প্রতিপাদ্য ব্রহ্মের অপরোক্ষ জ্ঞান হয় এবং এক উপনিষদই যথার্থশ্রুতি। স্বামী বিবেকানন্দ দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, "সর্বদাই সত্য—কেবলমাত্র সত্য শ্রবণ করিয়াই এই মহাশক্তির উদ্বোধন করিতে হইবে।" এই সত্যই উপনিষদবাক্য।
তবে শ্রবণের (সত্যকে শোনা) পরেও শ্রুতি বা উপনিষদ যে মনন (সত্যকে চিন্তা করা) ও নিদিধ্যাসন (যে-বিষয় শোনা হয়েছে, তার ধ্যান ও নিরন্তর পর্যালোচনা) করতে বলেছেন, তা কেবল শ্রবণের ফলে যে অপরোক্ষ জ্ঞান হয়, সেই জ্ঞানকে দৃঢ় করার জন্য। শ্রবণে অপরোক্ষ জ্ঞান না হওয়া তবেই সম্ভব হতো, যদি 'আমি'র এই স্বতঃঅপরোক্ষ স্বরূপকে বাদ দিয়ে ব্রহ্মের অপরোক্ষ জ্ঞান হতো। কিন্তু যখন 'আমি'র এই স্বতঃঅপরোক্ষ স্বরূপকেই অবলম্বন করে ব্রহ্মের অপরোক্ষ জ্ঞান হয়—তখন 'আমি'র এই স্বতঃঅপরোক্ষ সত্তা নিজ স্বরূপকেই "আমিই নির্বিকার নিষ্ক্রিয় নিত্যজ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্ম।" বলে অভ্রান্ত ও দৃঢ়ভাবে অনুভব করাকেই ব্রহ্মের অপরোক্ষ জ্ঞান হওয়া বলা হয়, তখন আর "শ্রবণে ব্রহ্মের অপরোক্ষ জ্ঞান হয় না।" বলার কোনো উপায়ই থাকে না।
মনন অর্থ বিচার। আর মনন-নিদিধ্যাসন শ্রবণেরই অঙ্গ মাত্র; তাই শ্রবণে অপরোক্ষ জ্ঞান সত্ত্বেও শ্রুতি বা উপনিষদ মনন ও নিদিধ্যাসন করতে বলেছেন। এর কারণ, কেবল কানে শোনা কখনোই প্রকৃত শ্রবণ নয়। শুনে তার অর্থ কাজে পরিণত না করলে সকলে তাকে 'শোনেনি'-ই বলে। 'তুমি তো কথা শোনো না।' মানে হলো, 'তুমি কথা শুনলেও তা কাজে লাগাতে পারো না।' অতএব শ্রুত বিষয়ে আন্তরিকতা, কাজে লাগানোর চেষ্টা এবং ঐকান্তিক শ্রদ্ধা থাকা চাই। তা সম্পর্কে সংশয়-বিপর্যয়াদি থাকলে বিচার জাগ্রত হয়; বিচারে নিঃসংশয় হলে তখন তার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই দৃঢ় একাগ্রতা জন্মে এবং তা ফলপ্রসূও হয়।
এখন কথা এ-ই, আমি আমার নিজস্বরূপটির অপরোক্ষত্ব সম্বন্ধে নিঃসংশয় ও নিশ্চিত; আর আমি নিজে যেমন নিজের কাছে জ্ঞাত, আর কোনো কিছু এর চেয়ে আমার কাছে অধিক জ্ঞাত নয়। ইন্দ্রিয় হতে উদ্ভূত জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ বললে, আমার নিজস্বরূপের জ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই অতিপ্রত্যক্ষ; কিন্তু আমি তো আমার এই অতিপ্রত্যক্ষ স্বরূপকে ব্ৰহ্ম বলে জানলে, যে-সব লক্ষণ দ্বারা শ্রুতি ব্রহ্মের স্বরূপ প্রতিপাদন করেছেন, আমার এই স্বরূপে তার কোনোটাই দেখি না, বরং উলটোটা দেখি—সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় ও তার পরিণতিতে। আবার শ্রুতিই আমাদের শ্রেষ্ঠ 'আপ্ত' বা 'অভ্রান্ত উৎস' বলে শ্রুতির মহাবাক্যও অগ্রাহ্য করতে পারি না। সুতরাং মনন বা বিচার চাই।
