আর কবে সময় হবে?

 
আর কবে সময় হবে? কবে আর তবে নিজের কাছে যাবে? আর কতকাল এমনি করে নিজের থেকে পালিয়ে বেড়াবে? তোমাদের আর কবে সে সময় হবে? গুনে গুনে বারোটা বছর হয়ে গেল, আমি চলতে শুরু করেছি নিজের সাথে, কেবলই নিজের সাথেই এখন আছি। কাউকে বলিনি, একটু সময় চাই, একটু সময় দেবে? বলিনি, কারণ সে সময় কারও হতো না, জানি। চাইলেই, কেবল চেয়ে ফেললেই যখন তখন যা খুশি আমি পাইনি কখনও। একাকিত্ব যে কী, তা আমি জানি। জীবনে ভয়ংকর কিছু একাকিত্বের রাত আর কিছু একলাদিন যাপনের পর মরে যেতে যেতে অবশেষে বাঁচতে শিখেছি আমি। এখন আর আমার একাকিত্বের ভয় নেই, যখন তখন চলে যাবারও কোনও ভয় নেই। হ্যাঁ, আমার মৃত্যুভয় আছে, কিন্তু এ-ও তো জানি, সকল প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবেই হবে! মৃত্যু হচ্ছে সেই অলিখিত চুক্তিপত্র, যা আমরা আমাদের জন্মের সাথে করেই নিয়ে এসেছিলাম। আর এজন্যেই একে মেনে নিতে খুব একটা কষ্ট পেতে হয়নি।


তোমরা ভাবো, তোমরা কেবলই মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়াও, অথচ তোমরা আদৌ কি আছ বেঁচে? তোমরা এর নাম দিয়েছ…সেলফ-আইসোলেশন! শেষপর্যন্ত, তা হলে একটা ছোট্ট ভাইরাস তোমাদেরকে বাধ্য করেই ফেলল তোমাদের নিজেদের কাছে ফিরে আসতে! এখন তোমরা চারদেয়ালের মাঝে বন্দি! এমনটা কি হবার কথা ছিল? এভাবে এতটা নির্লজ্জের মতো নিজের কাছে বাধ্য হয়ে ফিরে আসার কথা ছিল কি, তোমাদের? না, আমার এখন আর নিজের কাছে নিজেকে একা লাগে না। নিজেকে আমার খুব ভালো লাগে এখন। আমি যখন অনেক লোকের ভিড়ে কোনও কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই, তখন সেটিকে আমার কেবল কাজই মনে হয়। সেখানে আমি কোনও আনন্দ খুঁজি না। কাজে আনন্দ থাকবেই, এমন তো নয়। তবে কাজে কিছু কাজ থাকবে, এবং সেগুলো যেকোনও মূল্যে করতেই হবে। আমি জেনে গেছি, এই পৃথিবীটা যেমন একা, তেমনি আমরা প্রত্যেকেই একা। এটাকে আমার তুচ্ছ একটা ব্যাপার মনে হয়, যা নিয়ে অত ভাবার কিছুই নেই। নিজের সাথে নিজেই থাকা, এর চাইতে ভালো সঙ্গ আর হয় না। অথচ তোমরা কিনা তোমাদের সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গটি থেকেই প্রতিদিন পালিয়ে বেড়াও! বাইরের চাকচিক্য তোমাদের এতটাই মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, তোমাদের মনে হয়, ওই খোলসটাই আসল।


তোমরা কী নির্দ্বিধায়, কী সহজেই প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে নিজেদের অপমান করে যাচ্ছ, অথচ অন্যেরা যখন তোমাদের কখনও কোনও কারণে অপমান করে, তখন সেটিকে তোমরা বড়ো করে দেখো। তোমাদের ঠিক কবে আর হবে সময়, নিজেকে দেবার মতো? এই যে তোমরা প্রতিনিয়ত নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে বেড়াও, তোমাদের আসলে তুমি নিজে ছাড়া আর কে আছে, সত্যি? নিজের আপন সত্তাটিকে দূরে ঠেলে আসলে তোমরা কোন মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছ? তোমরা আর কবে যাবে, নিজের কাছে? তোমরা আর কতটা বাধ্য হলে নিজের কাছে ফিরে আসবে? এতদিন তোমরা রাত কি ভোর, দেখোনি কিছুই। ভোর হলে তোমরা ছুটেছ পথে। রাত হলে ফিরেছ তোমাদের আটপৌরে আস্তানাতে। তোমরা সময় পার করেছ যেনতেনভাবেই। তোমাদের আর কী কী চাই, বলো? আর কত টাকা? আর কয়টা গাড়ি? ঠিক কতটা বাড়ি চাই, তোমাদের? তোমাদের আলমারিগুলো কাপড়ে ভর্তি, তবুও তোমরা প্রত্যেকদিন শপিংয়ে যাও। তোমাদের কসমেটিকস ব্রান্ডের হলেই কেবল হয় না, অনেক অনেক পরিমাণে চাই। তোমরা একটা মোবাইল খুব বেশিদিন ব্যবহার করতে চাও না, কিছু দিন পরই আবার নতুন চাই।


