অতিমানবের আবির্ভাব

একমেবাদ্বিতীয়ম্ পরমেশ্বরের আনন্দ-এষণায় এই সৃষ্টির অভিব্যক্তি, বিকাশ ও প্রবাহ। এক হয়েও তাঁর আনন্দলীলার জন্য তিনি হলেন বহু। অসীম হয়েও তিনি ধরা দিলেন সীমায়। তাঁর সৃষ্টির গোপন রহস্য সব এখনও মানুষের কাছে উদ্‌ঘাটিত হয়নি। ধাপে ধাপে সৃষ্টি বিকশিত হয়ে চলেছে চেতনার বিবর্তন-ধারায়। তাঁর অনির্বচনীয় শক্তির কল্যাণে এবং ক্রিয়ায় প্রথমে গঠিত হলো জড়। জড়ের পর প্রাণ এবং প্রাণের পর মন। মানসচেতনার বিবর্তনের ফলে দেখা দিল বর্তমান সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ।




মানবচেতনার উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠল মানবসমাজ, ও তার ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, বিজ্ঞান, ভাস্কর্য এবং সামগ্রিক মানবসভ্যতা। পৃথিবীতে দেখা দিল বিভিন্ন জাতি, গড়ে উঠল রাষ্ট্রসমূহ। মানুষের মন-বুদ্ধির চরম বিকাশ সত্ত্বেও মানুষ হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। তার কোনো শান্তি নেই, কোথাও স্বস্তি নেই। মানবসমাজের মধ্যে লেগে আছে স্বার্থ-সংঘাত, লোভ-হিংসা, ঈর্ষা-দ্বেষ-কলহ। এ সমস্যা সমাধানের জন্য ভগবান বারেবারে মানুষের দ্বারে তাঁর দূত পাঠিয়েছেন। তিনি নিজে অবতাররূপে এসে মানুষকে পরম শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তবুও মানুষের চৈতন্যের উদয় হলো না।




প্রত্যেক ধর্ম‌ই মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে, ভগবান এক এবং সকলের মূল উৎস তিনি। বিভিন্ন পথে তাঁকে লাভ করা যায়, তাঁর কাছে পৌঁছানো যায়। তিনি রয়েছেন সমভাবে সকলেরই হৃদয়দেশে। তা সত্ত্বেও ধর্ম ও মতবাদ নিয়ে মানুষের হানাহানির অন্ত নেই। এর প্রধান কারণ, অজ্ঞানতা এবং ভগবানের অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের অচেতনা। মানুষের চেতনা আজ গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। জীবন আজ শাসিত হচ্ছে মিথ্যা, মোহ, মায়া ও অবিদ্যার শক্তির দ্বারা।




মানুষ ভালোবাসে তার উচ্ছৃংখলতা, অসংযম, দুর্বলতা ও অপূর্ণতাকে। যতদিন পর্যন্ত সে আত্মজয় করতে না পারবে, তার স্থায়ী সুখ ও শান্তি ততদিন আসবে না। পদে পদে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে তার ভেতরের রিপুগুলির দ্বারা। তার অন্তঃস্থ দিব্যসত্তাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে অচেতনা ও মোহের গাঢ় আস্তরণ। নিজের অহম্‌কে ছাড়িয়ে মহত্তর ও বৃহত্তর ভগবদ্‌চেতনাকে তার মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে সে ভয় পায়। সুন্দর, কল্যাণ ও সত্যকে সে সবসময়ই রাখে দূরে সরিয়ে—ফলত, সামঞ্জস্যহীন জীবনের সুখ কোথায়? আনন্দ কোথায়? শান্তি কোথায়?




আমাদের দৈহিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার বিজ্ঞানকে মানুষ ব্যবহার করছে ধ্বংসের হাতিয়ার রূপেও। একের উপর অন্যের আধিপত্য-স্পৃহা মানবাত্মাকে কলঙ্কিত করেছে বারবার, মানবসভ্যতাকে করেছে কালিমালিপ্ত। ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ-বুভুক্ষা যখন সামষ্টিক রূপ পরিগ্রহ করে, তখন মানুষের আসুরিক বৃত্তি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। তার ফলে ঘটে যুদ্ধবিগ্রহ, লোকক্ষয়, মনুষ্যত্বলোপ—প্রবল অশান্তি।




