#রাম_নবমী
সনাতনশাস্ত্র, সাহিত্য বা পুরাণে আমরা বহু দেব-দেবী, অবতার, রাক্ষস এবং আট জন চিরঞ্জীবীকে অষ্টসিদ্ধির প্রয়োগ করতে দেখি, তবে আটটি সিদ্ধির সবগুলিই তাঁদের সবার আয়ত্তে ছিল না। একমাত্র গণপতি এবং হনুমান এই আটটি সিদ্ধিকে নিজেদের আয়ত্তে এনেছিলেন। চিরঞ্জীবীগণ সম্পর্কে জানা যাক:
বেদব্যাস: যে-ঋষি মহাভারত রচনা করেন—তিনি পাণ্ডিত্য এবং প্রজ্ঞার প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি ছিলেন ঋষি পরাশর ও সত্যবতীর পুত্র, ঋষি বশিষ্ঠের প্রপৌত্র। ত্রেতাযুগের শেষের দিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সম্পূর্ণ দ্বাপর যুগ দেখার জন্য তিনি বেঁচে ছিলেন এবং কলিযুগের প্রাথমিক পর্ব দেখেছিলেন।
হনুমান: সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মচারী, যিনি রামকে সেবা করেছিলেন। তিনি ভগবান রামের একনিষ্ঠ ভক্ত—স্বার্থহীনতা, সাহস, ভক্তি, বুদ্ধিমত্তা, শক্তি, ব্রহ্মচর্য ও ধার্মিক আচরণের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তিনি শক্তিদাতা এবং সংকট নিরসনের দেবতারূপে পূজিত হন।
পরশুরাম: বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। তিনি সকল জাগতিক ও ঐশ্বরিক অস্ত্র-শস্ত্রের জ্ঞানে জ্ঞানী। কল্কিপুরাণ উল্লেখ করে যে, তিনি কল্কির সামরিক গুরু হবার নিমিত্তে সময়ের শেষে আবার আবির্ভূত হবেন। তারপর তিনি চূড়ান্ত অবতারকে স্বর্গীয় অস্ত্র গ্রহণের জন্য তপস্যা করার নির্দেশ দেবেন, যা শেষসময়ে মানবজাতিকে বাঁচাবে। (বিষ্ণুর দশাবতার হলেন:
১. মৎস্য - মাছরূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ, উল্লেখযোগ্য চরিত্র: বৈবস্বত মনু
২. কূর্ম - কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ, উল্লেখযোগ্য চরিত্র: মোহিনী
৩. বরাহ - শূকরের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ, উল্লেখযোগ্য চরিত্র: জয় ও বিজয়, চতুষ্কুমার, হিরণ্যাক্ষ
৪. নৃসিংহ - অর্ধনরসিংহরূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ, উল্লেখযোগ্য চরিত্র: প্রহ্লাদ, হিরণ্যকশিপু, নৃসিংহ
৫. বামন - খর্বকায় বামনের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ, উল্লেখযোগ্য চরিত্র: মহাবলী (দৈত্যরাজা)
৬. পরশুরাম - পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রামের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ, উল্লেখযোগ্য চরিত্র: পরশুরাম, কার্তবীর্যার্জুন, জমদগ্নি
