অস্পষ্ট জার্নাল: ১৫

 
নিরানব্বই।
জীবনের কাছে এর বেশি কী এমন রসদ রয়েছে, যা এই জীবন আমাদেরকে দেয়নি? যে জীবনে আমাদের বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে সুখ এনে দিতে পারেনি, মৃত্যুর দ্বারে বসে সেই জীবনেরই কাছে মৃত্যুকে থামিয়ে আমরা আবার কিছুটা সুখের আশা করতে থাকি---এখানেই আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, এটিই সবচাইতে করুণ। আমরা মৃত্যুকে থামিয়ে রাখতে চাইলেই কি সে আমাদের তীরে নৌকা ভিড়িয়ে থেমে যাবে? আমরা তো সেই মুহূর্তেই একটা অতৃপ্ত জীবন নিয়ে ঠিকই মৃত্যুকে বরণ করতে বাধ্য হব এবং সেই সূত্র ধরেই আমরা আবার এই জগতের কাছে ফিরে আসি। আমাদের জীবনের প্রতি ক্ষুধা আমাদেরকে অস্থিতিশীল করে তোলে, আমরা নিজেকে তৃপ্ত করতে ব্যর্থ হই, ফলে শেষমুহূর্ত পর্যন্তও আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলি তেমনই থেকে যায়। যদি আমরা দেখতে পাই, এই পৃথিবীর সাথে আমাদের নির্ভরযোগ্য কোনও সম্পর্ক নেই, এই জীবনের কাছে সুখলাভের কোনও পথ নেই; যদি আমরা দেখি, আমরা অদৃশ্যে মিলিয়ে যাই; যদি আমরা জানি, আমরা একটি স্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি---আমাদের এ সকল সচেতনতাই আমাদেরকে আলোকিত করে তোলে, এই অভিজ্ঞতাগুলো যখন আমাদের ভেতর থেকে আসে, তখনই আমরা প্রজ্ঞাবান। মৃত্যুর আগেই একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির হাজার বার মৃত্যু হয়। আমাদেরকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে গভীর চিন্তার সাথে গ্রহণ করতে হবে যেন আমরা আমাদের সচেতনতাকে কাজে লাগাতে পারি।
 
মৃত্যুকে সচেতনভাবে নিতে জানলে, যখন সত্যিই মৃত্যু এসে আমাদের কাছ থেকে জীবনটাকে ছিনিয়ে নেয়, তখন আর আমরা সেই শিশুর মতো কাঁদি না, যে শিশুটির কাছ থেকে এইমাত্র কোনও খেলনা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তখন বরং আমরা মৃত্যুকে স্বাগত জানাতে পারি, হাসিমুখে মৃত্যুর অভিজ্ঞতাকে জয় করতে পারি, মৃত্যুকে বলে দিতে পারি, ‘আমি তোমার জন্য তৈরিই ছিলাম, এখন আমাকে গ্রহণ করো, মুক্ত করো!’ যখন আমরা মৃত্যুকে এভাবে আমাদের অনুভূতিগুলো জানিয়ে দিই, তখন আমাদের কণ্ঠস্বরে এক পরমশান্তি ভেসে আসে, আমরা মৃত্যুকে আশীর্বাদের সাথে গ্রহণ করি। যখন একজন সাধারণ মানুষ অন্তত এটুকু জানে যে আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত, তখন সেই মানুষটিও একজন আলোকিত মানুষের মতোই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয়। এই জীবনের প্রতি তার সকল আশা চিরতরে শেষ হয়ে যায়, তখন এখানে আবার ফিরে আসবার কোনও ইচ্ছেই তার থাকে না। মৃত্যুর ছায়া প্রতিটি মানুষের উপরে সবসময় ছেয়ে থাকে, কিন্তু একজন অজ্ঞ মানুষকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর ভয়ে মৃত্যুর সাথেই লড়াই করতে হয়, যেখানে একজন আলোকিত মানুষ মৃত্যুর সত্যতাকে গ্রহণ করে সুখের সাথে প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকেন। ভয়ের অনেক কারণ থাকতে পারে, তবে তার মূল কিন্তু একটিই। যখন আমরা যে-কোনও বিষয় নিয়েই ভীত হই, তখন আপাতদৃষ্টিতে সেটিকে পার্থিব কোনও কারণ মনে হলেও একটু গভীরে ভেবে দেখতেই আমরা দেখব, আমাদের সকল ভয়ের প্রকৃত কারণ মৃত্যু, ভয়ের মূলটি মৃত্যুতেই প্রোথিত।
 
যখন আমাদের মাঝে অর্থ খোয়া যাবার ভয় আসে, আমরা ভয় পাই এই ভেবে যে আমরা দেউলিয়া হয়ে যাব, আমরা দারিদ্র্যের ভয় পাই, কিন্তু আরও গভীরে গেলে আমরা বুঝতে পারি, এটি আসলে অর্থ হারাবার ভয় নয়, এটি দারিদ্র্যের ভয়ও নয়, এটি আসলে মৃত্যুভয়। যখন আমাদের আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে, তখন আমরা আসলে মনে মনে ভয় পাই, এখন যদি আমরা বড়ো কোনও রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি, তবে আমাদের চিকিৎসার খরচ আসবে কোথা থেকে? যদি আমাদের ডাক্তার দেখাতে দেশের বাইরে যেতে হয়, কিন্তু আমাদের কাছে টাকা না থাকে, তখন আমাদের মৃত্যু হতে পারে! অর্থ না থাকলে আমরা কী করে নিজেকে বাঁচাতে পারব? আমাদের অর্থভয় আসলেই আমাদের মৃত্যুভয়ের জন্যই, কেননা আমরা মৃত্যুকে থামিয়ে দিতে চাই, আমরা আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই, কিন্তু সেজন্য আমাদের অর্থের প্রয়োজন। অর্থ আমাদের জীবনের নিশ্চয়তা এনে দেয়, আমাদের শরীরে খাদ্যের প্রয়োজন মেটায়। যখন আমাদের ভালোবাসার মানুষটি, হতে পারে আমাদের জীবনসঙ্গী, অথবা খুব কাছের কেউ, মৃত্যুশয্যায় পড়ে থাকে, তখন সেই মানুষটির সাথে সাথে আমাদের ভেতরেও মৃত্যুভয় এসে ভর করে, কেননা আমাদের ভালোবাসার মানুষটি আমাদেরই জীবনের অংশ, আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষটিকে আমরা নিজের অর্ধাংশ মনে করি, আর যখন আমাদের সেই অর্ধাংশ আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকে, তখন আমাদের আংশিক মৃত্যু ঘটে।
 
আমাদের কাছের মানুষগুলোর, যাদের সাথে আমাদের আবেগ জড়িয়ে আছে, তাদের মৃত্যু আমাদের ভেতরটাকে দুর্বল করে দেয়, আমাদের আংশিক ক্ষয় করে দেয়, এরূপ প্রতিটি আংশিক মৃত্যুর ভয় আমাদেরকে মৃত্যুর আরও কাছে নিয়ে যায়। আমরা আসলে আমাদের ভালোবাসার মানুষটিকে হারাবার ভয়ে ভীত নই বরং নিজের মৃত্যুভয়ে ভীত। কেননা আমাদের ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুতে আমাদেরও যে আংশিক মৃত্যু ঘটে, তার ফলে আমরা আর আগের সেই মানুষটি থাকি না, আমরা তখন আংশিক মৃত হয়ে পড়ে থাকি। কাউকে ভালোবাসলে আমরা নিজেরাই ভালো থাকি বলেই ভালোটা আমরা বাসি। তাই বলা যায়, জগতের সকল ভালোবাসাই মূলত নিজেকে ভালো রাখার জন্যই ভালোবাসা। আমাদের ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুতে আমাদের মনে হতে থাকে, এর চেয়ে বরং সেই মানুষটির সাথে আমি নিজেও মরে গেলে ভালো হতো, আমরা আমাদের নিজেদের মৃত্যুকামনা করতে থাকি, কেননা সেই অংশটি ছাড়া বেঁচে-থাকাটাই আমাদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। নিজ সত্তার খণ্ডঅংশ নিয়ে প্রতি মুহূর্তের মৃত্যুর চাইতে আমাদের সমস্ত অস্তিত্বের মৃত্যুই আমাদের কাছে শান্তির মনে হয়। কেননা আমাদের খণ্ডঅংশটি আমাদেরকে সর্বদাই মৃত্যুযন্ত্রণা দিতে থাকে, সেই মানুষটিকে ছাড়া আমরা যেন প্রতিদিন হাজার বার মরে যাই। আমরা প্রতি মুহূর্তেই মরে যাই, প্রতিটি ভয়ের মুহূর্তে মরে যাই, এরূপ মৃত্যু সঠিক মৃত্যুর পথ নয়। কেননা আমাদের সঠিক মৃত্যু এক বারই ঘটে, যা আমাদের জীবনে পূর্ণভাবে বাঁচার স্বাদ এনে দেয়, আমাদের সঠিক মৃত্যু আমাদের ভেতর থেকে পুনরায় মৃত্যুর সাধ-আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু ঘটায়।
 
