ন্যায় ও মঙ্গলের ফল ভোগ করার ইচ্ছে সবারই থাকে, কিন্তু ন্যায় ও মঙ্গলের পক্ষ অবলম্বন করতে সবাই চায় না। এ পৃথিবীতে অনেকেই অন্যায় ও অমঙ্গলকে দূরে সরিয়ে দেবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে যায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওরা কেবল তখনই কাজটি করে, যখন নিজের সাথে সেই অন্যায় ও অমঙ্গল ঘটে থাকে, অথচ নিজে বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গেলে অন্যের বেলায় একই কৌশলে অমঙ্গল ও অন্যায়কে দূর করার চেষ্টা তো করেই না, উলটো নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিপন্ন মানুষকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। এ ধরনের আচরণকে ঈশ্বরভক্তি বলে না, বরং স্বার্থপরতা বলে। প্রকৃত ভক্ত বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে, বিশেষ কোনো উপায়ে, বিশেষ কোনো অন্যায় ও অমঙ্গল দূর করেই তৃপ্ত হয় না, বরং সকল মানুষের ন্যায় ও মঙ্গলের জন্য নিজের ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর জন্য সবসময় সচেষ্ট থাকে।
হৃদয় কী? হৃদয় তা-ই, যা ভগবানকে প্রেমময়রূপে অনুধ্যান করে। প্রেমই পৃথিবীর একমাত্র সর্বজনীন ভাষা, যা দ্বারা পৃথিবীর সকল মানুষ একই আত্মিক সুরে বাঁধা পড়ে। ঈশ্বরকে হৃদয়ে ধারণ করার অর্থ হলো, ঈশ্বরের যে-প্রকাশ প্রেমে, তাকেই হৃদয়ে ধারণ করা; অর্থাৎ কোনো হিসেব না করে, কোনো স্বার্থচিন্তা না করে প্রেমকে হৃদয়ে জায়গা দেওয়া; কোনো বিশেষ কারণে নয়, বরং প্রেমের জন্যই প্রেমকে ধারণ করা। এর কারণ, হৃদয়ের সকল বৃত্তির কাছে প্রেমই একমাত্র মনোরম ও প্রশান্তির বস্তু। প্রেমই ভক্তি, ভক্তিই প্রেম।
বুদ্ধি এবং বিবেক সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে, হৃদয় সম্বন্ধেও তা-ই প্রযোজ্য, তাই সেসব কথার আর পুনরাবৃত্তি করছি না।
প্রেম দিয়ে ভগবানকে খুশি করা, এটাই, হৃদয়ের যে-ভক্তি, তার প্রধান লক্ষণ এবং এই ভক্তিই হৃদয়ের সব ধরনের উৎকর্ষের ভিত্তিভূমি। সত্য ও মঙ্গলভাবকে পেলে বুদ্ধি এবং বিবেক তৃপ্ত হয়। কিন্তু কেবল ভাবের মাধ্যমেই হৃদয় তৃপ্ত হয় না; হৃদয় শুধুই ভাব চায় না, বরং ব্যক্তিকে চায় এবং ব্যক্তিকেই হৃদয় খুশি করে। নিজের স্বার্থ ও সুবিধার জন্য কারও কাছ থেকে প্রেম আকাঙ্ক্ষা করা এক কথা, আর কারও উপরে নিজের জীবনের সমস্ত আনন্দ প্রতিষ্ঠিত করতে এবং নিজেও তার জীবনের সমস্ত আনন্দের আধার হতে চাওয়া আরেক কথা। তবে মানুষ যেহেতু সসীম ও অপূর্ণ, সেহেতু মানুষকে প্রেম দিয়ে ও তার কাছ থেকে প্রেম পেয়ে হৃদয়ের পরিপূর্ণ তৃপ্তি কখনোই আসে না। এর কারণ, এ পৃথিবীতে কোনো ব্যক্তিই পুরোপুরি নিঃস্বার্থভাবে প্রেমকে গ্রহণ ও প্রদান করতে পারে না; কেউই নিরপেক্ষভাবে হৃদয়ের মূল বিষয় প্রেমের অনুগামী হতে পারে না।
অপরদিকে, বুদ্ধি ও বিবেক সসীম সত্য ও মঙ্গলকে অনুসরণ করে ক্রমেই অসীম সত্য ও মঙ্গলের পথে ধীরে ধীরে পরিচালিত হয় এবং একসময় অসীমেই অবস্থান করে। ঠিক একইভাবে, আমাদের হৃদয়ও সসীম মানুষকে অবলম্বন করে তাতে অবস্থান নেয়, ধীরে ধীরে অসীম প্রেমের আস্বাদন করতে শেখে এবং একসময় নিজের একটি নিরপেক্ষ আশ্রয় লাভ করে সেই আশ্রয়েই থেমে যায়। জ্যোতির্বিদ যেমন আকাশের নক্ষত্রগুলি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিভিন্ন সত্যে উপনীত হন, নীতিগবেষক যেমন মানুষের ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন ও বিশেষ বিশেষ ঘটনা আলোচনা করে নীতির বিবিধ ভিত্তি, ন্যায় ও মঙ্গলের সর্বজনীন আদর্শ রচনা করেন, ঠিক তেমনি, যে-মানুষ হৃদয়ে প্রেমকে ধারণ করতে পারেন, তিনি নিজের চারপাশের মানুষের প্রেমকে যেমনি গ্রহণ করতে পারেন, তেমনি তাঁদেরকেও নিজের হৃদয়ের প্রেম অর্পণ করতে পারেন এবং এই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে হৃদয়ের অসীম আশ্রয়ে থাকতে থাকতে একদিন তিনি সেই প্রেমময় মহান পুরুষের প্রেমসাগরে গিয়ে নিমগ্ন হয়ে যান।
বুদ্ধি যাকে সত্যের বিচারে সত্যস্বরূপ বলে মেনে নেয়, বিবেক যাকে মঙ্গলের বিচারে মঙ্গলস্বরূপ বলে আশ্রয় দেয়, হৃদয় যাকে প্রেমের বিচারে প্রেমস্বরূপ বলে অনুধ্যান করে, আত্মা তাকেই সত্য, মঙ্গল ও প্রেমের একমাত্র আধার হিসেবে নিজের মধ্যে অনুধ্যান করে থাকে। কেবল সত্য, মঙ্গল ও প্রেমরূপে নয়, বরং যাঁর মধ্যে এই তিনটি সত্তা অবস্থান করে, এমন একজন অনন্ত পূর্ণ পুরুষরূপে আত্মা নিজের মধ্যেই পরমাত্মা বা ঈশ্বরের পূজা করে থাকে। এর কারণ, এই অদ্বিতীয় পূর্ণপুরুষই আত্মার স্বয়ংসম্পূর্ণ বিষয়রূপে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। বুদ্ধির কাছে যিনি সত্য, বিবেকের কাছে যিনি মঙ্গলময়, হৃদয়বৃত্তির কাছে যিনি প্রেমময়, আত্মার কাছে তিনিই অন্যনিরপেক্ষভাবে সত্য-মঙ্গল-প্রেমময় মহাপুরুষ; আত্মার কাছে তিনি সব বিবেচনাতেই মনমোহন ও সুখকর; আত্মা প্রথমেই, নিজের অজ্ঞাতসারে, স্বাভাবিক প্রবৃত্তির প্রেরণায় সেই পরমপুরুষের কাছে প্রধাবিত হয়। কিন্তু কালক্রমে সজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ করে শান্তি ও মোক্ষের অধিকারী হয়ে থাকে।
বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয় এবং আত্মা, এই চার ধরনের প্রবৃত্তির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েই ঈশ্বরপ্রেম পূর্ণাঙ্গ ভক্তিতে পরিণত হয়। মানুষের এই চারটি বৃত্তির যথাযথ ও স্বাভাবিক পরিচালনা ছাড়া ভক্তির উৎপত্তি পুরোপুরি অসম্ভব। ভক্তি মানুষের সব ধরনের উৎকর্ষের ভিত্তিভূমি এবং মানুষের সকল বৃত্তির যথাযথ ও পরিপূর্ণ বিকাশলাভের জন্য ভক্তির সাধনা একান্ত প্রয়োজনীয়।
কখনো কখনো মানুষের অজান্তেই তার অন্তরে ভক্তির ভাব সঞ্চারিত হয়ে থাকে। কীভাবে হয় এটা? মানুষ মাঝে মাঝে ভাবে, সে কোনো বিশেষ সত্যকে, বিশেষ মঙ্গলকে বা বিশেষ প্রিয় ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করছে। কিন্তু এখানে অন্য একটি ব্যাপার ঘটে। মানুষ নিজেই বুঝতে পারে না, একধরনের সর্বজনীন সত্য, মঙ্গল ও প্রেমের প্রতি সজ্ঞানেই হোক, আর অজ্ঞানেই হোক, তার হৃদয়ে গভীর আস্থা ও প্রীতি উৎপন্ন হয়েছে। যদি উৎপন্ন না হতো, তাহলে বিশেষ কোনো সত্যকে, মঙ্গলভাবকে বা প্রিয়জনকে প্রেমে নিমজ্জিত করতে সে পারত না। পুরো প্রক্রিয়াটি অবচেতনভাবেই সংঘটিত হয়। এ কারণেই সে ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে পারে না, আর চিন্তা করতে পারে না বলেই ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছেটাও তার মনে আসে না। তবু প্রেমের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রদর্শনের মাধ্যমে সে মূলত বৃহৎ প্রেমের, তথা ঈশ্বরপ্রেমের দিকেই পথ চলতে থাকে।