৭. রাম - অযোধ্যার যুবরাজ ও রাজা রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৮. কৃষ্ণ - দ্বাপরযুগে জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরাম সাথে অবতীর্ণ। ভাগবতপুরাণ অনুসারে, দ্বাপরযুগে অনন্ত নাগের অবতার বলরাম রূপে কৃষ্ণের সঙ্গে অবতীর্ণ হন। অধিকাংশ বৈষ্ণব শাখাসম্প্রদায় বলরামকে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করেন। যে-সকল সূত্রে বুদ্ধের কোনো উল্লেখ নেই, সেখানে বলরামকেই বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে দশাবতারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৯. বুদ্ধ - কলিযুগে বিষ্ণুর নবম অবতার হিসেবে অবতীর্ণ
১০. কল্কি - এই ভবিষ্যৎ অবতার কলিযুগের শেষ পর্বে অবতীর্ণ হবেন বলে হিন্দুরা মনে করেন।)
বিভীষণ: রাবণের ভাই; যুদ্ধের আগে বিভীষণ রামের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। রাম কর্তৃক রাবণ নিহত হবার পর তিনি পরবর্তীতে লঙ্কার রাজা হন। তিনি সবসময়ই ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। বিভীষণ সত্যিকারের চিরঞ্জীবী নন, কারণ তাঁর দীর্ঘায়ুর বর শুধুমাত্র মহাযুগের শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে থাকবে। (চতুর্যুগ বা মহাযুগ বা যুগচক্র হলো হিন্দুধর্মে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির কালগণনা পদ্ধতি। এই চতুর্যুগ হচ্ছে: সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ ও কলিযুগ।)
অশ্বত্থামা: দ্রোণের পুত্র। ভগবান শিবের মতো বীরত্বের অধিকারী পুত্র লাভের জন্য দ্রোণ ভগবান শিবকে খুশি করার জন্য বহু বছর কঠোর তপস্যা করেছিলেন। অশ্বত্থামা শিব, কাম, যম এবং ক্রোধের অংশ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তবে তিনি শিবের অবতার নন। মহাকাল অর্থাৎ মহাদেব অশ্বত্থামাকে একটি তলোয়ার দিয়ে তাঁর শরীরে প্রবেশ করেন—অশ্বত্থামা যদি অবতারই হতেন, তাহলে আর মহাদেবের তাঁর শরীরে প্রবেশ করার দরকার ছিল না। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অশ্বত্থামাকে এখনও-বেঁচে-থাকা ব্যক্তি বলে মনে করা হয়। তিনি অমর হতে পারেন, তবে কৃষ্ণ তাঁকে একটি অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন, কিন্তু কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন না বা স্পর্শ করতে পারবেন না, তাঁর শরীরে বেদনাদায়ক ঘা ও আলসার রয়েছে, যার কখনোই নিরাময় হবে না।
মহাবলী: অসুর বা অসুরদের শাসক, যিনি বর্তমান কেরালার আশেপাশে কোথাও বিদ্যমান ছিলেন। তাঁর পুত্র ছিলেন বাণাসুর। তিনি ছিলেন ত্রিভুবনের গুণী সম্রাট, বিরোচনের পুত্র ও প্রহ্লাদের নাতি, যে প্রহ্লাদ ছিলেন অসুর-বংশোদ্ভূত। তাঁকে বিষ্ণুর বামন অবতার পাতাললোকে পাঠান। প্রতিবছর ওনামের দিনে (কেরালার সরকারি মহোৎসব), তিনি কেরালা অঞ্চলে বসবাসকারী তাঁর নিজের লোকেদের সাথে দেখা করতে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসেন।