একশো।
যখন আমরা কোনও কাজ সঠিক পথে, সঠিক কৌশলে করি, তখন সেটি আর দ্বিতীয় বার করার প্রয়োজন পড়ে না। যখন আমরা এক বার সঠিকভাবে মৃত্যুবরণ করি, তখন আমাদের পুনরায় ফিরে আসার প্রয়োজন নেই। এ বিষয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। বহু বছর আগে একজন সংগীতশিল্পী ছিলেন, যিনি তাঁর সুরেলা গায়কীর জন্য জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি ভাবতেন, তিনি খুব ভালো গান গাইতে জানেন, কিন্তু তিনি আদতে একজন প্রাথমিক পর্যায়ের গায়ক ছিলেন। তিনি খুব কষ্টের সাথে কেবল গানের আদ্যক্ষরগুলো শিখেছিলেন, কিন্তু তাঁর স্টেজে দাঁড়িয়ে গান করার অভ্যাস ছিল, তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে গান করতে পছন্দ করতেন। কিন্তু তিনি এমন সব জায়গায় গান গাইতেন, যেখানে কেউ গান সম্পর্কে কিছুই জানত না, এমনকি গানের প্রাথমিক ধারণাগুলোও নয়। এজন্য তিনি ভাবতেন, তিনি আসলে খুব ভালো গায়ক, তাঁর নিজেকে নিয়ে গর্ব হতো। এক বার তিনি এমন এক জায়গায় গান গাইতে গেলেন, যেখানে গানের কিছু অভিজ্ঞ লোক ছিল, যাঁরা গান জানতেন। তিনি স্টেজে উঠে এক লাইন গান শোনাবার পর পরই সেখানকার শ্রোতারা কেঁদে উঠল এবং তাকে আরও গাইতে বলল। এভাবে প্রায় আট-দশ বার খুব কষ্টে গান করার পরে তিনি তাঁর গলায় এবং ঠোঁটে খুব ব্যথা অনুভব করলেন, ফলে তিনি শ্রোতাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন এই বলে যে, তিনি আর গান গাইতে পারছেন না, কেননা এরই মধ্যে তিনি খুব ক্লান্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর শ্রোতারা কিছুতেই তাঁকে ছাড়ছিল না। তিনি ভাবলেন, তাঁর শ্রোতারা তাঁর গানের সুরে পাগল হয়ে আরও অধিক শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে, তাঁর নিজেকে নিয়ে খুব গর্ব হচ্ছিল, কিন্তু তিনি সত্যিই এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে আর কিছুতেই গাইতে পারছিলেন না। তিনি তাঁর শ্রোতাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন, কিন্তু তাঁর শ্রোতারা তাঁকে জানাল, যতক্ষণ না তিনি সঠিক পদ্ধতিতে গান গাইতে পারছেন, ততক্ষণ তাঁকে গান গেয়েই যেতে হবে। গায়কটি তাঁর শ্রোতাদের কথায় আহত হলেন। তিনি এতক্ষণ এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে ছিলেন যে তিনি সঠিক পথেই হাঁটছেন, তাঁর শ্রোতারা তাঁর গানের সুরে পাগল হয়ে তার কাছে বারে বারে আরও গান শুনতে চাইছে, অথচ যখন তিনি বুঝলেন, তাঁর শ্রোতারা তাঁর ভুল শুধরে দেবার জন্য এতক্ষণ তাঁর গান শুনে কেঁদে যাচ্ছিল এবং চিৎকার করে আবারও গাইতে বলছিল, তখন তিনি আহত হলেন, তাঁর ভুল খুঁজে পেলেন, আর ভাবলেন, আহা, কত বোকাই না তিনি ছিলেন!
 
অনেক সময় স্রষ্টা আমাদেরকে একই পরিস্থিতিতে বারে বারে ফেলেন, এর অর্থ এ নয় যে আমরা তাঁর কাছে খুব দামি, এর অর্থ হচ্ছে, আমরা সঠিক পদ্ধতিতে কাজটি সম্পন্ন করিনি, ফলে স্রষ্টা চাইছেন আমরা যেন সঠিক পথে কাজটি শেষ করি। অনেক সময় আমাদেরকে এই জগতে ফেরত পাঠানো হয় এজন্য নয় যে আমরা স্রষ্টার খুব প্রিয় এবং পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেউ, বরং এর অর্থ হচ্ছে, আমাদের জীবনযাপনের পদ্ধতিটি ভুল এবং স্রষ্টা আমাদের বারে বারে সুযোগ দিচ্ছেন যেন আমরা সঠিক পথে জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে স্রষ্টার কাছে ফিরি, কেননা যদি আমাদের ভেতরে কোনও বিন্দু পরিমাণও ভুল কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবে আমরা স্রষ্টার কাছে মিশে যেতে পারব না, স্রষ্টা অসম্পূর্ণ নন, তিনি অপূর্ণতাকে গ্রহণ করেন না। সেজন্যেই আমাদের তিনি বারে বারে পাঠান যেন আমরা পূর্ণ অভিজ্ঞতা লাভ করে তাঁর কাছে ফিরি, কেননা কোথাও-না-কোথাও আমাদের অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছে, আমরা সেই অপূর্ণতা নিয়ে স্রষ্টার কাছে ফিরে যাচ্ছি। স্রষ্টার কাছে, অপূর্ণতা গ্রহণের অযোগ্য, তিনি কেবল পূর্ণতাকে গ্রহণ করেন। যতদিন আমরা মৃত্যুকে ভয় করব, ততদিন আমাদের ভেতরে ভালোবাসা কখনও জন্ম নেবে না। কেননা ভালোবাসা হচ্ছে স্রষ্টার পথ। ভালোবাসা একটি প্রার্থনা, ধ্যান, আরাধনা। এটি উপাসনা, কখনও কখনও অনুশোচনা। ভালোবাসা সব কিছুর সারাংশ এনে দেয়, ভালোবাসা সাধনার সর্বশেষ পর্যায়। আমাদের সেই সাধনার ঘরটি এখনও আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরে।
 
ভালোবাসা সম্পর্কিত আমাদের প্রায় সকল ধারণাই ভ্রান্ত। আমরা যেটিকে ভালোবাসা বলি, সেটি প্রকৃত ভালোবাসা নয়, এটি কেবলই একটি প্রতীক, যা কিনা আমরা কোনও প্রসাধনের বাইরে ব্যবহার করি। এটির অনেক আকৃতি থাকতে পারে, কিন্তু এটি ভালোবাসা নয়, যা আমরা ভাবি। যে মানুষ জানে, ভালোবাসাকে জানার অর্থ স্রষ্টাকে জানা, তার কাছে জানার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। যে মানুষ ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে মৃত্যুবরণ করে, সেটিই হয় তার চূড়ান্ত মৃত্যু। সেই ভালোবাসার শিক্ষায় শিক্ষিত হলে কারও এই পৃথিবীতে ফিরে আসবার আর কোনও কারণ নেই। একজন প্রকৃত প্রেমিক হতে গেলে নিজেকে, নিজের আমিত্বের সত্তাটিকে মুছে ফেলতে হবে। আমরা যত জলদি নিজের আমিত্বকে নিজের ভেতর থেকে মুছে ফেলতে পারব, তত জলদি একজন প্রকৃত প্রেমিক হয়ে উঠব। যখন আমরা পুরোপুরি একজন প্রেমিক হয়ে উঠব, তখন আমরা দেখতে পাবো, আমরা স্রষ্টার দ্বারে এসে গেছি, স্রষ্টা আমাদের প্রার্থনার ডাক শুনেছেন এবং আমাদের কাছে এসেছেন, আমাদের জন্য তাঁর দুয়ার উন্মুক্ত করেছেন, আমাদের ভালোবাসাকে গ্রহণ করেছেন।
 