প্রত্যেকদিন তোমাদের ফ্রেন্ডস-পার্টি থাকবে, আজ বার্থডে তো কাল নববর্ষ, তার পর দিন আবার অন্য কিছু। এক একটা অনুষ্ঠানে তোমরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচা করো, অথচ তা-ও তোমাদের মনে হয়, বাদ পড়ে গেল কী যেন, কী যেন করাই হয়নি! তোমাদের অনেকেরই বাসায় বাজার নেই, খাবার নেই, অথচ তোমরা দামি নামি পোশাকের পাহাড় গড়ো! আচ্ছা, ওই পোশাকগুলো পরে কী করো তোমরা? একটা পোশাক একবারের বেশি কোনও অনুষ্ঠানে তো আর পরা যায় না, তাই না? তোমরা এয়ারকন্ডিশনড রুম না হলে ঘুমুতে পারো না। তোমরা চিকেনফ্রাই নয়তো চিকেনকারি ছাড়া খেতে পারো না। বিশেষ কোনও প্রয়োজন না থাকলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোমরা বাইরে কাটাও, অথচ ঘরে বাইরে তোমাদের বাবা-মায়েরা কী দুর্বিষহ এক একটা দিন পার করে! কখনও খোঁজ নাও টাকাটা কোথা থেকে আসে?


এই যে তোমরা বড়ো বড়ো সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর সেমিস্টার ড্রপ দিয়ে, রিটেক নিয়ে দুই-একটা সাবজেক্ট করে করে অবশেষে চার বছর পর কোনও একরকমে ডিগ্রিটা কমপ্লিট করো, তারপর তোমাদের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত বাবা-মায়ের কাছে বিজ্ঞ-বিচক্ষণ হয়ে উদয় হও। তখন তোমাদের নিয়ে তোমাদের বাবা-মায়েদের ভেতরেও একটা অহংকার জন্মে যায়। তোমাদের নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ কোথায় যেন উবে যায়! দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি, পৃথিবীর প্রতি তোমাদের দায়িত্বের কথা তোমরা ভুলে যাও। এদিকে তোমাদের প্রতিবেশি, তোমাদের দরিদ্র আত্নীয়স্বজন কারও প্রতিই তোমরা ভুলেও তাকাও না। কেননা তোমাদের একটা প্রেসটিজ আছে, তোমরা যার-তার সাথে কথা বলো কী করে? তোমরা যারা অনেক অনেক পড়াশোনায় ব্যস্ত, সেই তোমাদেরও সময় হয় না ওদের দিকে তাকানোর। অনেক অনেক উপরে উঠতে হবে তোমাদের। তোমাদের কেবল উপরেই উঠতে হবে, হাতে একটুও সময় নেই। তোমাদের আসলে কারও কোনও সময় নেই। ভোরের সূর্যোদয় দেখার সময় নেই, ভরদুপুরের রোদের খেলা দেখার সময় নেই, রাতের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখার সময় নেই। তোমার সবাই অনেক বড়ো বড়ো মানুষ হচ্ছ!


তোমরা আসলে কী করো? হয় তোমরা বাসায় এসে ফুল ভলিউমে গান শোনো, নয়তো স্কুল - কলেজ - ভার্সিটি - কোচিং - প্রাইভেট শেষ করে বাসায় এসেই অন্যদিনের পড়ায় বসে পড়ো। রিকশায় চড়তে হয় খুব কম, নয়তো হয়ই না, এজন্য রিকশাওয়ালা-মামাকে কখনও যে বেশি ভাড়া দিতে হয় অকারণেই মানবিক হয়ে, সে কথা তোমাদের জানা নেই। তোমাদের কেবল গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড আছে এবং তোমরা কেবল তাদেরকেই সারপ্রাইজ দাও। গরীবদের, অসহায়দের কখনও সারপ্রাইজ পেতে নেই। কেননা তোমরা ভুলে যাও, মানুষ তার জন্মস্থান নির্ধারণ করতে পারে না। আর এজন্যেই নিজের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সৌভাগ্যের কথা তোমরা খুব চটজলদিই ভুলে যাও। তোমরা ভালোবাসা, মায়া, সহযোগিতা, সহমর্মিতা এই সবই ভুলে যাও। তোমাদের কাছে ভালোবাসা মানে কেবল দামি দামি গিফট, নয়তো প্রিয়জনের সাথে সেক্স। তোমাদের কাছে ভালোথাকা মানে যতটা অন্যদের দেখিয়ে-টেখিয়ে ভালো থাকতে পারা যায়, মানে শোঅফ। নিজেই নিজেকে নিজের কাছে ধোঁকা দেওয়ার কৌশলটা ধীরে ধীরে তোমরা খুব নিপুণভাবে শিখে ফেলেছ।


তোমাদের কাছে বিশেষদিন মানে কেবলই বাড়িতে চাঁদের হাট বসিয়ে ঘরভর্তি দামি দামি ফার্নিচার দেখানো। তোমাদের কাছে অনুষ্ঠান মানেই ব্যয়বহুল কোনও রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া আর সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করা। কিছু লাইক - লাভ - ওয়াও রিঅ্যাক্ট দিয়েই তোমরা জীবনকে চিনতে শিখছ। তোমরা তোমাদের বাচ্চাদের দামি দামি খেলনা কিনে দাও, অথচ তোমাদের নিকটআত্নীয়ের পেটে একবেলা আহার জোটে না। তোমাদের বাচ্চাদের অনেকগুলো শিক্ষক দিয়ে ব্যস্ত করে রাখো, অথচ ওরা কী পড়ছে কী পড়ছে না, তার কিছুই খোঁজ নাও না, আর মূল্যবোধের শিক্ষা? সে তো তোমাদের নিজেদেরই নেই! তোমরা ছুটি কাটাতে দেশের বাইরে যাও। অর্থ তোমাদের উপরে এত মোটা একটা প্রলেপ পরিয়ে দেয় যে সেই প্রলেপ একটা সময় তোমাদের দম বন্ধ করে দিতে চায়। এত এত দেয়াল পেরিয়ে তোমরা কী করে যাবে তোমাদের কাছে?


