ইন দ্য মুড ফর লাভ (২০০০)

ইন দ্য মুড ফর লাভ (২০০০)। বিশুদ্ধ ভালোবাসার গল্প। প্ল্যাটনিক, অথচ গভীর। গল্পের নিঃসঙ্গতার সুরটি আমাদের অনেকেরই খুব চেনা। সে সুরের হাত ধরে দুঃখ আসে, অস্তিত্বের যন্ত্রণা আসে, অপ্রাপ্তির বিষাদ আসে। বিষণ্ণতাই ভালোবাসার জন্ম দেয়। সে ভালোবাসা আরোপিত নয়, হৃদয়মথিত। সিনেমায় রং ও সুরের ব্যবহার যথাযথ, নান্দনিক, অপূর্ব। গল্পের প্রবাহ ধীর, তবে সুসংহত। কাহিনির বিন্যাস এমন, আপনি সে বিন্যাসে বিন্যস্ত হতে চাইবেন, প্লটটাকে নিজের অনুভবে নিয়ে আসতে ইচ্ছে করবে। মিস্টার চৌ এবং মিসেস চ্যানের দুঃখবোধ, একাকীত্ব আপনাকে স্পর্শ করবে। মুভি এগোতে থাকবে, আপনি নিজের মধ্যেও এক ধরনের অতৃপ্ত ভালোবাসা টের পাবেন। ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম কিংবা কবিতা অনুভব করলে যেমন আনন্দ হয়, ঠিক তেমন অনুভূতির আনন্দ এ ফিল্মে আছে। জার্নিটা শেষ হবার পর আপনার মনে হবে, এমন করেও সিনেমা বানানো যায়! এর স্রষ্টা ওং কার-ওয়াই জীবনচিত্রণের এক নিপুণ কারিগর, যিনি এ ফিল্মে জীবনকে এনেছেন যতটা ফিল্মের আইনে, ততধিক জীবনের কানুনে।

বিয়ের পর মানুষ বদলে যায়। বিয়ে যতটা না ভালোবাসার জন্ম দেয়, তার চাইতে অনেক বেশি জন্ম দেয় সংশয়ের। তখন মানুষের এমন কিছু দিক বেরিয়ে আসে, যা বিয়ের আগে বেরিয়ে এলে হয়তো বিয়েটাই হতো না। তবু সামাজিক ও পারিবারিক কারণে তেমন কিছু করারও থাকে না। বিবাহিত জীবন মূলত মেনে ও মানিয়ে নিয়ে বাঁচার জীবন। বিয়ে তাই একটি অসহায়ত্বের দিকে যাত্রা, দূরত্বের সূচনাপর্ব। বিয়েভাঙাটা খেলনাভাঙার মতো সহজ হলে ডিভোর্সের মহোৎসব হতো প্রতিদিনই। একটা মানুষ প্রকৃতপক্ষে কেমন, সেটি তার স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া কেউই ঠিকভাবে বলতে পারে না। তাই কারো আসল চেহারা চিনতে হলে বাইরে থেকে নয়, ঘরে ঢুকে চিনতে হবে। বিবাহিত মানুষ তার সঙ্গীর মানসিকতায় কিংবা আচরণে দিনের পর দিন ক্লান্ত হতেহতে একসময় অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়। কাছেআসা, বন্ধুত্ব, ভাললাগা, প্রেম, কখনোবা ভালোবাসা। এমনও হতে দেখেছি, ঘরের মানুষটিকে ভালোবেসেও বাইরের কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মে যায়। সে ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে না জেনেও তেমন কোনো প্রত্যাশা না রেখেই ভালোবাসাটা গভীর হয়ে যায় অনেকসময়ই। সে গভীরতায় সবসময়ই যে শরীর আসেই, তাও নয়। এর মানে কী দাঁড়াল? মানুষ মনের ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত জীব। সে ক্ষুধা ঘরে না মিটলে বাইরের দিকে মন যাবেই। এতে দোষের কিছু নেই।

খোঁজ নিয়ে দেখুন, বিশ্বের সবচাইতে সুন্দর মানুষটিকে বিয়ে করেছেন যে ব্যক্তি, তিনিও একসময় সে সুন্দর মানুষটির প্রতি আগের মতো আগ্রহ আর অনুভব করেন না। মানুষ স্বভাব, যাকে সে একবার পেয়ে যায়, তাকে সে অবহেলা করতে শুরু করে। এও মানুষ স্বভাব, অবহেলা পেলে কোথায় কদর আছে, তা খুঁজতে শুরু করে। ফলে ঘরের মানুষের সাথে সৃষ্ট দূরত্ব বাইরের মানুষের সাথে নৈকট্য তৈরি করে ফেলে। তখন একাকীত্ব ঘোচাতে মন এমন কাউকে খুঁজে নেয় যে মানুষটা মনের মতো। আর যদি এমন হয়, মানুষ বুঝে ফেলে যে তার সঙ্গীটি অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট কিংবা পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িত, তখন সেও বিকল্প পথ খুঁজে নেয়। স্বাভাবিক। মন এমন একটা সত্তা, যার আশ্রয়ের দরকার হয়। কারো কাছ থেকে অনুকূল পরিস্থিতিতে প্রশ্রয় পেলে মন সেখানে আশ্রয় নিতে চায়। এর নাম দ্বিতীয় প্রেম নয়, প্রেম। প্রেমের কোনো প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হয় না। প্রতিটি প্রেমই প্রথম প্রেম। প্রতিটি প্রেমের জন্মই প্রেমহীনতার বোধ থেকে।

মানুষকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না, প্রেম দিয়ে বাঁধতে হয়। কেমন প্রেমে মানুষ বাঁধা পড়ে? আমার মনের মতো প্রেমে? না। যাকে বাঁধতে চাইছি, তার মনের মতো প্রেমে। তেমন প্রেম আমার কাছে না পেলে সে তার কাছে ছুটে যাবে, যার মধ্যে সে তেমন প্রেম দেখেছে। বেশিরভাগ দম্পতিই নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভেতরটা লুকিয়ে বাঁচে। যার কাছে নিজেকে লুকিয়ে বাঁচতে হয় না, তার প্রতি প্রেম আসবে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এমন প্রেম ঘর ভাঙে না, ঘর ভেঙেছে বলেই এমন প্রেম আসে। ভালোবাসার শুরু হয় বন্ধুত্বের হাত ধরে। বন্ধুত্ব যখন ভালোবাসায় রূপ নেয়, তখন প্রায়ই, মানুষ ভয় পেয়ে যায়। ভালোবাসার ভার বহন করা পৃথিবীর কঠিন কাজগুলির একটি। সে কাজটি করতে গিয়ে লোকে বন্ধুত্বও হারায়, ভালোবাসাও হারায়। তবু এ হারানোর খেলায় সবাই নিজেকে রাখতে চায়। মানুষ পেতে ভালোবাসে, তার চাইতে বেশি ভালোবাসে পেয়ে হারাতে। যা কিছু হারাতে হবে, তা কিছুর প্রতিই মানুষের আকর্ষণ দুর্নিবার। হারাতে হবে জেনেও মানুষ যা পেতে চায়, হারিয়ে ফেলার পর তা নিয়েই সে বেঁচে থাকে।

মিস্টার চৌ এবং মিসেস চ্যান, দুইজনই দাম্পত্যজীবনে অসুখী। তারা পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার দহনে পুড়েছে প্রতিনিয়তই, তবু কী একটা বাধা তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে মুভির শেষ পর্যন্ত। মুভির আসল সৌন্দর্য এখানেই। মিসেস চ্যানের ভূমিকায় ম্যাগি চিউংয়ের সাবলীলতা এবং লাবণ্য আপনাকে পুরো সিনেমায় মুগ্ধ করে রাখবে। তার হাঁটা, তার ব্যক্তিত্ব, তার কথাবলা, পোশাক পরার ধরন বুকের মধ্যে ঝড় তুলে দেয় রীতিমতো! অতোটা নিখুঁত দেহপল্লবের অধিকারিণী চলচ্চিত্র-বিশ্বে হাতেগোনা। গল্পের নায়িকা দর্শকের দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ করে রাখে, কী এক আফসোস জাগিয়ে তোলে প্রতি মুহূর্তেই। সে আফসোস না পেয়েও হারানোর আফসোস! সেটি পেয়ে হারানোর চাইতেও তীব্র। রোম্যান্টিক সিনেমা দেখতে বসার আগে আমরা যা যা আশা করে দেখতে বসি, এ সিনেমায় সেসবের অনেককিছুই নেই, তবু সিনেমাটা দেখার পর মনে আসে, এ সিনেমায় যা দেখলাম, তা-ই রোম্যান্টিক সিনেমায় থাকা প্রয়োজন। সব পেয়ে গেলে ভালোবাসা পালিয়ে যায়, এ সিনেমা সব-পেয়েছি’র সিনেমা নয়, এ সিনেমা ভালোবাসা-পেয়েছি’র সিনেমা। কাছেআসার তীব্র ইচ্ছে, তবু দূরেথাকা, এই দূরত্বই ভালোবাসার প্রাণ। ভালোবাসা প্রাপ্তির কাব্য নয়, অপ্রাপ্তির কবিতা। ভালোবাসার মৃত্যু মিলনে, বৃদ্ধি বিচ্ছেদে। বিরহই ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখে।

পাবো না জেনেও যাকে চাওয়া যায়, যার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকা যায় একজীবন, যে প্রতি মুহূর্তেই বিচরণ করে মনের আন্তরিক আঙিনায়, যার কথা মনে এলেই অজান্তেই প্রার্থনা চলে আসে: ভাল থেকো, যার অস্বাভাবিকতাও স্বাভাবিক মনে হয়, যার কথা কিংবা আচরণ এক পৃথিবীসমান কষ্ট দিলেও যাকে ক্ষমা করে দেয়া যায় অবলীলায়, যার স্মৃতি গভীর বিষাদের সময় পাশে থেকে দুঃখ তাড়ায়, সেই চিরন্তন ভালোবাসার মানুষের সাথে যোগাযোগ এবং অ-যোগাযোগের অকপট দৃশ্যায়ন ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’।