তাকে যখন বলতাম অনেক আগে, যখন আমি বয়সে অনেক ছোটো ছিলাম, ‘আচ্ছা, আপনি সিগারেট কেন খান?’, তখন সে হেসে উত্তর দিত, ‘তুমি বড়ো হও, আস্তে আস্তে আমি সব ছেড়ে দেবো।’ আমি শুনে থ হয়ে থাকতাম। আমি বড়ো হলে উনি সিগারেট ছাড়বেন, এর মানে কী? আমি তখন অনেক ছোটো, এত কিছু বুঝতেও চেষ্টা করতাম না। আর এইসব প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথাও ছিল না। মানুষটার সাথে সময়ে অসময়ে খারাপ ব্যবহার করেছি। অনেক বেশিই করেছি! কারণ এটাই যে, আমি তাকে কখনও ভালোবাসিনি। যাকে ভালোবাসা যায় না, তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতেও আমাদের তেমন একটা সমস্যা হয় না। এই কারণেই ওরকম করা যায়। আর যাকে মানুষ ভালোবাসে, তার খারাপ ব্যবহারও সে তেমন একটা গায়ে মাখে না। গায়ে মেখেও-বা কী হবে! ভালোবাসা তো আর বন্ধ করে দিতে পারবে না! হঠাৎ করেই এই করোনার সময় মনে হলো, মানুষটার কাছে একবার ক্ষমা চেয়ে নিই। যদি বেঁচে না থাকি কিংবা সে না থাকে, তবে মাফ চাওয়া তো আর হলো না। সে কারণেই যোগাযোগ করা ও ক্ষমা চাওয়া। একটা জিনিস লক্ষ করলাম, মানুষটা এখনও ঠিক আগের মতোই আমাকে ভালোবাসে। ব্যাপার এটাও না। ব্যাপার হচ্ছে, তার সাথে করা খারাপ ব্যবহারের জন্য তিলে তিলে ভুগছি আমি, যাকে বলে বিবেকের দংশনে পুড়ে মরা। এর চাইতে ভয়াবহ শাস্তি আর হয় না। বার বার শুধু এটাই মনে হচ্ছে, সে আমাকে শুধু ভালোই তো বাসত! আমার কোনও ক্ষতি তো আর করেনি, আমার নামে বদনামও করেনি কোথাও, আমার ভুলও কখনও ধরেনি। তবে এত খারাপ ব্যবহার কেন করলাম আমি! এত কোটি মানুষের ভিড়ে কেউ যখন আমাদের ভালোবাসে এবং তা বাসে পাগলের মতো, তখন তাকে নিয়ে আমরা না ভাবলেও বা না ভালোবাসলেও তার সাথে করা খারাপ ব্যবহারের জন্য একদিন-না-একদিন ভীষণ পস্তাতে হয়। বার বার মনে হয়, কেন এমন করেছি? কী অপরাধ ছিল তার? ভালোই তো বাসত, পাপ তো আর করেনি! সে যখন এখন জিজ্ঞেস করে বসে, আমি কাউকে ভালোবাসি কি না। আমি চোখ বন্ধ করি, আর সাথে সাথেই তুমি ভেসে ওঠো চোখের সামনে। আমি কিছু বলি না তাকে, চুপ থাকি। এর কারণ, যাকে ভালোবাসি, সে আমাকে ভালোবাসে না। যে আমাকে ভালোবাসে, আমি তাকে ভালোবাসি না। কী এক অদ্ভুত ব্যাপার! ক ভালোবাসে খ’কে, খ ভালোবাসে গ’কে। গ আবার খ’কে ভালোবাসে না। খ আবার ক’কে ভালোবাসে না। কী এক অবস্থা! একটা জিনিস মিলিয়ে নিয়ো তুমি সময় হলে। আমরা কাউকে ভালো না বাসলেও একটা সময় পরে গিয়ে মনে হয়, আহা, মানুষটা তো সত্যি সত্যিই আমায় ভালোবাসত! তবে এত খারাপ ব্যবহার কেন করলাম? এত কঠোরই-বা কেন হলাম তার প্রতি! ব্লা ব্লা ব্লা! ওই সময়টা কেমন যে লাগে, বলে বোঝানো যায় না! যদি আমি কারও প্রতি খারাপ আচরণ করে থাকি, তবে আমি পুড়তে থাকি। কেউ যদি হাজারো বার আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার পরেও, আমি তার ব্যবহারে চুপ হয়ে যাই। পালটা জবাব দিই না। কারণ ভালো যে বাসি! সহ্য করার মনমানসিকতা নিয়েই ভালোটা বাসি এবং সহ্যও করে ফেলি। ভালোবাসলেই সম্ভব সহ্য করা, আর নয়তো না। ভালোবাসার মতন সুন্দর জিনিস বা বিষয় মনে হয় আর নেই পৃথিবীতে। সব কিছুরই সমাধান আছে বা হয়। কেউ কাউকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসার পরেও তাকে কেন যে পায় না, এর বোধ হয় কোনও সমাধান নেই। ও হ্যাঁ, আছে! ওই যে বলি না অদৃষ্ট! মানে কপালে নেই! কী এক মনভোলানো প্রবোধ! আচ্ছা, কপালে যদি না-ই থাকে, তবে কেন ভুল মানুষের জন্যই আমাদের মনে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়? মানুষ আর নেই নাকি? এর উত্তর তুমি জানো? আসলে ভালোবাসা মানে হলো কষ্ট পালা। আগে বা পরে কষ্ট পেতেই হবে। এটাই অদৃষ্ট। ভালোবাসার মানুষটা চোখের সামনে নেই, এটা কষ্ট। পৃথিবী থেকে বিদায় নিল কোনও-না-কোনও দিন, তখন