উদ্‌ভ্রান্তের মতো আমরা যখন স্রষ্টাকে ধর্মালয়ে খুঁজে বেড়াই, তখন আমাদের ভেতরের আমিত্ব আরও উন্নত হতে থাকে, আমাদের ইগো আত্মতৃপ্তি বোধ করতে শুরু করে। এমন সময় আমরা স্রষ্টার অজুহাতে যা-কিছুই করি না কেন, স্রষ্টাকে না পাওয়ার আক্ষেপ আমাদের মাঝে ঝড় তোলে। যেহেতু আমরা স্রষ্টাকে সকল ধর্মালয়ে খুঁজেছি, সেই অহমবোধ থেকে আমাদের ভেতরে এক চূড়ান্ত আত্মতুষ্টি, আত্মঅহমিকা তৈরি হয়, তখন এটি কেবল আমাদের নিজেদেরকে ভ্রান্ত তুষ্টিই এনে দেয়, স্রষ্টার সান্নিধ্য নয়। প্রতি মুহূর্তে আমরা যখন মৃত্যুর ভয়ে স্রষ্টার কাছ থেকে দূরে সরে যাই, তখন স্রষ্টাকে লাভ করা সম্ভব হয় না। স্রষ্টাকে পেতে চাইলে মৃত্যুভয় থেকে সরে এসে, স্রষ্টার ভালোবাসায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে দিয়ে তবেই স্রষ্টাকে পাওয়া সম্ভব, কেননা যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মাঝে আমাদের আমিত্বের কিছুমাত্রও অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণ স্রষ্টার ভালোবাসায় নিজেকে বিলীন করে দেওয়া অসম্ভব। স্রষ্টাকে পাবার প্রধান শর্তই হচ্ছে, নিজের অহমসত্তার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি। একজন প্রকৃত প্রেমিক তার ভালোবাসাকে পাবার জন্য নিজেকে লীন করে দিতে কখনও কুণ্ঠিতবোধ করে না, মৃত্যুভয় তাকে কখনও স্পর্শও করে না, বরং সে পার্থিব জগতের সকল ছোটো-বড়ো পরীক্ষাকে এমনভাবে গ্রহণ করে যেন জীবনের শেষমুহূর্তে এসে সে একবুক তৃপ্তি নিয়ে যেতে পারে এই ভেবে যে, সে তার দায়িত্ব, তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে পূরণ করতে চেষ্টা করে গেছে।
 
একশো এক।
আমাদের ভালোবাসার সাথে আমাদের দূরত্বটি আমাদের ইগোর সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমরা আমাদের ভালোবাসার সামনে যতটা ইগো নিয়ে যাই, আমাদের ভালোবাসার সাথে আমাদের দূরত্ব ঠিক ততটাই। আমাদের ইগোর পরিমাণ যত কমে আসে, আমাদের আমিত্ব যত অদৃশ্য হতে থাকে, আমাদের ভালোবাসার সাথে আমাদের দূরত্ব ততই কমতে থাকে। যখন আমরা পুরোপুরি ইগোশূন্য হয়ে পড়ি, তখন আমাদের ভালোবাসা সর্বোচ্চ স্থান লাভ করে, আমাদের ভালোবাসা জয়ী হয়। সুতরাং আমাদের ভালোবাসা কখনও আমাদের থেকে দূরে সরে নেই, বরং আমরা একে আমাদের থেকে কতটা দূরে সরিয়ে রেখেছি, সেটিই মূলকথা। স্রষ্টার সাথে আমাদের দূরত্ব নেই কিছুমাত্রও, যাকে আমরা দূরত্ব বলে জানি, সেটি আসলে পুরোটাই আমাদের ভ্রান্ত আমিত্বের দখলের ফল। আমার এবং আমার স্রষ্টার পথটা সোজা। আমরা যত আমাদের ইগোকে পরিষ্কার করব, ততই সেই পথ সংক্ষিপ্ত হতে থাকবে। যখন আমাদের ইগো পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে যাবে, তখন আমরা যদি আমাদের নিজের ঘরেও বসে থাকি, তা সত্ত্বেও স্রষ্টার দরজা আমাদের সামনেই দেখা দেবে। এর অর্থ, আমাদের থেকে আমাদের স্রষ্টার দূরত্ব আসলে একবিন্দুও নয়, স্রষ্টা এতটাই আমাদের কাছেই রয়েছেন। স্রষ্টা তাঁর দরজা কখনও আমাদের জন্য বন্ধ করে রাখেননি, আমরাই নিজেদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে রেখেছি।
 
ইগো এমনই এক বিষ, যা আমাদের মাঝে তিক্ততার সৃষ্টি করে। আমরা ভাবি, এটি আমাদেরকে স্রষ্টার কাছে যেতে, স্রষ্টার ভালোবাসা পেতে সাহায্য করবে, আমাদের মনকে পরিশুদ্ধ করে সেটিকে নতুন রূপে রূপান্তরিত করবে, কিন্তু যখন আমরা দেখি, এটি আসলে আমাদের কণামাত্রও সমৃদ্ধিশালী করেনি, বরং স্রষ্টার প্রতি ভ্রান্ত ধারণা, অবাস্তব চিন্তার জন্ম দিয়েছে, তখন আমরা এর ক্ষতির পরিমাণটা ঠিক বুঝতে পারি। যখন আমরা কোনও ধর্মালয়ে যাই, আমরা ভাবি, সেখানেই কেবল স্রষ্টা রয়েছেন, আমরা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করি, কেননা আমরা সেখানে পৌঁছুতে পেরেছি, যা আজ পর্যন্ত অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি, এখন আমরা সেইসব লোকেদের সামনে নিজেকে বড়ো এবং ভাগ্যবান বলে প্রমাণ করতে চাইব, কেননা স্রষ্টা আমাদেরকে তাঁর ঘরটি দেখিয়েছেন! আমার প্রশ্ন, এমন কিছু কি আছে, যেখানে স্রষ্টার সৃষ্টি নেই? যেখানে স্রষ্টার সৃষ্টি রয়েছে, সেখানে স্রষ্টা না থেকে পারেন? আমরা নিজেরাই যখন স্রষ্টার সৃষ্টি, তখন নিজের বাইরে স্রষ্টার ঘর কী করে খুঁজি? আমরা আমাদের আত্মজ্ঞানটি আর কবে তাহলে সঠিক উপায়ে কাজে লাগাতে সক্ষম হব?
 
আমাদের মাঝে স্রষ্টা যতটা রয়েছেন, তার বিন্দুমাত্রও কি বেশি রয়েছেন ধর্মালয়গুলোতে? আমাদেরকে স্রষ্টা এই শরীরে যতটা কারুকার্য দিয়েছেন, ধর্মালয়ের সৌন্দর্য কি তার চেয়ে কোনও অংশে বেশি, না কি কম? ধর্মালয়গুলো কোনওটাই কি স্রষ্টার নিজের তৈরি, যেভাবে তিনি আমাদের গড়েছেন? যখন আমরা কোনও ধর্মালয় থেকে ফিরি, তখন আমাদের আমিত্ব আরও বেশি গুণে বেড়ে যায়, কেননা আমরা আমাদের আমিত্বকে সেভাবেই শিখিয়ে পড়িয়ে, ঘষে মেজে তৈরি করেছি যে এতে কোনও ত্রুটি থাকতে পারে না। আমরা কখনও নিজেকে মুছে ফেলার কাজটি করিইনি, বরং একে আরও কীভাবে জানি ঘষে মেজে পরিষ্কার করেছি, ভাবখানা এমন যেন স্রষ্টা আমাদেরকে নোংরা অবস্থায় ফেলে গিয়েছিলেন! যখন আমাদের ভেতরের সকল শূন্যতার অনুভূতি মিলেও আর কোনও অনুভব তৈরি করে না, যেখানে শূন্যতারও কোনও স্থান নেই, কোনও শব্দ বা এমন কোনও বোধ নেই যে আমি শূন্য, তখনই আমাদের মাঝে প্রকৃত প্রেম বাস করে, তখনই আমরা স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি লাভ করি।
 