ব্রহ্মই যে আমাদের এই শরীরের মধ্যে মূল সত্তারূপে অবস্থান করছেন—শ্রুতি বহু স্থানে, ব্রহ্ম দ্বিপদের পুর (মানুষের বাসস্থান), অর্থাৎ তিনি এই মানবদেহ সৃষ্টি করে ওতে জীবাত্মারূপে প্রবিষ্ট আছেন—এই ধরনের অতি সুস্পষ্ট বাক্যে তা বারবার বলেছেন। আর এই জন্যই ব্রহ্মসূত্রকে শারীরিক-মীমাংসা বলে; অর্থাৎ শরীরে বাসকারী যে-ব্রহ্ম, তাঁরই বিচার বা বিশ্লেষণ। ব্রহ্মের নিরুপাধিক (উপাধি বা বিশেষণ নেই, এমন বা নির্গুণ) স্বরূপ পূর্বজ্ঞানসাপেক্ষ বলে তা ক্রিয়ারহিত পরমাত্মাস্বরূপ; জ্ঞানক্রিয়া (কোনো বিষয়কে কাজে লাগানোর আগে তা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করার প্রক্রিয়া) পূর্বজ্ঞানভূমি হতে নিম্নতর অবস্থা এবং জ্ঞানক্রিয়াতেই জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায়, অর্থাৎ জানাজানির বিষয়টি থাকে।
শ্রুতি এই শরীর, ইন্দ্রিয়, বৃত্তি ইত্যাদিতে অনুপ্রবিষ্ট এই স্বতঃঅপরোক্ষ সোপাধিক (উপাধিযুক্ত বা সগুণ) আত্মাকেই শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসন দ্বারা নিরুপাধিক ব্রহ্ম বলে প্রত্যক্ষ গোচর করাকেই 'পরাবিদ্যা' বলেছেন। ভূমা বা সর্বব্যাপী ব্রহ্মের উপদেশ প্রসঙ্গে শ্রুতি এই বিষয়টিই বিশেষভাবে বলেছেন। শ্রুতি ভূমার পরিচয়ে "ভূমাতে কোনোরূপ জানাজানির সম্পর্ক নেই।" উপদেশ দিয়ে ভূমাকে নিরুপাধিক বা উপাধিহীন ব্রহ্ম বলেছেন। আবার এমন উপদেশ এই দ্রষ্টা জীব (সোপাধিক আত্মা) হতে ভূমাকে (নিরুপাধিক ব্ৰহ্মকে) কোনো পৃথক তত্ত্ব বলে ভ্রম হতে পারে, এমন আশঙ্কায়, সঙ্গে সঙ্গেই ভূমাকে 'আমি' বলে নির্দেশ করেছেন।
অজ্ঞ-সাধারণ দেহ-ইন্দ্রিয়াদির সমষ্টিকে 'আমি' বলে মনে হতে পারে, এই আশঙ্কায়, তখনই আবার ভূমা 'আমি'কে আত্মা বলে নির্দেশ করে বলেছেন—এ ধরনের বিদ্বান ব্যক্তি নিজের আত্মার মনন ও অনুভূতির সাহায্যে 'ভূমা' অর্থাৎ নিরুপাধিক ব্রহ্মকে প্রত্যক্ষদর্শন করে 'স্বরাজ' অর্থাৎ 'সমস্ত লোকে বা স্থানে পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য' লাভ করেন এবং তখন নিজআত্মা হতেই সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়াদি সবই দর্শন করেন। এই সোপাধিক আত্মাই যদি বাস্তবিক নিরুপাধিক ব্রহ্ম বা তাঁর ধারক ও বাহক হন, তবে তো নিরুপাধিক ব্রহ্মের সকল লক্ষণই এই আত্মাতেও অবশ্যই আছে। অতএব, এই দেহ, ইন্দ্রিয়, বৃত্তি ইত্যাদি উপাধির সংঘাতের মধ্যে কোনটি আত্মা এবং আত্মাই যে ব্ৰহ্ম, এখন তা-ই দেখা যাক৷