তোমরা আসলে তোমাদের নিজেদের হারিয়ে ফেলেছ। তোমাদের ভেতরটা ফাঁকা-শূন্য, আর সেই শূন্যতাকে তোমরা বাইরের আবর্জনা দিয়ে ভরিয়ে রাখছ। তোমরা সব কিছুর মোড়ক উন্মোচন করো, অথচ নিজেকেই নিজের কাছে খুলে দেখোনি কখনও। এক একটা চনমনে দিন যায়, প্রকৃতি একা একাই নিজের সাথে খেলতে থাকে, নিজে নিজেই এক এক রূপে সাজতে থাকে, তারপর একসময় আকাশ ভেঙে সন্ধ্যে নামে। আবার রাতের আঁধার মাড়িয়ে প্রকৃতি সাজে এক ভিন্ন সাজে। অথচ তোমাদের এসবের কিছুই দেখা হয় না। আমার অবশ্য তোমাদের মতো অত তাড়া ছিল না, আমার করার যোগ্য গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ ছিল না, এজন্যই আমার ভীষণ সময় হতো এগুলো দেখার। আমার জানালার ধারে রোজ রোদমাখার, বৃষ্টিঝরা দেখার সময় হতোই! আবার ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর যখন হতো, তখন আমি চোখ ভরে আমার দৃষ্টিসীমার তীর পর্যন্ত তাকিয়ে থাকতাম। সারাবেলার ক্লান্তি মেখে রাতের চাঁদোয়া পেতে যখন নক্ষত্রেরা একে অপরের সাথে ফিসফিস করে গল্প জুড়ে দিত, আমি চেয়ে থাকতাম এই দুচোখের বাঁধভাঙা ঘুমে তলিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত। আমার পাশে বসে গল্প জুড়ে দেওয়ার মতো কেউ ছিল না।


আমি অবশ্য বরাবরই একটা ছোট্ট বোনের খুব অভাববোধ করেছি। ইস, আমার বড়ো বোনের মতো আমারও যদি ছোট্ট একটা বোন থাকত! তা হলে যখন তখন গল্প জুড়ে দিতাম, এটা ওটা ফরমায়েশ করতাম! আমার অবশ্য তোমাদের মতোই অনেক বন্ধুর মতো সহপাঠী ছিল, কিন্তু ঠিক বন্ধু বলতে যা বোঝায়, বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায়, তা তেমন কিছু না। আমি আসলে বরাবরই বন্ধুমহলে সবার পছন্দের হলেও অনেক অসামাজিক ছিলাম। তোমাদের মতো আমারও বন্ধুদের জন্মদিন আসত, তবে ওটা এলে হয় ভুলে বসে থাকতাম, নয়তো দুদিন আগে গিফটের প্যাকেটটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভিড় এড়াবার জন্যে আগে থেকেই কেটে পড়তাম। ওদের সাথে কখনও কেন যেন আমার মিলত না। ওরা কথা বলত, আড্ডা দিত, আর আমি ফ্যা ফ্যা করে তাকিয়ে থাকতাম, নয়তো হঠাৎই এমন একটা কথা বলে বসতাম যে ওরা সবাই হেসে মাটিতে গড়িয়ে পড়ত। আবার কখনও কখনও ভরাআড্ডায় কাউকে কিচ্ছু না বলে আস্তে করেই ওখান থেকে কেটে পড়তাম! এমন আজব একটা প্রাণীর সাথে কে বন্ধুত্ব করতে চাইবে, বলো?


এটা ওদেরই গুণ যে, ওরা আমার এই পাগলস্বভাব মেনেও আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখত, নিজে থেকেই যোগাযোগ করত। ওরা যখন আমাকে খুঁজত, তখন আমি কেবল একটা জিনিসই বুঝতাম, হয়তো ওদের আমার কাছে এখন কিছু সাহায্য চাই। নয়তো ওরা আমাকে সচরাচর এভাবে তো খোঁজেনি কখনও! আচ্ছা, এই যে আমি আমার সম্পর্কে এত আজেবাজে বস্তাপচা কথা বলে যাচ্ছি, আর তোমাদেরকে নিয়ে মজা করে যাচ্ছি, তোমাদের দোষ খুঁজে খুঁজে বের করছি, কেন বলো তো? কারণ তোমরা তোমাদের জীবনটাকে একটা গন্তব্য বানিয়ে ফেলেছ। তোমরা জন্মাচ্ছ, পড়াশোনা করছ, নয়তো অন্য কিছু করে টাকা কামাই করছ। তোমরা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছ, পার্টি করছ, চিল করছ, তারপর যা যা করে সবাই, মানে বিয়ে, সন্তান, গাড়ি, বাড়ি, বিলাসবহুল জীবনযাপন, দামি ফার্নিচার, সন্তানকে তোমাদের মতো করে দৌড়োতে শেখানো, তোমাদের মতো করেই বাঁচতে শেখানো, একটা ধর্মাচরণ-শিক্ষা নয়তো কোনও রকম টেনেহিঁচড়ে কাটিয়ে দেবার মতো একটা জীবন… এই তো! তারপর একটা সময় মৃত্যু। এছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য আছে তোমাদের? এমনই তো জীবনটা, বলো?