কৃপাচার্য: মহাভারতের রাজকুমারদের রাজকীয় গুরু। তাঁকে রাজা শান্তনু দত্তক নিয়েছিলেন। তাঁর বোন ছিলেন কৃপী, যিনি দ্রোণাচার্যকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে নিরপেক্ষতার কারণে দীর্ঘজীবনের জন্য পরিচিত এবং তাঁদেরকে নিজসন্তানের চোখে দেখতেন। কুরুক্ষেত্রের সকল যোদ্ধার মধ্যে তিনি তাঁর ভাগ্নে অশ্বত্থামা-সহ বেঁচে আছেন।
মার্কণ্ডেয়: মার্কণ্ডেয় ভৃগু ঋষির বংশে জন্মগ্রহণকারী প্রাচীন ঋষি। মার্কণ্ডেয়পুরাণে, বিশেষ করে, মার্কণ্ডেয় এবং জৈমিনি নামক ঋষির মধ্যে কথোপকথন রয়েছে এবং ভাগবতপুরাণের কয়েকটি অধ্যায় তাঁর কথোপকথন এবং প্রার্থনার জন্য উৎসর্গীকৃত। মহাভারতেও তাঁর উল্লেখ আছে।
বিশ্বাস করা হয়, সকল চিরঞ্জীবী জীবিত, বিশেষ করে, বিষ্ণুর দশম ও শেষ অবতার কল্কিকে সাহায্য করার জন্য, পাপীদের ধ্বংস করতে, পৃথিবীতে ধর্ম বা ধার্মিকতা পুনরুদ্ধার করতে এবং পরবর্তী মহাযুগের দ্বার উন্মুক্ত করতে পরশুরাম পুনরায় আসবেন।
এখন দেখা যাক, নবনিধি (নয় ধন বা সম্পদ) কী। শাস্ত্রে যে নয় প্রকারের ধনের কথা উল্লেখ আছে, সেগুলির দাতা হলেন রামভক্ত হনুমান। অমরকোষ অনুযায়ী যে নয় প্রকার নিধির উল্লেখ রয়েছে, সেগুলি হলো:
১. মহাপদ্ম (১০০ পদ্ম): এই নিধির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি সাত্ত্বিক প্রকৃতির হয়ে থাকে। তবে পদ্মনিধি-সম্পন্ন ব্যক্তির সঙ্গে এর স্থায়ীত্বের পার্থক্য রয়েছে। এর প্রভাব সাত প্রজন্মের পরে আর স্থায়ী হয় না, অর্থাৎ পরবর্তী সাত প্রজন্মের সম্পদের কোনো অভাব হয় না। এই নিধিসমৃদ্ধ ব্যক্তিও দান-ধ্যান করে থাকেন এবং সাতটি প্রজন্ম এ নিধির ফল উপভোগ করে।
২. পদ্ম (১০০ শঙ্খ): এই বৈশিষ্ট্যযুক্ত একজন ব্যক্তির মধ্যে সাত্ত্বিক গুণ রয়েছে এবং তাঁর উপার্জিত সম্পদও সাত্ত্বিক হয়ে থাকে। সাত্ত্বিক উপায়ে অর্জিত সম্পদ থেকে পরবর্তী অনেক প্রজন্মের অর্থের বা সম্পদের অভাব হয় না। এই জাতীয় ব্যক্তিরা স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত রত্ন দ্বারা সজ্জিত থাকেন সবসময়। পদ্মনিধি গুণসম্পন্ন ব্যক্তি উদারভাবে দান-ধ্যান করে থাকেন।
৩. শঙ্খ (১০০ মকর): এই নিধিপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি তাঁর সম্পত্তি নিজস্ব ভোগবিলাসের জন্য খরচ করেন। সবসময় নিজের জন্য অর্থাৎ নিজস্ব ভোগবিলাসের জন্যই তাঁর যত চিন্তা। তিনি প্রচুর উপার্জন করেন, তবে তাঁর অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার জন্য তাঁর পরিবার চরম দারিদ্র্যে জীবনযাপন করে। এই জাতীয় ব্যক্তি তাঁর নিজের উপভোগের জন্য অর্থ ব্যবহার করেন, যার ফলে তাঁর পরিবার খুবই আর্থিক কষ্টে দিন কাটায়। এই ধরনের ধন শত্রু এবং রোগ থেকে সুরক্ষাপ্রদান করে, এমন বলা হয়।
৪. মকর (১০০ কচ্ছপ): মকর (কুমির) নিধিকে শাস্ত্রে তামসিক নিধি বলা হয়েছে। এই নিধির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সাধক অস্ত্রের সংগ্রহকারী হয়ে থাকেন। এই জাতীয় ব্যক্তি রাজকীয় কাজে হস্তক্ষেপ করেন এবং শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এই নিধিপ্রাপ্ত সাধক সকল শত্রুকে নাশ করেন এবং যুদ্ধের জন্য সদাপ্রস্তুত থাকেন। অস্ত্রের প্রয়োগেই এই নিধির সাধকের প্রাণত্যাগ ঘটে।