কষ্ট। মানুষটা আমাকে বোঝেই না, এ তো অনেক কষ্ট! আমার কথা যদি বলি, তুমি আমার হলে না, এটাই আমার কষ্ট! (যদিও আমি আমার পাশে কাউকেই কল্পনা করি না, তা-ও বললাম আর কি বাকিদের বেলায়!) আমরাই ডেকে ডেকে কষ্টকে নিয়ে আসি জীবনে! আসলে বাচ্চারাই শান্তিতে আছে। এরা এখনও দুনিয়া কী, বোঝে না। খিদে পেলে কান্না করে দেয়; ব্যস্, হয়ে গেল! আর আমরা? কান্নাটা করব কখন? কার সামনে? শুধুই ঢোঁক গিলি কষ্টটা যখন বেশি বেড়ে যায়। কোনও মানে হয়? পেয়ে হারানোর চাইতে না পাওয়া অনেক ভালো। এই কারণে আমি অনেক কিছুই জীবনে অপরিহার্য বানাই না বা মনেই করি না। আমি ভীষণ শান্তিতে আছি। আহ্ সিঙ্গেল লাইফ! কত যে শান্তি, বলে বোঝানো যাবে না! গোটা একটা জীবন শান্তিতে শান্তিতেই শেষ করে দিলাম! নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আছে এখনও দুনিয়াতে। সেগুলির বেশিরভাগই দেখবে, একতরফা। এইগুলি অনেক দিন টেকে। কারণ দুই তরফ থেকে কোনও ডিসিশন নেই, ভাবনাও নেই। তাই একজনের কাছে শেষমেশ রয়েই যায় ভালোবাসাটা! শেষ হয়েও হয় না শেষ! মানুষটার কিছু কথা তোমার সঙ্গে শেয়ার করি। পড়ো, কেমন লাগে দ্যাখো। তুমি এলে আমার ঘরে আলো আর জ্বালব না। কারণ তুমি নিজেই তো একটা আলো! যদি আসতে আমার এই ছোট্ট নীড়ে, তবে সত্যিই আলো জ্বালানোর কোনও দরকার হতো না। আমার চোখে তুমি ছোট্ট একটা পরী আজও। এই পরীটাকে শুধু ভালোই বাসা যায়, বকা দেওয়া যায় না। জীবনে তুমি এলে না, তাই সিগারেটের সঙ্গেই বন্ধুত্বটা আমার গাঢ় হলো। যদি আসতে, তবে সিগারেট কেন, আরও অনেক কিছুই আমি চোখ বন্ধ করে ছেড়ে দিতাম। তুমি বড়ো হবার অপেক্ষায় ছিলাম। যখন বড়ো হওয়া শুরু করলে, তখন বুকে ভয় ছিল, যদি হারিয়ে ফেলি! দ্যাখো, আজ সত্যিই তোমাকে হারিয়ে ফেললাম! তোমাকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসতাম…ওহ সরি, আজও বাসি। তুমি কখনও আমাকে বুঝতেও চাইলে না। আজ যখন বলো, তোমার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করে দিতে, তখন কি খুব একটা কিছু হবে? ক্ষমা করে দিলেই কি তুমি আমার হয়ে যাবে? আমি তো তোমাকে ক্ষমা করতে বা না-করতে চাইনি, আমি শুধু তোমাকেই চেয়েছি! যদি তুমি আমার হতে, তবে আমি যে-কোনও পাপ কিংবা পুণ্য করতে রাজি হয়ে যেতাম! সবসময়ই কতটা মিস করেছি বা আজও করছি, সেটা তো তোমার বোঝার কথা! জীবনে কাউকে ভালোবেসেছো? সে বুঝেছে তোমার ভালোবাসা? বোঝেনি তো? হা হা হা! চিন্তা কোরো না, ভালোবাসা এমন অবুঝই হয়। আমরাই একটাসময় বেশ বুঝদার হয়ে যাই! আমি যে তোমাকে আজও ভালোবাসি, জানো সেটা? অবশ্য জানলেই-বা কী! যে বোঝেই না, তাকে আর কী বোঝাব! তোমাকে পেলে জীবনটা অনেক সুন্দর হতো। দ্যাখো না, জীবনটা আজ কেমন পানসে লাগে! …উপরের এইসব কথা সে যখন বলতে থাকে, তখন আমি শুনতে থাকি অপরাধীর মতো। জীবনের প্রত্যেকটা জিনিসের একটা সময় থাকে। সময়ের আগেও ভালো না, পরেও ভালো না। যখন সে অভিযোগ করেই বসে, আমার ব্যবহারটা কড়া ছিল, আমার তাকে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি, তখন মানুষটাকে বোঝাতে গিয়েও জিহ্বা কেমন ভারী হয়ে আসে। ফোন যখন দেয়, সে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে, কোনও কথা বলে না। আমি বুঝতে পারি, সে একের পর এক সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছে এই আশায়, যদি তার নীরবতা ভেঙে দিয়ে বলি, এত সিগারেট খাওয়া কি ভালো? সে তখন ঠিকই বলে বসবে, তুমি পাশে থাকলে সিগারেটের নামই ভুলে যেতাম! বলেছিলাম না, বড়ো হও, সব কিছুই ছেড়ে দেবো! কিন্তু তুমি তো আজও বাচ্চাই রয়ে গেলে। আমার কী দোষ বলো? যাকে আমি ভালোবাসি না, সে মানুষটা আমাকে আজও বাচ্চাই দেখে! আর যাকে আমি ভালোবাসি, সে মানুষটা কিনা আমাকে সেই পরিচয়ের পর থেকেই বুড়ি দেখে! হ্যাঁ মানছি, এর নামও অদৃষ্ট!