এত যুদ্ধবিগ্রহ করে এবং তার কুফল লাভ করেও মানুষ তার আদিম অন্ধ বৃত্তিগুলির পরিবর্তন ও রূপান্তর সাধন করতে পারেনি। মানুষ রয়ে গেছে আগের মতই অর্ধপশু এবং তিমিরাচ্ছন্ন। মানুষের এই দুর্গতির সমাধান কী? মানুষ যদি তার অন্তরের মধ্যে ভগবদ্‌চেতনাকে আবিষ্কার করতে পারে, তাকে জীবনে ফুটিয়ে তুলতে পারে এবং সর্বভূতে এক পরমেশ্বরের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারে, তবে সে তার অন্ধপ্রবৃত্তি ও তামসিক বৃত্তিসমূকে জয় করতে পারবে এবং তখনই তার মধ্যে জেগে উঠবে মানবপ্রেম, মহাজ্ঞান ও মহৎ মৈত্রীচেতনা। সে নিজেকে অনুকরণীয় করে তুলবে সকলের মধ্যে। বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সে মহৎ ঐক্যের চেতনায় বাস করবে, আর ঠিক তখনই তার মধ্যে চিরকালের জন্য স্থায়ী হবে প্রকৃত আনন্দ ও শক্তি।




ক্রমবিবর্তনের ধারায় সম্ভূত শত ত্রুটিবিচ্যুতিপূর্ণ অপূর্ণ মানুষ নিয়ে মহাপ্রকৃতি সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। তাঁর লক্ষ্য, এই পৃথিবীকে ভগবদ্‌চৈতন্যসম্পন্ন করে তোলা এবং অতিমানব ও অতিমানবগোষ্ঠীর জন্ম দেওয়া। এই জগতকে দিব্যভাবে রূপান্তরিত করে এখানে সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য দিব্যমানবের প্রয়োজন। মানুষের মন চেতনার শেষ পরিণতি নয়, মনের চেয়েও রয়েছে তার ঊর্ধ্বে চেতনার বহু বহু স্তর—ভগবানের সত্তাসম্পন্ন মহাচেতনা ও অতিমানস রয়েছে বহু ঊর্ধ্বে।




সেই অতিমানস‌ই পৃথিবীতে নেমে এসে এখানে অতিমানবের সৃষ্টি করবে। তখন এই অন্ধ প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষের আধিপত্য-দম্ভ পৃথিবীর বুকে থাকবে না; এখানে সৃষ্টি হবে নূতন জগত, নূতন দিব্যমানব। এই দুরূহ কাজটি মানুষের একক সত্তার সামর্থ্য দ্বারা সম্ভব নয়, এর জন্য হৃদয়ে মহাশক্তির অধিষ্ঠান প্রয়োজন। যারা নিজেদেরকে মহাশক্তির হাতে নিঃশেষে সঁপে দিতে পারবে, তারাই হতে পারবে দিব্যমানব। যে অঘটনঘটনপটিয়সী শক্তি মানুষের এমন ঊর্ধ্বগামিতাকে এ জগতে সম্ভব করে তুলেছে, সেই গভীর অতিমানস শক্তিকে মানুষের মাঝে প্রকটিত করে তুলতে হবে।




যুগ যুগ ধরে অসংখ্য সাধু-সন্ত-মনীষী'র স্বপ্ন: পৃথিবীকে সত্য-ন্যায়ধর্মের রাজ্যরূপে গড়ে তোলা—এখানে সত্য-শিব পরমব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা করা। তবে কীভাবে কোন শক্তির বলে তা সম্ভব হতে পারে, সে তত্ত্ব ও সত্যের সন্ধান তাঁরা দিতে পারেননি। ওঁদের অধ্যাত্মশক্তি এবং অতিমানসের শক্তি দ্বারা তা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। ধর্মীয় অনুশাসন মানবপ্রবৃত্তির রূপান্তর করতে পুরোপুরিভাবে অসমর্থ হয়েছে। তাই তো ভগবান নিজে এসে পৃথিবীর জন্য নানান পথনির্দেশ করে গেছেন বিভিন্ন অবতাররূপে, যাতে পৃথিবী হয়ে ওঠে দিব্য ও ভগবদ্, মানুষ হয়ে ওঠে দেবতাতুল্য অতিমানব।




তাঁদেরই গভীরতম নৈবেদ্য ও দুস্তর সাধনায় পৃথিবীতে নেমে এসেছে অতিমানস; এক নতুন জগতের জন্ম হয়েছে সাধারণ মানবসৃষ্টির অন্তরালে। এই অতিমানস-শক্তিই পৃথিবীতে দিব্য ও অতিমানবের সৃষ্টি করবে—মানুষের দিক থেকে চাই সেই শক্তির প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধাশীল অনুশীলন। তবেই পৃথিবী হবে মধুময়, স্বর্গের সাথে সে করবে মিতালি, রচিত হবে স্বর্গ-মর্ত্যের সেতু। সেই মহাশক্তির কল্যাণে পৃথিবী ক্রমশ চলে যাবে মহৎ ঐক্য ও এর দিব্যপ্রকাশের দিকে। তখন একদিন এই পৃথিবী হয়ে উঠবে অতিমানবের লীলাভূমি—অতিমানসের দীপ্তিতে।