৫. কচ্ছপ (১০০ কুমুদ): এই নিধিসম্পন্ন সাধক, কচ্ছপ যেমনি খোলসের মধ্যে তার সব কিছু লুকিয়ে রাখে, ঠিক তেমনি তাঁর সম্পত্তি গোপন রাখেন। এই সম্পত্তি তিনি নিজেও ব্যবহারও করেন না, অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দেনও না। সাপ যেমন কোনো পুরোনো গোপন ধন রক্ষা করে, এই নিধির সাধক সেই সাপের মতোই তাঁর সম্পত্তি রক্ষা করেন। এ জাতীয় ব্যক্তি ধন-সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তা গ্রহণ বা ভোগ করতে সক্ষম হন না। এই নিধিকে স্থিতিশীলতার প্রতীক বলা হয় এবং এটি সব ধরনের বিপদ থেকে সুরক্ষা প্রদান করতে পারে। এই নিধির সাধক অতিশয় কৃপণ হন।
৬. কুমুদ (১০০ কুন্দ): কুমুদ (মুকুন্দ) নিধি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির মধ্যে রজোগুণের আধিপত্য বেশি থাকে। তাই এটিকে রাজকীয় নিধি বলা হয়। এই নিধি দ্বারা সমৃদ্ধ কোনো ব্যক্তির মন কেবলই ভোগলিপ্সায় নিযুক্ত থাকে। এই তহবিলসমৃদ্ধ ব্যক্তির সম্পত্তির মেয়াদ মাত্র এক প্রজন্ম।
৭. কুন্দ (১০০ নীল): এর অর্থ জুঁইফুল। এই নিধিটিকে পবিত্রতার প্রতীক বলা হয় এবং এটি ব্যক্তিকে আধ্যাত্মিকভাবে আশীর্বাদপ্রাপ্ত হতে সাহায্য করে।
৮. নীল (১০০ খর্ব): এই নিধিসম্পন্ন ব্যক্তি সাত্ত্বিক ও রাজসিক উভয় ধরনেরই মিশ্রিত গুণসম্পন্ন হয়। এ ধরনের সম্পদগুলি কেবল ব্যবসায় দ্বারা প্রাপ্ত হয়। এই নিধির তহবিলের প্রভাব তিন প্রজন্ম ধরে চলে।
৯. খর্ব (১০০ অর্ব বা বিলিয়ন): এই নিধিকে মিশ্র নিধি বলা হয়। নাম অনুসারেই, এই নিধির অধিকারী কোনো ব্যক্তির সম্পদ হলো উপরের আট প্রকারের সম্পদের সংমিশ্রণ। এই নিধির অধিকারী একজন ব্যক্তি মিশ্র প্রকৃতির বলে অভিহিত হন। তাঁর কর্ম ও প্রকৃতি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। এটি বিশ্বাস করা হয় যে, এই নিধি গ্রহণকারী ব্যক্তি অহংকারী এবং হিংস্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। যখন সুযোগ পায়, তখনই সে অন্যের সম্পত্তি ছিনিয়ে নেয়।
হনুমানচালিসায়, ভগবান হনুমান এই আট সিদ্ধি এবং নয় নিধিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন, যা তাঁর শক্তি এবং ভক্তির প্রতীক বলে মনে করা হয়। তাঁর ভক্তরা সংকট নিরসনে শক্তি ও সাহসের জন্য তাঁর কাছ থেকে আশীর্বাদ চান।
