ভাবনা: আটশো সাতাশ ……………………………………………………… এক। মাঝে মাঝে আমি অকারণেই বিষণ্ণ হয়ে যাই। বিষণ্ণতার এমন ধূসর উদ্যাপন দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকে। নিরুত্তাপ, নিরুদ্বেগ, নিরবচ্ছিন্ন। কাউকে কিছু বলি না, আশেপাশের সবার সাথে থেকেও আমি একলা থাকি। সবাই বোঝে, কিছু একটা হয়েছে। কী হয়েছে, তা খুঁজতে কেউ চায় না। আমাদের মন খারাপের খোঁজ রাখার দায়টা কারুর নেই, তাই ইচ্ছেও নেই। লোকে মন ভালো করার নানান বুদ্ধি দেয়। আমি শুনতে থাকি আর ভাবি, আহা, আমি যেমনি করে ওদের নীরবে শুনছি, তেমনি করে আমার মনের কথাগুলি শোনার মতো সময় ও ধৈর্য যদি ওদের মধ্যে একজনেরও হতো! ওরা আমাকে যা যা বলে, আমি তার সবই জানি। আমার এই মুহূর্তে পরামর্শের প্রয়োজন নেই। আমার শুধু একজন মানুষের প্রয়োজন যে আমার কথাগুলি চুপচাপ শুনবে, আমাকে জাজ করবে না। এটাই কেউ বোঝে না, সবাই শুধু পরামর্শ দিতে শিখেছে, শুনতে কেউ শেখেনি। কথা শোনানোর মানুষ পথে-ঘাটে, কথা শোনার মানুষ কোথাও কেউ নেই। পৃথিবীতে শিক্ষকের কোনও অভাব নেই, বন্ধুরই বড়ো অভাব। আমি নিজে না মানলেও আমার মন আজ ঠিক বুঝে গেছে, আমার ভালোবাসার মানুষটি এই যে অনেক দিন ধরে আমাকে রোজ রোজ ডজনখানেক ‘আই লাভ ইউ’ লিখে পাঠায়, সে আদতে কোনওদিন আমাকে ভালোইবাসেনি। মানুষটা মূলত তার স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনেই আমার সঙ্গে আছে। এই থেকে যাওয়াটা নামে মাত্র, কাজে নয়। কেউ আমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে যাচ্ছে, এই ব্যাপারটা না বুঝলেই বরং ভালো। বুঝে ফেলতে পারলে বিরাট সমস্যা হয়ে যায়। তখন তাকে ভেতর থেকে আর গ্রহণ করা যায় না। মনের মধ্যে খুব কষ্ট হয়। সেই কষ্টটা তাকে না পাওয়ার নয়, নিজের মনকে বোঝাতে না পারার। মন বোঝে যদিও, সে আমার ছিলই না কখনও, তবু তা মানতে চায় না। প্রত্যাখ্যানও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু প্রতারণা মেনে নেওয়াটা খুব কঠিন। আমার পুরনো মানুষটা আর ফিরে আসে না, শুধুই তার স্মৃতিরা ফিরে ফিরে আসে। ইদানীং আমার হুট করেই মন খারাপ হয়ে যায়। কেন হয় ওরকম? জানি না। আমি আজও যে মানুষটিকে রোজই ‘ভালোবাসি’ বলি, তাকে বোধ হয় আগের মতো নিজের সবটুকু দিয়ে ভালো আমি আর বাসি না। ভালোবাসতে এই না পারাটা ক্যানসারের মতো, কেবল বাড়তেই থাকে। ভালোবাসা বেড়ে চলে যতটা, উদাসীনতা বেড়ে যায় তার চেয়ে অনেক বেশি। যে আমায় ভালোবাসে, তাকে ভালোবাসতে না পারাটা যদি হয় দুর্ভাগ্য, তবে আমি যাকে ভালোবেসেছি, তাকে ভালোবাসতে আর না পারাটা মৃত্যুর সমান। মনে জায়গা দেওয়ার চাইতে অনেক বেশি কঠিন মন থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া। আমি যেখানে মনের দাবিতে শরীর এনেছি, সেখানে সে শরীরের দাবিতে মন টেনেছে। শরীরের সত্যি দাবিতে শরীর এলে তার নাম সমঝোতা, আর মনের মিথ্যে দাবিতে শরীর এলে তার নাম পাপ। যে পাপের কষ্টে আমি ছটফট করছি, সে পাপের সুখে আমার ভালোবাসার মানুষটি বিভোর হয়ে আছে। প্রায়ই আমার ভীষণ উদাস লাগে। কেন লাগে? ঠিক বুঝতে পারি না। যাদের আমি কাছের ভাবি, তাদের সবাই কেবলই আমার আত্মীয়স্বজন কিংবা রক্তের সম্পর্কের, আদতে ওদের কেউই আমার আপন নয়। যার নিজের বলতে কেউ নেই, সে-ও তা মেনে বা মানিয়ে নিতে পারে; কিন্তু যার নিজের বলতে যারা আছে, তাদের কেউই আসলে তার নিজের মানুষ নয়, সে কীভাবে তা মানতে পারে? এসবের উত্তর আমার কাছে নেই। আর নেই বলেই আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়। সেই যন্ত্রণা শেষ হলে আমি উদাসদৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকি। ওরা দেখে, আমার দৃষ্টি আকাশের দিকে; আমি দেখি, আমার দৃষ্টি আমার এই নিরর্থক জীবনটার দিকে। আমার খুব হুটহাট কান্না পায়। জানি না, কেন পায়। আমি যাদের বন্ধু ভেবে এসেছি সবসময়ই, ওরা আদতে আমার বন্ধুই নয়, স্রেফ পরিচিত। পরিচিতদের বন্ধুর জায়গায় বসিয়ে আবার সেখান থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে খুব কষ্ট হয়। আমার বিপদের সময় পাশে পাইনি যাকে, তাকেও আমি