যখন আমাদের মাঝে কিছুমাত্র শূন্যতার বোধটুকুও থাকে, তখনও আমরা পুরোপুরি শুদ্ধ নই। আমাদের সকল বোধ, আমিত্ব, শব্দ, শূন্যতা, অর্জন সকল কিছুই অদৃশ্য হয়ে যাবে তখন, যখন স্রষ্টার শব্দ আমাদের কানে পৌঁছায়, আমরা সেখানে, যত ভিড়ে অথবা নৈঃশব্দ্যের মাঝেই থাকি না কেন, স্রষ্টার শব্দ সব জায়গায় আমাদের ভেতর থেকে উচ্চারিত হতে থাকে। এটি এমন এক সময়, যখন জীবনের সকল অভিজ্ঞতার মৃত্যু ঘটে। এজন্যেই ভালোবাসাকে মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত বলা হয়েছে, কেননা ভালোবাসার পূর্বশর্তই হচ্ছে ভালোবাসায় প্রথমেই প্রেমিকের মৃত্যু ঘটে। যখন কোনও ভালোবাসায়, যে ভালোবাসে এবং যাকে ভালোবাসে, এই দুইয়ের বোধটি শূন্য হয়ে যায়, তখন সেখানে কেবলই ভালোবাসা থাকে, তাকেই প্রকৃত ভালোবাসা বলে। এরূপ ভালোবাসায়, ভালোবাসার সুগন্ধ ছড়ায়। স্রষ্টার সাথে আমাদের ভালোবাসার সম্পর্ক এরূপ পর্যায়ে আসে এবং ঠিক তখনই সেই মুহূর্ত আসে, যখন আমাদের এই পৃথিবীর খেলা থেকে মুক্তি ঘটে, এখানে আমাদের আর কখনও অন্য কোনওভাবে ফিরে আসতে হয় না। মাছ ধরবার সময় একটি জালে সবসময় যেমন ছোটো মাছগুলো সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়, শুধু বড়ো মাছগুলো ধরা পড়ে, জেলে যে মাছগুলো বড়ো হয়ে গেছে সেগুলো রেখে অন্যগুলো আবার নদীতে ছেড়ে দেয়, তেমনি যখন আমাদের স্রষ্টার কাছে যাবার প্রকৃত যোগ্যতা হয়, তখন স্রষ্টাই আমাদের চিরতরে এই পৃথিবী থেকে তুলে নেন, তার আগমুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টির এই বিশাল সমুদ্রে রেখেই বারে বারে তাঁর তুলে নেবার যোগ্য হবার সুযোগ করে দেন।
 
যারা স্রষ্টার ভালোবাসায় নিজেকে শূন্য করে ফেলে, তারা স্রষ্টার কাছে যাবার জন্য সবসময়ই তৈরি থাকে, কেননা যখন তাদের দরজায় মৃত্যু আসে, তারা তখন আনন্দিত হয় এই ভেবে যে, এখন সে এই ক্ষুদ্র জীবনের জাল থেকে চিরতরের জন্য মুক্ত হচ্ছে, কিন্তু যারা এই পার্থিব জীবনকেই বড়ো করে দেখে, তাদের কাছে মৃত্যু হচ্ছে জীবনের সমাপ্তি, যেখানে একজন প্রজ্ঞাবান মানুষের কাছে এটি চিরমুক্তির এবং আনন্দের। একজন প্রকৃত প্রেমিক এবং একজন সাধারণ মানুষের পার্থক্য এখানেই। একজন আলোকিত মানুষের কাছে এই পৃথিবী একটি স্বপ্নের জায়গা। আমরা মৃত্যুকে কালো রাতের চোখে দেখি, এই জীবনের আঁধারের রূপে দেখি, কিন্তু একজন প্রজ্ঞাবান মানুষের কাছে মৃত্যু একটি অন্তিম জীবনের শুরু। যে শুরুটা তখনই সম্ভব, যখন আমরা এই জীবনটিকে সঠিকভাবে যাপন করে যেতে পারব, কেননা আমাদের সঠিক জীবনধারণ-পদ্ধতিই আমাদেরকে একটি সঠিক মৃত্যু এনে দেয়। আমাদেরকে মৃত্যুর সেই পথটিই খুঁজে নিতে হবে, যে পথে মৃত্যু একবারই হয়, যে পথে মৃত্যু এলে এই পৃথিবীতে আমাদের আর ফিরে না আসতে হয়। কেননা আমরা মৃত্যুর সেই জাল থেকে বারে বারে বেরিয়ে যাই এবং আবার এই একই জীবনের পথে ফিরে ফিরে আসি।
 
একশো দুই।
নিজেদেরকে জীবনের উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইলে আমাদেরকে বড়ো মাছ হতে হবে যেন মৃত্যু জাল ফেললে আমরা জালের ফাঁকে দিয়ে পিছলে আবার ফিরে না আসি। যখন আমরা আমাদের সকল আমিত্বকে ঝেড়ে ফেলি, তখনই আমাদের পক্ষে এতটা বড়ো হওয়া সম্ভব। আমাদেরকে সবসময় আমাদের আমিত্বের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে, আমাদের সব কাজে এমনভাবে সচেতন হতে হবে যেন আমাদের মনের অজান্তেও কখনও আমাদের আমিত্ব এসে আমাদের দখল না নিয়ে নেয়, কেননা কাজটি এত সূক্ষ্মতার সাথে ঘটে যে আমরা জানতেই পারি না আমরা কখন বদলে গেলাম। আমাদের ইগো আমাদেরকে ভঙ্গুর করে দেয়। এটি অন্য কারও কথা শোনে না, এটি নিজেই নিজের পাকে জড়িয়ে পড়ে, আবার কখনও কখনও নিজের জড়ানো গিঁটটা খুলতে গিয়ে নিজেই নিজেকে আঘাত করে বসে। আমাদের ইগোর ধরনটা বড্ড বিচিত্র। দাম্ভিকতা কখনও সারল্য আনে না, একজন শিক্ষক যদি সরল না হয়ে দাম্ভিক হন, তবে তাঁর পক্ষে প্রকৃত শিক্ষক হওয়া অসম্ভব, আর এজন্যেই দাম্ভিকেরা কখনও গুরু হয়ে ওঠেন না। আমাদের ভেতরের সকল জটিলতাই এই অহমসত্তার তৈরি। যে ব্যক্তি নিজের জীবনকে ওষুধের উপর নির্ভরশীল করে তোলেন, তাঁর রোগগুলো হয়তো ভালো হয়, হয়তো তিনি শারীরিকভাবে সুস্থও থাকেন, কিন্তু একটি দিনও তিনি ওষুধ ছাড়া বেঁচে থাকতে পারেন না। আমাদের ইগো আমাদের জীবনের সেই ওষুধের মতো, এটি হয়তো আমাদের জটিল অবস্থাগুলোকে সহজ করে, কিন্তু দিনশেষে আমরা আমাদের ইগোর দ্বারাই চালিত হতে থাকি, আমরা আমাদের ইগোর উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। তখন ইগো ছাড়া আমাদের একটি সমস্যারও সমাধান হয় না, এটি বাস্তবপক্ষে জীবনটিকে আরও জটিল থেকে জটিলতর করে তোলে।
 
আমাদেরকে আমাদের ইগো ঝেড়ে ফেলে আমাদের মনের জটিলতাগুলোর সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে হবে, এর মূলে কী কী বিষয় সম্পৃক্ত, যা আমাদের জটিলতা সৃষ্টির কারণ, অথবা আমরা কোন প্রেক্ষিতে এটিকে জটিলভাবে দেখছি, সেইসব প্রশ্ন নিজের অহমসত্তা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে করতে হবে। যখন আমরা এভাবে এগোব, তখন আমাদের ভেতরের বিশুদ্ধ চিন্তাগুলো আমাদেরকে একটি সোজা পথ দেখাবে, যেটি আমাদেরকে সহজ সমাধান এনে দেবে সেই সমস্যাটির, যাকে আমরা আমাদের ইগোর দ্বারা পরিচালিত হয়ে জটিল করে আসছিলাম। আমাদের সকল দ্বন্দ্বের কারণই আমাদের অহমসত্তাটি। ইগো হচ্ছে একটি জটিল অবস্থা এবং আত্মসমর্পণই হচ্ছে এর সহজ সমাধান। আমরা একটু খেয়াল করলে দেখব, পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থে আত্মসমর্পণকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ সমর্পিত হতে বলা হয়েছে। যখন আমরা কোনও কিছুর প্রতি, হোক সেটি মানসিক, শারীরিক অথবা অন্য কোনওভাবে, সমর্পিত হই, তখন সেটি সবসময় আমাদের সামনে একটি সহজ সমাধানের এবং শান্তির পথ খুলে দেয়, আমাদের জটিল অবস্থাগুলোকে অজটিল করে তোলে, আমাদের মানসিক দ্বন্দ্বগুলোকে ভেঙে ফেলে। কোনও সমস্যাকে যখন আমরা চোখ বন্ধ করে দেখি, তখন সেটি একেকজনের কাছে একেক রকমের মনে হবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। একজন গুরুর কাজ হচ্ছে, শিষ্যের চোখ খুলে দিয়ে সমস্যাগুলোকে স্বচক্ষে দেখতে সাহায্য করা। আমাদের ইগো আমাদের চোখ বন্ধ করে দেয়, ফলে আমরা সমস্যাগুলোকে যথাযথভাবে দেখতে পারি না, সমর্পণের মাধ্যমে আমাদের চোখ খুলে যায়, ফলে আমরা সমস্যার প্রকৃত রূপটি দেখতে পারি বলেই সমাধান খুঁজে বের করাও সহজ হয়ে পড়ে।
 