অণিমাদি অষ্টসিদ্ধিও যে অতি তুচ্ছ, তা-ও তুলসীদাসজি বর্ণনা করেছেন এবং সেগুলি নিঃসন্দেহে ভক্তিপথের বিঘ্নই। এই অত্যুজ্জ্বল ভক্তিমণি কীভাবে লাভ করতে হয়, তা তুলে ধরার জন্য তিনি রামচরিতমানসের শুরু থেকেই এই মণির সন্ধানের সকল রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন। সৎসঙ্গই যে প্রথম সোপান, তিনি প্রথমেই তার উল্লেখ করেছেন। সজ্জনের লক্ষণ, তাঁর সান্নিধ্যে যাবার পথ এবং সৎসঙ্গের প্রভাব ও মাহাত্ম্য; একইসাথে, অসন্তের বা অসাধুর লক্ষণের সাথে সন্ত বা সাধুর লক্ষণের তুলনা করে আমাদের কোন পথ অবলম্বন করা কর্তব্য, তা বিচারপূর্বক গ্রহণ বা বর্জন করতে উপদেশ দিয়েছেন। সৎসঙ্গ ও বিবেকের প্রভাবে নামে রুচি হয়, এজন্যই তিনি নামের মহিমাকীর্তন করেছেন।
বিচারের সাথে উচ্চাবস্থায় যাবার পথে ভগবানের স্বরূপ ও রামের অবতারত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ আসতে পারে। ভরদ্বাজের মতো ভক্ত-শ্রেষ্ঠ ঋষির মুখে এই সন্দেহের কথা শোভা পেয়েছে—তাতে অবশ্য তিনি বহু লোকের বিশেষ উপকার করেছেন। রামের স্বরূপ বর্ণনার মধ্যেই এই সন্দেহের ভঞ্জন করা হয়েছে। নানা প্রকারের প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়ে ভক্তজনের স্তুতি ও প্রার্থনার মধ্যে হৃদয়ের ব্যাকুলতা, জ্ঞান-বৈরাগ্যের প্রভাব ও ভক্তির আদর্শ প্রস্ফুটিত হয়েছে।
ভক্তির ক্ষুধা জাগলেই মানুষ প্রকৃত সুখ ও শান্তির স্বাদ গ্রহণ করতে পারে, নয়তো পারে না—তুলসীদাসজি এই সত্য অনুভব করে বার বার ভক্তির অলৌকিক ও অপার্থিব মাহাত্ম্যের কীর্তন করেছেন। এর সাথে সাথে রামের চরিত্রগাথা পাঠ, শ্রবণ ও মননের দ্বারা যে পাপ-সন্তাপ নাশ হয় এবং জ্ঞান, বৈরাগ্য ও মোক্ষসাধনের দ্বার উন্মুক্ত হয়, তা তিনি রামের কথামাহাত্ম্যে বলেছেন।
জ্ঞান ও ভক্তির আপাতবিরোধ দৃষ্ট হলেও এই দুই প্রকৃতপক্ষে যে এক, তা উল্লেখ করে তিনি উভয়ের পার্থক্য দেখিয়েছেন। ভক্তিহীন জ্ঞান আর লবণশূন্য ব্যঞ্জন সমান—দুই-ই শুষ্ক, নীরস ও বেকার। ভক্তি তো মাথার মণি, তার প্রভায় অবিদ্যা (আধ্যাত্মিক অজ্ঞতা) ও মোহান্ধকার দূর হয়ে যায়; তার স্পর্শে লোহাও সোনা হয়, বিষও অমৃত হয়ে যায়। তা লাভ না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নেই, স্বপ্নেও সুখ নেই এবং তা লাভ করলেই জন্ম-জরা-মরণাদি পরম্পরা সংসার-দুঃখ সম্যক্রূপে নিবৃত্ত হয়ে থাকে।
এই ভক্তির ছন্দ বুঝে তাল মিলিয়ে চলতে পারিলে নীচ জাতির প্রতি প্রেমের তত্ত্ব, গোঁড়ামির কুফল, ভগবদ্বিমুখ মানুষের সম্পত্তির বিড়ম্বনা, পিতা-মাতা প্রভৃতি গুরুজনের আদেশ অমান্য করাও কোন ক্ষেত্রে কর্তব্য, নারদের মতো ঋষির মধ্যেও মোহ কেন, ইত্যাদি বহু লৌকিক কর্মে কর্তব্যাকর্তব্য বিচারের সাহায্যে নির্ধারণ করা সহজ হয়ে থাকে। আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক বাতাবরণে লোকশিক্ষার এক অপূর্ব ম্যানুয়েল হিসেবে ‘ভারতীয় সংস্কৃতির জীবন্ত সমষ্টি’, ‘মধ্যযুগীয় ভারতীয় কবিতার জাদুবাগানের সবচেয়ে উঁচু গাছ’, ‘সমস্ত ভক্তিমূলক সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ’ এবং ‘জনপ্রিয়দের জন্য সেরা এবং সবচেয়ে বিশ্বস্ত পথপ্রদর্শক’ রামচরিতমানস ভারতীয় তথা বিশ্বের মানুষের পরম সখার ভূমিকায় সদাঅবতীর্ণ।