নির্বোধের মতো দিনের পর দিন বন্ধু ভেবেছি। আজ আমি বুঝে গিয়েছি, অসংখ্য বন্ধুর ভিড়ে একটিও মানুষ আমার নেই, যাকে আমি কোনও শর্ত ও স্বার্থ ছাড়া বিপদের সময় পাশে পাবো। প্রয়োজনের সময় পাশে থাকে না যে, সে আর যা-ই হোক, বন্ধু কিছুতেই নয়। পরিচিতদের বন্ধু ভাবার চাইতে বড়ো বোকামি আর হয় না। মাঝে মাঝে আমার খুব একা লাগে। কেন লাগে, ভেবে পাই না। আমি বুঝতে পারি, সাড়ে সাত-শো কোটি মানুষের ভিড়ে আমার একটাও নিজের মানুষ নেই। আমার মনটা কেমন জানি করে। কেন এমন লাগে? মনকেমনের শুরুটা ঠিক কবে? কী কারণে আমার মনটা এমন ঘর ছেড়ে পালায়? আমি বুঝি না, আমি আসলে কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। আমি আর এখন কারুরই কেউ হই না। কেউই আমার কিছু হয় না। আমি এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সাথেই সম্পর্কহীন হয়ে বেঁচে আছি। আমার চোখের সামনে পড়ে থাকা প্রতিটি সম্পর্কই এক-একটি দায়মোচন মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। এত কিছু হয়ে যাচ্ছে আমার সাথে, অথচ এসবের একটিও কারণ আমি জানি না। আমার সাথে যা হচ্ছে, তার সবই হচ্ছে অকারণে। আমি আজ জেনে গেছি, প্রতিটি অকারণের পেছনেই অন্তত একটি হলেও কারণ থাকে। দুই। শান্ত কিংবা কাঁপা কাঁপা হাতে একটি ছোট্ট চিরকুটে ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ লিখে আত্মহত্যা-করা প্রতিটি মানুষের মৃত্যুর পেছনে তার সবচাইতে কাছের মানুষটিই দায়ী থাকে। কখনওবা, সে সংখ্যাটি এক থেকে একাধিকে ওঠে। ভালো করে খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, সেই মৃত্যুর জন্য এমন মানুষই দায়ী থাকে, সমস্ত দৃশ্যমান দায় থাকা সত্ত্বেও যাদের দায়ী করা যায় না। এমনকী সমাজের চোখে যা নিছকই একটি স্বেচ্ছামৃত্যু, তা ঘটাতে প্রত্যক্ষভাবে সব ধরনের ভূমিকাপালন করবার পরও কিছু মানুষকে কিছুতেই দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। জীবন কখনও কখনও খুব জটিল হয়ে পড়ে। আমরা এমন কিছু মানুষকে ভালোবাসি, বেঁচে থাকবার সময়ে যাদের ঘৃণা করে বাঁচা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমরা এমন কিছু মানুষকে নিয়ে বাঁচবার স্বপ্ন দেখি, যারা একসময় আমাদের মৃত্যুর একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঘাড়ের উপর যে মৃত্যু ক্রমাগত নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে, আমরা তাকেই জীবনের নানান উপচারে ভরিয়ে তুলবার স্বপ্ন দেখি। এই জীবনের কঠিনতম সমীকরণটি কখন তৈরি হয়, জানেন? যখন দেখবেন, আপনি যে মানুষটিকে ভালোবাসেন, সে মানুষটিই আপনার সমস্ত ঘৃণার একমাত্র উৎস হয়ে যায়। আপনি না পারবেন তাকে ভালোবাসতে, না পারবেন তাকে ঘৃণা করতে; আর ভুলে যেতে তো পারবেনই না! সেই উটকো অপ্রয়োজনীয় মানুষটিই হয়ে পড়ে আপনার আয়ুর চাইতেও দামি। এর চেয়ে বড়ো অসহায়ত্ব আর নেই। ঘৃণা আর ভালোবাসা, এই দুই সত্তা যখনই একবিন্দুতে এসে মিলিত হয়, ঠিক তখনই শুরু হয়ে যায় জীবনের যত বিপত্তি, যত সংকট। আপনার মনের মধ্যে অনুভূতির এই চরম বৈপরীত্য যদি একই ব্যক্তির জন্য সৃষ্টি হয়, তখন জীবনে নেমে আসে তীব্র রকমের অর্থহীনতা। মানুষ যাকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে, দিনের পর দিন তাকেই ঘৃণা করতে যখন সে বাধ্য হয়, তখনই তার হাতে পরাজয়ের সেই বিষণ্ণ চিরকুটটি ওঠে যেখানে লেখা থাকে: আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি আত্মহত্যাই এক-একটি নিখুঁত ও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ভাবনা: আটশো আটাশ ……………………………………………………… এক। যে পুরুষের মধ্যে কোনও নারী একবার তার নিজের বাবার ছায়া দেখতে পায়, সে পুরুষকে নারীটি সব কিছুর বিনিময়ে হলেও নিজের জীবনে রেখে দিতে চায়। মেয়েরা, তার পছন্দের ছেলেটির কোন কোন দিক তার বাবার মতো, তা নিয়ে ভাবতে পছন্দ করে। ছেলেদের মধ্যেও কেউ কেউ এই কাজটি করে। মায়ের ছায়া দেখতে পায় যে নারীর ভেতর, তাকে সে আপন করে রাখতে চায়। মানুষ শৈশবের বিশ্বস্ত ভালোবাসায় বাঁধা পড়ে থাকতে ভালোবাসে। যখন