এই যে আজকে যেমন একটা পরিস্থিতিতে বাধ্যতামূলকভাবে পড়ে গেছ আর আটকে গেলে বলে ভাবছ, তা নিয়ে একটু ভেবছ? কেন এমন হচ্ছে? একাকিত্ব আঁকড়ে ধরছে, থাকতে পারছ না। নিজেকে নিজের বোঝা মনে হচ্ছে, আসলে কেন এমন হচ্ছে? এমন তো তোমাদের হবার কথা ছিল না, তাই তো? তোমরা কেউ কি ভেবেছিলে আজ এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে পড়বে, নিজের কাছেই আটকে যাবে? কেউ হয়তো ভাবোনি, কিন্তু কেউ কেউ হয়তো এমন পরিস্থিতির জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকে। আমাদের মাঝে কেউ কেউ সব সময় সব পরিস্থিতির জন্যেই প্রস্তুত থাকে। হয়তো তারা তোমার আমার মতো অত কিছু জানে না, কখন কোন পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে তা-ও বোঝে না, তবে পরিস্থিতি ভালো খারাপ যেমনই হোক, সেটাকে মেনে নিয়ে মানিয়ে নিয়ে চলতে ঠিকই জানে। তোমরা যেমন এখন ঘরে থেকে থেকে অস্থির হচ্ছ, এটা করছ ওটা করছ, একে জ্বালাচ্ছ ওকে জ্বালাচ্ছ, তেমনি অনেকেই আছে, যারা নিজেদের পেছনে সময় দিয়েই কূলকিনারা পাচ্ছে না। ওদের হাতে সময়ই নেই! ওরা সারাদিনই ব্যস্ত ওদের নিজেদের আনন্দের কিছু উপকরণ নিয়ে। শোনো, তোমাদেরও করার মতো অনেক অনেক কাজ আছে। যদি তোমরা সেগুলো শুরু করো, তবে দুমাসেও ফুরোবে না। তোমাদের চারপাশে একটু তাকিয়ে দেখো, অনেক অনেক কাজ পেয়ে যাবে। অবশ্য অলসরা কোনও কাজ খুঁজে পায় না। আসলে কাজ খুঁজে পাবার কিছু নয়, কাজ তৈরি করে নেওয়ার জিনিস।


জীবনটা একটা সংযুক্ত তালা-চাবির মতো। আমরা যদি কোনও বিশেষ কিছুতে সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে চাই, তা হলে সেই গন্তব্যটাই সব কিছু নয়। কারণ আমাদের সব কিছুই একটা ভ্রমণের মধ্য দিয়ে চলে। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিও সেই ভ্রমণেরই একটি অংশ। এখন আমরা হয়তো আমাদের ভ্রমণের একটা পোর্টে রয়েছি, কিছু দিন পর আবার এটি বদলে যাবে তখন হয়তো অন্য আর একটা পোর্টে থাকতে হবে। আজ যে বদ্ধ অবস্থায় আমরা পড়েছি, অবশ্যই তার একটি চাবি রয়েছে। সেই চাবিটাই খুঁজে বের করতে হবে। এমন অজস্র ভ্রমণ আমাদের জীবনে একটার পর একটা আসতে থাকে। আমাদের জীবনের প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্ত এক একটি ঘটনা, আর এই ঘটনা থেকে আমরা কে কতটা শিক্ষা নিচ্ছি, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনও খেলোয়ারের ক্ষেত্রে দুটো শব্দ খুব গুরুত্ব বহন করে---জয় এবং পরাজয়। এই জয় এবং পরাজয়ের মাঝামাঝি বলে কিছু হয় না। আর এটার সাথে আর একটা বিষয় যুক্ত হয়, সেটি হচ্ছে ‘ড্র’।


এই জেতা এবং হারা, এটি এমন একটি বিষয়, যা অন্য কিছু বিষয়ের সাথে জড়িত। পুরো ব্যাপারটাকে আমরা যদি একে ১ থেকে ১০-এর মধ্যে ধরি, তবে ১ হচ্ছে সবচেয়ে লো ম্যাচিউরিটি, আবার ৫ হচ্ছে অ্যাভারেজ ম্যাচিউরিটি, এবং ৯ বা ১০ হচ্ছে ম্যাচিউরিটি টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি, অর্থাৎ সর্বোচ্চ ম্যাচিউরিটি। একে যদি একটি সরলরেখার মাধ্যমে দেখানো যায়, তা হলে ১-৪ এর মধ্যে কেবল জেতা এবং হারা, ওখানে ওরাই আছে, যারা নিজেদের কেবল জেতা ও হারার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়। তারা মূলত জেতা অথবা হারা, এর বাইরে বা এর বেশি কিছু বুঝতে চায় না, ভাবতেও পারে না। তারা যদি জিতে, তা হলে তাদের মন খুশি থাকে, তারা সুখী থাকে; আর তারা যদি হারে, তা হলে মন খারাপ থাকে, তারা তখন অশান্তি ও অস্বস্তি অনুভব করে। ৫-এর উপর যারা যেতে পারে, তারা ক্রমেই সকল হার-জিতের ঊর্ধ্বে চলে যায়, এবং জীবনের উচ্চতর নানান দিক ও তাৎপর্যের সাথে তাদের প্রতিনিয়তই পরিচয় ঘটতে থাকে। এ এক আশ্চর্য আনন্দময় ভ্রমণ!