শ্ৰুতি বলেছেন, এই দেহমধ্যে যিনি অনুভবকর্তা অর্থাৎ জ্ঞাতা, এবং যিনি এই দেহে সর্বাপেক্ষা অন্তরতম, তিনিই আত্মা, আর আত্মাই ব্ৰহ্ম। আমরা দেখেছি, দেহমধ্যে এই যে কে যেন 'আমি' 'আমি' করছে—জ্ঞানই এই 'আমি'র প্রকৃত স্বরূপ; সুতরাং জ্ঞানই সকলের প্রকাশক বলে এই দেহমধ্যে এই 'আমি'ই জ্ঞাতা। আবার জাগ্রত অবস্থায় সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রার সুখ ও অজ্ঞানাবস্থা এই 'আমি'ই স্মরণ করে বলে তখনও এই আমি-জ্ঞান থাকে; তবে অজ্ঞানই তখন জ্ঞানের বিষয় হওয়ায় উক্ত স্বরূপের এই আমি-জ্ঞান অজ্ঞাত থাকে। আর জাগ্রতাবস্থা, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি, এই তিনের মধ্যে যখন সুষুপ্তিই বাকি দুটোর অন্তর, অর্থাৎ সুষুপ্তিতেই জাগ্রতাবস্থা ও স্বপ্ন সুস্থির হয়, তখন অবশ্য এই আমি-জ্ঞান সুষুপ্তিরও অন্তরে থাকে বলে এই দেহে এই 'আমি'ই বিশুদ্ধতম স্থিতাবস্থা, তাই অন্তরতম সত্তা। আর 'আত্মা' ও 'আমি' এ দুটি স্বরূপবোধক পর্যায়শব্দ মাত্র। অতএব, এই দেহমধ্যস্থ আত্মা 'আমি'ই এবং 'আমি'ই ব্ৰহ্ম।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে জ্ঞানই সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার সমুদয় শ্রুতিও একবাক্যে এই জ্ঞানকেই ব্রহ্ম বলে ঘোষণা করেছেন। আমরাও দেখেছি, অনাদি অধ্যাসবশত এই দেহমধ্যে জ্ঞানই নিজেকে নিজে 'আমি' বলে অপরোক্ষভাবে জানছে;—এখানে এই দেহ কিন্তু কারণদেহ বা আনন্দময়কোষ—যাকে মূল-অজ্ঞান (অজ্ঞান অর্থ: 'জ্ঞানের সঞ্চার হয়নি যাতে', মানে সত্তার প্রাথমিক দশা) বলে। আর জ্ঞানই আমার এই 'আমি'র প্রকৃত স্বরূপ বলে সারাবিশ্বের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি আমার এই 'আমি'র জানার উপরই নির্ভর করে; কিন্তু আমার এই 'আমি'র অস্তিত্ব এই 'আমি'রও জানার অপেক্ষা করে না—ব্যবহারক্ষেত্রে এটা কোথা হতে যেন এসে হাজির হয় এবং জ্ঞাতা কর্তা ও ভোক্তা হয়ে নিজের প্রয়োজনমতো এই বিশ্বকে ব্যবহার করে।
