: বাবা, দেখো তো, এই সার্টিফিকেট দুটো কীসের?
: দেখি এদিকে দে …………… (চশমা চোখে দিয়ে দেখলেন কিছু সময় ধরে) ও আচ্ছা, এগুলি কিছু না। এগুলি এখনও আছে? কোথায় পেলি?
: তোমার পুরনো সার্টিফিকেটের ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে।
: এগুলি কিছু না, বাবা। এসব কাউকে দেখাস না, ওই ঝুড়িতে ফেলে দে।
: কেন বাবা? ফেলে দেব কেন? এখানে তো লেখা আছে, তুমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলে।
: আরে না! আমি ওসব কিছু করিনি। কাউকে বলিস না এটা। ফেলে দে ফেলে দে! তোকে কে বলল এসব? তোর মা?
: না না, মা তো এই কাগজগুলির ব্যাপারে জানতই না কিছু। আমরা আজকে হঠাৎ করে পেলাম।
: এখানে যা লেখা আছে, তা সত্যি না। আমি যুদ্ধ করিনি। যুদ্ধ করেছিল আমার বন্ধু ইরফান।
: উনি কে?
: ওওও……..ই আমাদের থানার হাই-কমান্ড ছিল। অনেক সাহসী ছেলে!
: তা হলে এখানে তোমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লেখা আছে কেন?
: ওটা অনেকদিন আগের কথা, বাবা। আমার অত সাহসটাহস ছিল না। যুদ্ধ করতে অনেক সাহস লাগে।
: এর মানে, তুমি এমনিএমনিই ওই সার্টিফিকেট নিয়েছিলে? কিন্তু, কেন?
: ওরকম আরকি! আমি প্রতিদিন গ্রামে-গ্রামে গিয়ে লোকের বাড়ি থেকে খাবার, কাপড় চেয়ে চেয়ে নিয়ে আসতাম। ওইসময়ে মানুষ অনেক ভাল ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু চাইলেই দেওয়ার চেষ্টা করতো। সেগুলি এনে প্লাটুনে জমা দিতাম। আর অস্ত্রশস্ত্র নানান কায়দায় লুকিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পৌঁছে দিতাম। আর তেমন কিছু করিনি। ওইটুকু তো সময়ের দাবি ছিল সে-সময়।
: বাবা, এটাও তো এক ধরনের যুদ্ধ, তাই না? আচ্ছা, কখনও ধরা পড়োনি?
: একবার কিছু লোক আমাকে অস্ত্রসহ ধরে ফেলেছিল। হারামজাদারা রাজাকার! পেছনে হাত বেঁধে ওদের ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছিল। পথের মাঝখানে ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় প্রস্রাব করার কথা বলে কৌশলে খালে ঝাঁপ দিয়ে ডুবসাঁতার দিয়ে পালিয়ে গেছি। হাহাহাহাহা………
: তা হলে? তোমার তো রিস্ক ছিলই! তাই না?
: আরে না! তোরা তো যুদ্ধ দেখিসনি, তাই বুঝতে পারছিস না, সে-দিনগুলি কেমন ভয়ংকর ছিল। যুদ্ধ মানে, একেবারে অস্ত্র নিয়ে জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়া। আমি তো বাবা গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে ওসব করতাম। ওসবে কি আর কিছু হয় নাকি?
: কী যে বল বাবা! ওটারও তো দরকার ছিল ওইসময়ে।
: না না! তোরা জানিস না। ওইসময়টা ছিল জীবন নিয়ে খেলার সময়। আমার অত সাহস ছিল না, বাবা। ভাবলে আফসোস হয়, কেন অন্তত একটা হলেও যুদ্ধে গেলাম না!
: বাবা, এই যে এই সার্টিফিকেট দুটো ছিল তোমার কাছে, তুমি তো চাইলেই এগুলি দেখিয়ে একটা মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিতে পারতে।
: আমাকে যদি জিজ্ঞেস করত, তুমি যুদ্ধে গেলে না কেন, তা হলে তো লজ্জা পেতাম। কী দরকার!
: এখানে তো আর লেখা নেই যে তুমি যুদ্ধে যাওনি। বলে দিলেই হতো, দুএকটাতে অংশ নিয়েছিলে!
