অস্পষ্ট জার্নাল: ৯

 
সাতান্ন।

আজকালকার দিনে ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ বদলে গেছে। বন্ধুত্বের প্রকৃত সংজ্ঞা থেকে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজকের দিনের বন্ধুগুলি আমাদের আজীবনের বন্ধু নয়। হয়তো আমরা একই স্থানে কাজ করি অথবা একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করি, এরই প্রেক্ষিতে কিছুদিনের জন্য আমরা একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হই। আমরা ভাবি, আমরা একে অপরের বন্ধু। এটি বন্ধুত্বের প্রকৃত সংজ্ঞা নয়। আমরা আমাদের বাবা-মা, বংশ, ধর্ম, জন্মস্থান, পরিবার এগুলি নিজেরা নির্বাচন করতে পারি না, কিন্তু আমরা নিজের বন্ধু নিজেই নির্বাচন করতে পারি। বন্ধুত্ব-এর সংজ্ঞা এমন যে, যাদের সাথে থাকলে আমরা আনন্দ অনুভব করি, যাদের উপস্থিতি আমাদের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়, যাদের আচরণ, চিন্তাভাবনার ধরন ও কাজ আমাদেরকে খুব প্রভাবিত করে, যাদের সঙ্গ আমাদেরকে হঠাৎই অনুভূতির এমন এক পরিস্থিতিতে নিয়ে যায়, যা আমরা এর আগে কখনও অনুভব করিনি। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ---যাদের সংস্পর্শে আমরা আমাদের শক্তির শীর্ষে উঠতে পারি, যাদের সাথে থাকলে আমরা নিজেকে কখনওই ‘লো ফিল’ করি না। আর এটিই বন্ধুত্ব-এর প্রকৃত সংজ্ঞা। পুরো পৃথিবী যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখনও যে ব্যক্তিটি পাশে এসে দাঁড়ায়, সে-ই আমাদের বন্ধু। একজন বন্ধু কখনওই আপনাকে ছেড়ে যাবে না, এমনও যদি হয়, আপনার পাশে দাঁড়াতে গিয়ে সে নিজেই বিপদগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে, তা-ও যাবে না। এমন ভালোবাসার কোনও ব্যাখ্যা হয় না, কোনও যুক্তি বা সমীকরণ দিয়ে আপনি এটার কূলকিনারা খুঁজে পাবেন না। এমনও হতে পারে, সুখের সময়ে তাকে হয়তো দেখাই যায় না, অথচ দুঃখের সময় তাকে ঠিকই পাওয়া যায়।


প্রকৃত বন্ধু কে, কিংবা আমাদের এই জীবনের জন্য কোন ব্যক্তিটি সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝতে চাইলে খুব সহজ একটি কাজ আমরা করতে পারি। এই যে আমরা এখন বেঁচে আছি, তাই আমাদের পাশে অনেককেই দেখতে পাই, যারা আমাদের পাশে আছে আমাদের দেখাতে, আমাদের মনে জায়গা নিতে, আমাদের কাছ থেকে কোনও সুবিধা আদায় করতে, কোনও একটা সংকোচবোধ থেকে, কিংবা কিছু একটা কারণে। যখন আমরা মারা যাব, যখন আমরা আর কিছুই দেখতে বা অনুভব করতে পারব না, যখন আমাদের পাশে কে আছে কে নেই, তা আমরা বুঝতে পারব না, যখন আমাদের (মৃতদেহের) পাশে এসে দাঁড়ালেও যা না দাঁড়ালেও তা, তখনও আমাদের মৃতদেহের পাশে আসবে কিংবা আমাদের স্মৃতি মনে করে সারাজীবনই সত্যি চোখ ভিজে যাবে যে মানুষটির, সে-ই আমাদের বন্ধু। আমরা তার মুখে ও চোখে থাকি না, শুধুই মনে থাকি। এ অনেক বড়ো একটা ব্যাপার! একমাত্র সেই মানুষটিই আমাদের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে। চোখ দুইটি বন্ধ করে পাঁচমিনিট ভাবলেই আমরা বুঝে ফেলব, আমাদের এই জীবনে কে জরুরি কে জরুরি নয়। এই জীবনের জন্য জরুরি ব্যক্তি কারা, তা যত সহজে বুঝতে পারব, ততই আমাদের মঙ্গল। আমরা আমাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় দিয়ে দিই তাদের, যাদের মনে আমরা থাকিই না। কী দরকার? সময়ের চাইতে দামি আর কী আছে? এই দামি জিনিসটাকেই অপাত্রে দিয়ে জীবনটাকে দুর্দশাগ্রস্ত করে রাখার কী অর্থ? এমন অনেকেই আছে, যারা হয়তো আমাদের প্রতি কপট-প্রেম দেখায় না, কিন্তু সত্যিই আমাদের ভালোবাসে সকল যুক্তি ও তর্কের ঊর্ধ্বে উঠে। তাদের খোঁজ করতে হবে। তাদের সকল যুক্তি, ব্যাকরণ, চিন্তা, কারণ, পরিস্থিতি ভুলে অন্ধভাবে ভালোবাসতে হবে। তাদের ভালোবাসা দেওয়া ও তাদের কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়া---মূলত এই দুই নিয়েই জীবন। মজার বিষয়, আমাদের অনেক বন্ধু আছে, যাদের আমরা হয়তো সারাজীবনেও কখনও চিনতে পারি না, যাদের সাথে আমাদের কখনও দেখা হয়নি…হবেও না।


এমন একজন বন্ধু নির্বাচন করলে একজন শিক্ষক নির্বাচন করা সহজ হয়ে যায়। কেননা যিনি আমাদের সত্যের পথে, আলোর পথে, অস্তিত্বের পথে শিক্ষা দেন, তিনিই আমাদের প্রকৃত শিক্ষক। তিনিই আমাদের জীবনব্যাপী শিক্ষক। যদি আমরা একজন বন্ধু নির্বাচন করতে না পারি, তবে আমরা শিক্ষক নির্বাচন করতে পারব না। যদি আমরা ভালো বন্ধু নির্বাচন করতে সক্ষম হই, তবে আমরা আমাদের আজীবনের বন্ধু নির্বাচনে সক্ষম হব। যখন আমরা বন্ধু নির্বাচন করব, তখন আমাদের উচিত আমাদের বন্ধুর পথ অনুসরণ করা। কেননা একজন ভালো বন্ধু আমাদের কখনও তার পথ অনুসরণ করতে বাধ্য করবে না। সে কখনও আমাদের উপর তার ধারণা, দর্শন ও নির্দেশনাগুলি চাপিয়ে দেবে না, সে কখনও আমাদের সাথে এ বিষয়ে উচ্চস্বরে কথা বলবে না, সে আমাদের সাথে তর্কে জড়াবে না। সে কেবল আমাদের ইঙ্গিত দেবে এবং এটিই আমাদের শিক্ষকের পথ। আমাদের ব্যথা যাকে স্পর্শ করে না, সে কখনওই আমাদের বন্ধু নয়। আমাদের বন্ধুরা কখনও অহেতুক উচ্চস্বরে কথা বলে না কারণ তারা উন্মাদ নয় কিংবা আমাদের সামনে এলে তাদের সমস্ত মন ও কণ্ঠস্বর আপনাআপনিই প্রশমিত হয়ে আসে, তাদের আমাদের কাছে কোনও চাহিদা বা স্বার্থ নেই। তারা আমাদেরকে তাদের পথে নিতে কখনও বাধ্য করে না। তারা কেবল তাদের শিক্ষা, তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে প্রকাশ করে থাকে। এরপর আমরা তাদের পথ অনুসরণ করব কি করব না, এটি সম্পূর্ণই আমাদের ইচ্ছা। যদি আমরা আমাদের প্রকৃত বন্ধুর কথা শোনার উপযুক্ত হই, যদি আমরা তাকে গ্রহণ করতে জানি, তবেই কেবল আমরা ভীষণভাবে উপকৃত হব।