মানুষ নিজের অজান্তেই ঈশ্বরপ্রীতির কাজ করে ফেলে। অনেক গণ্যমান্য বড়ো বড়ো পণ্ডিত মানুষ নিজেকে ধর্মহীন এবং নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দেন এবং পৃথিবীর সবাই তাঁদেরকে ওরকমই জানে। কিন্তু তাঁরা তাঁদের অন্তরে যে-ভাব ধারণ করেন এবং যে-জ্ঞানের চর্চা করেন, তার প্রকাশ এমনভাবে হয়, যা ধর্মেরই অনুরূপ। ধর্মে যা যা করতে বলা আছে, তাঁরা সেগুলির সব কিছুই করেন; তবে তাঁরা নিজেরাই জানেন না যে, ওসব কাজ করতে ধর্মে বলা আছে এবং তাঁরা নিজের অজান্তেই ধর্মের পথে চলছেন। এভাবেই তাঁরা, ধর্ম থেকে নিজেদেরকে দূরে দাবি করলেও, মূলত নিজের আত্মায় ঈশ্বরকে অধিষ্ঠিত করে ভগবদ্ভক্তির প্রমাণ দিয়ে থাকেন। ধর্মের মূলসুরে পথ চলেন যিনি, তিনিই মূলত ধার্মিক—তা তিনি নিজে মানুন বা না মানুন।
ওসব বড়ো বড়ো মানুষ, যাঁদের পৃথিবী নাস্তিক হিসেবে জানে, তাঁরা সত্যকে নিষ্কামভাবে সত্য বলেই গ্রহণ করেন; অসত্যের দ্বারা নিজের বুদ্ধিকে পরিচালিত হতে দেন না, বরং সর্বজনীনভাবে যা সত্য বলে স্বীকৃত, সেটির পথের অনুগামী হন। যদি আপনি তাঁদের জিজ্ঞাসা করেন যে, তাঁরা ঈশ্বরের পথের অনুগামী কি না, তারা তৎক্ষণাৎ তা অস্বীকার করবেন এবং বলবেন, আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি না; অথচ আপনি নিরপেক্ষভাবে ভাবলে দেখতে পাবেন, ঈশ্বরের পথে চলতে গেলে যা যা করতে হয়, তারা সেগুলি করেন; যা যা বর্জন করতে হয়, তারা সেগুলি বর্জন করেন। এ থেকে প্রমাণিত হয়, ধর্মের পথ মূলত মানুষ হয়ে ওঠার পথ। যদি মানুষ হয়ে ওঠার পথে চলতে না পারেন, তবে আপনি যতই নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করুন না কেন, ধর্মের মূল শিক্ষাটাই আপনার হয়নি।
মানুষ যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, নিজের জটিল মনের সমস্ত শক্তি ও কাজ সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে বা বুঝতে সে কখনোই পারে না। আমাদের চরিত্রের অনেক গোপন শক্তি ও সম্পদ অনেকসময় আমাদের অলক্ষে ও অজ্ঞাতে ভূগর্ভস্থ বীজের মতো অঙ্কুরিত ও পরিবর্ধিত হয়ে থাকে। ঈশ্বরপ্রেমের বেলাতেও একই ঘটনা ঘটে। ঈশ্বরের প্রতি মানুষের যে প্রেম ও কর্তব্য, তা অনেকসময় তার নিজের আত্মজ্ঞানের আলোতে মুকুলিত ও বিকশিত হবার অনেক আগেই আত্মদৃষ্টির অন্তরালে তার হৃদয়ের গর্ভে অঙ্কুরিত ও পরিবর্ধিত হয়ে যায়। যে-সকল পণ্ডিত ব্যক্তি সত্যকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকেন, সত্যের প্রতিষ্ঠায় প্রাণ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না, কিন্তু সত্যরূপ ঈশ্বরের উপাসনা করার কথা বললে ঘৃণায় ও তাচ্ছিল্যে ভ্রু কুঁচকে ফেলেন, তাঁরা জনসাধারণের জ্ঞান ও বুদ্ধির অতীত অনেক কঠিন তত্ত্ব আবিষ্কার ও আয়ত্ত করেছেন, এটা ঠিক; কিন্তু কখনও নিজের অন্তর্নিহিত ধর্মপ্রবৃত্তির আলোচনা ও ভাবনা-অনুশীলন করার সময় করতে চান না। নিজের আত্মার শক্তি ও সম্ভাবনার হিসেব করার ব্যাপারে তাঁদের কোনো আগ্রহই নেই, কিন্তু আকাশের অগণিত নক্ষত্রকে গুনে সেগুলির তালিকা প্রস্তুত করে দিতে তাদের বিন্দুমাত্রও আলস্য নেই। তাঁদের ভাবনাই তাঁদের ধর্ম, তাঁদের কাজই তাঁদের ধর্ম; এমন পবিত্র কর্মী মানুষই প্রকৃত ধার্মিক। তাঁরা নিজেরাই জানেন না, তাঁদের অন্তরে বুদ্ধিগত ভক্তিভাব স্তূপীকৃত হতে হতে ক্রমেই পর্বতের সমান হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা ধর্ম মানেন না বলে নিজেরাই দাবি করেন, কিন্তু বাস্তবে, যে-কোনো ধার্মিক ব্যক্তির তুলনায় ধর্মের পথে বেশি চলেন।