যে গুরু আমাদের মনের চোখ না খুলে বরং অর্থের বিনিময়ে সমস্যার সমাধান তুলে ধরেন, তিনি কখনও প্রকৃত গুরু নন। আমরা যদি এমন কোনও সান্নিধ্যে যাই, যেখানে আমাদের সমস্যার সমাধান রয়েছে, কিন্তু প্রতি বার সমস্যা এলে আমাদের তাঁর কাছেই দৌড়াতে হয়, তবে বুঝতে হবে, আমরা সঠিক সান্নিধ্যে নেই। কেননা একজন প্রকৃত গুরু কেবল শিষ্যের চোখ খুলে দেওয়ার কাজ করে থাকেন, তার সমস্যার সমাধানের কাজটি নয়। যখন অর্থের বিনিময়ে এ ধরনের সমাধান আমরা গ্রহণ করি, তখন সেটি গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক নয়, সেটি একটি সেবা মাত্র, যা কিনা অর্থ দিলেই পাওয়া সম্ভব। জীবনের যে-কোনও সমস্যায় গুরুর উপর নির্ভরশীল হবার অর্থই হচ্ছে, ওষুধনির্ভর জীবন, ইগো নির্ভর জীবন; এমন আত্মার কোনও মুক্তি নেই, কেননা এরূপ আত্মা পরমুখাপেক্ষী। বন্ধ চোখে সমস্যাগুলো কেমন হতে পারে, একটি গল্প দিয়ে সেটি বোঝানো যেতে পারে। ধরুন, আপনি কিছু জন্মান্ধ মানুষের সামনে একটি হাতিকে দাঁড় করিয়ে তার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। যেহেতু মানুষগুলো অন্ধ, যেহেতু তারা কখনওই স্বচক্ষে হাতি কী, অথবা কেমন সেটি, তা দেখেনি, সেহেতু তারা হাতির বিভিন্ন অঙ্গ ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাতি সম্পর্কে তাদের ধারণা তুলে ধরবে। কেউ কেউ হয়তো শুধুমাত্র হাতির পা ছুঁয়ে বলবে হাতি লম্বা একটি গাছের মত, কেউ তার কান ছুঁয়ে বলবে, হাতি একটি ছাউনির মত, কেউবা তার পেট ধরে হয়তো বলবে, এটি ডিম্বাকৃতির কিছু। এক্ষেত্রে কারও বক্তব্যই কি হাতির প্রকৃত বিবরণ দিতে পারবে? যদি আমরা না জানতাম এই মানুষগুলো অন্ধ, তবে আমরা এদের কী বলে সম্বোধন করতাম? অবশ্যই আমরা তাদের বিশেষজ্ঞ বলেই সম্বোধন করতাম!
 
যে ব্যক্তি হাতির এত বিচিত্র বিবরণ তুলে ধরতে পারে, তিনি কি বিশেষজ্ঞ নন? অথচ যারা নিজেরাই অন্ধ, তাদের পক্ষে এর চাইতে বেশি কিছুই করা কি সম্ভব? যে গুরু আমাদের সমস্যার সমাধানে সদাতৎপর থাকেন, তিনিই এরূপ বিশেষজ্ঞ। সকল বিশেষজ্ঞই অন্ধ, কেননা বিশেষজ্ঞ হতে গেলে অন্ধ হয়ে যাওয়াই নিয়ম। আমাদের সমস্যাগুলো যখন আমরা চোখ বন্ধ করে দেখি, তখন বিষয়গুলো আমাদের কাছে এভাবেই ধরা দেয়; সেক্ষেত্রে একটি সমর্পিত মনই পারে মনের চোখ খুলে দিতে। একজন বিশেষজ্ঞ একটি বিষয়ের উপর অনেক দিক তুলে ধরতে জানেন, কেননা তিনি ওই একটি বিষয়টিতে তাঁর সমগ্র সময় খরচ করেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার পক্ষে, মূল বিষয়টি কী, সেটি তুলে ধরা সম্ভব নয়, কেননা তিনি সেই বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় নিয়ে জানেন না, তিনি কেবল সেই হাতিটির একটি পা সম্পর্কে সমস্ত কিছু খুঁটিয়ে দেখেছেন, এজন্যেই তিনি কেবল সে একটি পা সম্পর্কেই সমস্ত কিছু বলতে পারেন। কিন্তু তার সমগ্রের কণামাত্রও তিনি জানেন না। এজন্যেই বিশেষজ্ঞরা কখনও নিজের সমস্যার সমাধান করতে পারেন না, তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য অন্যের কাছে দৌড়ান, তাঁরা নিজেরই নিজেদের রোগ ধরতে জানেন না। আমাদের সামনে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যাঁরা নিজেরা হয়তো কোনও একটি বিষয়ে ভালো জানেন, কিন্তু তাদের সামনে অন্য যে-কোনও বিষয় তুলে ধরলেও তাঁরা এমন ভান করতে থাকেন যেন তাঁরা বিষয়টি সম্পর্কে, এমনকি এরূপ সকল বিষয় সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তাঁরা এমনকি স্বীকারও করতে চান না যে তাঁরা জানেন না, তাঁরা কেবল তাঁদের ভ্রান্ত বিশ্বাসে অটল থাকেন, এজন্যেই তাঁরা খুব সহজেই খুব অল্পেই অন্যের উপর ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়েন।
 
একশো তিন।
অজ্ঞ ব্যক্তিরা তাঁদের অজ্ঞতাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে জানেন না। তাঁরা তাঁদের ইগোর দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকেন। এরূপ ব্যক্তিরা সাধারণত অন্যদের উপদেশ দিয়ে থাকেন, কিন্তু খুব করুণ হলেও সত্য যে তাঁদের উপদেশ তাঁরা নিজেরাই কখনও অনুসরণ করেন না। এই সম্পর্কে মহানবীর একটি ঘটনার বিবরণ রয়েছে। একদিন হযরতের নিকট তার একজন ভক্ত এসে বললেন, হুজুর, আমার ছেলে ভীষণ বেশি পরিমাণে আখের গুড় খায়, কিন্তু আপনিই বলুন, অতিরিক্ত আখের গুড় খাওয়া কি শরীরের জন্য ভালো? আমি আমার ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছি, কিন্তু সে কিছুতেই আমার কথা মানছে চাইছে না। আপনি যদি দয়া করে আমার ছেলেকে একটু বুঝিয়ে বলেন, তাহলে ও নিশ্চয়ই আপনার কথা মান্য করবে। তখন তিনি লোকটিকে সাত দিন পরে তাঁর ছেলেকে নিয়ে দেখা করতে বললেন। লোকটি সাত দিন পর তাঁর ছেলেকে নিয়ে হাজির হলে তিনি ছেলেটিকে অতিরিক্ত পরিমাণে গুড় খেতে নিষেধ করলেন এবং ছেলেটির কাছে এর অপকারিতাও তুলে ধরলেন। যাবার সময় ছেলেটির বাবা হযরতকে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর, আপনি তো সেদিনই তাকে ডেকে কথাগুলো বলতে পারতেন, কিন্তু সেটি না করে আপনি সাত দিন সময় কেন নিলেন? তখন হযরত তাঁকে জানালেন, আমি নিজেই আখের গুড় খেতে খুব ভালোবাসি এবং আমি নিজেও প্রচুর আখের গুড় খাই। যখন আমি নিজেই ঠিক নই, তখন আপনার ছেলেকে কী করে সেই উপদেশ দিই, যা আমি নিজেই মেনে চলি না? এই সাত দিন আমি নিজের অতিরিক্ত গুড় খাওয়ার অভ্যাসটি ত্যাগ করে তবেই আপনার ছেলেকে সেই উপদেশ দিয়েছি, আর এজন্যেই আপনাকে সাত দিন পর দেখা করতে বলেছিলাম। লোকটি হযরতের উপদেশের অর্থ বুঝতে পারলেন।
 