আটান্ন।
মানুষ মূলত রহস্যময় প্রাণী। আমাদের মধ্যে এমন কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে, যা আমাদের জীবনকে আলোকিত করে, এই আলোই আমাদের সত্যের কেন্দ্রে নিয়ে যায়। একজন ভালো শিক্ষক এই আলোর সাহায্যে আমাদের সামনে জীবনের সহজ ও সুন্দর দিকগুলি উন্মোচনের কাজটি করেন। তিনি আমাদের এমন এক আনন্দের খোঁজ দেন, যাতে করে আমরা জীবনের প্রকৃত অর্থ খুজেঁ পাই। জীবন সাধারণত দুটি নীতিতে চলে। একটি প্রয়োজনীয়তা, অন্যটি শক্তি। অসচেতন মানুষ শুধু এই প্রয়োজনীয়তার নীতিতে বিশ্বাসী। সচেতন মানুষ সর্বদা শক্তির খোঁজ করে। প্রয়োজনীয়তার নীতি সীমাবদ্ধতার নীতি। শক্তির নীতি প্রয়োজনীয়তার ঊর্ধ্বে। আমরা যত সচেতন হব, ততই প্রয়োজনীয়তার ঊর্ধ্বে বিপুল এক শক্তিতে বাস করব। কেবল প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরাই এমন শক্তির ঊর্ধ্বে বিচরণ করে থাকেন। তাঁরা সব সময় নীরব থাকেন, নীরবে কাজ করে যান কিন্তু তাঁরা যখন কিছু বলেন, তখন তাঁরা শক্তির ঊর্ধ্বে উঠে বলেন। সেই বলাটা এতটাই তীব্র ও সত্য যে তাকে কোনও কিছু দিয়েই আর নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না।


এই দুটি নীতির উৎস একটিই, আর সেটি হচ্ছে পরমসত্যের উৎস। সমগ্র অস্তিত্ব এই দুইটি নীতির ভিত্তিতেই চলে। চলার এই প্রক্রিয়া আমাদের একইসাথে পরমানন্দ এবং বিপুল শক্তির খোঁজ দেয়। আমরা তখনই এর খোঁজ পাই, যখন আমরা পূর্ণমাত্রায় সচেতন হই। যখন আমরা এই দুই নীতিকে সমন্বয় করে চলতে পারি, তখনই আমরা সে আলোর দেখা পাই, সে সত্যের দেখা পাই। ভালোবাসাই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ রহস্য। ভালোবাসায় বাস করা যায়, ভালোবাসার অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়, কিন্তু ভালোবাসাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটি রহস্যাবৃত। এটি সকল বোধজ্ঞানের ঊর্ধ্বে। এটিকে আমরা আমাদের অনুভূতি ও স্মৃতিতে ধারণ করতে পারি। ভালোবাসার কোনও অবয়ব নেই, শরীর নেই। ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে অদৃশ্য হতে থাকে এবং এর সর্বোচ্চে পৌঁছুলে এটি নৈঃশব্দ্যের সাথে মিলিয়ে যায়। সর্বোচ্চ ভালোবাসার কোনও ভাষা থাকে না। শারীরিক ভালোবাসা, ভালোবাসার সব থেকে নিম্নস্তর। যে ভালোবাসা কেবলই শরীরনির্ভর, সেটি আদতে ভালোবাসাই নয়, বড়োজোর কামনা। ভালোবাসার সর্বোচ্চ স্তরটি ক্রমাগত আন্তরিক প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। এটিকে কোনও ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কেবল যখনই আমরা ভালোবাসার সর্বোচ্চ অনুভূতি লাভ করি, তখন সে অনুভূতি অশ্রু হয়ে ঝরে। ভালোবাসা একটি বিশুদ্ধ অনুভবের নাম। এই অনুভব মানুষকে সুখী করে, স্বস্তি দেয়, আনন্দে রাখে, সাথে মনের শক্তি অনেক অনেক বাড়িয়ে দেয়।


ভালোবাসা তিনটি স্তরের হয়ে থাকে---অবচেতন, সচেতন এবং সর্বোচ্চচেতন। বস্তুগত ভালোবাসা হচ্ছে অবচেতন ভালোবাসা, সর্বোচ্চ ভালোবাসা হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের চেতনাগত ভালোবাসা এবং এই দুইয়ের মাঝে সচেতন ভালোবাসার বাস। ভালোবাসার রাজ্যে কোনও অতীত, বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ বলে কিছুই নেই। ভালোবাসা নিজ রাজ্যে সদাসমাসীন। যেদিন থেকে আমরা সত্য ভালোবাসার খোঁজে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিই, সেদিন থেকেই আমরা মৃত, কেননা সেই দিনই আমাদের পুরনো আমি’র মৃত্যু ঘটে গেছে। সুতরাং আমাদের আর নতুন করে মৃত্যুর কোনও ভয় নেই। যেদিন আমাদের পুরনো আমি’র মৃত্যু ঘটেছে, ঠিক সেইদিনই আমরা নতুনভাবে জন্মলাভ করেছি। আমরা যেদিন থেকে জন্ম নিয়েছি, সেদিন থেকেই আমাদের নতুন জীবনের শুরু এবং নতুন জীবনের এই পথে পুরনো কোনও কিছুই আর রাখা চলবে না। আমাদেরকে নতুন করে নিজেকে তৈরি করতে হবে। আমরা আমাদের নাম, আমাদের পরিচয় আমাদের খ্যাতি কিংবা প্রতিপত্তি সবকিছুকে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। এখন এই নতুন জীবনে আমরা সকল প্রকার বোঝা থেকে, সকল প্রকার দায় থেকে মুক্ত।


কখনও কখনও, আমাদের এই নতুন জন্মের কথা জানতে আমাদের অনেক সময় লেগে যেতে পারে। নতুন আমি’কে সাজাতে এত সময় দিতে হয় যেন পুরনো আমি’র অস্তিত্বের কথা মনে আসার সুযোগই পাওয়া যায় না। মূলত নতুন জীবনের শুরুতে পুরনো জীবনের মৃত্যু আলোর পথে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। আমাদের সচেতন মনে এটি অনেক সময়ই চোখে পড়ে না। যখন আমরা ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করি, তখন প্রথমেই এটি ঘটতে থাকে যে আমরা আমাদের পুরনো সত্তা থেকে, অস্তিত্ব থেকে বেরিয়ে যাই। পরিবর্তনগুলি এমনভাবে আমাদের সাথে ঘটতে থাকে যে আমাদের পুরনো কোনও সত্তা ছিল, সেটাই ভুলে যাই। যখন আমরা আমাদের মনের গভীরে প্রবেশ করি, তখন আমাদের নিজেদের কাছেই নিজেদের অচেনা মনে হয়। এটিই ভালোবাসার গভীরতম অংশ। ভালোবাসা আমাদেরকে আমাদের পুরনো সত্তা থেকে বের করে এনে নতুন সত্তায় রূপ দেয়। এই সবকিছুই যেন হঠাৎ করে ঘটতে থাকে। আমরা একবার যদি এই স্রোতের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করি, তখন সেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনও উপায় থাকে না। পৃথিবীর অনেক তুচ্ছ বিষয় তখন আমাদের আর স্পর্শ করে না। আমরা এমন এক আনন্দরাজ্যের খোঁজ পেয়ে যাই, যেখানে থেকে যাওয়া যায় অনন্তকাল।


উনষাট।
ফ্রেডেরিক নীটশের একটি রূপক গল্প আছে। গল্পটি এমন যে, একদিন এক পাগল পাহাড়ের চূড়া থেকে পাহাড়ের পাদদেশের বাজারে এল। সময়টি ছিল দিনের বেলা। চারিদিকে সূর্যের আলোয় আলোকিত থাকা সত্ত্বেও পাগলটি একটি প্রদীপ হাতে এসেছিল। সে একটি দোকানে ঢুকল এবং তার প্রদীপটা উঁচু করে কিছু একটা খুঁজতে লাগল। দোকানদার পাগলকে প্রদীপ হাতে দেখে হাসছিল এবং এরই মধ্যে চারপাশে লোক জড়ো হয়ে গেলো। সবাই পাগলটিকে দিনের বেলা প্রদীপ হাতে দেখে হাসতে লাগল। এবার দোকানদার পাগলটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী খুঁজছ?’ ‘তুমি দিনের বেলায় প্রদীপ হাতে কেন বেরিয়েছ?’ পাগলটি দোকানিকে বলল, ‘আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি। তোমরা কি দেখেছ, ঈশ্বর কোথায়?’ তারা পাগলটির কথা শুনে হাসতে লাগল এবং তাকে নিয়ে মজা করতে লাগল। তারা বলল, ‘ঈশ্বর কি শিশু যে হারিয়ে গেছে? ঈশ্বর কি এমন কিছু যে এদিক সেদিক লুকিয়ে আছে? তারা এ ধরনের আরও অনেক প্রশ্ন ছুড়তে লাগল এবং মজা করতেই লাগল।’ তারপর হঠাৎ সেই পাগলটি বলতে শুরু করল, ‘তোমরা কি জানো, আমরা ঈশ্বরকে মেরে ফেলেছি? আমি, তুমি এবং আমরা সকলে মিলে ঈশ্বরকে মেরে ফেলেছি? কিন্তু মনে হচ্ছে, এখনও তোমাদের কান পর্যন্ত খবরটি পৌঁছায়নি। এটি তোমাদের বোধগম্য হতে সময় লাগবে। তুমি এবং আমি, আমরা সকলেই ঈশ্বরকে মেরে ফেলেছি। কিন্তু কাজটি আমরা এতটা অচেতন অবস্থায় করেছি যে এটি আমাদের বোধগম্য হতে সময় লাগবে। সংবাদটি আমাদের কাছে পৌঁছুতে সময় লাগবে। আমি বেশ বুঝতে পারছি যে, তোমরা কেন হাসছ; তোমরা এখনও জানোই না তোমরা আসলে কত বড়ো ভুল করেছ!’