বাস্তবিক জ্ঞানের নিজ স্বরূপ-সম্বন্ধীয় এই আমি-জ্ঞান যখন জ্ঞানেরই নিজকৃত অনাদি অধ্যাস হতে উৎপন্ন—কেননা অজ্ঞান জড়, সুতরাং জড়ের কর্তৃত্ব নেই—তখন অবশ্য এই অনাদি অধ্যাসেরও পূর্বসিদ্ধ অধিষ্ঠানরূপে জ্ঞানের সত্তা স্বীকার করতে হয়; সুতরাং জ্ঞান গীতার সেই "অনাদিমৎ পরং ব্রহ্ম", অর্থাৎ অনাদি ও নির্বিশেষস্বরূপ ব্রহ্মই জ্ঞেয়, তিনিই আদি ও অমৃত। আবার অধ্যাস ব্রহ্ম হতেই সৃষ্ট, সুতরাং জ্ঞানই অধ্যাসকর্তা বলে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের কর্তা ব্রহ্মও এই জ্ঞানই। জ্ঞানই নিত্যমুক্ত ব্রহ্মও বটে, কারণ 'মুক্তি' অর্থ 'সমুদয় সৃষ্টিতে যথেচ্ছ অধিকারপ্রাপ্তি'—নিশ্চুপ পাথর হয়ে যাওয়া নয়—কেননা নির্বাণ (মুক্তি) আর নির্বিকারত্ব (জড়ত্ব অর্থে) ভিন্ন বিষয়। এ না হলে মুক্তি পরম পুরুষার্থও হতো না এবং ভুলেও কেউ মুক্তির ইচ্ছাপোষণ করত না।
মুক্তি অর্থ পূর্ণ স্বাধীনতা—প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব; আর এটা জ্ঞানেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তাই আত্মার প্রমাতৃত্ব প্রতিপাদন প্রসঙ্গে ভামতীকার বাচস্পতি মিশ্র বলেছেন, "'প্রমাতৃত্ব' শব্দের অর্থ 'প্রমার কর্তৃত্ব', এ কর্তৃত্ব হলো স্বতন্ত্রতা। অর্থাৎ যে প্রমা কর্তা হবে, সে প্রমা—অন্যান্য যে-সকল কারক আছে—তাদের দ্বারা প্রেরিত হবে না; অথচ ওই সকল কারকের সে-ই প্রকৃত বিচারে প্রয়োগকর্তা হবে।" স্বামী বিবেকানন্দ এটা আরও সরল ভাষায় অতি সুস্পষ্ট করে বলেছেন, "মুক্ত স্বভাবের অর্থ বাহ্য সকল বস্তুর অনধীনতা। ইহার অর্থ এই, উহা ব্যতীত কোনো বস্তুই উহার উপর হেতুরূপে কোনো কার্য করিতে পারে না।" আমরা দেখেছি, অধ্যাসই সমুদয় সৃষ্টির মূল; আর জ্ঞানই এই অধ্যাসের কর্তা। সুতরাং মূলে যে-বিষয়ে যার পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে, সেই একই বিষয়ে পরে কি তার কর্তৃত্ব লোপ পায়? সুতরাং জ্ঞান সেই নিত্যমুক্ত ব্রহ্ম।
মূল-অজ্ঞানই হোক অথবা তার যে-কোনো গুণ বা ধর্মই হোক, জ্ঞানের জানার উপরই যখন সকলের সত্তা নির্ভরশীল, এবং জ্ঞান যখন পূর্ণ 'কামচার' অর্থাৎ ইচ্ছাময়, তখন স্বভাবশুদ্ধ জ্ঞানের কি সেই নিজেরই অঙ্গীকৃত আগন্তুক গুণ বা ধর্মে কিছুই এসে যায়? দেখা যায়, যাতে যার অধ্যাস হয়, তাতে তার গুণ বা ধর্ম কিছুই লিপ্ত বা যুক্ত হয় না; আর এই অধ্যাস জ্ঞানেরই জ্ঞানপূর্বক অঙ্গীকৃত একটা ব্যাপার মাত্র। অতএব, জ্ঞানস্বরূপ এই আত্মা বা এই 'আমি'ই সদাশুদ্ধ ব্রহ্ম—"অহং ব্রহ্মাস্মি"। তবে 'আমি' ব্রহ্ম হয়েও নিজেকে 'ব্রহ্ম নই' বলে যে জানছি, এর কারণ শ্রুতিবাক্য শ্রবণ না করা, অথবা শ্রবণ করেও অনাদর বা উপেক্ষাহেতু বিচার না করার গভীর ও সূক্ষ্ণ অনুভূতির অভাব—অজ্ঞান নয়; কেননা অজ্ঞান জ্ঞানেরই কর্তৃত্বাধীন।
