আমায় জাগালে যখন

আমি যে তোমাতে রয়েছি, তুমি যে আমাতে রয়েছ, এতে আর আমার সংশয় নেই। আমি তোমাতে, তুমি আমাতে; আমি তোমার, তুমি আমার… এ ছাড়াছাড়ি হবার নয়। ছাড়াছাড়ি হওয়া যে অসম্ভব… এ তো রীতিমতো দিব্যচক্ষুতে দেখছি। আমি তোমায় ভুলি, ক্রমাগতই ভুলি, কিন্তু এই ভোলাতে তোমার আমার মেশামেশি, তোমার আমার অভিন্নত্ব কখনোই ঘোচে না। আমি তোমায় ভুলেও তোমাতেই থাকি, তোমার দৃষ্টির ভেতরেই থাকি। আমার ভালোবাসা ক্ষণিক—এই আছে তো এই নেই।





আমি যখন তোমায় মনে করি, তোমায় দেখি, তখনও ভালো করে ভালোবাসতে পারি না। আর তোমায় নিয়ে যে সারাদিন কাটাব, তা তো হয়ই না। কিন্তু তোমার ভালোবাসা তো আর এমন ক্ষণিক নয়, এমন তরল‌ও নয়। এই যে তোমার দৃষ্টি আমার উপর, এতে আমি প্রেম দেখছি। এই যে তোমার ব্যস্ততা আমার জন্যে, এতে আমি প্রেম দেখছি। এই তোমার প্রেম একেবারে আমার প্রাণের ভেতর। আমার প্রাণ যেমন সত্য, তুমি আমার প্রাণ, এ যেমন সত্য, তুমি আমায় ভালোবাসো, এ-ও তেমনি সত্য।




এই তোমার ভালোবাসা, এই তোমার আমার প্রতি আপন ভাব, আমার ভালোবাসার জন্যে, সুখের জন্যে, সুখের চেয়ে আরো ভালো জিনিসের জন্যে তোমার সকল ব্যস্ততা। সেই ভালো জিনিস তুমি নিজে। তোমায় আমি জানি, তোমায় আমি চিনি, তোমায় আমি আপন মনে করি, তোমাতে আমি ডুবে থাকি, মজে থাকি---এ সব‌ই আমার সবচেয়ে ভালো জিনিস। এই জিনিস আমি সকল সময় চাই না; অনেকসময়ই কেবল বাইরের দেখাশোনা, কথাবার্তা, সে-সকল সুখ নিয়ে থাকি। সে অবশ্য আমার অন্য খেলা।




তুমি আমাকে অনেক খেলা করতে দাও। কিন্তু খেলার ভেতরেই মনে করিয়ে দাও যে, এ নিছকই খেলা, খেলা ছেড়ে তোমার কাছে যেতে হবে, তোমায় দেখতে হবে, তোমায় আপন ভাবতে হবে, তোমাতেই তন্ময় হতে হবে। অনাদি ঘুম থেকে জাগিয়েছ এই দেখার জন্যে, এই মঙ্গল সম্ভোগ করবার জন্যে। এর চেয়ে মঙ্গল আর নেই। এই মঙ্গল দেবার জন্যেই তুমি ব্যস্ত। ব্যস্ততাটা বুঝি না অতিরিক্ত খেলায় মত্ততার জন্যে। কিন্তু খেলা ভাঙলে ঠিক‌ই বুঝি। বুঝি, সে খেলার মধ্যেও ব্যস্তই ছিলে। আমার জীবনের লক্ষ্য আমি ভুলি, কিন্তু তুমি ভোলো না।




আমার সাধন ক্ষণিক, তোমার সাধন অনন্ত। এই যে দিব্যজ্ঞান জাগিয়েছ, এ জাগরণ বুঝি আর যাবে না! নিদ্রাটা অনাদি বলেই বোধ হয় এমন হয়। কখনও যে পূর্বের কোন‌ও জন্মে তোমাকে চিনেছিলাম, তা তো মনে হয় না। জানি না, কোনোদিন হয়তো মনে ঈশ্বরপ্রেম জাগবে আর আমার মুক্তি হবে। কিন্তু সে যে একেবারে ঘুম পাড়াবে, তা তো বোধ হয় না। এই জাগরণের জন্যেই এই সমস্ত আয়োজন৷ এই জাগরণে, এই চেনায়, এই ভালোবাসাতেই তোমার সৃষ্টির সার্থকতা।




তোমার ভালোবাসা তো আছেই। যখন একেবারে ঘুমিয়েছিলাম, তখনও তোমার ভালোবাসা ছিল। তখনও জানতে, একদিন এইভাবে জাগাবে, ভালোবাসাবে। আমার ভালোবাসা বাড়ানোতে, আমার ভালোবাসা স্থায়ী করাতেই তোমার সৃষ্টির সার্থকতা। তবে ঘুম কমে যাক, খেলা কমে যাক, ভোল কমে যাক! শৈশব গিয়ে বাল্য আসুক, বাল্য গিয়ে যৌবন আসুক। জ্ঞানে জাগাও, প্রেমে জাগাও, চেষ্টায় জাগাও। তোমার নিজ চিরজাগ্রত ভাবটিই আজ জাগ্রত করো।