আমাদের লড়াইগুলি

 আমরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন ধরনের লড়াই করছি। লড়াই করছি নানান জিনিসের বিরুদ্ধে, নানান মানুষের বিরুদ্ধে, নানান পরিস্থিতির বিরুদ্ধে, এমনকী আমাদের মনের বিরুদ্ধেও। অনেকেই কষ্ট লুকিয়ে ফেলতে জানি, অনেকেই ততটা ভালো লুকোতে জানি না। তবে কষ্ট লুকিয়ে ফেললেই কষ্ট কমে যায় না, বরং আরও বাড়তে থাকে। এমন নয় যে আমরা ভালো থাকতে চাই না; ভালো থাকতে আমরা চাই, তবু কেন জানি ভালো থাকতে কিছুতেই পারি না।
  
 কেউ যখন আমাদের সামনে এসে বলে, 'তোমার ভালো থাকা দরকার।', তখন আমরা মনে মনে হাসি আর ভাবি, এই কথাটা তো অভিনব কিছু নয়, আমি নিজেও জানি যে আমার ভালো থাকা দরকার। এইসব উপদেশ দেওয়া সোজা, এমনকী উপদেশটা দেয় যারা, তারা নিজেরাও যে ভালো আছে, তা কিন্তু নয়। ভালো যে থাকতে হবে, এটা সবাই জানে, এটা নিয়ে এত পণ্ডিতি দেখানোর কিছু নেই।
  
 যারা আমাদের ভালো থাকতে বলে, তাদের বেশিরভাগেরই বলার ধরনে এমন কিছু আছে, যা আমাদের হেয় করে। ওদের কাউকে আপনার দুঃখের কথা শুনতে বলে দেখুন; দেখবেন, ওদের সময়ই নেই শোনার। ওরা বোঝেই না আপনাকে, বুঝতে চায়ও না; না বুঝেই পরামর্শ দেয়। তখন আরও বেশি খারাপ লাগে। ওদের মধ্যে আবার এমন লোকজনও দেখবেন, যারা ভাবে, আপনি বোধ হয় নাটক করছেন কিংবা মনোযোগ নেবার চেষ্টা করছেন। ওদের ধারণা, আপনি অ্যাটেনশন-সিকার। ভাবুন তো, ওরা যদি আপনাকে কিংবা আপনার মানসিক অবস্থাকে বুঝতেই না পারে, তাহলে ওরা আপনাকে সাহায্য করবে কী করে? আর সাহায্যই যদি করতে না পারে, তবে এত বড়ো বড়ো কথা বলার কী দরকার? ওদের ওসব শুনলে উলটো আপনার মন খারাপ হয়, এবং ওরা এটা জানে। জেনে-বুঝেই ওরা ওসব বলে।
  
 এমন প্রায়ই হয়। মানুষ আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে, আপনার হৃদয় ভেঙে দিয়ে চলে যাবে, আপনি প্রিয় কাউকে হারিয়ে ফেলবেন। এরপর? যা আপনার প্রাপ্য ভেবেছেন, তা আপনি পাবেন না, অন্য কেউ পাবে। আবার আপনি কষ্ট পাবেন, আপনি বুঝতেই পারবেন না, এখানে আপনার দোষটা কোথায়! একাকিত্ব এসে আপনাকে গ্রাস করবে, ধীরে ধীরে আপনি আশেপাশের সবাইকে অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করবেন। চারিদিকে আপনি মানুষ নয়, শুধুই ছায়া দেখবেন। মনে হবে, সবাই আপনার ক্ষতি করতে চায়, কেউ আপনাকে ভালোবাসে না, সবাই আপনাকে ঠকাচ্ছে।
  
 আপনার কোনও দোষ না থাকা সত্ত্বেও আপনি সবসময়ই দেখবেন, আপনি যা ভাবছেন, তা হচ্ছে না। এসব ভেবে রাতে ঘুম আসবে না, সারাক্ষণই অস্থিরতায় কাটবে। প্রায়ই মন খারাপ হবে, মেজাজও খারাপ থাকবে। কিছুই ভালো লাগবে না, সবাইকেই এবং সব কিছুকেই বিরক্ত লাগবে।
  
 এইসব হয়; শুধু আপনার নয়, আমারও হয়, সবারই হয়। মাথায় রাখুন, এ পৃথিবীতে কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয়। দুঃখও একসময় চলে যায়। সময় যত সামনের দিকে যায়, ততই দেখবেন, নতুন নতুন স্মৃতি এসে জীবনে যুক্ত হচ্ছে, আগের কষ্টগুলির উপর কিছু নতুন স্মৃতির প্রলেপ পড়ে যাচ্ছে ক্রমশই, এবং এভাবে করে আপনার আগের যন্ত্রণা ও আফসোস ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ হতে থাকবে। অতীতের কষ্টগুলি, যা একদিন খুব গভীর ও তীব্র মনে হচ্ছিল, তা তুচ্ছ মনে হবে। আপনি আবারও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবেন। ওই সময়টাতে পৌঁছোনোর জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়।
  
 হঠাৎ একদিন পেছনে ফিরে তাকিয়ে ভাববেন, ভাগ্যিস! কষ্টটা জীবনে এসেছিল! নইলে এত কিছু শিখতাম কী করে? মানুষ চিনতাম কী করে? আজকের জায়গায় আসতামই-বা কী করে? আপনিই বলুন, সূর্যাস্ত না থাকলে সূর্যোদয় কি আদর পেত এতটা?