আয়ুর অসহায়ত্ব

আপনি কি জানেন, জীবনটা একটা সাপলুডুর বোর্ডের মতন? যে গুটির চালে ম‌ই বেয়ে উপরে উঠে যান, ঠিক একই গুটির চালে সাপের মুখে পড়ে নিচেও নেমে যান। বড়ো চালেও যেমন সাপের মুখে পড়তে পারেন, ঠিক তেমনি ছোটো চালেই ম‌ই বেয়ে তরতরিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যেতে পারেন। এখানে সবচাইতে বেশি মানেই সবচাইতে ভালো নয়, সবচাইতে কম মানেও সবচাইতে খারাপ নয়। জীবনে আমরা বেশি পেয়েও সব হারাই, আবার কম পেয়েই সব পাই।

আপনি যতই ভালো খেলোয়াড় হন না কেন, দেখবেন, জিততে জিততে অনেকসময় হেরে বসে আছেন। আবার, অদক্ষ খেলোয়াড়ও হারতে হারতে শেষ মুহূর্তে জিতে যায়। সবসময় দক্ষতার মাপে জীবন চলে না। জেতার নাম জীবন নয়, যাপনের নাম‌ই জীবন।

জীবনের এই যে হারজিত, এই যে পাওয়া না পাওয়ার দ্বিধাদ্বন্দ্ব, এত কিছুর পরও জীবন কি কারও থেমে থাকে? থাকে না, কখনো কখনো থমকে যায় শুধু। তবে হ্যাঁ, জীবন থেমে না গেলেও কোথায় কোথায় কী কী যেন থেমে যায়। তখন সব কিছুই কনফিউজিং লাগে। বাঁচতে গিয়েও মনে প্রশ্ন জাগে: আদৌ বেঁচে আছি তো?

কারও সুখ থেমে যায়, কারও হাসি থেমে যায়, কেউ মধ্যরাতে অভ্যস্ত সুরে বিলাপ করা কিংবা একেবারেই সংগত কান্নাটুকুও থামিয়ে দেয়, কেউ নিজের জন্য বাঁচা থামিয়ে দেয়, কেউবা ভালোবাসা-বাসি থামিয়ে দেয়। থামাতে না চাইলেও কীভাবে যেন ঠিক‌ই থেমে যায়।

মানুষ মূলত এখানেই মরে যায়। এখানটাতেই মানুষ মূলত হেরে যায়।

আপনি চলছেন-ফিরছেন, খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, সব কাজ ঠিকঠাক নিয়মেই করছেন, সব দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালন করছেন, সবার পছন্দের দাম মেটাতে গিয়ে রীতিমতো নিখুঁত হয়ে গেছেন একদম রোবটের মতন। কিন্তু আপনি যে ভেতরে ভেতরে মরে গেছেন, মানুষ তা সহজে টের পাবে না। যাদের জন্য রক্ত জল করে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাদের সময়‌ই নেই আপনার এই আত্মিক মৃত্যু নিয়ে ভাবার। সব ছেড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে, কিন্তু পারবেন না। এর নাম আয়ুর অসহায়ত্ব।

তারপর, অনেক দিন পর কিংবা হুট করে একদিন যখন আপনার শরীরের মৃত্যু হবে, সেদিনটাকে আপনার মৃত্যুবার্ষিকী ধরে প্রতিবছর আপনার মৃত্যুদিবস পালন করবে সবাই। অথচ আপনি যে সেই কবেই কত বছর আগেই জীবিত থাকতেই প্রথম একদিন মারা গেছেন, সেটা আর কেউ কখনোই কোনোদিনও জানতে পারবে না . . . এক আপনি বাদে। অথচ নিজের মৃত্যুতে কাঁদার অধিকারটুকুও আপনার নেই। জরুরি ছিল নিজের মৃত্যু দেখে কষ্টে কাঁদা, অথচ মানুষ কাঁদতে পারে কেবল অন্যের মৃত্যু দেখে।

মানুষ মৃত ব্যক্তিকে যতটা ভালোবাসে এবং যত্নে রাখে, তার ছিটেফোঁটাও মানুষটা বেঁচে থাকা অবস্থায় করে না। করত যদি, তাহলে হয়তো অনেক মানুষকেই মৃত্যুর আগেই মরতে হতো না। জীবনকে তাই মৃত্যুর আগেই উপভোগ করুন; জেনে রাখুন, আপনার কষ্টে আপনার প্রিয় মানুষগুলোর তেমন কিছুই এসে যায় না। ওরা আপনার ভালো চায়, কিন্তু কী করলে আপনার ভালো হয়, সেটাই ওরা জানে না, কিংবা জানলেও ওদের তা পছন্দ না হলে মানতে চায় না।

আসলে আমাদের কেউ চায় না, আমাদের কাছ থেকে পাওয়া সুখ বা স্বাচ্ছন্দ্যটুকুই শুধু সবাই চায়।