আমরা কাউকে খুঁজি ক্ষণিকের জন্য, তখন খুঁজি এমন কাউকে যে আমার শরীরের ও মনের প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিতে রাজি। সেই আমরাই যখন কাউকে খুঁজি সারাজীবনের জন্য, তখন খুঁজি এমন কাউকে যে আমাদের সমস্ত ক্লান্তি ও অ-সুখকে আশ্রয় দিতে রাজি। তাই তখন আমরা স্রেফ পার্টনার খুঁজি না, খুঁজি মায়ের নিঃশর্ত স্নেহ ও বাবার সুশীতল ছায়া। দেহের বাহ্যিক অবয়ব পেরিয়ে হৃদয়ের একান্ত গভীরে আত্মায় মিশে যেতে পারে, এমন কাউকে পেলে বাকি জীবনের জন্য কাছে রেখে দিতে বড়ো ইচ্ছে করে। দিনশেষে মানুষ নিজেকে পরমআস্থায় ও মমতায় ঘেরা দেখতে চায়। সুস্থভাবে বাঁচতে হলে সুখের আবাদের চেয়ে স্বস্তির নিরাপত্তা জরুরি। মানুষ যখন নিবিড় অনুধ্যানে নিজেকে প্রশ্ন করে, সে আসলে কী চায়, মন তখন রূপ নয়, গুণ নয়, বিত্ত নয়, কেবলই মায়ার টানটা নিয়েই বেশি হাঁটে। মানুষ মায়ায় আটকে থাকতে ভালোবাসে। মায়ার মোহে মানুষ সমস্ত যুক্তির ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে নিজেকে সেই মায়ার উৎসের দিকেই শেষমেশ সমর্পণ করে। কুৎসিত দেখতে কেউ যখন কোনও সুন্দর মানুষের ভালোবাসা-প্রেম অর্জন করে, তখন খোঁজ নিয়ে দেখলে জানা যাবে, এর রহস্যমূলে যা রয়েছে তার নাম মায়া। মানুষ একবার যার মায়ায় বাঁধা পড়ে, তাকে পেতে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। তার চোখে সেই মায়া-জাগানিয়া মানুষটিই এই পৃথিবীর সবচাইতে আকর্ষণীয় ও সুন্দর মানুষ। কে দেখতে কেমন, তার চাইতে বড়ো কথা কাকে দেখতে কার কেমন লাগে। সহজ করে বলি। যাকে দেখলে আপনার মনে হয়, ‘একেও অমুক ভালোবাসে! কীভাবে সম্ভব!’, সে ওই অমুকের চোখে ভীষণ সুন্দর একজন মানুষ। আমরা ভুলে যাই, যে যাকে ভালোবাসে, সে তাকে নিশ্চয়ই সুন্দর দেখে! তা নিয়ে কথাবলাটাও মূর্খতার পরিচয় দেয়। তার চাইতে বড়ো কথা, কে কার সাথে বাঁচলে ভালো অনুভব করবে, সেটা ঠিক করে দেওয়ার আমরা কেউই না। আমাদের চোখে কোন দু-জনকে মানায়, তা দিয়ে সে দু-জনের জীবন চলে কি? আপনি যার সুখের দায়িত্ব নিতে পারেন না, তার পছন্দের মানুষ নিয়ে রায় দেওয়ার আপনি কে? সুখ, শান্তি, স্বস্তি---এসবের কোনও সর্বপালনীয় ব্যাকরণ হয় না। ভেতরের সৌন্দর্য সবসময়ই বাইরের সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যায়। বাইরের চোখ দিয়ে আমরা শরীরের মানুষ দেখি, আর ভেতরের চোখ দিয়ে আমরা মনের মানুষ দেখি। ভেতরের চোখ দিয়ে কোনও মানুষ যা দেখতে পায়, তার চাইতে বড়ো সত্য অন্তত সে মানুষটির জীবনে আর নেই। অন্য কারও সত্য ঠিক করে দেওয়ার দায় বা দায়িত্ব কোনওটিই আমাদের নেই। একমাত্র নির্বোধরাই নিজের মনের সত্যকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। যে সত্য লোকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়, সে সত্য যতটা সত্য, ততোধিক রাস্তার ক্যানভাসারের সস্তা মলম। আমরা যেন মাথায় রাখি, কারও ব্যাপারে আমাদের রায়ের চাইতে তার বোধের সত্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই সত্যই পৃথিবীর সব সৌন্দর্যের গোপন রহস্য। মানুষ মনের সত্যে ভর করেই পৃথিবী দেখে। মানুষ বদলালে মনের সেই সত্যও বদলে যায়। মানুষ যত, সত্য তত। মানুষ তার নিজের মনের সত্যের প্রতি তার সমস্ত দৃষ্টিকে নিবদ্ধ রেখে বাঁচে। আমাদের চোখের দৃষ্টি যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকেই অন্তরের দৃষ্টির শুরু। এইজন্যই, ভালোবাসার মানুষের বেঢপ গড়নের ভুঁড়িও কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার মতো অনিন্দ্যসুন্দর লাগে, কোটরের ভেতরে ঢুকে-যাওয়া কালি-পড়া চোখদুটোও পদ্মফুলের শুভ্রতায় ভাস্বর হয়ে ফুটে থাকে, কুচকুচে কালো চামড়াটি ছোঁয়ার সময়ও মনের মধ্যে একধরনের অপাপবিদ্ধ স্বর্গীয় অনুভূতির জন্ম হয়। ভালোবাসার মানুষের বেসুরো কর্কশ স্বরও রবিশঙ্করের সেতারের জাদুময় মূর্ছনা ছড়ায়। ভালোবাসতে জানে না যারা, তাদের মাথায় এসব কখনও আসবেই না। ভালোবাসার মানুষকে আমরা সুন্দর দেখি, সুন্দর ভাবি, সুন্দর শুনি। এটা নিয়ে উটকো লোকের বিচার বা