অবিশ্বাসে চির

তোমাকে আত্মারূপে পেয়েও আমি এত অস্থির হই কেন? এই তো তুমি সুলভ, সুগম, চির-বর্তমান। যেমন তোমার বিচিত্র বিশ্বরূপে, তেমনি বিশ্বরূপ সরিয়ে দিয়ে, এই অন্ধকার মধ্যেও তুমি বিদ্যমান। তুমি প্রাণ, তুমি মন, তুমি দ্রষ্টা, শ্রোতা, মন্তা, বোদ্ধা, স্মর্তা, নানা ভাবে, নানা রূপে, এক অখণ্ড বস্তু হয়ে প্রকাশিত। আমার দৈনন্দিন জীবনের সকল অবস্থায়, সকল কাজে তুমি জ্ঞানরূপে, শক্তিরূপে, কর্তারূপে প্রকাশিত হচ্ছ।




তোমাকে প্রয়াস করে ধরতে যাই কেন? তুমি তো ধরা দিয়েই রয়েছ। তোমার নামই-বা অত বার উচ্চারণ করি কেন? নামী যে তুমি, তুমি তো প্রতিমুহূর্তে প্রকাশিত, চোখ মেলে তোমাকে দেখলেই তো হয়। হে আমার আত্মন, আমার আমিত্ব, আমার সর্বস্ব, তোমার চেয়ে অন্তরতর আর কিছুই তো নেই, আর কেউই তো নেই। তুমি অন্তরতম। আমি যা চাই, তা তো পেয়েছি। এ-ই তোমার ভালোবাসা।




প্রতিমূহূর্তে, জীবনের প্রতিস্পন্দনে, তোমার ভালোবাসা। এই ভালোবাসা আমার হৃদয়ে সাক্ষাৎ অনুভবের বিষয়, অনুমান করতে হয় না, প্রমাণ করতে হয় না। আমার ওঠায়-বসায়, আমার প্রতি চিন্তায়, প্রতি পদক্ষেপে, প্রতি কাজে এই ভালোবাসা। আমার দেখায়, আমার শোনায়, আমার স্পর্শে, আঘ্রাণে, আস্বাদনে এই ভালোবাসা। আমার বই পড়ায়, আমার এই লেখায়, আমার বলায় এই ভালোবাসা।




আমি যে প্রেমিককে চাই, প্রিয়কে চাই, যার মতো আর কেউ ভালোবাসে না, যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, যাকে নিয়ে আমি নির্জনে, গোপনে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন কাটাতে পারি, যাকে পেলে সব অভাব পূর্ণ হয়, সেই ব্যক্তি তো তুমি। তুমি এমন কাছে, এমন ঘনিষ্ঠ, এমন ব্যস্ত, এমন আদরযুক্ত, যেমন আর কেউ নয়, যেমন আর কেউ হতে পারে না। আমার সাধনার ব্যর্থতাবোধ, তোমার কৃপার বিপক্ষে আমার অভিযোগ, সব তো এখন চলে যাওয়া উচিত। আমার সব সাধ তো পূর্ণ, আর তো কিছু চাইবার রইল না।




এখন যদি আমি শান্ত না হই, সুখী না হই, তবে তার ওজর কোথায়? আমার অত দিনের সুখস্বপ্ন কি তবে সফল হতে চলল? আমার দুঃখের নিশি কি অবসান হলো? এই যাকে আমার হৃদয় বলি, এতে যে অসীম, অগাধ, অতলস্পর্শ প্রেম রয়েছে, এতে যে সকল মায়ের মাতৃত্ব, সকল পিতার পিতৃত্ব, সকল পত্নীর পত্নীত্ব, সকল স্বামীর স্বামিত্ব, সকল বন্ধুর বন্ধুত্ব রয়েছে, তা কে জানত? এ যে জগতের সকলকে আলিঙ্গন করতে পারে, এর কাছে যে সকলই আপন, তা কে জানত? এই হৃদয় যে সমস্ত শান্তির উৎস, সমস্ত তৃপ্তির উৎস, সমস্ত সুখের উৎস রয়েছে, তা কে জানত?




তুমি আজ আমাকে কী দেখালে, কী শোনালে, কী আশা দিলে, কী প্রতিশ্রুতি দিলে! আমি চেয়ে থাকি তোমার মুখপানে। আমি প্রতীক্ষা করে থাকি দেখবার জন্যে অতঃপর তুমি আমাকে নিয়ে কী করো। তোমার পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়। তোমার রাজ্যে অদ্ভুত, আপাত-অসম্ভব ঘটনা অনেক ঘটেছে, শুনেছি। তুমি আমাকে প্রেমিক করবে, প্রেমে ডোবাবে, আমার সমস্ত সন্দেহ, অবিশ্বাস, অপ্রেম, একেবারে ধুয়ে ফেলবে, এ কথা আমার মতো অবিশ্বাসীর কাছেও অসম্ভব বলে বোধ হয় না। দেখি, তুমি কী করো।