পারিবারিক কর্তব্য এবং রাজা হিসাবে কর্তব্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হওয়ায় সীতার মতো পরম পবিত্র চরিত্রের অধিকারিণী সতীকে বনবাস দেওয়ায় ‘রাজধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রতিপন্ন হয়েছে। বিভীষণ অনেক চেষ্টা করেও রাবণকে সত্যপথে আনতে না পেরে অন্যায়ের সাথে অসহযোগই করেছিলেন। রামচরিতমানসে তুলসীদাসজি হনুমান, গুহক চণ্ডাল (রামায়ণে উল্লিখিত নিষাদরাজ, রামের মিতা—”তার চেয়ে ভালো গুহক চাঁড়াল”~~সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত) প্রভৃতি নীচ জাতির প্রতি অগাধ প্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন; সীতার পরম পবিত্র আদর্শ চরিত্র বর্ণনা করে এবং অহল্যা, শবরীর অতুলনীয় ভক্তির মাহাত্ম্য প্রকাশ করে নারীদের পূজাও করে গেছেন।
ভগবান ভক্তকে উচ্চাসন দিয়ে ভক্তির শ্রেষ্ঠত্বই প্রতিপন্ন করেছেন। ভরত, মহাবীর হনুমান, গুহক চণ্ডাল প্রভৃতি রামনাম করেন, আবার রামও তাদেরকে চিন্তা না করে থাকতে পারেন না—ভক্তই তো ভগবানের বৈঠকখানা। (একই আদর্শ গীতাতেও বিধৃত হয়েছে।) এই ভক্তি লাভের জন্য জাতি-বর্ণ বিচারের কোনো প্রয়োজন নেই; মহাবীর হনুমান নীচ জাতি হলেও ভারতের সব জায়গায় তাঁর পূজা হয়ে থাকে। তুলসীদাসজির এক দোঁহাতেও আছে—”জাতি পাঁতি গনিয়ে যো কিয়া হৈ বরন বিচার, তুলসী কহে হরিভজন বিনু চারো জাত চামার।” ভক্তিহীন হলে সমস্ত জাতিই নীচ হয়ে যায় এবং কলিযুগে বর্ণসঙ্করের কথাও তিনি বলেছেন—”ভয়ে বরন সঙ্কর কলী, ভিন্ন সেতু সব লোগ”; “ভগতিবন্ত অতি নীচউ প্রানী, মোহি প্রানপ্রিয় অসি মম বানী” ইত্যাদি।
যা-ই হোক, লৌকিক ও বৈদিক, ব্যাবহারিক ও আত্মিক ব্যবস্থা যতই আপাতবিরোধী ও সমান্তরাল রেখার মতো দৃষ্ট হোক না কেন, একমাত্র ভক্তিই তার অতি পবিত্র মণ্ডলের মধ্যে সকলকে মিলিয়ে দিয়ে নিজের কোলে ধারণ করতে পারে।
এই ভক্তিলাভের পথে বিঘ্ন কী, তা-ও তুলসীদাসজি বিচার করেছেন। প্রথমত, ইন্দ্রিয়সমূহ—প্রবল কাম, ক্রোধ ও লোভই নরকের দরজা এবং এরা মুনিগণেরও মন হরণ করে থাকে। ভোগের কামনা ত্যাগ করে, অন্য সকল ভরসা ছেড়ে ভগবানের শরণাগত হতে পারলে আর ভয় নেই, ইন্দ্রিয়দমনও তখন সহজে হয়। ছল, চাতুরী ও অভিমান তো ভক্তির পথ থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে মানুষকে দুঃখের কূপে নিক্ষেপ করে। সরলতা, বাক্য ও কাজের একমুখী ভাব, ছোটো ছোটো কাজেরও ভগবদ্-অভিমুখী গতি এবং বিনয়নম্র ব্যবহারই তা দূর করতে পারে।