রায় স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বিরক্ত করে। আমরা এতটাই অপদার্থ ও নির্বোধ যে, যাকে নিয়ে আমাদের বাঁচতে হয় না, তাকে নিয়েও আমরা জাজমেন্টাল হয়ে বাঁচি! আমাদের মনের এমন বেকারত্ব ও দৈন্যের জন্যই এই পৃথিবীর যত অসুখ! ভালোবাসা প্রায়-অনাবিষ্কৃত এক ইন্দ্রজাল। এই জালে আটকে যায় যারা, তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না, এ কীসের মধ্যে যে তারা বেঁচে আছে! আজ হোক, কাল হোক, একটু আগে বা দেরিতে আমরা প্রায় সবাই-ই ভালোবাসার অমন ইন্দ্রজালে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে যাই। যে প্রেমে আপনি পড়েননি, সে প্রেম নিয়ে অর্ধেক বুঝে বা না বুঝে হাজারো রায় আপনি দিয়ে দিতেই পারবেন। নিজে কখনও ওরকম কিছুতে ডুব মারলে কেবল তখনই বুঝতে পারবেন, আপনি যা যা বলেছেন একসময়, তার সবই ছিল অনুমাননির্ভর ও ডাহা মিথ্যে। দুই। অন্যকে ছাগল বলার আগে নিজে মানুষ হওয়াটা জরুরি। যাকে দেখলেই ফালতু মনে হয়, অসহ্য লাগে, মেজাজ খারাপ হয়, তার দিকে তার পরেও তাকানোর মানেটা কী আসলে? সে কি আপনার ভালোলাগা মন্দলাগার তোয়াক্কা করে? না কি সে আপনার কোনও ক্ষতি করছে? না কি আপনি তার দিকে তাকালে সে টাকা পায়? তাকে ভালো না লাগলে তার দিকে তাকাবেন না, তার ধারেকাছেও ঘেঁষবেন না। ব্যস্! লাগে না ভালো, তা-ও তার পাছায় পাছায় ঘোরে! কোন সে বলদ, এমন আজব টুরু-লাভে পোড়ে! কিছু মানুষকে দেখি, কোনও একটি বিশেষ দেশের প্রতি অসীম ঘৃণা পুষে রাখে। আমরা অন্য একটি দেশকে যতটা ঘৃণা করি, যদি তার সিকিভাগও নিজের দেশকে ভালোবাসতাম, তবে আমাদের দেশটা আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারত। একটি দেশ এগোয় তার নাগরিকদের আন্তরিকতায়, সেই দেশের প্রতি অন্য একটি দেশের নাগরিকরা কী ধরনের মানসিকতা ধারণ করে, ওতে দেশটির কিছুই এসে যায় না। আমাদের দেশের সম্পর্কে আমাদের তুলনায় পিছিয়ে-থাকা কোনও দেশের নাগরিকদের প্রবল ঘৃণাও আমাদের জিডিপি একটুও কমাতে পারবে না, আমাদের এগিয়ে চলাকে সামান্যতমও ব্যাহত করতে পারবে না। বরং এর বদলে নিজের দেশের প্রতি ওদের ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ দেশটির আমাদের সমকক্ষ হওয়ার সম্ভাবনাকে অনেক বাড়িয়ে দেবে। গাধার তীব্র ক্রোধও সিংহের একটি কেশরকে পর্যন্ত নাড়াতে পারে না! তিন। আমার পড়া সবচাইতে সৎ উৎসর্গপত্রটি এই বইয়ের। সেখানে লেখা: আমার স্ত্রী মার্গানিট এবং সন্তান ইলা রোজ ও ড্যানিয়েল অ্যাডাম-কে, যারা না থাকলে এই বইটি হয়তো আরও দু-বছর আগেই বেরিয়ে যেত। (To my wife Marganit and my children Ella Rose and Daniel Adam without whom this book would have been completed two years earlier.) চার। দেখো, একদিন তোমার সব থাকবে, শুধু আমিই থাকব না। সেদিন বুঝবে। তোমার চারপাশে ছড়ানো থাকবে রাশি রাশি সুখের পসরা, তবু আমার শূন্যতায় সেদিন তোমার খুব কান্না পাবে। অনেক কেঁদেও আমাকে আর ফিরে পাবে না, সামনে পড়ে থাকবে কেবলই আমার টুকরো টুকরো স্মৃতি। ভাবনা: আটশো উনত্রিশ ……………………………………………………… এক। আমি খুব ছোটোখাটো কিছু স্বপ্ন দেখি। বেড়ালের দুটো তুলতুলে বাচ্চা আর একটা কুকুরছানা থাকবে আমার। ওদের কোলে উঠিয়ে খোলা ব্যালকনিতে বসে বসে রোজ বিকেলে চায়ের কাপ হাতে আকাশে পাখিদের নীড়ে-ফেরা দেখব। সারাআকাশে মায়া ছড়াতে ছড়াতে সারি সারি পাখিরা ঘরে ফেরে। কেউ কেউ সারিতে ফেরে না, একা একা ওড়ে। এর নাম কি নিঃসঙ্গতা? আত্মপ্রত্যয়? নির্ভীকতা? না কি এ শুধুই অভিমান? আমি খুব ছোটো ছোটো কিছু স্বপ্ন বুনি। নিজের টাকায় ছোট্ট একটা ঘর বানাব। সে ঘরের দেয়ালগুলি হবে ধবধবে সাদা। একটা বড়ো পিয়ানো থাকবে দখিনমুখি ঘরটায়। সে ঘরটি হবে হাওয়ার এক বিশ্বস্ত সমুদ্র। অফিস থেকে ফিরে অখণ্ড ব্যস্ততাহীনতায় টুক করে পিয়ানোর সামনে বসে পড়ব। সেখানে আমি সুর তুলব, গলা ছেড়ে গান ধরব। হোক বেসুরো, তবু তো নিজের গলা! যা আমায় সুখী করে, তা-ই তো এই পৃথিবীর সুন্দরতম সুর। দিনযাপনের ক্লান্তি দূর করে নিজের সাথে নিভৃত আলাপচারিতায় কেটে যাবে কিছু