আমরা কখনও বিষয়টিকে এভাবে ভেবে দেখি না যে, এই জেতা আর হারা বিষয়টি সম্পূর্ণই তাৎক্ষণিক একটা অনুভূতি। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, যেদিন আমরা জিতি অথবা যেদিন আমরা হারি, সেই মুহূর্তটা আমাদের জীবন থেকে কত দ্রুত পালিয়ে যায়! তখন এটাকে কেবলই একটা ঘটনা মনে হয়। আবার যেদিন আমরা কোনও কিছুতে হেরে যাই, অথবা কোনও বিষয়ে কোনও কিছুতে আমরা সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হতে না পারি, তখন মনে হয়, সময়টা যেন কাটতেই চাইছে না। সময়টা যেন থমকে গেছে। এটা মনে হবার ব্যাপারটা তখনই আসে, যখন আমরা এটিকে গন্তব্য ধরে নেই। যখন কিছু জিনিস আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তখন সেটি কেবল আমাদের ভ্রমণেরই একটি অংশ। এটা আমাদের সারাজীবনের প্রাপ্তি নয়। সময় বদলাবেই যদি আমরা নিজেদের বদলাই। এভাবে করে দেখলে সেটাকে গ্রহণ করে নেওয়াটা অনেক সহজ হয়।


আমি আমার জীবনে এমন কিছু মানুষ দেখেছি, যাদের ঠিক কতটা টাকাপয়সা আছে, তারা নিজেরাই সেটা জানে না। তারা সেগুলো রাখার জায়গা না পেয়ে তাদের ঘুমোবার বালিশে পর্যন্ত টাকা ভরে রাখে। এই যে তারা এত পরিমাণ টাকা থাকা সত্ত্বেও আরও টাকা টাকা করে, এটাতে আসলে কতটুকু আনন্দ আছে? আমি তা ঠিক জানি না, কিন্তু আমি যেটা জানি সেটা হলো, একটা সময় এটা তাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। তারা ভাবতেই থাকে, আরও টাকা চাই, আরও টাকা চাই! টাকা একসময় স্রেফ কিছু সংখ্যায় পরিণত হয়। এটা তখন এক ধরনের নেশা---সংখ্যা দেখার ও গোনার নেশা। এটা ঠিক একটা সফটওয়ারের মতো। এটা চলতেই থাকে অক্লান্তভাবে, ওরা এখান থেকে আর বেরোতেই পারে না। এদের প্রচুর থাকা সত্ত্বেও এরা অসন্তুষ্ট। এরা, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মানুষকে বিশ্বাস করতে গিয়েও অনেক ভাবতে থাকে। আমরা প্রতারিত হতেই পারি, কিন্তু তাই বলে আমরা মানুষকে বিশ্বাসকরা ছেড়ে দেবো? এভাবে বাঁচা যায়? কতদিন যায়? যদি আমরা বিশ্বাস করে শেষপর্যন্ত হেরেও যাই, তারপরও আমরা আসলে কী হারাই?


আমরা যেদিন আমাদের মাথায় এই…আর একটু হলে ভালো হতো…সফটওয়্যারটা ইনস্টল করে ফেলব, সেদিন থেকেই আমরা নিশ্চিত জানব যে আমরা আজকের জীবনটাতে বেঁচে নেই, আমরা সব সময় ভবিষ্যতের জীবনটাতেই বাঁচছি। এবং, আমরা যখনই কেবল আমাদের আমাদের ভবিষ্যতের দিকে পড়ে থাকব, তখনই আমাদের চোখ সব সময় আমাদের ডানে বামে যেতে থাকবে। ধরো, তুমি এই মুহূর্তে যে ড্রেসটা পরে আছ, এখন এর চেয়ে দামি কোনও ড্রেস পরে কেউ যদি তোমার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, তখন তোমার মনে কী আসবে প্রথমেই? তখন তোমার মনে হবে, ইস্‌, আমার যদি ওই ড্রেসটা থাকত, তা হলে বোধহয় খুব ভালো হতো! অথবা আমাদের থেকে যারা ভালো আছে, যাদের আর্থিক অথবা অন্যান্য সব অবস্থা আমাদের থেকে তুলনামূলক বিচারে খুব ভালো, তাদের দেখে আমার মনে হবে, আহা, আমাদের যদি তাদের মতো ভালো অবস্থা থাকত! আমাদের জীবনটাও যদি তাদের মতো অমন করে ভালো হতো! কষ্টের শুরুটা কিন্তু এখান থেকেই। এ এক ধরনের স্বেচ্ছা-আরোপিত দারিদ্র্য!