: ছিঃ! ওটা হয় নাকি? কিন্তু কেন? এতদিন পর এসব কথা কেন? কী করবি সার্টিফিকেট দিয়ে?
: পাপ্পু তো সামনে বিসিএস দিবে। ওর কাজে লাগত।
: কী কাজে? (বাবা, সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সম্পর্কে জানেন না।)
: সার্টিফিকেট দেখালে চাকরি পেতে একটু সুবিধে হয়।
: কেন? তুই চাকরি পাসনি? তখনও তো সার্টিফিকেট ছিল না। এখন কেন? আর এই দুটো কাগজের কথা তো আমার মনেও ছিল না।
: আহা বাবা, সেটা না! ওটা থাকলে একটু সহজ হত আরকি!
: যে জিনিস আমি নিজেই লজ্জায় নিইনি, সে জিনিসের উপর তোদের এত লোভ কেন? পাপ্পুর নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেতে ইচ্ছে করে না?
: তুমি নাওনি, হয়তো তুমি এটার ভ্যালু বুঝতে পারনি বলে। অনেকেই তো নিয়েছেন, তাই না? কাজেও লাগছে।
: হাহাহাহাহা………… শোন, আমি সে-সময় যুদ্ধে না গিয়ে ভুল করেছি। সার্টিফিকেট নিয়ে একই ভুল আবারও করাটা ঠিক হত না।
: আচ্ছা বাবা, মেজো কাকুও তো সার্টিফিকেট নেয়নি। নিলে তো সৌরভের কিছু সুবিধা হতো। (সৌরভ আমার কাকাতো ভাই।) কাকু আর্মসট্রেনিং নিয়েছিল না?
: হ্যাঁ হ্যাঁ, শ্রীধাম অস্ত্র চালাতে পারত। আমাদের কারও কথা না শুনে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে যুদ্ধে গিয়েছিল। কয়েকটা যুদ্ধও করেছে। পরে একটা ফ্রন্ট ব্যাটেলে ওর পাশেই ওর এক স্কুলফ্রেন্ড গুলি খেয়ে মারা যায়। এরপর ও আর ভয়েই যুদ্ধ করেনি। পালিয়ে এসেছে।
: ঠিক আছে। তার মানে, কাকু তো যুদ্ধ করেই মুক্তিযোদ্ধা! কাকু তো সার্টিফিকেট নিতে পারত!
: হ্যাঁ পারত। ও নেয়নি আক্ষেপ থেকে। ও সবসময়ই এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগত। যুদ্ধ নিয়ে তোদের সাথে কখনও কিছু বলেছিল?
: না বাবা, কাকু কখনওই কিছু বলেনি তো!
: বলবে না, বলার কথাও না। ও কাউকে কিছু বলে না, বলতে লজ্জা পায়।
: আচ্ছা বাবা, এখানে লেখা আছে, আমাদের গ্রামের নাম বানাতলি, ডাকঘর ছুফিয়া মাদ্রাসা। এটা ভুল না? আমাদের গ্রামের নাম তো মধ্যম মুরাদপুর, ডাকঘর মলিয়াইশ।
: যুদ্ধের ওইসময়ে নাম ভিন্ন ছিল।
: ও আচ্ছা। বাবা, এখানে যে থানা হাই-কমান্ড ইরফানুল হক সাহেবের সিগনেচার আছে, উনি কে?
: ও-ই হল ইরফান, আমার বন্ধু। অনেক সাহসী ছেলে ছিল, বাঘের মত হুংকার দিত! আমাকে বলত, তুই যুদ্ধ করতে পারবি না। তুই আমাদেরকে অন্যভাবে হেল্প কর। ও-ই বলে দিত কী কী করতে হবে।
: উনিই তোমাকে সার্টিফিকেট দুটো ইস্যু করেছিলেন?
: হ্যাঁ, সেসময় সবাই সার্টিফিকেট নিচ্ছিল। যারা ক্যাম্পে যেত, কিছু করত না, শুধু খাওয়াদাওয়া করত, ওরাও নিয়েছিল। আমিও নিয়ে নিলাম আরকি! যদি কখনও কোনও কাজে লাগে, সে-আশায়। পরে মনে হল, এটা ঠিক হয়নি।
: আচ্ছা বাবা, ক্যাম্পে গেলে খাওয়া যেত?