সময়। সুরের মূর্ছনায় হাওয়া বয়ে চলার শব্দহীনতা শুনব নিজের নিয়মে। চৈতন্যের এই নৈঃসঙ্গ্যযাপনের নামই যে প্রার্থনা! আমার খুব ছোটো কিছু ইচ্ছে আছে। সেই ইচ্ছেগুলি ডায়েরিতে লিখে রাখব। জীবনে সব কিছু পেয়ে যাব যেদিন, সেদিনই ঠিক বুঝে ফেলব, আমার ইচ্ছেগুলি পূরণ করবার সময় হয়তো এ জীবনে আর কখনও পাবো না। সেদিন থেকে শুরু হবে আমার অপ্রাপ্তিগুলি একটি একটি করে ডায়েরিতে লিখে রাখা। মানুষ যেদিন থেকে সবার চোখে মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করে, সেদিন থেকেই শুরু হয় একজন উনমানুষ হওয়ার দিকে তার বেদনার্ত যাত্রাটি। এ জীবনে যা-কিছু না পেয়েই মরে যাব, তা-কিছুর নিখুঁত বর্ণনা থাকবে সেই ডায়েরিতে। আমার মৃত্যুর পর আমার অপূর্ণ সমস্ত ইচ্ছের নীরব সাক্ষ্য দেবে সেই ডায়েরির ধূসর কিছু ছাই। আমার কিছু আদুরে আহ্লাদ আছে। বর্ষাযাপনের অভিমানে দরজা আটকে রুমের ভেতরে বসে থাকলে প্রিয় মানুষটি একছুটে এসে দরজায় মৃদুআঘাতে কড়া নেড়ে বলবে, বৃষ্টিতে একদম ভিজে গেছি গো! আমায় না নাও, আমার হাতের কদমগুচ্ছটি অন্তত নাও? বাহুতে আইসক্রিমের ব্যাগটা ঝুলছে, এই ফুলগুলি গ্রহণ করে আমাকে একটু উদ্ধার করো, প্লিজ? আমার টুকরো টুকরো কিছু স্বপ্ন আছে। আমার যা-কিছু থাকবে, তার সবই আমি মৃত্যুর আগে রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর-বেড়াল আর ঘরহীন মানুষের নামে লিখে দেবো। আমার শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উইল করে দান করে যাব। আমার খুব ইচ্ছে, আমার প্রিয় চোখদুটো আমার মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকুক। আমার কিডনি মৃত্যুপথযাত্রী কারুর প্রাণটা বাঁচিয়ে দিক। সবাই জানবে, আমি নেই। আর ওদিকে আমার দু-চোখের কাজল আমার অস্তিত্বের হাজিরা দেবে প্রতিদিনই! আমার আজন্ম সাধ, আমার মৃত্যুর পর আমার জন্য একটি পয়সাও খরচ করা না হোক। আমার মৃত্যুর খবরটি যেন আমার কাছের মানুষদের কাছেও না পৌঁছায়। ওরা সবাই জানুক, আমি বেঁচে আছি। যখন আমার জন্য কারও অশ্রু ঝরে, তখন আমার মনে হয়, পাপের ভারে যেন আমার সমস্ত বোধ নুয়ে পড়েছে! মৃত্যুর পরেও আমি কারুর কান্নার দায় নিতে চাই না। যে মানুষটি সম্পূর্ণ প্রত্যাশাহীনভাবে বাঁচে, তার মৃত্যুর পর কারুর অশ্রুর কণামাত্রও প্রত্যাশা জীবিতাবস্থাতে সে ভাবনাতেও আনতে পারে না। আমি চাই, আমার মৃত্যুর সাথে সাথেই আমার সমস্ত ইচ্ছে, অর্জন ও স্বপ্নরা দলবেঁধে মরে যাক। ওরা আমার সন্তানের মতো। মায়ের মৃত্যুর পর সন্তানেরা প্রায়ই অবহেলায় ও অনাদরে বেঁচে থাকে। অমন অবহেলা ও অনাদরের চেয়ে বরং মৃত্যু শ্রেয়। দুই। লতা মঙ্গেশকরের বয়স যখন মাত্র ১৩, তখন তাঁর বাবা শ্রী দীননাথ মঙ্গেশকর হার্টের অসুখে মারা যান। মীনা, আশা, ঊষা, হৃদয়নাথ এই চার ছোটো ভাই-বোন এবং তাঁর মায়ের দেখাশোনার সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কোমল কাঁধটিতে। তিনি সেই অল্প বয়সেই দায়িত্বটি খুব গুরুত্বের সাথে নেন এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি হিসেবে কর্তব্যপালন করতে বিভিন্ন সংগীতনাট্য ও সিনেমায় গেয়ে ও অভিনয় করে ব্যস্ত সময় কাটাতে থাকেন। সময় বয়ে চলে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ব্যস্ততা। বয়স বেড়ে গেলে একসময় তিনি নিজেই আর বিয়ে করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। প্রতিটি নিখুঁত আত্মত্যাগের জন্যই কোনও-না-কোনও পুরস্কার নির্ধারিত থাকে। নিজেকে পোড়ানোর আয়োজনে যে যজ্ঞের কাঠ, তার আগুন কখনও নিভে যায় না। সুকুমার রায়ের ‘আর্কিমিডিস’ থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘রাজা হীয়েরো এক সেকরার কাছে একটি সোনার মুকুট গড়াইতে দিয়াছিলেন। সেকরা মুকুটটি গড়িয়াছিল ভালোই, কিন্তু রাজার মনে সন্দেহ হইল যে, সে সোনা চুরি করিয়াছে এবং সেই চুরি ঢাকিবার জন্য মুকুটের মধ্যে খাদ মিশাইয়াছে। কোনও সহজ উপায়ে এই চুরি ধরা যায় কি না জানিবার জন্য বন্ধু আর্কিমিডিসকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। আর্কিমিডিস সব শুনিয়া বলিলেন, “একটু ভাবিয়া বলিব।” ভাবিতে ভাবিতে কয়েক দিন কাটিয়া গেল। একদিন স্নানের সময়ে কাপড় ছাড়িয়া সবে তিনি স্নানের টবে পা দিয়াছেন, এমন সময় খানিকটা জল উছলিয়া পড়ামাত্র, হঠাৎ সেই প্রশ্নের এক চমৎকার মীমাংসা তাঁহার মাথায় আসিল। তখন কোথায় গেল স্নান! তিনি তৎক্ষণাৎ ‘Eureka!’ ‘Eureka!’ (পেয়েছি! পেয়েছি!) বলিয়া রাস্তায় ছুটিয়া বাহির হইলেন।…যে জিনিস পাইয়া তিনি আনন্দে এমন আত্মহারা হইয়াছিলেন, বিজ্ঞানে এখনও তাহাকে “আর্কিমিডিসের তত্ত্ব” বলা হয়।’ পৃথিবী আর্কিমিডিসের সেইদিনের পাগলামিটা মনে রেখেছে একজন আত্মভোলা বিজ্ঞানীর মহৎ আবিস্কারের গল্প হিসেবে। সবার সেই সৌভাগ্য হয় না, বাকিরা শুধুই পাগল থেকে যায়। পাগলামি সবাই-ই করে, তবু পৃথিবীর ইতিহাসে কেবল জিনিয়াসদের পাগলামিই ঠাঁই পায়। লোকে পাগল তাকেই বলে, যার পাগলামিটা শেষঅবধি নিছকই পাগলামি থেকে যায়। অমন কাউকে লোকে কেবল পাগল বলেই ছেড়ে দেয় না, তার পরে আরেকটি শব্দ যোগ করে পাগল-ছাগল বলে। অসীম সাধনা ও হিসেবি পরিশ্রম এই দুইয়ের হাত ধরে ব্যর্থতার সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে সাফল্য আসে। সাফল্যের শর্টকাট একটাই---বুঝে শুনে পরিশ্রম করা। যেই কাজটি মানুষ ভালোবেসে করে, সেই কাজের পেছনে ক্রমাগত সময় দিতে দিতে একসময় সে পারদর্শী হয়ে ওঠে। দক্ষ হাতের কাজ ও আনাড়ি হাতের কাজ কখনও এক হয় না। কাজের ফলাফলে অনেক পার্থক্য থাকেই থাকে। লোকে বলে, অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে, অপেক্ষার নয়, কর্মময় অপেক্ষার ফলই মিষ্টি হয়। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে যে যত বার ও যত প্রবলভাবে মাটিতে পড়ে যায়, তার মগজের শক্তি ও কাজের ধার তত বাড়ে। শ্রমের ধরনটা হোক এমনই, যাতে খাটতে খাটতে চোখের নিচে পড়া কালচে দাগ একদিন কাজের স্বীকৃতির কাজল হয়ে দু-চোখ রাঙিয়ে দেয়। শ্রমের যাত্রাটা হোক নীরব ও নিরবচ্ছিন্ন, এর ফলের প্রকাশটা হোক সরব ও মহিমান্বিত। কাজের সময় যে যত বেশি বকে, কাজের শেষে লোকে তাকে তত বেশি বকে। নীরবে অপেক্ষা করতে জানতে হয়। কণ্ঠস্বরটা কখন শোনাতে হবে, তা জানতে হয়। খেলার শুরুটা দেখে শেষটা অনুমান করা যায় কি? যায় হয়তো কারও কারও ক্ষেত্রে। ওরা কিংবদন্তীতুল্য খেলোয়াড়। আপনি যদি ওদের দলে হন তো ভালোই। আর যদি না হন, তবে নিজেকে এমন চমৎকারভাবে তৈরি করে তুলুন যেন আপনি যেমনই খেলুন না কেন, আপনার উপর দর্শকরা কখনও আস্থা না হারায়। সবাই যেন আপনার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে থাকে কখন আপনি গোলটা দেবেন, তা দেখার জন্য। একজন লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো হয়ে উঠুন। ওঁরা যতক্ষণ মাঠে থাকেন, ততক্ষণই সবাই ওঁদের পায়ের দিকে তাকিয়ে অধীর অপেক্ষায় থাকে কখন ওঁদের পায়ের বলটি গোলপোস্টের ভেতরে ঢুকবে, তা দেখার জন্য। খেলার শেষমিনিটেও ওঁরা খেলার ফলাফল পালটে দিতে পারেন। কেউ বিশ্বাসই করতে পারে না যে আজকের খেলায় ওঁদের পায়ে গোল না-ও হতে পারে! নিজেকে অতটাই নির্ভরযোগ্য জাদুকর করে গড়ে তুলুন। গাধার কাছ থেকে কেউ বাঘের গর্জন প্রত্যাশা করে না, বাঘের কাছ থেকে কেউ গাধার চিৎকার কল্পনাও করে না। বাঘের মতো বাঁচার আনন্দটা ওখানেই! ভাবনা: আটশো ত্রিশ ……………………………………………………… এক। আমার ওয়ালে আসেন যাঁরা, তাঁদের সকলেই আমার চাইতে উন্নত ধরনের মানুষ---কি জ্ঞানে, কি চরিত্রে, কি বুদ্ধিমত্তায়; এককথায়, সমৃদ্ধির সব দিক বিবেচনায় তাঁরা উন্নততর। এ নিয়ে আমার মধ্যে কোনও দুঃখ নেই। আমি আপনার শ্রেষ্ঠত্ব নতমস্তকে মেনে নিয়েছি। একজীবনে মানুষ আর কতটুকুই-বা পায়! ছোট্ট একটা জীবন, কিছু না পেয়েও ঠিক কাটিয়ে দেওয়া যায়! আপনি এটা নিশ্চিতভাবেই জেনে রাখুন, আপনার মতন মহৎ মানুষ আমি নই, আর তা হওয়ার দূরতম আকাঙ্ক্ষাও আমি রাখি না। আমি খারাপ, তাই আমি নরকেই যাব। নরকে যেতে আমার আপত্তি নেই, তবে আপনারা কেউ কেউ যেমনি করে আমায় টানাহেঁচড়া করেন স্বর্গের দিকে, ওটা আমায় খুব বিরক্ত করে। আমি সাধারণত স্বর্গের এজেন্টের কাছ থেকে কয়েক-শো