আশ্বস্ত হবার মুহূর্তে

বড়ো ভীত আর উদ্‌বিগ্ন মন নিয়ে তোমার কাছে এসেছিলাম। ক্রমাগতই ভয় হয়, এই বুঝি তোমাকে হারালাম, আর হারাব ভেবে ভেবে দারুণ উদ্‌বেগ হয়। তুমি প্রাণরূপে, জীবনরূপে, আত্মারূপে, দ্রষ্টারূপে, শ্রোতারূপে, মন্তারূপে, বোদ্ধারূপে, স্মর্তারূপে, বিচিত্র বিশ্বরূপে প্রকাশিত হয়ে দেখালে, তোমাকে আমি হারাইনি। নির্জনে, নিভৃতে, অন্ধকারের মধ্যে, প্রিয়রূপে, প্রেমিকরূপে, অন্তরতর ও অন্তরতমরূপে দেখা দিয়ে আশান্বিত করলে যে তোমাকে হারানো অসম্ভব।




যে প্রিয়তম ব্যক্তিদের একসময়ে উচ্ছ্বসিত প্রেমের সাথে আলিঙ্গন করেছি, তারা তো দূরে চলে গেছে। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তো অন্তরতম ছিল না। তোমার সাথে ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে সেই ঘনিষ্ঠতার তুলনাই হয় না। তাদের দেখা, শোনা, স্পর্শ, আবেগ অপেক্ষাকৃত বাইরের ছিল। বাইরের ছিল আর সাময়িক ছিল। তাতে হৃদয়ের কামনা পূরণ হতো না। তোমাকে ভালোবাসতে পারলে হৃদয় একেবারে পূর্ণ হয়ে যাবে। সেই ভালোবাসাই আমার হচ্ছে না। তাই আমার ভয়, তাই আমার উদ্‌বেগ।




তোমার সঙ্গে আমার যা-কিছু মিলন হয়, সেসবের মধ্যে চিন্তার প্রভাব, বুদ্ধির প্রভাবই বেশি দেখি। প্রেম যদি থাকে, তা অতি অল্প... তা প্রভাতের শিশিরবিন্দুর মতো শুকিয়ে যায়। আমার চিন্তা, আমার বোঝা যতই গভীর হোক, তাতে আমি স্থায়ীভাবে তোমাকে পাবো না; এ কথা তুমি আমাকে বার বার বলেছ। প্রেমের অভাবেই আমি তোমাকে স্থায়ীভাবে পাচ্ছি না। প্রেমের অভাবে চিন্তার বোঝাও অস্থির হয়ে যায়। একবিন্দু প্রেমের প্রভাবে হারানো জ্ঞান আবার ফিরে আসে।




তোমার চিন্তার বিচার আমি চেষ্টা করলে করতে পারি। তুমি সেই চেষ্টাকে নিশ্চয়ই অনুপ্রাণিত করো, সফল করো; কিন্তু চিন্তা করেও আমি প্রেম আনতে পারি না। কী নিয়মে তুমি প্রেম জাগাও, প্রেমকে শুকিয়ে ফেলো, তা আমি বুঝতে পারি না। তুমি যখন হৃদয়ে প্রেমের উদয় করে আমার সাধনা সফল করো, তখন মনে হয়, এই সফলতা আর বুঝি যাবে না। কিন্তু তা তো হয় না, সে-অবস্থা তো বরাবরই চলে যায়। আমি যখন জীবন্তভাবে, মধুর অনুভবে তোমাকে পাই, তখন যদি তোমাকে নিয়ে বসে থাকি, তোমাকে আর না ছাড়ি, না ভুলি, তবে কি তুমি একেবারে স্থায়ীভাবে আমার হয়ে যাও? আমার তা-ই মনে হয়।




তোমাকে না ছাড়লে, না ভুললে, তুমি কেন বিনা কারণে আমায় ছাড়বে? কিন্তু তোমাকে এই রূপে দৃঢ়ভাবে, স্থায়ীভাবে ধরে রাখার শক্তি-সুবিধা তো তুমি আমাকে দাও না। আমি তোমার কৃপার উপর নির্ভর করে দেখি, আমি যতটা সম্ভব তোমার কাছে বসে থাকতে পারি কি না।




আমার হৃদয়ে প্রেমের বীজ নেই বলে তো বোধ হয় না। আমার সেই প্রথম বয়সের প্রেমপিপাসা তো অতৃপ্তই রয়েছে, তুমি দেখতে পাচ্ছ। মানুষের কাছে নিরাশ হয়ে আমি তোমার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। আমার বাঞ্ছিত প্রেম কোনো মানুষ দিতে পারবে না, তা আমি নিশ্চয় বুঝেছি। তুমি ছাড়া প্রেমের তৃপ্তি আর কোথাও নেই, তা আমি নিশ্চয়ই জানি। এখন তোমার কাছে যদি সে-প্রেম না পাই, তোমাকে ভালোবেসে যদি শান্ত, সুখী, সবল না হতে পারি, তবে জীবন বিফলই হলো, জীবনের অবলম্বিত কাজও অকৃত রইল।




তুমি যে আমার জীবন এভাবে ব্যর্থ করবে, তা তো বিশ্বাস হয় না। এই চেষ্টা, এই প্রার্থনার মধ্যেই কৃতার্থতার বীজ দেখছি। প্রত্যেক চেষ্টা, প্রত্যেক প্রার্থনাই আংশিকভাবে সার্থক আর পূর্ণ সার্থকতার প্রতিশ্রুতি ... এ-ই কি তোমার বাণী শুনছি?