: হ্যাঁ, যেত। অনেক খাবার আসত। আমরা সবাই মিলে খেতাম। অনেকেই শুধু খেতে যেত। ওদেরকে নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। ওরা কোনও কাজই করত না, ফাঁকি দিত। ওদেরও সার্টিফিকেট আছে।
: তোমার নেই কেন? তুমিও তো একটা নিতে পারতে!
: বাবা, ঈশ্বর যাকে যতটুকু দরকার, তাকে ততটুকুই দেন। এর বেশি দিয়ে আমি কী করব?
: আচ্ছা, তুমি নাকি যুদ্ধের সময় টিউশনি করতে আর টিউশনি থেকে যে টাকা, খাবার আর কাপড় পেতে, সেটা ক্যাম্পে দিয়ে আসতে? মা বলল।
: হ্যাঁ, করতাম করতাম। কিন্তু না না, অত দিতাম না! নিজের খরচ চালাতেই টিউশনি করতাম। তোর মা শুধু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে।
: আচ্ছা। বাবা, তোমার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বন্ধুদের কথা মনে পড়ে?
: (বাবা হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে………) পড়ে। অনেকে তো যুদ্ধেই মারা গেছে। ওরা তো আর আমার মত কাপুরুষ ছিল না, সাহসী ছিল, যুদ্ধ করেছে। পঙ্গু হয়ে গেছে অনেকেই। এর মধ্যে অনেকে মারাও গেছে। অনেকেরই কোনও খবর জানি না। আমার বয়স হয়ে গেছে, বাবা। আমিও একদিন ওদের কাছে চলে যাব। তোদেরকে সুখী দেখে যেতে পারলেই আমি খুশি। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। ঈশ্বর আমাকে অনেক দিয়েছেন; আমার যোগ্যতার চাইতেও বেশি দিয়েছেন। সব তাঁর কৃপা।
দেখলাম, বাবার চোখে জল, দৃষ্টি ঘোলাতে হয়ে এসেছে। চশমাটা খুলে ডানহাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছছেন। আর কথা বাড়ালাম না। পাশের রুমে গিয়ে মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলাম।
আজকে সকালে ঘুম থেকে উঠে স্রেফ কৌতূহল থেকেই বাবার পুরনো কাগজপত্র, অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ তিনটা কাগজ চোখে পড়ল।
একটি বাংলায়; পূর্ণ নামঠিকানা সহ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাবার পরিচয়পত্র। তারিখ লেখা : ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ইংরেজি (খুব সম্ভবত, সিগনেচারের নিচে ভুল তারিখ দেয়া)। দ্বিতীয়টি, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা মুক্তিবাহিনির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্বপালন করেছেন, এ মর্মে একটি সার্টিফিকেট। তারিখ লেখা : ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। দুটোই মিরসরাই থানা গেরিলাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্সের ইনচার্জ থানা হাই কমান্ড ইরফানুল হকের স্বাক্ষরিত। তৃতীয়টি, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার পৈতৃক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তিনি ও তাঁর পরিবার লুটপাটের শিকার হয়েছেন, বাবার আপন কাকাকে রাজাকার-বাহিনির সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছে ও গুলি করে হত্যা করেছে, বাবা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত, এমন কিছু কথাসম্বলিত প্রত্যয়নপত্র।
বাবা চাইলেই খুব সহজেই একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। কেন করেননি, সেটার অকপট সরল স্বীকারোক্তি শুনে শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়ে গেছে। আমি এ জীবনে সবচাইতে ঘৃণা করে এসেছি, ঘৃণা করি এবং আজীবন ঘৃণা করে যাব সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে বিষয়টাকে, সেটি হল, হিপোক্রিসি। আজকে বুঝলাম, কীভাবে করে কিছু কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রক্ত থেকেই চলে আসে।
আমাদের বাবা এমন একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যাঁর কোনও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেই। আমাদের বাবা, আমাদের অহংকার। বাবার মতন বড় কখনওই হতে পারব না।
আসলে, ঈশ্বর সবাইকে সবকিছু দেন না। ঈশ্বর মানুষ বুঝে সৌভাগ্য দান করেন।