আসলেই তা-ই। আমরা আমাদের ভেতরের ঈশ্বরকে জাগাইনি অনেকদিন হয়ে গেল। আমরা নিজেরা মৃত, আমাদের ঈশ্বরও মৃত। আমরা খুঁজতেই শিখছি না, কেননা আমাদের মাথায়ই নেই যে আমাদের কিছু একটা হারিয়ে গেছে। যা হারিয়েছে আমাদের, তা হচ্ছে বোধ, নিজের হৃদয়ের সাথে সংযোগ, বিবেক। এইসব নেই বলে আমাদের প্রতিটি প্রার্থনাই অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে, আর প্রার্থনাই যেখানে ভিত্তিহীন, সেখানে আমাদের সমস্ত প্রার্থনা পৌঁছানোর গন্তব্যটিও প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা স্রেফ নিঃশ্বাসের সমুদ্রে বেঁচে আছি, আর কিছুই না। আমাদের ভেতরটা মরে বসে আছে, এই মৃত্যুটা আমরা নিজেরাই ধরতে পারছি না। ধরতে পারছি বলেই নিজেদের জাগানোর জন্য আমাদের মধ্যে কোনও তাড়না বা প্রতীতির উদ্ভব হচ্ছে না। আমরা এমন কিছু পেয়ে বসে আছি, কিংবা এমন কিছু পাওয়ার জন্য নিজেদের ছোটাচ্ছি, যা-কিছু আমাদের চোখের সামনে থেকে অনেক বড়ো, অনেক মহৎ ঐশ্বর্য লুকিয়ে ফেলছে প্রতিমুহূর্তেই।


অচেতনতা থেকে সচেতনতার মধ্যকার দূরত্ব অনেক বেশি। যখন আমরা কোনও কিছুতে গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকি, তখন আমাদের সাথে কী হচ্ছে, এটা সেই মুহূর্তেই আমাদের বোধগম্য হয় না। এতেই বোঝা যায়, আমরা কতটা গভীরভাবে আচ্ছন্ন ছিলাম, কিন্তু আমরা সেই মুহূর্তে এটি উপলব্ধি করিনি। যখন আমরা পুরনো আমি থেকে নতুন আমি’তে পরিবর্তিত হই, তখন তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সেটি বুঝতে পারি না। যখন আমরা বুঝতে পারি, ততদিনে আমরা পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়ে যাই। সত্যের পথে আমাদের এভাবেই গভীরতার সাথে আছন্ন হয়ে যেতে হবে, তবেই আমরা সেই আলোর দেখা পাব। আমাদের ভয় পেলে চলবে না। আমরা যদি ভয় পাই, তবে আমরা সামনে এগুতে পারব না। আমাদের কেবল নিয়মিত অনুশীলন করে যেতে হবে। আমাদের নিজেকে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে সত্যের সেই পথে। কাজটি করতে ভালো লাগুক আর না-ই লাগুক, ধৈর্য আর স্থৈর্য নিয়ে কাজটি করে যেতেই হবে প্রাথমিক অবস্থায়। পরে ধীরে ধীরে কাজটির মধ্যে প্রবেশ করে ফেললে কাজটিই হয়ে উঠবে আমাদের পুরো জীবনের ধ্যান, জ্ঞান।


ষাট।
একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে যে, আত্মসমর্পণ আর আনুগত্যের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। আত্মসমর্পণের অর্থ হচ্ছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পিত করা এবং আনুগত্য হচ্ছে একপ্রকার বাধ্যতা থেকে মেনে নেয়া। নিজেকে সমর্পণের অর্থ, আমাকে যা করতে হবে, তার সবটা করার জন্যেই আমি প্রস্তুত অথবা মাথা পেতে মেনে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু আনুগত্যের বেলায়, সুযোগ পেলে অথবা পরিস্থিতি ভেদে অথবা সহ্যসীমার ঊর্ধ্বে উঠে গেলে সাধনা ছেড়ে দেবার রাস্তাটাও নিহিত থাকে। গভীর আনুগত্যে যদি আমরা হ্যাঁ-ও বলি, তবুও তার কোথাও না কোথাও অদৃশ্য এক ‘না’ লুকিয়ে থাকে। আমরা চাইলেই সেই হ্যাঁ-অবস্থা থেকে না-তে চলে আসতে পারি। কিন্তু আত্মসমর্পণে কোথাও না-এর কণামাত্রও সুযোগ থাকে না। প্রকৃতপক্ষে, ‘হ্যাঁ’ ছাড়া এখানে ‘না’-এর কোনও অস্বিত্বই নেই। অপরদিকে, আনুগত্যের ক্ষেত্রে, সুযোগ পেলে এই আবৃত-গুপ্ত ‘না’ প্রকট হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে। আমরা যতবার সচেতনভাবে ‘হ্যাঁ’ বলি, ঠিক ততবারই অবচেতন মনে না-ও বলি। দর্শনের ভাষায়, আমাদের মস্তিষ্কের দশ ভাগের এক ভাগ সচেতন এবং বাকি নয় ভাগ অবচেতন। আমরা যতবার কোনও কিছুতে ‘হ্যাঁ’ বলি, ততবারই এই অবচেতন অংশ আরও শক্তিশালী হতে থাকে এবং মস্তিষ্কে ‘না’-এর একটা জোরালো ভিত গড়ে তোলে। এই ‘না’ যখন প্রকট আকার ধারণ করে, তখন এটি ‘হ্যাঁ’-এর বিরূদ্ধে শক্তিশালী হয়ে প্রতিশোধ নেয়।


কেবল একজন ভণ্ড, একজন কপট ব্যক্তিই এমন অনুগত হয়ে থাকে। একজন অকৃত্রিম, আন্তরিক মানুষের পক্ষে অনুগত হওয়া সম্ভব নয়, বরং সে সর্বদা সমর্পিত হয়ে থাকে, যাকে আমরা সাধারণত পাগল বলে থাকি। ভণ্ড, কপট স্বভাবের মানুষ কখনও নিজেকে সমর্পণ করতে পারে না। এ কারণেই কপটরা যখন কোনও কিছুতে বারেবারে ‘হ্যাঁ’ বলে থাকে, তখন সে আসলে ভেতরে ভেতরে তার ‘না’-কেই প্রশ্রয় দেয়। একজন আন্তরিকতাপূর্ণ মানুষ সচেতনভাবেই পাগল হয়ে থাকে। সেই পাগলামি কোনও একটা নিয়তে বা প্রার্থনায় নিজেকে ব্যাপ্ত করে রাখার পাগলামি। পৃথিবীতে যারাই অনেকদূর গেছে, তাদের সম্পর্কে জানতে গেলে দেখা যাবে, তাদের প্রত্যেকেই সচেতনভাবেই পাগল ছিল। নিজের পথে সামনের দিকে অগ্রসর হতে গেলে এমন পাগল হয়ে ওঠার কোনও বিকল্প নেই।


অনেক সময় দেখা যায়, যারা অনেক কথা দেয়, তারাই বেশি কথার বরখেলাপ করে, অথচ দেখা যায়, যারা কোনও কথাই দেয় না, অথবা কোনও কাজের শুরুতে তার অপারগতাটুকু প্রকাশ করে, তারাই বরং জলদি জলদি সেই কাজটি করে দেয়। এটি কেন হয়? কারণ আমরা যখন সচেতনভাবে কোনও কিছু করতে অস্বীকার করি, সেটি বারেবারে আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়, আর তখন নিজের স্বস্তির টানেই আমরা কাজটি করে ফেলি। অথবা কখনও কখনও ভেতরে ভেতরে কাজটা না করার ফলে একপ্রকার অপরাধবোধ কাজ করে বিধায়, আমরা অবশেষে কাজটি করেই ফেলি। আবার এমনও দেখা যায়, আমরা অনেক সময় অনেক কিছু করে ফেলার কথা দিই, কিন্তু আমাদের ভেতরে সেই একইভাবে একটা ‘না’ থেকে যায়, যে না-টা হচ্ছে হ্যাঁ-এর উলটোপিঠের ‘না’। তখন একটা প্রতিশোধস্পৃহা ভেতরে ভেতরে কাজ করতে থাকে যে, আমি যদিও কথা দিয়েছি, তবুও কাজটি আমি করব না, কেননা আমার ভেতর একটা দ্রোহী বা প্রতারিত, একটা কপটমন বারেবারে আমাকে তাড়া করছে…আর ঠিক সেই পরিস্থিতি থেকেই আমরা কাজটি ছেড়ে দিই। অন্যদিকে, একটি সমর্পিত মন কখনও সত্যের পথে কোনও কাজকেই অবমূল্যায়ন করে না, বরং তাকে যেটি করতে বলা হয়েছে, সেই কাজটি তার সর্বোচ্চ শক্তি এবং সামর্থ্য দিয়ে করে যাওয়ার চেষ্টা করে।