যে উপদেশ নিজের জীবনে প্রয়োগের অযোগ্য, যে উপদেশ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত নয়, যে উপদেশ নিজের কোনও কাজে আসে না, সে উপদেশ মূল্যহীন। একজন প্রকৃত গুরু নিজের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন, তিনি কোনও বই পড়ে সেগুলো অর্জন করেন না। এজন্যেই একজন প্রকৃত গুরুর শিক্ষা সবসময় জীবনমুখী হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা সবসময় বইনির্ভর হয়ে থাকেন, তাঁরা জীবনের কাছে কোনও শিক্ষালাভ করেন না, তাঁদের সকল শিক্ষাই বইনির্ভর, এজন্যেই যে-কোনও সমস্যায় তাঁদেরকে বইয়ের নির্দেশনাই অনুসরণ করতে দেখা যায়। বইয়ের বাইরে তাঁরা একটি কথাও বলতে জানেন না। তাঁরা মানুষের শারীরবৃত্তীয় সমস্যার সমাধান করতে জানলেও কখনও মানসিক সমস্যা নিয়ে কিছুই জানেন না। মানুষের শরীরের সাথে মনের সংযুক্তির বিষয়টি সম্পর্কে তাঁরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কিন্তু এজকন প্রকৃত গুরু মানুষের শরীরের সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, মানুষের মানসিক দিকগুলোর অবস্থা জানেন, তিনি জানেন, প্রায় সমস্যার সাথেই শরীর এবং মন উভয়ের সংমিশ্রণ রয়েছে। এ কারণেই তারা জানেন, মানুষের সকল সমস্যার সমাধান তার নিজের কাছেই রয়েছে, এজন্য তাকে বাইরে যাবার প্রয়োজন নেই, পরমুখাপেক্ষী হবার প্রয়োজন নেই।
 
একজন বিশেষজ্ঞ এমন কিছুর সমাধান দিতে চান, বাস্তবে যার কোনও অস্তিত্বই নেই। একজন গুরু জানেন, যখন নিজের সত্তা বলে কিছুই থাকে না, সেখানে সমাধানের কোনও প্রশ্নই আসে না। যে নিজেকে লীন করে দিয়েছে, যার নিজের বলে কিছুই নেই, তার কোনও সমস্যা কী করে থাকবে? সমস্যা তো সেখানেই সৃষ্টি হয়, যেখানে কিছু-না-কিছু একটা অবশিষ্ট থাকে। আমাদের প্রকৃত সমস্যার শুরু এখানেই---আমরা নিজেদের অনেক কিছু ভেবে বসে থাকি, ফলে আমাদের মাঝে নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হয়। আচ্ছা, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? যদি আমরা কখনও এমন গুরুর সান্নিধ্যে আসতে চাই, যিনি নিজেকে হারিয়ে, নিজের শূন্যতায় অভিজ্ঞ, তবে আমাদেরকে তাঁর পায়ে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে সমর্পিত করতে হবে। কেননা একজন প্রকৃত গুরু তিনিই, যিনি স্রষ্টার নৈকট্যলাভ করেছেন। এ কারণেই তিনি জানেন স্রষ্টা কী, আর স্রষ্টাকে জানতে হলে সর্বপ্রথম গুরুর পায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে, কেননা একমাত্র তিনিই জানেন, কোন পথে স্রষ্টাকে পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে স্রষ্টার আগে একজন শিষ্যের কাছে তাঁর গুরুই তার স্রষ্টা। কেননা স্রষ্টাই আমাদের একমাত্র শিক্ষক, আর স্রষ্টাকে তিনিই সব থেকে ভালো জানেন, যিনি স্রষ্টার কাছে শিক্ষালাভ করেছেন, পৃথিবীর কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়। একজন প্রকৃত গুরুর পক্ষেই স্রষ্টাকে সম্পূর্ণরূপে জানা সম্ভব, আর এজন্যেই সর্বপ্রথম গুরুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে।
 
নিজেকে সমর্পণ করাই স্রষ্টার পথের চাবি। আমরা যখন সমর্পিত হই, তখন আসলে আমরা বাইরের কারও কাছে সমর্পিত হই না, বরং নিজের কাছে নিজেকে সমর্পিত করি। সমর্পণের মাধ্যমেই খোঁজার প্রথম স্তরের সূচনা। কেননা যখন আমরা স্রষ্টার কাছে আমাদের সকল সমস্যার সমাধান চাই, তখন সর্বপ্রথম আমাদেরকে স্রষ্টার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত করতে হবে। আমরা সবসময় স্রষ্টার কাছে নিজেকে সমর্পণ না করেই স্রষ্টার উপরে সন্দেহ নিয়ে স্রষ্টার কাছে যাই। যখন আমাদের জীবনে কোনও ঝড় আসে, সেটি আমাদেরকে ভেঙে চুরমার করে দেয়, আমরা তখন বলি, স্রষ্টা কোথায় এখন? আমাদের ভেতরে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। অথচ আমরা কখনও স্রষ্টাকে পূর্ণহৃদয়ে, সমগ্রচিত্তে স্রষ্টার কাছে কখনওই যাইনি। আমরা একটি ভাসা ভাসা বিশ্বাসে থাকি, আমরা জানি, স্রষ্টা আছেন, কিন্তু আমরা কখনও আমাদের সমস্যার আগে অথবা সমস্যার পরে স্রষ্টার কাছে পূর্ণহৃদয়ে নিজেদেরকে সমর্পণ করি না। আমরা সেই স্রষ্টার কাছেই সব কিছু চেয়ে বসে থাকি, যাঁকে আমরা কখনও জানিইনি। যাঁর অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের সংশয়ে কেটেছে বহু বছর। এমন একটি সন্দেহপ্রবণ হৃদয় নিয়েও আমরা স্রষ্টার সাহায্য কামনা করি! যখন আমরা নিজেরাই সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিই, স্রষ্টা কোথায়, তখন আমরা কী করে সেই দ্বিধাগ্রস্ত এক স্রষ্টার কাছে নিজেদের সমস্যা তুলে ধরি? যেখানে আমাদের বিশ্বাসের ভীতে ঘুণ ধরে গেছে, সেখানে আমরা কী করে ভালো ফল আশা করি? আমাদের পক্ষে এমন কোথা থেকেও কি কোনও সমাধান পাওয়া সম্ভব, যেখানে আমরা তাঁর অস্তিত্বের সংশয়ে ভুগি?
 
একশো চার।
আমাদেরকে সব কিছুর আগে সকল দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, সকল আমিত্বের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে সম্পূর্ণরূপে স্রষ্টার কাছে, তাঁর আধিপত্যের কাছে সমর্পিত হতে হবে। যেন আমার মাঝে আমি বলে কিছু নেই, আমার বলে কিছু নেই, আমি কোনও আলাদা সত্তা নই, আমি সেই পূর্ণাঙ্গ সত্তার একটি অংশ এবং সেই সত্তাকে জানতে হলে, সেই সত্তার কাছে আমার সকল সমস্যার সমাধান চাইবার আগে আমি তাঁরা উপরে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করছি, আমি নিজের শূন্যতায় সমর্পিত হচ্ছি। যখন আমরা আমাদের মানসিক দ্বিধাগুলোকে স্রষ্টার সামনে রেখে সম্পূর্ণ নির্ভার হয়ে কেবল স্রষ্টায় আস্থা রাখতে পারব, তখন থেকেই আমাদের মুক্তির পথ শুরু। আর এটি তখনই সম্ভব, যখন আমরা মনে প্রাণে এই বিশ্বাস রাখি যে, সমগ্রের সূচনা কেবল একটি অস্তিত্ব থেকেই। কিছুই সত্য নয়, কেবল সেই একটি অস্তিত্ব ছাড়া। এবং যখনই আমরা আমাদের সকল সমস্যা নিয়ে পূর্ণবিশ্বাসে সব কিছু স্রষ্টার কাছে সমর্পিত করি, তখন সেটি আপনাআপনি সঠিক পথ ধরে, আমাদের হৃদয়ে ভগ্ন, জটিল অবস্থাগুলো ভেঙে যায়, কেননা স্রষ্টার কখনও আমাদের সমস্যার সমাধানের প্রয়োজন নেই, আমাদের সকল সমস্যার সমাধান আমাদের নিজেদের মাঝেই রয়েছে, কিন্তু আমরা আমাদের ইগোর দ্বারা প্রতারিত হয়ে নিজেদের থেকে দূরে সরে গিয়েছি, ফলে যে সমস্যার কোনও অস্তিত্বই নেই, কখনও ছিল না, আজ সেটিই আমাদের মনে নানা রকমের অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে।
 