রাম স্বর্ণমৃগের লোভে তার পেছনে পেছনে ছুটেছিলেন অথবা সীতা শোকে অধীর হয়েছিলেন—এটা দ্বারা ধীর ব্যক্তিগণের মনে বৈরাগ্য বরং আরও দৃঢ় হয়েছে। অবশ্য এই সমস্তের মূলে তো মায়া—এই মায়ার শক্তি অসীম, এটা ব্রহ্মা-বিষ্ণুকেও নাচিয়ে ছাড়ে। আর আমাদের মতো সাধারণ জীবের দেহ, সম্পদ, জ্ঞান, বৈরাগ্য ইত্যাদির অহংকার তো নিতান্তই অলীক, বৃথা ও সর্বনাশকর। মায়া জীবকে অণিমাদি অষ্টসিদ্ধির প্রলোভন দেখিয়েও শুদ্ধ ভক্তিলাভের পথে বিঘ্ন উৎপন্ন করে থাকে।
তবে এক্ষেত্রে যা করা সমীচীন, তা হচ্ছে: এগুলিকে শত্রু জেনে সেদিকে দৃক্পাত না করে চলা, আর তা করতে পারলেই বন্ধন এড়াতে পারা যায়। জীব মায়ার অধীনে আসাতে তাতে যে জড় ও চৈতন্যের গ্রন্থি লেগে গিয়েছে, এটা ছিন্ন করার জন্য তুলসীদাসজি গ্রন্থিভেদ যোগ বর্ণনা করেছেন। মূর্খে ও পণ্ডিতে আহার-নিদ্রা সম্বন্ধে কোনো ভেদ নেই, কিন্তু ভেদ আছে বিদ্যাতে। এ বিদ্যা তত্ত্বজ্ঞান-বিদ্যা। এ বিদ্যার কাজই গ্রন্থিভেদ। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদেরকে শেখাচ্ছেন গ্রন্থিভেদের অর্থ:
প্রকাশং চ প্রবৃত্তিং চ মোহমেব চ পাণ্ডব।
ন দ্বেষ্টি সংপ্রবৃত্তানি ন নিবৃত্তানি কাঙ্ক্ষতি।।
(গীতা, ১৪/২২)
শ্রীভগবান উবাচ, হে পাণ্ডব, প্রকাশং চ (প্রকাশ অর্থাৎ জ্ঞান) প্রবৃত্তিং চ (কর্মপ্রবৃত্তি) মোহমেব চ (এবং মোহ) সংপ্রবৃত্তানি (প্রবৃত্ত হলে) [যিনি] ন দ্বেষ্টি (দ্বেষ করেন না), নিবৃত্তানি চ (এবং সেগুলি নিবৃত্ত থাকলেও) ন কাঙ্ক্ষতি (আকাঙ্ক্ষা করেন না) [তিনি গুণাতীত বলে কথিত হন]।
শ্রীভগবান বললেন, হে পাণ্ডব, সত্ত্বগুণের কার্য প্রকাশ বা জ্ঞান, রজোগুণের ধর্ম কর্ম-প্রবৃত্তি এবং তমোগুণের ধর্ম মোহ—এ সকল গুণধর্ম প্রবৃত্ত হলেও যিনি দুঃখবুদ্ধিতে দ্বেষ করেন না এবং ওই সকল কাজে নিবৃত্ত থাকলেও যিনি সুখবুদ্ধিতে তা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তিনিই গুণাতীত বলে উক্ত হন।
তাৎপর্য: দেহে প্রকৃতির কাজ চলছে চলুক। আমি তাতে লিপ্ত নই। আমি অকর্তা, উদাসীন, সাক্ষীস্বরূপ।—এই জ্ঞান যাঁর হয়েছে, তিনিই ত্রিগুণাতীত ব্রহ্মজ্ঞানী। দেহ থাকতে ত্রিগুণের কাজ চলবেই, কিন্তু দেহী যখন এতে লিপ্ত হন না, তখনই তিনি ত্রিগুণাতীত হন। তখন তাঁর মধ্যে আর গ্রন্থিভেদ থাকে না।
এমন ব্যক্তি সংপ্রবৃত্ত (আপনাআপনিই প্রবৃত্ত) বস্তুতে (যেমন বার্ধক্যে) দ্বেষ করেন না (বয়স বাড়ছে বাড়ুক।), নিবৃত্ত বস্তুতে (যেমন যৌবনে) আকাঙ্ক্ষা করেন না (যৌবন ফুরিয়েছে ফুরোক।)। তিনি ‘উদাসীনবদাসীনঃ’ অর্থাৎ সংসারে উদাসীনের মতো থাকেন। অতএব, একজন জ্ঞানী ব্যক্তি উদাসীনের মতোই ব্যবহার করেন। সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা, জপ, তপস্যা, ব্রত, যম (সংযম বা সঠিক জীবনযাপন), নিয়ম ইত্যাদি সাধন করে বিজ্ঞানময়ী (বিজ্ঞান অর্থ: ব্রহ্ম সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞান) বুদ্ধির দীপ জ্বালাতে পারলেই সেই দীপাশিখায় আত্মানুভূতির তথা সুখের সুন্দর প্রকাশ দেখা যায় এবং ভেদজ্ঞান ও ভ্রম (অবিদ্যা বা অজ্ঞান) দূর হয়।