একজন আত্মসমর্পিত মানুষের কাছে তার শিক্ষকের কথাই মুখ্য, কেননা সে তখন নিজেকে তার শিক্ষকের কাছে সমর্পিত করে। একটি সমর্পিত মন একটি পূর্ণহৃদয় দিয়ে ভালোবাসার সাথে কাজ করে যায়। সেই সব কাজের প্রতি তার পরিপূর্ণ মনোযোগ, ভালোবাসা, আবেগ, সম্মান, আন্তরিকতা সবকিছু একত্র হয়ে নিজেকে সেই পরম অস্তিত্বের পথে ঢেলে দেয়। ভালোবাসার যেমন কোনও শরীর হয় না, তেমনি যে বা যারা ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়, তাদেরও কোনও অবয়ব হয় না; ঠিক যেমন…দুটি হৃদয় যখন ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়, তখন তাদের শরীরটা কেবল আলাদা থাকে, কিন্তু তাদের উভয়ের হৃদয়ে একটাই আত্মা বাস করে। এটিকেই সমর্পিত হওয়া বলে। একটি সমর্পিত আত্মা অহমসত্তার (বা ইগোর) অনেক অনেক ঊর্ধ্বে উঠে যায়। সেই আত্মায় কোনও ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’-বোধক শব্দ থাকে না। সেখানে কোনও আনুগত্যের স্থান থাকে না। একে যদিও আনুগত্যের মতো দেখায়, আসলে একটি সমর্পিত মন আনুগত্য অথবা অনানুগত্যের ঊর্ধ্বে। মানুষ আনুগত্যের মুখোশে বিতৃষ্ণা বা ছলনাকে লুকিয়ে রাখে। আমরা আনুগত হই, যেন আমরা প্রতারণার মাধ্যমে কোনও কিছু আদায় করে নিয়ে পারি। বস্তুগত কোনও সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্যেই আমরা আনুগত্যের সাহায্য নিই, কেননা এটির দ্বারা সহজেই কাউকে ঠকানো যায়।


একটি শক্তিশালী হৃদয় আর একটি দুর্বল হৃদয়ের পার্থক্য এখানেই। একটি শক্তিশালী হৃদয় অথবা একটি সমর্পিত হৃদয় আনুগত্য এবং আত্মসমর্পণের পার্থক্য করতে পারে। তাদের হৃদয়ের দৃষ্টি এতটাই প্রখর থাকে যে তারা কাউকে দেখেই বলে দিতে পারে, সামনে-থাকা ব্যক্তিটির মনে আসলে কী চলছে। তারা মানুষকে দেখে না, মানুষের ভেতরটাকে দেখে। এটা একটা চর্চা, নিয়মিত করলে নিজেকে এই কাজে শাণিত করে ফেলা যায়। অপরদিকে, আনুগত্য আমাদের সত্তাকে বিভক্ত করে ফেলে। আনুগত্যের ফলে আমরা একই মানুষ একটি আত্মার হয়েও দুটি ভিন্ন রঙ ধারণ করি, এজন্যই দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দেওয়ার বেলায় আনুগত্য ধ্বংসাত্মক। যা-কিছু আমাদের ভেঙে ফেলে, যা-কিছু আমাদের অকৃত্রিম বানিয়ে ছাড়ে, সেই সবকিছুই আমাদের ধ্বংসের দ্বারে নিয়ে যায়। অর্থাৎ আমাদের শুভ লক্ষণযুক্ত দিকগুলিই আমাদের জন্য ধ্বংস ডেকে আনে নিজেদেরই ভুলে। আমরা যদি আনুগত্যের পিছে না ছুটে বরং সচেতনভাবে নিজেদের পুরোটা দিয়ে আন্তরিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করি, তবে আমাদের পৃথিবীটা আরও সুন্দর হয়ে যাবে। অথচ আমাদের এই সচেতনভাবে কাজ করার শক্তি কৌশলে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে আর হচ্ছে, যার ফলে আমরা রোবটমানবে পরিণত হয়েছি।


পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সর্বজনগৃহীত মূল্যবোধ হচ্ছে আনুগত্য। আমরা আনুগত্যেকে এজন্য সহজভাবে মেনে নিয়েছি, যার ফলে আমাদের যা বলা হয়, আমরা যন্ত্রের মতো তা-ই করে যাই, সেসবই মেনে নিই। মেনে নেওয়া ও মন থেকে নেওয়া, দুইটি ভিন্ন ব্যাপার। প্রথমটি আনুগত্য, দ্বিতীয়টি সমর্পণ। নৈতিকতার নামে আমাদের হাতে আনুগত্যের পোশাক ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এটা এতটা নীরবে, যৌক্তিকতা বাতাবরণে করা হয়েছে যে, আমরা আমাদের স্বাভাবিক বোধশক্তিকেও আজ আর কাজে লাগাতে পারি না, আর ওটার বিরুদ্ধে তো নয়ই! সৃষ্টির সূচনা থেকে রীতি আর প্রথার নামে উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদের উপর জোরপূর্বক আনুগত্যের এই চকচকে পোশাক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের স্বভাবজাত সন্দেহ, প্রতিবাদ, চিন্তার ভাষা কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং আমাদের উপর একটি নিয়মের বোঝা চাপিয়ে এটিকে অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। আমাদের সত্যতা যাচাই করার অধিকার নেই, আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, যার ফলে আমরা সহজেই অন্যের দ্বারা প্রতারিত হই, এর পালটাজবাবে অন্যের সাথে প্রতারণা করি। মূলত মানুষ আজ বোধশক্তিসম্পন্ন সবচেয়ে উন্নত যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়, যেখানে আনুগত্য কেবল সমাজের তৈরি একটা আরোপিত-কৌশল।


আমাদের ভালোবাসার মানুষের কাছে নিজেকে সমর্পিত করতে হবে। কেননা যখন আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষের কাছে সমর্পিত হই, তখন আমরা ওই মানুষটির কাছে নয়, বরং আমরা আমাদের ভালোবাসার কাছে নিজেকে সমর্পণ করি। আমরা তখন সেই শরীরকে নয়, সেই আত্মাকে ভালোবাসি। যখন দুইটি আত্মা ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়, তখন দুইটি হৃদয় একে অপরের কাছে সমর্পিত হয়। ভালোবাসা কাউকে অধিকার করে না, কাউকে অধিকার দেয় না। ভালোবাসা সকল কর্তৃত্বের ঊর্ধ্বে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং আধ্যাত্মিক সত্তা। ভালোবাসার নিজস্ব ভাষা আছে। যখন আমরা ভালোবাসাকে গ্রহণ করি, তখন এটিই আমাদের পথ দেখায়। প্রকৃত ভালোবাসার পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। যখন দুইটি আত্মা ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়, তখন সেটিই হয়ে ওঠে পরমপ্রার্থনা। দুটি প্রেমাত্মা একত্রিত হলে তারা একই ভাষায় কথা বলে, তাদের চিন্তাচেতনা, তাদের চলার পথ এক হয়ে যায়, কেননা তাদের উৎস অভিন্ন। বাহ্যিকভাবে এটিকে আনুগত্য মনে হতে পারে, কিন্তু এটি ঐশ্বরিক সমর্পণ। এজন্যই বলা হয়, ‘একজন ভালো সন্তান হও, ভালো সঙ্গী হও, ভালো বাবা-মা হও, ভালো বন্ধু হও।’ এখানে ‘ভালো’ বলতে আনুগত্যকে নয় বরং সমর্পণকে বোঝানো হয়েছে। সমর্পণের অর্থ প্রকৃত ও অকৃত্রিম হওয়া। আমরা ঠিক যতটা সৎ, যতটা উদার, যতটা নোংরা, যতটা কপট,…আমাদের চিন্তাচেতনা আমাদের ভেতর থেকে আমাদের ঠিক যেমন পথে পরিচালিত করে,…সেইসবকে ঠিক সেইভাবে তুলে ধরাই নিজেকে সমর্পিত করা। ভালোবাসার মানুষের কাছে এভাবেই আত্মসমর্পণ করতে হয়।