আমার কথা হচ্ছে, স্রষ্টা এই মুহূর্তে আমাদের যা-কিছু দিয়েছেন, এটিকে আমরা কেন প্রচুর ভাবছি না? কেন বারে বারে নিজেকে অভাবী মনে করছি? কেন আমরা ভাবছি যে আমাদের আর একটু হলে ভালো হতো? ধরে নিই, আমি আমার জীবনে এই মুহূর্তে যা-কিছু পাচ্ছি, সেটা পৃথিবীর ৭০% মানুষেরই নেই বা তারা পাচ্ছে না, তা হলে কেমন লাগবে? আমরা কি জানি যে, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই স্পেসিফিক কিছু জিনিস রয়েছে, যেগুলো পৃথিবীর অন্য কারও মধ্যেই নেই? অবশ্যই তা আমরা জানি। তো এখন আমরা যদি আমাদের ভেতরের এই শক্তির খোঁজ না করে কেবল অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করতে থাকি, তা হলে সেটা আদৌ নিজের সাথে কতটা উচিত-কাজটি হচ্ছে? এই যে আমরা প্রতিদিন নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করতে থাকি, আসলেই কি এই পৃথিবীতে তুলনা বলে কিছু আছে? সত্যিই নেই। কেননা আমরা সকলেই এক একটা ভিন্ন শক্তি নিয়ে জন্মেছি। তুলনা করার ব্যাপারটাই সম্পূর্ণ আমাদের নিজেদের তৈরি বিষয়। আমাদের যার কাছে এই মুহূর্তে যা আছে, সেটাই সব থেকে ভালো, সব থেকে যোগ্য, সব থেকে সুন্দর, সব থেকে সেরা। যা দিয়ে আমার এই মুহূর্তে কাজ চলছে এবং ভালোভাবেই চলছে, সেটা নিয়ে মনের মধ্যে কখনওই কণামাত্রও অসন্তোষ তৈরি করার কোনও মানে নেই।


আমাদের প্রত্যেকেরই আমাদের জীবনের ভিন্ন বিস্তার বা ডাইমেনশনটা জানা উচিত। আমাদের এই দেশটা যখন স্বাধীন হবার জন্য যুদ্ধ করছিল, সেই দীর্ঘ নয়মাস কিন্তু যাঁরাই এই স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই একটা ভিন্ন ভিন্ন কাজ ছিল। তাঁদের প্রত্যেকেই একা একা তাঁদের যাঁর যাঁর নিজ নিজ কাজটুকুই করছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কি এটা ভাবতেও পেরেছিলেন যে তাঁদের একার কোনও কাজ আমাদের আজকের এই বিজয় এনে দেবে? কিন্তু তাঁরা সকলেই এটা জানতেন যে, কোনও একজন মানুষ এই দেশটাকে স্বাধীন করতে পারবে না। নিজেদের সবটুকু দিয়েই তাঁদের প্রত্যেকেই সেই বিন্দুর মাঝেই সিন্ধু খোঁজা শুরু করেছিলেন। সেসময় প্রত্যেকটা মানুষ ভেবেছিলেন, বিশেষ করে কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করেছিলেন যে, আমার জীবন যদি চলে যায় তো যাক, তবুও শেষপর্যন্ত আমার দেশ আর আমার জাতির জন্য, আমার দেশের স্বাধীনতার জন্য আমি লড়াই করে যাব। আমরা যদি কেবল ভাবি যে আমরা যে স্বাধীনতাটা পেয়েছি, সেটা পেতে আমাদের লেগেছে অন্তত নয়মাস, যদিও এর প্রস্তুতিপর্বের সূচনাব্যাপ্তি ছিল এর চেয়েও অনেক অনেক দীর্ঘ, বিশেষ করে ভাষাআন্দোলনের পর থেকেই যে জাতিগত একতা, যে সত্তার প্রয়োজনীয়তা, যে মানুষের সমতা, যে একটা স্বীকৃতির অভাব আমরা অনুভব করেছিলাম, সেখান থেকেই কিন্তু এর সূচনা এবং পর্যায়ক্রমে এসবের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ও বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কিন্তু আমরা আমাদের চূড়ান্ত স্বাধীনতাটা পাই।


আমি কথাটা আসলে কেন টানলাম এখানে? কারণ আমরা কোনও ভালো একটা বিষয় গ্রহণ করতে ঠিক যতটা সময় নিই, তার চেয়েও অনেক অনেক কম সময়ে আমরা একটা খারাপ, একটা নেগেটিভ বিষয় ছড়িয়ে দিই---নিজের মধ্যে, অন্যের মধ্যে। আমরা যদি বিষয়টাকে এভাবে দেখি, যুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধে নেমেছিলেন, তাঁদের যাঁর যাঁর বাসা থেকে, তাদের যাঁর যাঁর পরিবার থেকে কি প্রথমেই কোনও সাপোর্ট দেওয়া হয়েছিল? অথবা কতজনের পরিবার থেকে অনায়াসেই যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল? প্রথমেই তাদের পরিবার কী বলেছিল? বলেছিল, কোনও দরকার নেই অথবা এক কথায় ‘না’ করে দিয়েছিল। হয়তো বলেছিল, তুমি একা একা কী করবে? তুমি একাই কি দেশকে স্বাধীন করবে? অথচ পরবর্তীতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষই কিন্তু জীবন দিয়েছিলেন। তখনকার দিনের নারীদের আজকের চেয়ে হাজারগুণ বেশি রেস্ট্রিকশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তা সত্ত্বেও তাঁরা বিভিন্নভাবে দেশের জন্য কাজ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন, এমনকি অকল্পনীয় রকমের দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই তাঁরা তাঁদের পুরো জীবন অতিবাহিত করেছেন। তাঁরা কিন্তু স্বেচ্ছায় অমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।