বাস্তবিক জ্ঞানের স্বরূপ-বিষয়ক এই আমি-জ্ঞান অনাদি অধ্যাসবশত উৎপন্ন বলে অধ্যাস থাকাকাল অবধি এটা আছেই। তথাপি ব্যবহারকালের আগে অজ্ঞ-সাধারণের এটা জ্ঞানগোচর না হলেও, তখনও তাদের নিজের অস্তিত্বে কোনোরূপ সংশয় না থাকা এবং ব্যবহারকালে তাদের নিজের জানার কিছুমাত্র অপেক্ষা না রেখেই এসে হাজির হওয়া কি ওই সময়েও এই আমি জ্ঞানটি থাকার প্রমাণ নয়? আমি-জ্ঞান কখনোই বাহ্যিক উৎস বা কারণের মুখাপেক্ষী নয়, বরং তা বরাবরই স্বজাত এবং স্বতঃপ্রবৃত্ত।
আনন্দময় কোষের আমি-জ্ঞান জ্ঞানেরই স্বরূপ বলে দেয়, 'আমি' শব্দ স্ব-স্বরূপেরই বোধক হওয়ায় জ্ঞানের স্বয়ংপ্রকাশতা হেতু স্বসম্বেদ্যভাবে (কেবলই নিজের কাছে বোধগম্য উপায়ে) জ্ঞানভেদে একটা 'কেবল আমি'-জ্ঞান থাকে—নতুবা 'আমি' উপাধিরহিত ব্রহ্মের নিরুপাধিক স্বরূপ শেষ পর্যন্ত অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়ই থেকে যায়। তবুও এখানে 'আমি' উপাধি থাকা সত্ত্বেও তখন ব্রহ্মের নিরুপাধিক স্বরূপেরই অপরোক্ষ জ্ঞান হয়, কেননা তখন অজ্ঞানের আর অন্য কোনো উপাধিই থাকে না এবং জ্ঞান এখানে এই আমি-জ্ঞানের জ্ঞানক্রিয়ার কর্তা হয় না—জ্ঞানস্বরূপই অপরিবর্তনীয় থাকে। এটা বোঝানো এবং বোঝা উভয়ই কঠিন; আর একেই উপনিষদে পরাবিদ্যা বলে—যা নিজেকেই অসীম ধৈর্য ও সাধনার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে হয়।
যদিও আনন্দময় কোষের স্বতঃঅপরোক্ষ জ্ঞানস্বরূপ আমি-জ্ঞান নির্বিকল্পক বিধায় অজ্ঞ-সাধারণের কাছে অজ্ঞাত থাকে, তবু যখন ওই জ্ঞানস্বরূপ 'আমি' বহির্মুখিতাবশত ক্রমেই বুদ্ধি, মন, ইন্দ্রিয় ও দেহকে অবলম্বন করে অহম্-ইদম্'এর অর্থাৎ জ্ঞাতা-জ্ঞেয়ের ভেদহেতু সবিকল্পক জ্ঞানের বিষয় হয়, তখন কিন্তু তা সাধারণের অনুভবগোচরে আসে। তবে, নিজ প্রকৃত স্বরূপের জ্ঞানের অভাববশত এই 'আমি' তখন বুদ্ধ্যাদি (বুদ্ধি, মন, বিবেক ইত্যাদি) সহায়ককেই 'আমি' বলে জ্ঞান (মনে) করে এবং এর ফলে, করণ বা সহায়কের ধর্মকেই নিজের স্বরূপধর্ম মনে করায় নিজের মধ্যে ওই সকল ধর্মাক্রান্ত বোধে সুখ ও দুঃখের অনুভূতি হয়; আবার সহায়কের কৃতকাজও নিজের কাজ মনে করে ওই সকল কাজের বশে কাজ ও তার ফল অনুযায়ী লোক বা স্থান ও অবস্থা লাভ করে, এবং নিজেকে বদ্ধজীব বলে জ্ঞান করে।