ভালোবাসার নিজস্ব কোনও রূপ নেই, আমরা কেবল আমাদের আপনজনের এক-একটি রূপ কল্পনা করে তাকে ভালোবাসি। এটি ভালোবাসার একটি অজুহাত অথবা একটি দরজা, যার মাধ্যমে আমরা ভালোবাসার ঘরে প্রবেশ করি। প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা কেবলই আত্মার পথ ধরে চলে। যে হৃদয়ে ভালোবাসা নেই, সে হৃদয়ে প্রার্থনা নেই, সে হৃদয়ে স্রষ্টা নেই। ভালোবাসার কাছে সমর্পিত হবার অর্থই স্রষ্টার কাছে সমর্পিত হওয়া। স্রষ্টা ভালোবাসার মানুষের রূপ ধরে আমাদের কাছে আসেন। আমরা যখন আমাদের ভালোবাসার মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করি, আমরা আসলে তখন আমাদের স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করি। এই আত্মসমর্পণ একটি আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ। অপরদিকে, আনুগত্য একটি খোলসমাত্র। যে-কোনও খোলস আমাদের শেষপর্যন্ত কেবল ধ্বংসের দিকেই নিয়ে যায় অবধারিতভাবে।


একষট্টি।
মানুষ জন্মগতভাবে অজানাকে জানার তৃষ্ণা নিয়েই বাঁচে। আমরা সকলেই ক্রমাগত আমাদের অভ্যন্তরীণ শক্তির খোঁজ করে চলেছি। মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীর মাঝে পার্থক্য এখানেই। মানুষ একমাত্র প্রাণী, যে তার অস্তিত্বের উৎসের খোঁজ করে চলছে, যে তার ভাবনার গভীরে প্রবেশ করে, জীবনের আধ্যাত্মিকতা খুঁজে ফেরে, যে সত্যান্বেষণে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়। তাই বলা যায়, ধ্যান আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। আমরা যদি ধ্যানে প্রবেশ করতে চাই, তবে আমাদের ভেতরের সেই ঘুমন্ত সত্তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আর সেই ঘুমন্ত সত্তাকে জাগিয়ে তোলার প্রক্রিয়াই হচ্ছে ক্রমাগতভাবে ধ্যানের চর্চা করে যাওয়া। কেননা আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই সত্যের খোঁজ পাওয়ার অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমরা যদি অনবরত অযাচিত আর ভিত্তিহীন কাজে জীবনের সময়গুলি নষ্ট করি, তবে আমরা কখনওই সেই সত্তার খোঁজ পাব না। সময় আমাদের হাত থেকে দ্রুত পিছলে যাচ্ছে। এটাই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবার প্রকৃত সময়, যেন আমরা নিজেদের বলতে পারি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা সত্যের খোঁজ করে তবেই মরব। আমাদের নিজেদের ভেতরে সেই তীব্র ক্ষুধার বেগ তৈরি করতে হবে, যেন আমরা যদি ঘুমিয়েও থাকি, তবুও যেন এই তৃষ্ণা আমাদের ভেতরে জাগ্রত থাকে।


আমরা যা-কিছুই করি না কেন, তার সবই যেন আমাদেরকে সেই সত্যের কাছে নিয়ে যায়। নিজের ভেতরে সেই তীব্র ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। যখন আমাদের ভেতরে সেই তীব্র ক্ষুধার সৃষ্টি হবে, তখন সত্যের পথে যা যা প্রয়োজনীয়, তার সব উপাদান আমাদের কাছে আপনিই এসে ধরা দেবে। হ্যাঁ, যখন আমরা সত্যকে তীব্রভাবে জানতে চাই, তখন সেটি এতটাই শক্তিশালীভাবে কাজ করে। এটি কোনও সাধারণ ইচ্ছা নয়, এটি প্রতিটি জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য। জীবনের সার্থকতা এখানেই। বৈষয়িক বা জাগতিক ইচ্ছা, যেমন অর্থ, খ্যাতি, প্রাসাদ, ক্ষমতা…এইসবকিছু আমাদের সত্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। এর এক-একটি ইচ্ছা আমাদের এক-এক দিকে টেনে নেয়, আমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। এসব ইচ্ছা আমাদেরকে আকর্ষিত করতে থাকে এবং সত্যের খোঁজ থেকে আমাদেরকে দূরে সরিয়ে দেয়। এগুলি সব তখন এক-একটি নেশার বস্তুতে পরিণত হয়। আমরা পাগলের মতো এসব কৃত্রিম সুখের পিছে ছুটতে থাকি। যখন আমরা অর্থের পিছু ছুটি, তখন অর্থের নেশায় আমরা বুঁদ হয়ে থাকি। তখন যে-কোনও উপায়ে আরও অর্থ উপার্জন করাই আমাদের মুখ্য কাজ হয়ে দাঁড়ায়। যখন আমরা সাফল্যের পিছু ছুটি, তখন আমরা অন্ধের মতো কেবল সাফল্যকেই ছুঁতে চাই। আমরা আমাদের যাবতীয় সবকিছু উজাড় করে হলেও সাফল্য পেতে চাই। আমরা জগতজুড়ে খ্যাতির আশায় আমাদের পুরো সময় এর পেছেনে লাগিয়ে দিই। এবং, আমরা ক্রমশই এমন একটা দুঃখের দুষ্টচক্রে নিজেকে আবর্তিত করতে থাকি, যেখান থেকে বেরিয়ে যে আসতে হবে, সেটাই আমৃত্যু আমাদের মাথায় আসে না। আমাদের জীবনযাপন ও মৃত্যুযাপন, দুইই হয়ে যায় যন্ত্রণাবিদ্ধ, মামুলি।


আমরা কখনও কি নিজেদের জিজ্ঞেস করে দেখি, এসব জাগতিক সাফল্য আসলে আমাদের কী দেয়? জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বাঁচার মতো বেঁচে থাকা, প্রতিটি মুহূর্তকে আলিঙ্গন করে এর রসআস্বাদন করাই আমাদের জীবনের প্রকৃত রহস্য। অথচ আমরা জাগতিক এসব মোহে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে থাকি যে আমরা, এমনকি, সচেতনভাবে শ্বাস নিতেও ভুলে যাই। জাগতিক মোহ আমাদেরকে একসাথে অনেকগুলি গন্তব্যের দিকে পরিচালিত করে, যার ফলে আমাদের ভেতরে মাঝে মাঝেই এই বোধ কাজ করে যেন আমরা তলিয়ে যাচ্ছি। যখন আমরা সত্যের খোঁজ করি, তখন সকল জাগতিক মোহ কেটে যায়। এটি আমাদের একক পথে পরিচালিত করে। তখন জাগতিক এ সকল উদ্দেশ্যগুলি, যার পেছনে আমরা এতকাল পাগলের মতো ছুটেছি, সেই সবকিছু খুব ছোট মনে হতে থাকে। কচুগাছের পাতায় একবিন্দু পানি যেভাবে জমে থাকে, আমাদের জাগতিক সাফল্যগুলি এমনই। যে-কোনও সময় এটি মাটিতে পড়ে যেতে পারে। এই একবিন্দু পানির সাথে সমুদ্রের কোনও যোগাযোগ নেই। সত্য সাগরের মতো বিশাল, এর সাথে কচুপাতায় জমে থাকা একফোঁটা পানির কোনও তুলনা হয় না, যোগাযোগও হয় না। সত্যের খোঁজ এবং জাগতিক সাফল্যের ভেতর পার্থক্য এখানেই। সত্যের সাগরে অন্যান্য সকল সাফল্য ছোট ছোট শাখানদী কিংবা নদী হয়ে অবশেষে সাগরে মিশে যায়। হায়, কচুপাতায় একবিন্দু পানিকেই পুরো সমুদ্র ভেবে আমরা এই মূল্যবান জীবনটা কাটিয়ে দিই!


