অঙ্কবোঝার পর

 
আজ যদি এখানেই মরে পড়ে থাকি,
তোমাদের মধ্যে কে টের পাবে, বলো?
তবে যে বলো, শেষমুহূর্তটা পর্যন্ত পাশে থেকে যাবে?
শেষমুহূর্ত যে কী, তার আদৌ কিছু বোঝো তোমরা?


তোমরা আমাকে দুঃখ পেতে দেখোনি,
কাঁদতেও দেখোনি বোধহয়।
শুধুই ব্যথা পেতে দেখেছো, তা-ও…কখনও কখনও।
দেখেছো আর ভেবেছো, ব্যথা পেলে আমার গায়ে বুঝি লাগে না।
এই পৃথিবীর সমস্ত অশ্রু তোমাদের নামেই লিখে দিয়েছেন ঈশ্বর!
চোখে অশ্রুপ্রপাত না দেখলে কান্নাটা বোঝেই-বা ক’জন, বলো?


আমি আগে দুঃখ পেতাম,
এখনও পাই---তবে তা দুঃখ নয়, বেশি দুঃখ।
বেশি দুঃখে কেউ কাঁদে না,
মানুষ কাঁদে মূলত…অল্প দুঃখে কিংবা দুঃখে।
আমি আমার নিজেকে অনেক কষ্ট পেয়েও হাসতে দেখেছি।
আর তোমরা? আমাকে শুধুই হাসতে দেখেছো!
নিজেকে আমি গলা ছেড়ে গাইতে দেখেছি ততক্ষণ পর্যন্ত,
যতক্ষণ না কণ্ঠ ভেঙে রক্ত বেরোয়...
তোমরা দেখোনি তার কিছুই…তোমরা আমাকে শুধুই গাইতে দেখেছো!


তোমরা ভাবো, মানুষ ব্যথা পেলেই বুঝি কাঁদে!
আরে বোকার দল, মানুষ ব্যথা পেলে কাঁদে না,
মানুষের কান্না পেলে তবেই মানুষ কাঁদে!
কান্না-পাওয়া আর ব্যথা-পাওয়া, এই দুই…এক তো নয়!


আচ্ছা, তোমাদের গানে এত দুঃখ কেন?
তোমাদের হাসিতে এত ভাবনা কেন?
আমি তোমাদের দেখি আর ভাবি,
সত্যিই, তোমরা যন্ত্রণাকে কখনও ছুঁয়ে দেখোইনি!
তোমাদের কাছে যন্ত্রণার অর্থ---কেবলই সুখের অভাব!
সুখ এলে মানুষ যে কতটা অসহায় হয়ে পড়ে, সে খোঁজ তোমাদের নেই।


খিদে পেলে লোকে খায়, খিদে না পেলেও খায়।
যার ঘরে খাবারই নেই, তার কিন্তু খিদে আর পায় না---
তোমার এটাও বিশ্বাস করে বেঁচে আছো! কীভাবে আছো, বলো তো?
সত্যিই, বেঁচেথাকার প্রয়োজনে,
তোমরা অনেক কিছুই বিশ্বাস করে ফেলতে পারো।


এই জীবন তোমাদের জন্যই এসেছে গো, বেঁচে নাও ইচ্ছেমতো!
রোদ্দুর দেখে হাসো, বৃষ্টি দেখে কাঁদো।
শীত এলে আগুনের সামনে বসে কাঁপো।
বসন্তে রবীন্দ্রনাথকে টানো...শরত নামলে কথার ভাঁজে ঘুমোও।
এমন জলেভাসা ছায়াপথে…আহা, তোমাদের কেমন স্বচ্ছন্দ বিচরণ!


এর বাইরের যে জীবনটা, তা তোমাদের হিসেবেই আসে না।
সে জীবনের মানুষগুলো তোমাদের চোখেই পড়ে না।
জীবনকে তোমরা রেখে দিচ্ছ…দারুণ, জ্যান্ত…ঠিক এভাবেই!
হ্যাঁ, জীবন এভাবেই হয়ে ওঠে…তোমাদের…একান্তই ব্যক্তিগত!


আমাকে কখনও ‘ভালোবাসি’, বোলো না।
ওরকম শুনলে, নিজেকে বোকা বোকা লাগে;…কখনও, ঘেন্না পর্যন্ত ধরে যায়!
আমাকে কখনও ‘ঘৃণা করি’, বোলো না তা-ও!
তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ঘৃণার মিছিল দেখলে নিজেকে বড্ড দামি মনে হয়!
তোমাদের ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা, দুইই জমিয়ে রেখো…
অন্য কারও জন্য, যে এখনও তোমাদের মুখোশের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছে…!


তোমরা জানোই না,
তোমাদের সব কিছুই মেনে নিয়ে, হাসতে…আমি ঠিক শিখে নিয়েছি!
তোমরা মানোই না,
তোমাদের চোখে যা খেলা করে, তার খোঁজ তোমরা আজও পাওনি!
তোমার বোঝোই না,
তোমার যা বুঝতে পারো, আমার কাঁধে তা চাপিয়ে দেওয়ার নামই সভ্যতা নয়!


তোমাদের শহরে আমাকে আর রেখো না!
সে শহর, আমার আমার নিঃশ্বাসযাপনের ভূমি…আজ আর নয়!
তবু, গায়ের জোরে রাখোই যদি, রাখছো যাকে, সে মানুষটিই আমি নই!
তোমরা আমাকে চেনো না, কেবলই চেনার আস্পর্ধায় বিরক্ত করে যাচ্ছ!
তোমাদের সমস্ত স্বোপার্জিত অনুমান নিয়ে…তোমরা ভালো থেকো।