আজ একটা ছোট্ট ভাইরাস কোনও অস্ত্র ছাড়াই কত দ্রুত যুদ্ধঘোষণা করে দিল! অথচ দেশকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ কেবল এক প্রতিরক্ষা সেক্টরেই ব্যয় করা হয় বা এই সেক্টরকে আরও শক্তিশালী করার জন্য চেষ্টা করা হয়, তার কতটা অংশ চিকিৎসা সেক্টরে ব্যয় করা হয় বা ওটা নিয়ে গবেষণার পেছনে চেষ্টা করা হয়? আসলে আমরা যতটা পারি, ব্যয়গুলোকে ততটা সামঞ্জস্য রেখে খরচ করলে হয়তো আজকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে সমস্যার মুখোমুখি আমরা হয়েছি, তার তুলনায় হয়তো কিছুটা কম ঝুঁকি পোহাতে হতো। আমি এর মাধ্যমে এদেশের প্রতিটি পর্যায়ের মানুষের সামগ্রিক সেবার বিষয়টা আসলে কোন পরিস্থিতিতে আছে, সেটাই বোঝাতে চাইছি। অথবা কী করলে কী হতে পারত, সেটা বোঝাতে চাইছি।


আমরা কি জানি আসলে কী আমাদের এই জীবনটাকে পরিবর্তন করে দেয়? আমাদের এই জীবনটাকে বড়ো কোনও জিনিস পরিবর্তন করে না, খুব সামান্য একটা জিনিস, খুব সামান্য একটা বিষয়ই আমাদের জীবনটাকে পরিবর্তন করে দেয়। এত বিশাল দৈত্যাকৃতির টাইটানিক জাহাজটি ডোবার জন্য কিন্তু বড়ো কিছুর প্রয়োজন পড়েনি, প্রথমে কেবল ছোট্ট একটি ছিদ্র হয়েছিল একটা হিমশৈলীর সাথে ধাক্কা লেগে এবং পরে এটি বড়ো আকার ধারণ করে আস্তে আস্তে পুরো জাহাজটিকেই ডুবিয়ে দেয়। এই ভাইরাস, যেটি আজ আমাদের ঘরের ভেতর বন্দি করে ফেলেছে, পুরো পৃথিবীকে শান্ত করে দিয়েছে, এটা দেখেও এরপরও কি আপনি বলবেন যে আমাদের এই ছোট্ট চড়ুইপাখির জীবনটাকে পরিবর্তনের জন্য আমাদের অনেক বড়ো কোনও পরিবর্তনের আশা করা প্রয়োজন? কখনওই নয়।


এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে আমাদের জীবনে সফল হবার জন্য সব সময় বড়ো কোনও পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। ছোট্ট কোনও কারণকেও আমরা বড়ো পরিবর্তনে পরিবর্তিত করতে পারি। সুতরাং যদি তুলনা করতেই হয়, তবে নিজের গতকালকের অবস্থা ও অবস্থানের সাথে আজকের তুলনা করুন। আজ থেকে ঠিক তিন মাস আগে আপনি কেমন ছিলেন, আর আজ আপনার ভেতর কী কী ভালো এবং নতুন পরিবর্তন এসেছে, সেটি দুইয়ের তুলনা করলেই নিজের উন্নতি কি অবনতি, ঠিকই টের পেয়ে যাবেন। আপনি আপনার শক্তি আর দুর্বলতা, এই দুটোকে যদি পাশাপাশি রাখেন, আর ভাবেন, কোনটা আগে কী ছিল, আর এখন কেমন আছে, তা হলেই টের পেয়ে যাবেন। আপনি যদি একটু খোলামন নিয়ে চিন্তা করে থাকেন, তা হলে আপনি দেখতে পাবেন, আপনার শক্তি কিন্তু আসলে বাড়ছে।


আমি একটা কথা জানি, যা আমাকে আমার এক শিক্ষক শিখিয়েছিলেন। উনি বলতেন, যখনই তুমি তোমার স্টুডেন্টকে কোনও শিক্ষা দেবে, তখনই ভাববে যে, সে তোমার থেকে বড়ো হতেও পারে অন্য কোনও ফিল্ডে, এবং এটা মাথায় রেখেই তাকে শিক্ষাদান করবে। আসলে আমরা আমাদের জীবনে সামনে এগোনোর জন্যে কত কিছু খুঁজতে থাকি, কতশত বার আমরা বলি ‘ইস্‌, আমি যদি ওই সুযোগটা পেতাম!’ আসলেই কি এটা উচিত? অথবা এটা কতটা প্রয়োজন? আমাদের নিজেদের মধ্যেই যা যা ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলি নিয়ে আমরা ভাবি না কেন? আমাদের জীবনে সামনে এগোনোর জন্য অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করার কোনও প্রয়োজন নেই। যেটা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে, নিজের সাথে নিজে আমরা কতটা সংযুক্ত হতে পারছি। কতটা আমরা আমাদের নিজেদের সাথে আমাদের নিজেরদেরই যোগাযোগদক্ষতা বাড়াতে পারছি। আমরা যদি আমাদের ভাবনার ধারণক্ষমতাকে ১ থেকে ১০-এর মধ্যে ধরি এবং এতে যদি আমাদের ধারণ ক্ষমতা বর্তমানে ৩ থাকে, তা হলে আমরা যদি আমাদের ভাবনার সেই ধারণক্ষমতাকে ৬-এ বাড়িয়ে দিই অথবা ৯-এ বাড়িয়ে দিই, তখন সেই ক্ষমতা কতটা বৃদ্ধি পাবে? কখনও ভেবেছি এভাবে?