সত্যের খোঁজ করে যাওয়া এমন একটি আকাঙ্ক্ষা, যেটি আমাদের ভেতরে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতো জ্বলতেই থাকে। এটি আমাদের আমিত্বকে প্রকট করে। আমাদের ভেতরের এই দেদীপ্যমান প্রকট আকাঙ্ক্ষাই আমাদের পরিচালিত করে। কেননা তখন আমাদের আর কোনও পিছুটান থাকে না। তখন আমাদের আর কোথাও ছুটবার প্রয়োজন নেই। আমরা শান্ত-সমাহিত হলে সত্য একাই আমাদের কাছে এসে ধরা দেয়, অস্তিত্ব নিজেই নিজের রহস্য আমাদের কাছে তুলে ধরে। বিভিন্ন উপাদান একত্রিত হয়ে সত্যকে জানার ইচ্ছা আমাদের মাঝে স্পষ্ট হয়, আর এই অদম্য ইচ্ছাই আমাদের কাছে এর জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান এনে একত্রিত করে। আর যখন আমরা পুরোপুরি আলোকিত হই, তখন সেখানে ‘আমিত্ব’ বলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ‘আমি’ বলে তখন আর কোনও পৃথকসত্তা নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা আমাদের এই আমিত্বকে উপড়ে ফেলতে পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা বুঝে নেব, আমরা আসলে এখনও সঠিক পথে নেই। কেননা আমরা যখন প্রকৃতই আলোকিত হই, তখন এটি আমাদের সেই মূল অস্তিত্বেরই অংশ, এখানে নিজের বলে আলাদা কোনও অস্তিত্ব থাকে না।


বাষট্টি।
যদি আমরা নিজেদের আলোকিত বলে দাবি করি, তবে আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারি যে, আমরা এখনও প্রকৃত অর্থে আলোকিত নই। প্রজ্ঞাকে কখনও নিজের বলে দাবি করা যায় না, কেননা আমরা জ্ঞানকে নিজের বলে দাবি করার আগেই নিজের আমিত্বকে এই আলোকসম্পাতে বিলীন করে দিই। যদি আমরা নিজেদের আলোকসত্তা বলে দাবি করি, তবে আমরা আসলে ভ্রান্তিতে বাস করছি। নিজেকে এটি দাবি করার অর্থই হলো, অহংকারী হয়ে ওঠা, আর একটি অহংকারী সত্তা কখনও আলোর অংশ হতে পারে না। একজন মানুষ তখনই প্রকৃতই আলোকিত হয়, যখন সে আলোর মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়, যখন তার মাঝে নিজের বলে আর কিছু থাকে না। এরপর আমরা বলি, আমি চিন্তা করি অথবা আমি মনে করি, আমিই দীপ্তি, আমিই আলোক। প্রকৃতপক্ষে সত্যর পথে আলোকসম্পাতে ভাবনার কোনও স্থান অথবা সংযুক্তি নেই। চিন্তা সর্বদাই জ্ঞানালোকের চেয়ে বহূদূরের, কারণ চিন্তা এমনই একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া, যা আমাদেরকে নিজের ভাবনার জগতে নিজেকেই তলিয়ে নিয়ে যায় এবং আচ্ছন্ন করে রাখে। এটি এমন এক প্রক্রিয়া, যা আমাদের চোখকে বেঁধে ক্রমাগত অন্ধের মতো বিপথে চালিত করে, আমাদের চোখে সত্যের আলোক প্রতিফলিত হতে দেয় না। এমন চিন্তা একটি বিধ্বংসী যন্ত্র, যা ভালো জিনিসগুলিকে ক্রমাগত তার নিজের সমস্ত ভুল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিকৃত করে দেয়।


অনেকে বলে, আমার মনে হয়, আমি প্রেমে পড়েছি! ভালোবাসা চিন্তার মাধ্যমে হয় না, ভালোবাসা একটি অনুভূতি। এটিকে কেবল অনুভব করা যায়। ভালোবাসা সকল চিন্তাজগতের ঊর্ধ্বে। তেমনি প্রজ্ঞা অথবা প্রজ্ঞাবান হওয়া কোনও চিন্তার বিষয় নয়, এমনকি এটিকে অনুভবও করা যায় না, এটি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ঠিক যেমন ভালোবাসা চিন্তার ঊর্ধ্বে, তেমনি জ্ঞানও অনুভূতির ঊর্ধ্বে। এককথায়, প্রজ্ঞা, চিন্তন, অনুভূতি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যখন এটি আমাদের মাঝে সৃষ্টি হয়, তখন এটি নীরবে আমাদের মাঝে বিরাজ করে। জ্ঞান কোনও আকস্মিক বিষয় নয়, হয় এটি আমাদের মাঝে উপস্থিত, নয়তো অনুপস্থিত। এর কোনও মধ্যমপন্থা বলে কিছু নেই। যখন আমরা বলি, আমরা প্রায় ভালোবাসার কাছাকাছি অথবা আমরা অনুভূতির কাছাকাছি, এমনটি কখনও হতে পারে না। হয় আমরা ভালোবাসার মধ্যে বাস করি, নয়তো এর বাইরে। আর যদি আমরা ভাবি, আমরা ভালোবাসার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, তার অর্থ, আমরা ভালোবাসা তৈরি করতে চাইছি, অনুভূতিকে সৃষ্টি করতে চাইছি।


ভালোবাসা, অনুভূতি, প্রজ্ঞা, জ্ঞান এগুলি কখনও তৈরি করা যায় না। এগুলি সদাবিরাজমান, এগুলি আমাদের মাঝে সৃষ্টির সূচনা থেকেই বিদ্যমান এবং আমৃত্যু থেকে যাবে। এসবকে কেবল জাগাতে হয়---উপযুক্ত সময়ে, পরিস্থিতিতে, অনুষঙ্গে। সুতরাং আমাদের ভেতরের এসকল ভ্রান্ত ধারণাগুলিকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। আমরা কেউ প্রজ্ঞাবান হতে পারি না, এটি নিজেই নিজসত্তায় আমাদের মাঝে সুপ্ত অবস্থায় সব সময়ই থাকে। এটি আমাদের অস্তিত্বেরই প্রকৃতি। আমারা একে যে প্রলেপ দিয়ে ঢেকে রেখেছি, আমাদের কেবল সেই প্রলেপগুলি ঝেড়ে ফেলতে হবে। অস্তিত্ব তার নিজস্ব সম্পূর্ণতায় পূর্ণাঙ্গ। জীবনকে বুঝতে গেলে আমাদেরকে কখনও কখনও জীবনের সাধারণ যুক্তির ঊর্ধ্বে যেতে হবে। জীবনের মহত্তম হিসেবগুলি সব সময় এর নিম্নতর হিসেবের সম্পূর্ণ বিপরীত। গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাস জীবনের দুইটি নীতির কথা বলেছিলেন। একটি প্রয়োজনীয়তার নীতি এবং অপরটি হচ্ছে শক্তির নীতি। এই প্রয়োজনীয়তার নীতিগুলি সব সময় জীবনের নিম্নতর হিসেবে বাঁধা, আর শক্তি হচ্ছে জীবনের মহত্তম হিসেব। যদিও উভয়ই বৃহৎ অস্তিত্বের অংশ, কিন্তু এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এরা ভিন্নভাবে কাজ করে। জীবনের এই নিম্নতর হিসেবগুলি এর পরিমাণগত দিক দিয়ে হয়ে থাকে, কিন্তু এর মহত্তম হিসেব বরাবরই এর গুণের বিকাশ ঘটায়।


যদি আমরা সমগ্রের একটি কণাকে বুঝতে সক্ষম হই, তবেই আমরা বৃহৎকে বুঝতে পারব। জীবনের নিম্নতর হিসেবগুলি এক-একটি কণার সমান, আর মহত্তম হিসেব একটি সমুদ্রের মতো বিশাল। সমুদ্রের বিশালতার মতো এর এক-একটি ফোঁটাতেও সত্য লুকিয়ে থাকে। পরিমাণগত দিক দিয়ে দুইটি দিক সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও গুণগত দিক দিয়ে সম্পূর্ণ এক। সমগ্র অস্তিত্বের কিছু অংশ যদি এর থেকে আমরা আলাদা করে ফেলি, অথবা কিছু যদি যোগ করি, এরপরও অস্তিত্ব পূর্ণাঙ্গ থেকে যাবে। আমরা যদি স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্বকে তাঁর থেকে আলাদা করে দেখি অথবা তাঁর সাথে আরও কিছু যুক্ত করে দেখি, তারপরও স্রষ্টা স্রষ্টাই থেকে যাবেন। যদি আমাদের অস্তিত্ব প্রজ্ঞাবান হয়, তবে এর প্রতিটি অংশকেই প্রজ্ঞাবান হতে হবে। কেবল তখনই এটি আমাদের কাছে প্রকট হয়ে ধরা দেবে। একটি সমগ্র শুদ্ধতার প্রতিটি অংশই শুদ্ধ হতে হবে। অস্তিত্বের গুণগত দিকটাই মুখ্য, এর পরিমাণগত দিক নয়। অস্তিত্ব কতটা বিশাল, তার চাইতে…এর গুণ কতটা প্রকট, সেটিই মুখ্য। আমরা যেমনই হই না কেন, আমরা তেমনভাবেই সবকিছু মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ সত্তা। সমগ্র অস্তিত্ব একটি পূর্ণগঠনের বুদ্ধিমত্তা। সুতরাং আমরা যেমনই হই না কেন, আমরা সকলেই সেই বুদ্ধিমত্তার এক একটি ক্ষুদ্র অংশ। যদি আমরা সমগ্র বুদ্ধিমত্তার জন্য এর প্রয়োজনীয়তার একটি ক্ষুদ্র অংশ না হতাম, তবে আমাদের সৃষ্টি করাই হতো না, কেননা অস্তিত্ব পূর্ণাঙ্গতায় বিশ্বাসী এবং অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা থেকেই এর সৃষ্টি।