আমাদের সন্দেহ, আমাদের অবিশ্বাস আমাদের নিজেদের উপরে এতটাই চেপে বসেছে যে, আমাদের নিজেকে নিজের কাছে ভয়ানক করে তুলেছে, আমরা আমাদের সমস্যাকে সামনে থেকে দেখতে ভয় পাই, আমরা সেগুলো থেকে পালিয়ে বাঁচি যেন সেগুলো থেকে পালিয়ে বাঁচাই সমাধান, কেননা আমরা কখনও আমাদের সন্দেহের মুখোমুখি হতে চাইনি, আমরা কখনও নিজেকে নিজের কাছে ধরা দিইনি। অথচ এমন কঠিন মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়েও আমরা নিজেকে এমন ভ্রান্ত আশ্বাস দিই যে, আমরা সব কিছু জানি, আমরা আমাদের সকল প্রশ্নের সমাধান, আমাদের সকল সমস্যা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা রাখি, যখন কিনা আমরা আমাদের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান হয়ে থাকি, যখন কিনা আমরা আমাদের প্রকৃতির থেকেই পালিয়ে বাঁচি! আমরা আমাদের রাস্তাগুলোকে জটিল করি, অথচ এর সহজ সমাধান চাই, আমরা আমাদের অস্তিত্বের সমস্যার সমাধানটি অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, অস্তিত্বের থেকে পালিয়ে কী করে পেতে পারি! আমরা এমন কোনও সমস্যায় নেই, যার সমাধান অন্য কারও কাছে আছে, অথচ আমাদের নিজেদের কাছে নেই, আমরা কেবল আমাদের প্রশ্নগুলো ভুল জায়গায় ভুল উপায়ে করে যাচ্ছি। ফলে যত বারই আমরা কোনও সমস্যার সমাধান করতে যাই, সেটিকে তখন আরও জটিল করে তুলি। যখন আমরা সঠিক উপায়ে প্রশ্ন করতে জানব, তখন উত্তরগুলো সহজেই আমাদের চোখের সামনে এসে হাজির হবে। এর কারণ হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেক প্রশ্নের সমাধান আমাদের প্রশ্নের মাঝেই লুকায়িত, কিন্তু আমরা প্রশ্নগুলোকে সঠিক উপায়ে করতে জানিনি বলেই কখনও সেটি আমাদের সামনে খোলাসা হয়নি।
 
একজন আলোকিত মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করার ধরন জানেন বিধায় তাঁর কাছে সব কিছু সহজ সত্যে ধরা দেয়। যখন আমরা স্রষ্টাকে বাইরে কোথাও খুঁজতে বের হই, তখন আমরা আমাদের প্রশ্নের বাইরে উত্তর খুঁজি, যার ফলে স্রষ্টা আমাদের কাছে অজানা এবং দুর্বোধ্যই থেকে যান। স্রষ্টা কোনও কাল্পনিক সত্তা নন, তিনি আমাদেরই প্রকট অস্তিত্ব; এ কারণেই যখন আমরা নিজের কাছে নিজের ভেতরে ফিরে যাই, তখন আসলে আমরা আমাদের স্রষ্টার কাছে ফিরে যাই। আমাদের সকল সমস্যা আমাদের অস্তিত্বের থেকেই সৃষ্ট, সুতরাং আমাদের সকল সমাধানও একমাত্র আমাদের অস্তিত্বের মাঝেই পাওয়া সম্ভব। যখন আমরা নিজেরাই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ি, তখনই কেবল আমাদের সমস্যা বলে আর কিছুই থাকে না। যখন রোগী অনুপস্থিত, তখন রোগের উপস্থিতি কী করে সম্ভব? স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা হচ্ছে আমাদের সমাধান, যখন আমরা স্রষ্টার কাছে নত হই, তখন সেটি প্রার্থনায় পরিণত হয়, স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা, আস্থা এই সব কিছুই স্রষ্টার প্রতি আমাদের প্রার্থনার এক একটি রূপ। আর স্রষ্টার কাছে যাবার দুটি পথ থাকতে পারে, একটি হচ্ছে প্রার্থনা, অপরটি ধ্যান। ধ্যানের পথ হচ্ছে প্রজ্ঞার পথ, আলোর পথ, যাতে করে আমরা নিজেদের সম্পর্কে সমগ্র অস্তিত্বের সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং প্রার্থনার অর্থ হচ্ছে, ভালোবাসা, একান্ত সাহচর্য, স্রষ্টার সাহচর্য, সৃষ্টির সাহচর্য। এই দুই পথই স্রষ্টার পথ।
 
ধ্যানের রাজ্যে শেষসময় পর্যন্ত যেটি সবচাইতে বড়ো বাধা হয়ে কাজ করে, সেটি হচ্ছে ‘আমিত্ব’ বা ‘অহমসত্তা’। নিজের আমিত্বের ওপরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করাই ধ্যানের প্রধান চ্যালেঞ্জ। ধ্যানের জগতে ইগোকে জয় না করা পযর্ন্ত এটি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে থাকে। আমরা যতই ধ্যানের গভীরে যেতে থাকি, তত বেশি করে এটি শক্তিশালী হয় এবং আমাদের উপরে এক রাজত্ব সৃষ্টির দৃঢ় প্রচেষ্টা চালায়। যদি আমরা ইগোকে জয় করতে না পারি, তবে শুধু ধ্যানই পর্যাপ্ত নয় স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। কেননা ইগো আমাদের এবং আমাদের স্রষ্টার মাঝে একটি সূক্ষ্ম কাচের দেয়াল তৈরি করে রাখে, যেখানে আমরা তাঁকে দেখতে পাই ঠিকই, কিন্তু তাঁর সঙ্গে একাত্ম হওয়া, কিংবা মিশে যাওয়া, তাঁকে শুনতে পাওয়া সম্ভব হয় না। যখন আমরা সম্পূর্ণরূপে আমাদের ইগোকে জয় করি, অর্থাৎ আমাদের ভেতর থেকে এর সমস্ত আধিপত্যকে ঝেড়ে ফেলি, তখনই আমাদের মাঝে সেই পরম শূন্যতা তৈরি হয়, যা আমাদের অস্তিত্বকে জানার জন্য অতৃপ্ত, আমাদের ভেতরে তখন এক বিশাল অভাব সৃষ্টি হয় স্রষ্টাকে জানার। তখনই সেই সময়, যখন অস্তিত্ব আমাদের কাছে নিজেকে মেলে ধরে, নিজের সকল গোপনীয়তা আপনাআপনি খোলাসা করে দিতে থাকে, এমন সময়ই স্রষ্টা আমাদের সাথে একাত্ম হন, আমাদের সকল প্রশ্নের সমাধান দেন, আমাদের ভাবনাজগতের সকল সংশয়ের সমাপ্তি ঘটান। এই পর্যায়ে এসে স্রষ্টা এবং ধ্যানীর (যিনি ধ্যান করেন) মাঝে কোনও দেয়াল থাকে না।
 