যত যা-ই হোক, সত্যকে ভোলা কঠিন; তাই বদ্ধাবস্থাতেও 'আমি' নিজের মুক্ত স্বরূপের ইঙ্গিত পায় এবং বুদ্ধ্যাদি জড় বস্তুকে 'আমি' বলা সত্ত্বেও অলক্ষ্যে তাতে নিজজ্ঞানস্বরূপকেই আরোপ করে। কিন্তু যিনি সুধীর, তিনি নিজের প্রকৃত স্বরূপের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে, মুক্তির ইচ্ছায় শ্রুতিবাক্য শ্রবণ ও মনন দ্বারা গভীর ও সূক্ষ্ণ অনুভূতিসম্পন্ন হয়ে আনন্দময় কোষে 'আমি'র স্বতঃঅপরোক্ষ নিজ প্রকৃত স্বরূপের প্রত্যক্ষ দর্শন লাভ করে "ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্ব্বসংশয়াঃ" (যখন জীবের হৃদয়স্থ অবিদ্যা ও অজ্ঞানরূপ গ্রন্থি ছিন্ন হয়, যখন সংশয়ের খণ্ডন হয়—তখনকার অবস্থা) হন; এবং তখন স্বতঃই 'অহং ব্রহ্মাস্মি' (আমিই ব্রহ্ম), 'শিবোহহং' (আমিই শিব—শুভ, দয়ালু ও মহৎ—মঙ্গলময়), 'সোহহং' (আমিই সেই)—এই নিদিধ্যাসন অর্থাৎ একতানভাবের উপর হয়।
তখন শ্রবণ পূর্ণানন্দ প্রাপ্ত হওয়ায় এর ফল অপরোক্ষ জ্ঞানসিদ্ধ হয় এবং "মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ।”, অর্থাৎ মনের চেয়ে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, আর বুদ্ধির চেয়ে যা শ্রেষ্ঠ, তা হচ্ছেন তিনি (ব্রহ্ম)। বুদ্ধিরও অতীত সেই সত্তার "স্বেন রূপেণাভিনিষ্পদ্যতে", অর্থাৎ নিজের প্রকৃত স্বরূপেই অবস্থিতি ঘটে। সুতরাং বুদ্ধ্যাদির অধ্যাসকালেও, আগে নিজ প্রকৃত স্বরূপের অপরোক্ষ জ্ঞান হওয়ার কারণে, "এই সোপাধিক 'আমি'ই সেই নিরুপাধিক ব্রহ্ম"—এই দৃঢ় ও অভ্রান্ত অনুভব জাগ্রত হওয়ায় তিনি বুদ্ধ্যাদির ধর্ম বা কর্মে লিপ্ত হন না। মুক্ত যিনি, তিনি তাঁর জীবনের সব ঘটনাকেই লীলারূপে দর্শন করায় পাপভাগী অর্থাৎ দুঃখভাগী হন না; আর বদ্ধ যাঁরা, তাঁরা তাঁদের জীবনের সকল ঘটনাই সত্য এবং অপরিহার্য বলে জানেন, তাই পাপভাগী হন, অর্থাৎ দুঃখ পান।
এখন সব কথার শেষকথা—ব্ৰহ্মবিদ্যার কেবল অধ্যয়ন-অধ্যাপনা কখনোই পরাবিদ্যা নয়—যদি না তাতে নিজ প্রকৃত স্বরূপের অপরোক্ষ জ্ঞান আরোপিত বা যুক্ত হয়। তাই চার বেদ-সহ ব্রহ্মপর বা ব্রহ্মনিষ্ঠ শাস্ত্র অধ্যয়ন করা সত্ত্বেও নিজ প্রকৃত স্বরূপের অপরোক্ষ জ্ঞান না হওয়ায় দেবর্ষি নারদ শোকমুক্ত হতে না পেরে, (শ্রীমদ্ভাগবত অনুযায়ী) ব্রহ্মার নিজের চার জন মানসপুত্রের অন্যতম ভগবান সনৎকুমারের সমীপস্থ হয়ে আত্মস্বরূপের অপরোক্ষ জ্ঞান লাভে শোকমুক্ত হন। অতএব, "অথ পরা যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে।" (পরাবিদ্যার সাহায্যেই শাশ্বত ও নিত্য ব্রহ্মকে জানা যায়।)