এই পৃথিবীতে ভোগান্তি বলে কিছু নেই। আমরা যেগুলিকে কষ্ট নাম দিয়ে থাকি, সেগুলি আসলে আমাদের নিজেদেরই মনগড়া হিসেব। আমরা এখনও ঘুমিয়ে আছি বলেই কষ্টগুলি আমাদের দুঃস্বপ্নে ভেসে আসছে। আমাদের এই ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগতে হবে, তবেই আমরা প্রকৃত আনন্দের খোঁজ পাব। যদি আমরা মানসিক দুর্দশাগ্রস্ত হই অথবা অন্ধ হয়ে থাকি, তবে কী করে আমরা অস্তিত্বের দোষ দিই? কী করে এটিকে দুঃস্বপ্ন ভেবে নিই? আমাদের মেনে নিতে খারাপ লাগবে অথবা হয়তো আমরা মেনে নিতে চাইব না যে এই কষ্টগুলি বস্তুত আমাদের নিজেদেরই সৃষ্টি। যখন আমরা প্রকটভাবে সচেতন হব, কেবল তখনই এই দুঃস্বপ্নগুলি, এই অন্ধত্বগুলি পুরোপুরি আমাদের জীবন থেকে বিদায় নেবে। কষ্টের তীব্রতা কতটুকু, তা আমাদের ভাবনার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। একবার এক ব্যক্তি মোটরদুর্ঘটনায় তার দুটি পা-ই হারিয়ে ফেলল। পরবর্তী দুমাস সে দুশ্চিন্তায় ঘুমুতে পারল না, সে মেনেই নিতে পারছিল না তার দুটি পা-ই নেই। অবশেষে সে যখন দেখল, এটি মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই, খুব বেশি হলে সে দুটি কৃত্রিম পা লাগিয়ে নিতে পারে। তখন থেকে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় সে তার চোখ বন্ধ করে এটা কল্পনা করতে লাগল যে, সে দৌড়চ্ছে, হাঁটছে, সব কাজ করছে; তারপর ধীরে ধীরে সে কল্পনা করতে লাগল, তার কোনও শরীরই নেই। যখন থেকে সে কল্পনা করতে লাগল, তার কোনও শরীর নেই, সে কেবল একটি আত্মা, তখন থেকে মনে প্রশান্তি ফিরে এলো। সে হুইল চেয়ারে করে দিব্যি তার সব কাজ করে যেতে লাগল। যখন সে দেখল, সে হয়তো হাঁটতে পারে না, কিন্তু তার হাত দুটো দিয়ে সে অনেক কাজ করে যেতে পারে, তখন সে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করতে লাগল। তারপর থেকে লোকটি পুরো বদলে গিয়েছিল।


তার যে দুটি পা-ই নেই, এই বোধটুকু তার ভেতরে কখনও কাজ করত না। দুর্ঘটনা তার কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। এটাই ধ্যানের শক্তি। আমরা যখন নিজেকে অশরীরী কল্পনা করি, আমাদের আত্মার বোধ তখন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। স্বেচ্ছা-কষ্টভোগ কখনও আশীর্বাদ বয়ে আনে না। কে জানে আমরা হয়তো আমাদের আশীর্বাদকেই কষ্টভোগে রূপান্তরিত করছি! আমরা নিজেরাই নিজেদের চিন্তার দ্বারা কষ্টভোগ করছি, অথচ আমরা সেজন্য স্রষ্টাকে দোষ দিই। যদি আমাদের বোঝায় ভুল থাকে, তবে আমরা কী করে সেই দায় স্রষ্টার উপর চাপাতে পারি! আমরা ভুলভাবে সবকিছুর ব্যাখ্যা করছি, এটা মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হতে পারে, কিন্তু এটাই সত্য। আর কষ্টদায়ক হলেও সত্য আজীবন সত্যই থেকে যাবে। আমাদের বোধ অথবা চিন্তার দ্বারা এটিকে বদলে ফেলা যাবে না। সত্য প্রাকৃতিক, আর প্রকৃতি কখনও নির্বোধ হতে পারে না। প্রকৃতি পরম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। আমরা যারা প্রকৃতির বিরোধিতা করি, তারাই প্রকৃতিকে ধ্বংস করি, বাস্তুসংস্থানকে ধ্বংস করি, বাতাসকে দূষিত করি। এ ধরনের মানুষকে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতে হবে। যদি প্রকৃতি নির্বোধ হয়ে থাকে, তবে আমরা বোধসম্পন্ন হই কী করে? এবং আমরা বোধসম্পন্ন না হলে সমগ্রের অস্তিত্ব কী করে সত্য হয়! প্রকৃতিকে অস্বীকার করার অর্থই হচ্ছে, নিজেকে অস্বীকার করা আর নিজেকে অস্বীকার করলে মূলত আমরা পরমসত্যকেই অস্বীকার করি।


তেষট্টি।
আমরা হয়তো বলতে পারি, যদি প্রকৃতি এতই বোধসম্পন্ন হবে অথবা যদি প্রকৃতি সত্যিই ন্যায়শাস্ত্রসম্মত হয়ে থাকে, তবে মৃত্যু সংঘটিত হয় কেন? কেননা প্রকৃতি একটির বিরুদ্ধে অন্যটিকে কাজে লাগায়। যদি মৃত্যু না থাকত তবে জন্ম কী করে হতো? জন্ম, মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহ, সবকিছুই প্রকৃতির একটির বিরূদ্ধে অন্যটির সঞ্চালন, যা ক্রমাগত চক্রাকারে ঘুরছে। ঠিক যেমন দিনের আলো রাতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে অথবা দিনের আলোই রাতের আঁধার ঘুচিয়ে দেয়। একটি অন্যটির সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও একটির প্রয়োজনেই অন্যটি ঘটে থাকে। ঘৃণার বোধ আছে বলেই ভালোবাসা এতটা সত্য। আমরা কাউকে ঘৃণা করি বলেই অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারি। অথবা অপ্রয়োজনীয় কারও চলে যাওয়ার মাধ্যমেই আমাদের জীবনে প্রয়োজনীয় কারও আগমন ঘটে। কেননা প্রয়োজনীয়তা জীবনের নিম্নতর নীতি, এটি অস্তিত্বেরই ক্ষুদ্র একটি অংশ। যদি আমাদের অস্তিত্বের আমাদের প্রয়োজন না থাকত, তবে আমরাও এখানে থাকতাম না। অস্তিত্বের প্রয়োজনেই আমাদের আগমন এবং বিস্তার। যদি পুরুষ না থাকত তবে নারীসত্তার কি প্রয়োজন হতো? নারী এবং পুরুষ উভয়েই একে অপরের পরিপূরক। ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক চৌম্বকতত্ত্ব ছাড়া বিদ্যুতের কোনও অস্তিত্ব থাকত না।