প্রতিদিন যদি আমরা শরীরচর্চা করি, তবে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাগুলো ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। আমাদের সক্ষমতাগুলোও একইসাথে বাড়ে। আমাদের এই জীবনে প্রায় সবারই দুই-একবার চিকেনপক্স হয়েছে, অনেকে একে গুটিবসন্ত বলে থাকি। তো বেশির ভাগ মানুষেরই এটি সারাজীবনে একবার হয়, কিন্তু অনেকেরই এটি দুইবার কিংবা তার বেশিও হয়। যাদের একবারের বেশি হয়, তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম হবার জন্যেই এমনটা হয়। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যেটি দেখা যাচ্ছে, সেটি হচ্ছে, এটির বাহ্যিক শক্তি তখনই কঠিন আকার ধারণ করছে, যখন আপনার ভেতরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম। বাহ্যিক চাপ যদি বেশি হয়, আর আপনার ভেতরের শক্তি যদি তার থেকে কম হয়, তা হলে এটি আপনার ভেতরের শক্তিকে হারিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা যদি আমাদের ভেতরের শক্তিকে বৃদ্ধি করতে পারি, তখন আর কোনও বাহ্যিক শক্তি এসে আমাদের ভাঙতে পারে না। আর এই ভেতরের শক্তিটাকে সচেতনতার সাথে বৃদ্ধি করতে হয়। এটা একদিনে হয় না। এটা নিয়ে আমরা কখনও ভেবেছি কি? আমরা কেন ধরেই নিই যে আমাদের কখনওই খারাপ কিছু হবে না? এটা আগে থেকেই কিছুটা ভেবে নিলে কিছু না কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার চিন্তাটা মাথায় আসে। এতে করেই আমরা যেকোনও পরিস্থিতি, যেকোনও পরীক্ষা উতরে যেতে পারি।


যেকোনও বড়ো পরিবর্তন যদি আমরা চাই, তা হলে আমাদের ছোট ছোট জিনিসকে গুরুত্ব দিতে হবে। একটা সরলরেখা হাজার হাজার বিন্দুকে যোগ করার ফলেই তৈরি হয়। সেই হাজার হাজার বিন্দুগুলোর কয়েকটি সেটকে একত্রিত করে আরও বড়ো একটা সরলরেখা তৈরি হয়। বিন্দুগুলো একটার সঙ্গে আর একটা এমনভাবে মিলে থাকে যে সেটি সরলরেখায় রূপ নেয়। আপনি যেকোনও জিনিসকে বড়ো করে না দেখে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে দেখুন, তা হলে দেখবেন, যেকোনও সমস্যারই সমাধান আছে। অন্য কারও জীবনের সাথে নিজের জীবনটাকে মিলিয়ে দেখতে গেলে সমস্যা বাড়েই শুধু, কমে না। যদি তুলনা করতেই হয়, তা হলে আপনার ছোটবেলার সাথে বড়োবেলার তুলনা করুন, দেখবেন, আপনি ছোটবেলায় অনেক ইউনিক ছিলেন। কারণ ছোটবেলায় আপনি আপনার চারপাশে কোনও দেয়াল রাখেননি। আপনার বিশ্বাস করার ক্ষমতা তখন খুব বেশি ছিল। আপনি সে সময় কোনও কিছুকেই অসম্ভব ভাবতেন না। আপনার মনে তখন কোনটা সম্ভব আর কোনটা অসম্ভব, এমন কোনও প্রশ্নই আসত না।


কিন্তু যতই আপনি বড়ো হতে থাকলেন, ততই আপনার মন আপনার সব কাজের একটা উদ্দেশ্য খুঁজতে থাকল। বেনিফিটের নেশায় আপনি জীবনের সহজ স্বাভাবিক আনন্দের খোঁজ না করে বরং কোন কাজটি করলে আপনার বেনিফিট আসবে, সেই কাজে ডুবে গেলেন। আপনি তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনার সব কিছুরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন, যেমন আমরা কী খাব, আমরা কী কথা বলব, আমরা কোথায় যাব, ইত্যাদি ইত্যাদি। এত কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমরা একটা সময় নিজেকে সম্পূর্ণ ভুলে যাই, নিজেকে অবহেলা করতে থাকি। আমরা আমাদের খাদ্যাভাসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি, যা কিনা আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর, সেগুলোই খাওয়ার অভ্যাস করে ফেলি। আমাদের শরীরকে অবহেলা করতে থাকি। আমাদের মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায়, এমন অনেক কাজও আমরা করি। এবং এই জিনিসগুলো একটা সময় পুরোপুরি আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তখন আমাদের নিজেকে তাৎক্ষণিকভাবে চাইলেও আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। তো যখন এমন হয়, তখন আরও স্থির হতে হবে, আরও ধৈর্যের সাথে আস্তে আস্তে সব কিছু আবারও নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এটি কখনও একদিনে সম্ভব নয়।