আমি হেঁটে চলি ছোটো ছোটো পদক্ষেপে, ধীরপায়ে; তবু আমার প্রতি পদক্ষেপেই পেরিয়ে যায় কয়েক হাজার মুহূর্ত।
দু-চোখ খোলা রেখে খুব খেয়াল করে চলি যদিও, তবু প্রতিটি ভোরেই কেটে যায় কয়েক হাজার বছর।
আমার থাকার জন্য একটা জায়গা লাগবে, যে জায়গার কোনও পতাকা নেই। নিজের নামে ইতিহাস রাখার জন্য কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীর দরকার আমার নেই। বিশ্বাস করার জন্য কোনও ধর্মও আমার লাগবে না। ভাবার জন্য লাগবে না একটিও দর্শন। নিজেকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেও বিজ্ঞানের দাস হয়ে বাঁচতে আমি চাই না। দেখানোর জন্য সম্পদ কিংবা যার কাঁধে নিজের সমস্ত ভার তুলে দিয়ে নির্ভার থাকা যায়, এমন শাসক না হলেও আমার চলবে।
থাকার জন্য আমার একটা জায়গা লাগবে, রাখার জন্য আমার কোনও জায়গা লাগবে না। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আমার একটা পৃথিবী লাগবে, কিনারা ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাঁটার জন্য আমার একটা ছায়া লাগবে, ফিরে আসার পথটা খুঁজে পেতে আমার একটা দিগন্ত লাগবে, কারও সঙ্গে ভাগ করে নেবার জন্য, আমার সন্তান এবং স্বপ্নদের যত্নে রাখার জন্য আমার একটা ঘর লাগবে, যে ঘরে বেঁচে থেকে, সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে হলেও, আমি অক্ষত রাখতে পারব ভালোবাসাকে।
নিজেকে শান্ত রাখার জন্য, সান্ত্বনা দেবার জন্য... নিজের কানের কাছে ইচ্ছেমতো রূপকথা, পৌরাণিক কাহিনি, গান কিংবা কবিতা আওড়ে যাবার প্রয়োজনে একটি নির্ভীক কণ্ঠস্বরের দাবি আমার আছে। যেখানে যা দেখেছি আজ অবধি, তার মধ্যে যা যা আমায় কষ্ট দিয়েছে, এবং একাকিত্ব ও নিরাশায় ডুবিয়ে দিয়েছে, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার জন্য তাড়া দিয়েছে বারে বারে, সব ছেড়ে-ছুড়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে শিখিয়ে দিয়েছে, ...ওসবের মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে বুঝে নিয়েছি, নিজেকে সারাজীবনের জন্য লুকিয়ে রাখার মতো জায়গা নেই কোথাও, ধরে রাখার কিংবা ছেড়ে দেবার কিংবা ভুলে যাবার বাধ্যতা তৈরি করে, তেমন কিছুও নেই কোথাও।
এমন একটাও দিন নেই, এমন একটাও জায়গা নেই, এমন একটাও পদক্ষেপ নেই, এমন একটাও মুহূর্ত নেই, ---যা লুকিয়ে রাখা যায়। প্রতি পদক্ষেপেই আমি পেরিয়ে যাই হাজার বছর। প্রতিটি মুহূর্তই যেন আসে আমার শেষ সুযোগের বারতা নিয়ে।
অসীম দুঃখের অবগুণ্ঠন ভেদ করার রাস্তাটা আমায় চিনে নিতে হবে, এই পৃথিবীর অসীম রাত্রির সীমাহীন অজ্ঞতা দূরে সরাবার পথও খুঁজতে হবে। ধরে রাখা যায় কিংবা ধরে রাখতেই হয়, এমন একটিও বিন্দু নেই কোথাও; বিজলির দ্রুততম ঝলকানির মতন হারিয়ে যায় সবই চোখের নিমিষে!
যা-কিছু শেকল পরায় এ দু-পায়ে, তা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আমি নিজের হাতেই খুন করব কিছু অভ্যেস, কিছু বিশ্বাস, কিছু মান্যতাকে।
আমি এক মিথ্যের পৃথিবীতে বাঁচি, কিছু ভ্রান্তি আর কিছু ইন্দ্রজাল ধারণ করে আয়ুক্ষয় করি, স্বার্থপরতার গরল পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করি। এবং, এইসব করি ও করতেই থাকি কেবলই আমার আশেপাশে ছোটা মানুষগুলির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে।
এই পৃথিবীর কোনোকিছুই আমার নয়, আমি নিজেও এই পৃথিবীর নই… যেখানে আমি বেঁচে আছি… আমি এই জায়গাটিকে ঠিক চিনি না, এই জায়গাটি কিছুতেই আমার নয়, কেননা আমি যা হতে চাই, যেভাবে বাঁচতে চাই, তার কিছুই এখানে নেই। আমি এখানে কেবলই এক আগন্তুক মাত্র। আমার থাকার জায়গাটিও আমার কাছে রবাহুত তাই।
লুকিয়ে যাবার একটিও জায়গা নেই কোথাও, পৃথিবীর একটিও প্রান্ত নেই, চাইলেই যেখানে আশায় বাঁচা যায়… আজ এই পৃথিবীতে আগুন লেগেছে, কোলাহল, মিথ্যে আকাঙ্ক্ষা এবং অহেতুক সব চাহিদার আগুনে আজ পুড়ে যাচ্ছে সবকিছুই। এই পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নগণ্য অঞ্চলেও আজ ভয়, রক্ত ও হাজারো মৃত্যুর অবিশ্রান্ত হোলিউৎসব, বিজ্ঞানের আশীর্বাদে সময় ও স্থানের সংকুচিত রূপের ক্রমআঘাতে চারিদিকে শুধুই দুর্দশা আর অশ্রু, এবং অযুত মুহূর্তের নৈরাশ্যক্লিষ্ট পরিণতি…
পুরো পৃথিবীটাই একটা ফাঁদ! সেই ফাঁদে পড়ে আমার সারাদেহ আজ যেন এক ভগ্ন মানচিত্র, আমার গল্পগুলিও ফাঁদের, আমার স্বপ্নগুলিও মোহের; আমার ভয়গুলি, আমার বিশ্বাসগুলি আমাকে বন্দি করে রেখে দেয় অনন্তকাল ধরে সেই নিরাপদ প্রকোষ্ঠে, যা আমি নিজেই তৈরি করেছি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে।
কিন্তু এখন আমি জেনে গেছি, নিজের কাছ থেকেই লুকিয়ে থাকা যায়, এমন একটিও জায়গা নেই এই পৃথিবীর কোথাও… এমনকী, এমন বিন্দুও নেই, যেখানে থেকে গিয়ে নিজেকে আড়ালে রেখে দেওয়া যায় অনন্তকাল…
থাকার জন্য আমার একটা জায়গা লাগবে, যার কোনও পতাকা নেই।
নিজেকে মুক্তি দেবার জন্য আমার একটা রাস্তা লাগবে, যার খোঁজে আমি হেঁটে চলেছি…
খুব ধীরপায়ে সময় নিয়ে আমি হাঁটছি… অথচ প্রতিটি পদক্ষেপেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে সতত হাজার পদধ্বনির শব্দ।