প্রকৃতি ভালো করেই জানে, কী করে সবকিছুতে ভারসাম্য বজায় রাখা যায়। সুস্থতা-অসুস্থতা, সুন্দর-কদাকার, সাফল্য-ব্যর্থতা, কষ্টভোগ-আশীর্বাদ এই সবকিছুই প্রকৃতির অংশ। এসবের মধ্য দিয়েই প্রকৃতি সবার সাথে ন্যায়আচরণ ঘটায়। প্রয়োজনীয়তার নীতি আমাদের নিচের দিকে নিয়ে যায় এবং শক্তির নীতি আমাদেরকে উপরের দিকে ঠেলে দেয়। জীবসত্তাকে টিকিয়ে রাখাই প্রয়োজনীয়তার নীতি দ্বারা পরিচালিত, অপরদিকে মানবসত্তা টিকে থাকে শক্তির নীতিতে। এর একটি আমাদের রোবটে পরিণত করে এবং অন্যটি চিত্তের স্বাধীনতা দান করে বলেই আমাদের অস্তিত্বের ভারসাম্য বজায় থাকে। যৌক্তিকতা জীবনের সঠিক প্রক্রিয়া নয়, মতামতের ভিন্নতার মাধ্যমেই জীবনের বৃদ্ধি। বৈপরীত্য আছে বলেই জীবন এতো সুন্দর। যৌক্তিকতার ভিত্তিতে যদি কেবল পুরুষ সৃষ্ট হতো? অথবা যদি কেবল নারীদের সৃষ্টি করা হতো? যদি সমগ্র বিশ্বে পুরুষেরা পুরুষের সাথে মিলনে লিপ্ত হত? অথবা এক নারী অন্য নারীর সাথে? তাহলে আমাদের নিজেদেরই কি ভালো লাগত? কেবল যদি এটা চিন্তা করি যে, সমগ্র পৃথিবী সমকামিতায় লিপ্ত, তখন আদৌ আমরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেব? প্রকৃতি একটির বিরূদ্ধে অন্যটিকে তার পরিপূরকরূপে জীবনের বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে, তা না হলে আমাদের জীবন রসবোধশূন্য, একগুয়ে, পানসে হয়ে যেত।


চিন্তার মাঝেই আনন্দ বিরাজমান। দুশ্চিন্তা আছে বলেই আনন্দের মূল্য এতো বেশি। দুশ্চিন্তা এলেই আনন্দের সম্ভাবনা প্রকট হয়। ধরুন, আপনি কাউকে ভালোবাসেন, ভালোবাসার জের ধরে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে আপনি যদি তাকে কেবল ভালোবাসা দিয়েই মুড়িয়ে রাখেন, সারাক্ষণ কেবল ভালোবাসি ভালোবাসি বলতে থাকেন, সারাদিন আদর দিয়ে দিয়ে অশান্ত করে তোলেন, তবে কিছুদিন বাদে আপনার কেমন লাগবে? যদি দিন বলে কিছু না থাকত? অথবা যদি কেবল রাত হতো? সারাবছর যদি বর্ষাকাল হতো, কিংবা বসন্তই থেকে যেত সবটা সময়ই? কেমন হতো যদি জীবন বিচিত্র না হতো? বৈচিত্র্য আছে বলেই জীবন এতটা জীবন্ত। যেখানে জীবন নেই, সেখানে বৈচিত্র্য বলে কিছু হয় না। একটি জীবন্ত গাছের পাতারা মরে যায়, নতুন পাতা গজায়, গাছটি বড়ো হয়, একসময় সেটি ফুল অথবা ফল দেয়, একসময় বীজ দেয়, এভাবেই জীবন টিকে থাকে, জীবনের রচনা - সমাপ্তি এর মাঝেই। একটি মৃত গাছের কোনও বৈচিত্র্য থাকে না। যখন আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষের সাথে ঝগড়া করি, তখন সেখানে আমাদের মাঝে একটি ছোটোখাটো বিচ্ছেদ ঘটে যায়। আমরা রাগে ওই মুহূর্তে ভাবতে থাকি, অনেক সহ্য করা হয়েছে, আর নয়। এখানেই সমাপ্তি! ওই নারী অথবা ওই পুরুষের সাথে আমরা আর কথা বলব না, আর তার কাছে যাব না, ইত্যাদি ইত্যাদি।


আমরা এরপর তার থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে সরে যাই অথবা কিছু মুহূর্তের জন্য তার থেকে দূরে সরে থাকি, তার সাথে কথা বলি না, আমরা তাকে আমাদের চোখের সামনে সহ্য করতে পারি না, তাকে দূরে দূরে রাখি, আমরাও দূরে সরে থাকি। অনেক সময় প্রকৃত ঘটনার তীব্রতা যতটা না, তার চেয়েও বেশি দূরে সরে যাই। আমরা ভাবি, এবার বোধহয় সব শেষ। আর কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না। এরপর কিছু মুহূর্ত গেলে আমাদের রাগ কমতে থাকে, আমরা ধীরে ধীরে তাকে মিস করতে থাকি, তারপর একটা সময় আমাদের মনে হয়, মানুষটা আসলে অতটাও খারাপ নয়। এরও অনেক পরে গিয়ে আমাদের নিজেদেরও কিছু দোষ আমাদের চোখে পড়ে, তখন আমরা আবার একে অপরের কাছে যাই। সেই মুহূর্তে আমাদের মনে হয়, এ যেন স্বর্গীয় সুখ। এভাবেই আমাদের জীবন কাটতে থাকে। আমরা সকালে ঝগড়া করি, রাতেই সব ভুলে এক হয়ে যাই, আবার হয়তো রাতে ঝগড়া করি, সকালে ঘুম থেকে উঠে সব ঠিক হয়ে যায়। একে অপরের দূরে যাবার মধ্যেই একে অপরের কাছে আসার আনন্দ ভোগ করা যায়। সেই আনন্দ তখন প্রকট হয়ে আমাদের পরম এক সুখের স্রোতে ভাসিয়ে নেয়। এভাবে ডান বাম করেই জীবনের প্রক্রিয়া চলমান।


কিছু বিষয় আমরা দর্শক হয়েও জানতে পারি, আবার কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলি কেবল অংশগ্রহণের মাধ্যমেই জানা যায়। কিছু বিষয় বাহ্যিক দিক থেকে ভুল মনে হয়, আবার সেই বিষয়ের অভ্যন্তরে গেলেই আমরা তার সত্যতা অনুধাবন করতে পারি। কেবল সচেতনভাবেই আমরা এর প্রকৃত কারণ জানতে পারি। আমাদের যখন কোনও কিছু বাহ্যিক দিক থেকে ভুল মনে হয়, তখন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা উচিত। কেননা যখন আমাদের অভিজ্ঞতালাভের সুযোগ আসবে, আর সেদিন আমরা ঠিক সত্যটা জানতে পারব। অনেক কিছু, যা আপাতদৃষ্টিতে আমাদের চোখে নিরর্থক মনে হয়, অথবা যা-কিছু আমরা আজ অবমূল্যায়ন করি, আমরা যদি ধৈর্য ধরে থাকতে পারি, একদিন সেটি আমাদের হয়তো তার মূল্য বোঝাবে। সাধারণত আমরা যে জিনিসকে খুব সস্তা মনে করি, সেসব ক্ষেত্রেই এমন হয়। হঠাৎ যখন সে জিনিস আমাদের হাতছাড়া হতে থাকে, তখন আমরা এর প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করি। অনেকের কাছে প্রচুর অর্থ আছে বলে সে অর্থের অবমূল্যায়ন করে যেন-তেনভাবে খরচা করে ফেলে, কারও কাছে এই মুহূর্তে অনেক সময় আছে বলে সে সময়কে অবহেলা করে, অপচয় করে নষ্ট করতে থাকে…একদিন যখন এই জিনিসগুলি দুষ্প্রাপ্য হয়, সেদিন সে বুঝতে পারে, আসলে এতদিন সে আসলে কতটা ভালো ছিল অথবা নিশ্চিন্তে ছিল। যা-কিছু আমরা অবমূল্যায়ন করি, একদিন তার জন্যেই আমাদের চড়া মূল্য দিতে হয়।


জীবনের এমন কিছু সত্য জানতে চাইলে নিবিষ্ট মনে ধ্যান বা অনুধ্যান করতে হয়। নিজেকে সময় দিতে হয়। আমরা অন্যদের সময় দিতে দিতে, রাজ্যসুদ্ধ লোকের সাথে কথা বলতে বলতে, নিজের সাথে বসে কিছু সময় আলাপ করতে পারি না, সে সময়টাই আমাদের হাতে নেই। সেই কাজটি খুব সহজেই ধ্যানের সাহায্যে করা যায়। নিজের মনের সাথে নিজের যাপন, এর মানেই ধ্যান। ধ্যান এমন এক জিনিস, যা কেবল অংশগ্রহণের মাধ্যমেই জানা সম্ভব। বিপুল অর্থ অথবা অন্য কোনও কিছুর বিনিময়ে ধ্যান সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। ধ্যান এই পৃথিবীর নানান রহস্য ও সে রহস্যের উপর আমাদের মনের প্রভাব কী, আমাদের মনের শক্তি ও শক্তিকে কাজে লাগানো, এমন নানান বিষয় নিয়ে ভাবতে ও বুঝতে শেখায়। ধ্যান এক অমোঘ সত্য, যে সত্যকে জানতে হলে আমাদের এতে অংশগ্রহণ করতে হবে। নিজের সাথে নিজের এই যে যাপন বা ধ্যান, সেটিই আমাদের অনন্য মানুষ করে তোলে।