একশো পাঁচ।
আমরা যখন প্রকৃত অর্থেই কাউকে ভালোবাসি, তখনও সর্বপ্রথম আমাদেরকে নিজেকে বিলীন করে দিতে হয়, নিজের ভেতরের ছোটো বড়ো সকল অহংকারগুলোকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হয়, নিজের ভেতরের ইগোকে সম্পূর্ণরূপে টেনে পরিষ্কার করে বাইরে ফেলে দিতে হয়, কেননা ইগো আমাদের ভেতরের আগাছা, এটি আমাদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে বাধা দেয়, আমাদেরকে শক্তসমর্থ হতে বাধা দেয়। যখন আমরা আমাদের সমস্ত ইগোকে ঝেড়ে ফেলি, তখন আমাদের ভেতরটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে। তারপর আমরা সেখানে যা-কিছু রোপন করি, সেটি তখন জলদি বিকশিত হয়। প্রকৃতিতে বৃষ্টি যেমন করে সব কিছু ধুয়ে মুছে প্রকৃতিকে সজীব, প্রাণবন্ত করে তোলে, চারদিকটা কেমন নিষ্কলুষ আর শুদ্ধ হয়ে ওঠে, যখন আমরা আমাদের ইগোকে সম্পূর্ণরূপে ভেতর থেকে ঝেড়ে ফেলি, তখনও আমাদের হৃদয়ের সকল ধুলোময়লা পরিষ্কার হয়ে হৃদয় দূষণমুক্ত হয়ে যায়। স্নিগ্ধ প্রকৃতির মতোই তখন সেই স্নিগ্ধ হৃদয় সজীবতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ভালোবাসার অর্থই হচ্ছে, ভালোবাসার কাছে নিজেকে বিলীন করে, নিজেকে শূন্য করে তুলে ধরা। এজন্যেই যিনি ভালোবাসেন, তাঁর ধ্যানের প্রয়োজন নেই, তাঁর ভালোবাসাই তাঁর জন্য যথেষ্ট, কিন্তু সেই ভালোবাসাকে বিশুদ্ধ হতে হবে, নির্মল, দূষণমুক্ত হতে হবে। যিনি প্রকৃত ভালোবাসায় সিক্ত হন, কেবলমাত্র তাঁরই ধ্যানের প্রয়োজন নেই, কেননা তাঁর ভালোবাসাই তাঁর প্রার্থনা, আর প্রার্থনায় ধ্যানের চাইতে তাড়াতাড়ি স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভ করা যায়। কিন্তু আমরা অনেকেই প্রকৃত ভালোবাসা কী, তা জানি না, আমরা প্রার্থনার জন্য প্রস্তুত নই, আমরা ভালোবাসার জন্য প্রস্তুত নই, কেননা আমরা যেটিকে ভালোবাসা বলি, সেটি ভালোবাসা নয়, ভালোবাসার প্রকৃত সত্তা এর চাইতে অনেক অনেক উচ্চে অবস্থিত।
 
আমরা কখনও নিজেকে শূন্য করে ভালোবাসতে শিখিনি, আমরা কখনও ভালোবাসায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে শিখিনি, আমাদের ভালোবাসার মধ্যে কোথাও-না-কোথাও ফাঁক থেকেই যায়, কোথাও-না-কোথাও এসে আমরা ঠিক ঠিক আমাদের ইগোর দ্বারা পরিচালিত হই, আর যখন আমরা আমাদের ভ্রান্ত ইগোর দ্বারা পরিচালিত হই, তখন ভালোবাসার যে অসীম এক শক্তি রয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। তখন সেই ভালোবাসা দুর্বল হয়ে পড়ে, তার কোনও শক্তি থাকে না, সেটি তখন কোনও ইবাদত নয়, সেটি তখন এক ফাঁপা খোলস মাত্র, যাকে আমরা ভালোবাসা নাম দিয়ে আমাদের ভালোবাসার মানুষের সামনে মেলে ধরি। এজন্যেই ধ্যানের প্রয়োজন পড়ে। কেননা ধ্যান নিজের মাঝে নিজেকে একাত্ম হতে শেখায়, ধ্যানের মাধ্যমে নিজের আমিত্ব ধীরে ধীরে থিতু হতে থাকে এবং একটা পর্যায়ে এসে যখন সেটি পুরোপুরি থিতু হয়ে পড়ে, তখনই সেখানে প্রকৃত ভালোবাসা জন্মায়। এজন্যেই যারা প্রকৃত ভালোবাসা কী, জানেন না, তাঁদেরকে সর্বপ্রথম ধ্যানে বসতে হয়। ধ্যান আমাদের নিজেকে চিনতে শেখায়, ধ্যানের মাধ্যমে আমাদের ভেতরটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, ধ্যানের মধ্যে দিয়েই আমরা নিজের ভেতরের ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত সব কিছু দেখতে পাই। ফলে এটি আমাদের সকল অশুদ্ধিকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। ইগোর ঊর্ধ্বে গিয়ে ধ্যানের চর্চা করা যায় বিধায় ধ্যানের মাধ্যমে একটা পর্যায়ে এসে ইগোকে ঝেড়ে ফেলা যায়, যেটি কিনা প্রার্থনার মাধ্যমে করা কঠিন।
 
নিজেকে তখনই পুরোপুরি ভালোবাসা সম্ভব, যখন আমরা সম্পূর্ণরূপে নিজেকে জানতে সক্ষম হই, নিজেকে জানাও তখনই সম্ভব, যখন আমরা নিজের সকল কিছু নিয়ে নিজের নগ্ন সত্তাটিকে নিজের সামনে নিয়ে আসতে সক্ষম হই, আর যখন আমরা নিজেকে পরিপূর্ণ উপায়ে জানার মাধ্যমে নিজেকে ভালোবাসতে শিখি। তখন নিজের ভালোবাসার মানুষ অথবা ভালোবাসার প্রতিও আমরা প্রকৃত হয়ে উঠতে পারি, নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ঢেলে দিতে পারি, কেননা তখন আমাদের মাঝে কোনও ভণ্ডামি থাকে না, নিজের কাছে নিজের লুকোবার কিছুই থাকে না। এই শতাব্দীর একটি খুব সস্তা এবং সর্বজনীন বিষয় হচ্ছে, আমরা সকলেই প্রবলভাবে ইগোইস্টিক, অর্থাৎ আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের নিখুঁত মনে করি, আমাদের কাছে মনে হয়, আমাদের ভেতরে কোনও ভুল নেই। যখন আমরা ভাবি, আমাদের মাঝে কোনও ভুল নেই, আমরা একটি নিখুঁত সত্তা, তখন মনে আসে, তাহলে কেন আমরা সমর্পিত হব? আমরা যে প্রকটভাবে আমাদের আমিত্বের দ্বারা পরিচালিত, এর মাধ্যমে সেটিই পরিষ্কার করে বোঝা যায়। আর যেহেতু আমরা নিজেদেরকে নিখুঁত ভেবে বসে থাকি, সুতরাং এর পরের স্তরটি হচ্ছে, আমাদের সমর্পিত হবার প্রয়োজন নেই, এভাবেই আমাদের ইগো আমাদের ওপরে প্রকট আকারে প্রভাব খাটাতে থাকে। এজন্যেই আমাদেরকে ধ্যানের চর্চা করতে হবে, কেননা যখন আমরা ধ্যানের গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করব, তখন আমরা প্রার্থনার যোগ্য হয়ে উঠব। ধ্যানের মাধ্যমেই আমরা প্রার্থনার গভীরে প্রবেশ করি। ফলে একটা সময় আমাদের ধ্যানের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু প্রার্থনার কোনও মৃত্যু ঘটে না। ধ্যান কিংবা জ্ঞানের মৃত্যু ঘটতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার কোনও মৃত্যু নেই। কিন্তু ভালোবাসাকে খুঁজে পেতে আমাদের ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করতে হয়।
 
আমাদের প্রার্থনাই হচ্ছে স্রষ্টা, আমাদের প্রার্থনাই হচ্ছে ভালোবাসা। প্রার্থনার অর্থ হচ্ছে, একজন প্রেমিক হয়ে ওঠা, একজন পূজারি কিংবা আরাধ্য হয়ে ওঠা। একজন প্রেমিক কতটা প্রজ্ঞাবান, সেটি কোনও বিষয় নয়, সে কতটা প্রেমিক হয়ে উঠতে পারে অথবা সে কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছে, প্রেমের কোন পর্যায়ে সে আছে এবং কোনও পর্যায়ে এগুচ্ছে, সেটিই মুখ্য। প্রার্থনাই মুখ্য জ্ঞান নয়, তবে প্রকৃত পূজারি হয়ে উঠতে গেলে, প্রকৃত প্রেমিক হতে হলে প্রজ্ঞাবান হওয়ার প্রয়োজন আছে। কেননা আলোকিত না হয়ে আমরা জানতে পারি না আসলে আমরা কোন পথে আছি এবং কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এ কারণেই যখন একজন সমর্পিত হৃদয় কোনও সমস্যায় পতিত হন, তখন তিনি স্রষ্টার দ্বারে সকল সমস্যার কথা তুলে ধরেন, কিন্তু একজন অহমসত্তাসমৃদ্ধ হৃদয় তার মস্তিষ্কের দ্বারস্থ হয় এবং এখানেই একজন প্রকৃত প্রেমিক আর বিষেশজ্ঞের মধ্যে পার্থক্য। আমরা ভাবি, আমাদের সকল সমস্যার সমাধান আমাদের কাছেই, সুতরাং আমরা নিজের সমস্যার সমাধানেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু একজন প্রেমিক কখনও নিজের সমস্যাকে নিজের ক্ষুদ্রতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখেন না, তিনি তাঁর সমস্যাকে সমগ্রের মাঝে দেখতে পান, ফলে তিনি সমগ্রের যিনি মূল, তাঁর কাছেই আশ্রয় চান।