হাত দূরে থাকি। আমরা যেন মাথায় রাখি, যাঁর পাপের ভারটা আমাকে বহন করতে হবে না, গায়ে পড়ে তাঁকে পুণ্যের পাঠ দিতে যাওয়ার মানেই হলো, নিজেকে একজন বিরক্তিকর মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা। নিজে স্বর্গে যায় না নরকে যায়, তার নাই ঠিক, আরেক জনকে স্বর্গে নেওয়ার ধান্দায় বিজি! কী এক উটকো বিচারক ---নিজে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে আরেক জনের ফাঁসির আদেশ দেয়! যে গাঁজা ফুঁকলেও আপনার ফুসফুস পোড়ে না, সে সিগারেট ফুঁকলে আপনার মন কেন পোড়ে? সুযোগ পেলে সব শালাই ভগবান হতে চায়! দিনশেষে, ওরা হয়ে যায় শালা, ভগবান নয়। এসব নিয়ে আমি বিরক্ত। বিরক্তির এমন প্রকাশ দেখে কেউ কেউ, যা যা ডায়লগ এ জীবনে কষ্টেসৃষ্টে শিখেছেন, তা তা নিখুঁত কর্তব্যজ্ঞানে ঝেড়ে ফেলেন। খুব কমন একটি হলো, অহংকার পতনের মূল। আরে ভায়া, যে পতন ঠেকাতে জানে না, তার অহংকার থাকলেও পতন হবে, না থাকলেও পতন হবে। পতন ঠেকাতে শিখুন, জীবন সুখের হবে। বিনয় অনেক বড়ো জিনিস, যখন তা সঠিক জায়গায় দেখানো হয়। অপাত্রে বিনয় দুঃখ আনে। ছাগলের সামনে বিনীত হওয়ার কিছু নেই। ব্যাটা খায়ই তো কাঁঠালপাতা, চোখের সামনে বিনয় পেলে তা-ও পাতা ভেবে কচকচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। আরেকটি ডায়লগ দেখি: দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য। তো ব্রাদার, আপনার সামনে সুজন সখি হয়ে নাচানাচি করলে কি আমি টাকা পাব? না কি আপনি আমাকে দুর্জন হিসেবে সার্টিফিকেট দিলে তা ধুয়ে আমি জল খাব? বাই দ্য ওয়ে, যে লোকটা পরিত্যাজ্য, তার কাছে এসে অমন নাচেন কেন? ভাই রে ভাই, তোর লজ্জাও নাই? প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় নিয়ে বলি। একসময় আমি কমেন্টে লেখা থেকে কথা গ্রুপের প্রচারণা করতাম, এখন করি রৌপ্যরূপ গ্রুপের। এ নিয়েও অনেকের দুঃখ! দুঃখটা কীসের, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। রৌপ্যরূপ আমার ছোটো ভাই ও তার স্ত্রীর প্রতিষ্ঠান। ওরা অনলাইনে রুপার গহনা বিক্রি করে। কোয়ালিটি, কালেকশন ও কমিটমেন্ট বিবেচনায় বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ওদের ধারেকাছেও কেউ নেই। ওদের সম্পর্কে আমি আপনাদের সামনে বললামই তো মাত্র সেদিন! তার বহু বহু আগে থেকেই রুপার অলংকার বিক্রির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচাইতে বড়ো প্রতিষ্ঠানটির নাম রৌপ্যরূপ। গহনা বিক্রি করে যা টাকা আসে, তা দিয়ে আমাদের সংসারের সিংহভাগ খরচ চলে। আমার নিজের পেইজের ওয়ালে আমি সেই প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা করব না তো কি আপনার ফজলিআমের বিজ্ঞাপন দেখে নাচব? আপনি আমার ওয়ালে এসে আম – লিচু – কলা – জাম্বুরা বেচলে আমার কী লাভ? আপনার ভাইয়ের ব্যবসায়িক সাফল্য বাড়াতে আপনি কাজ করতেন না? না কি সুশান্ত পালের এমন কাজ করা নিষেধ? এ নিয়মটা কার বানানো? আপনার? ওহ্ রিয়েলি!? ইউ আর ছো ছুইঠ...ছো খিউঠ! সুশান্ত আপনার খায় না পরে? হ্যাঁ, যদি আমার ওরকম ‘নির্লজ্জ প্রচারণা’ দেখে আপনার গা বেশি চুলকায়, তবে আপনি আমাকে আনফলো বা ব্লক করে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারেন। (গুগলে সার্চ করলে কীভাবে একটা পেইজকে আনফলো করতে হয়, তা ছবি- ও ভিডিয়োসহ চলে আসে। একটু কষ্ট করে সেখান থেকে দেখে নিলে ভালো হয়।) আপনি আমাকে ফলো করলে আমি টাকা পাই না। আপনি রৌপ্যরূপ-এর কাস্টমারও না। আপনার কাছ থেকে আমি এক কাপ রং-চা’ও প্রত্যাশা করি না। আপনার কাছ থেকে আমার তেমন কিছু শেখারও নেই। এত ‘না’-র পরেও আপনার হা-হা রিঅ্যাক্ট বা হেইট-কমেন্ট দেখলে আপনাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দেবো, এমন সমুদ্রসমান টুরু-লাভ আমার মধ্যে নেই। বেয়াদব ও বেআক্কলের প্রতি সহনশীলতার দেখানোর ন্যূনতমও দায় আমার নেই। যে পেইজের ব্যানলিস্টে লক্ষাধিক সদস্য, সে পেইজের ওয়ালে এসে এত তিড়িংবিড়িং করা যায় না, ডিয়ার চৌধুরী সাহেব! আমি গরিব হতে পারি, তবু আমারও অনেক (ফেইসবুক) ইশটিটাশ আছে! আমি মাথায় রাখি, আপনি আমার এখানে এসেছেনই মাখন খেতে। আমার লেখা বা কথার মাধ্যমে আপনি আমাকে চেনেন। চিনতে গিয়ে আপনার একটি পয়সাও খরচ হয়নি। আপনার এই চেনায় আমার পকেটে একটি পয়সাও ঢোকেনি। আপনার বাসায় পুলিশ পাঠিয়ে আমি আপনাকে আমাকে চিনতে বাধ্য করিনি। নিজের প্রয়োজনেই আপনি আমাকে চিনেছেন। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আমাকে অতিদ্রুত ভুলে যান, ওতে আমার কিছুই এসে যাবে না। আমার লেখা পড়েন ফ্রি-তে, কথা শোনেন ফ্রি-তে, তবু এত প্রত্যাশা আসে কোত্থেকে, বস? অমরত্বের চাইতে আয়ু জরুরি। ভালোবাসার চাইতে ভালোথাকা জরুরি। ফেইসবুকের চাইতে পরিবার জরুরি। (আপনি কি খেয়াল করেছেন, আমি কৌশলে এই পোস্টের মাধ্যমে রৌপ্যরূপ-এর প্রচারণা করে ফেলেছি? এটা খেয়াল করে কি আপনার মেজাজ খারাপ হয়েছে? রাগে-ক্ষোভে সবকটা চুল পুড়ে যাচ্ছে? আপনি কি এই মুহূর্তেই আমাকে আনফলো করে দূরে চলে যাবেন? এখন কি আপনার জন্য আমাকে নেচে নেচে সৈয়দ আব্দুল হাদীর ‘যেয়ো না সাথি…’ গানটা কান্নাজড়ানো কণ্ঠে গাইতে হবে? ভাই…ও ভাই, কী করতে হবে শুধু এক বার বলুন...এক বার...আপ্নের পিলিজ লাগে! তবুও আমাকে ছেড়ে যাবেন না! আপনি আমাকে ছেড়ে গেলে আমি ভাতে মরব, কাপড়ে মরব। আপনার প্রেম, আপনার ভালোবাসা, আপনার সম্মান, আপনার শ্রদ্ধা, আপনার লাইক, আপনার কমেন্ট, আপনার শেয়ার…এসব চিবিয়ে খেয়ে খেয়েই তো আমার পেট ভরে, স্যার!) দুই। আমার সংগ্রহের আরও কয়েকটি বই... বড়ো ইচ্ছে, কখনও বইগুলি গোছানো গেলে আমার ক্ষুদ্র লাইব্রেরিটির উপর একটি ডকুমেন্টারি বানাব। তা অনেকেরই কাজে আসবে। মাঝে মাঝে এই যে বইয়ের ছবি শেয়ার করি, বই নিয়ে কিছু লিখি, তা দেখে যাঁদের মনে আসে, 'দ্যাখো না, ব্যাটা কেমন শোঅফ করছে!', তাঁদের সবিনয়ে বলি, 'অনুগ্রহ করে অমন ভাববেন না। আপনার জন্য যা শোঅফ, কারও কারও জন্য হয়তোবা তা-ই বইকেনার ও বইপড়ার প্রেরণা।' শোঅফ তো কিছুটা করছিই---আপনার চেহারা ভালো বলে সেলফি দিয়ে নিজেকে দেখাচ্ছেন, আমার চেহারা তেমন ভালো নয় বলে বই দিয়ে নিজেকে দেখাচ্ছি। উদ্দেশ্য কিন্তু একই! বই কিনে ও বই পড়ে আর কিছু হোক না হোক, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, মন একটু হলেও এগোয়। জীবন থেকে এরকমই শিখেছি। ভাবনা: আটশো একত্রিশ ……………………………………………………… এক। পরিশ্রম করতে পারা, এটা অনেক বড়ো একটা সুযোগ। সবার ভাগ্যে সে সুযোগ জোটে না। কিংবা জুটলেও, যখন জোটে, তখন পরিশ্রম করতে পারার মানসিক বা শারীরিক সামর্থ্যটাই আর থাকে না। কীরকম? একটু ভেঙে বলি। আমরা চাইলেই এমন কোনও কাজের পেছনে শ্রম দিতে পারি না, যে কাজ আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। প্রায়ই দেখা যায়, সময় ও পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে নেই। এমনও হয়, যে কাজে শ্রম ঢাললে সেখান থেকে প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে, সে কাজটি করার সুযোগই আমরা পাচ্ছি না। যে জায়গায় থাকতে পারলে আমরা আমাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন পেতাম, হয়তো সেখানে থাকতেই আমরা এখনও পারিনি। সবাই-ই কিন্তু যোগ্যতার অভাবে অবমূল্যায়িত হয় না, অনেকেই সুযোগের অভাবে অবমূল্যায়িত হয়। আবার কারও কারও অবমূল্যায়নের পেছনে দায়ী যথেষ্ট ইচ্ছেশক্তির অভাব। এরকম ব্যাপারগুলি ঘটলে পরিশ্রমের সুযোগটাই আর তৈরি হয় না। যে কাজে সময় ও শ্রম দিলে জীবনে সমৃদ্ধিলাভ করা যায়, সে কাজের খোঁজ জানতে পারা কিংবা সে কাজে নিজেকে প্রবৃত্ত রাখতে পারা খুব জরুরি। যাঁদের সামনে এই দুইটি রাস্তা খোলা নেই, পরিশ্রম করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাঁরা পরিশ্রম করার সুযোগটাই পান না। মানুষ এগোতে পারে না পরিশ্রম না করার কারণে নয়, সঠিক লক্ষ্যের পেছনে পরিশ্রম করতে না পারার কারণে। সামনে অনেক রাস্তা, সেখান থেকে কোন রাস্তাটি আমার, সঠিক সময়ে তা বোঝাটা খুব জরুরি। আবার এ-ও ঘটে, লক্ষ্য সঠিকই আছে, কিন্তু সেই লক্ষ্যের দিকে এগোনোর সকল রাস্তাই কোনও-না-কোনও কারণে বন্ধ। লক্ষ্য খুঁজে না পাওয়া, লক্ষ্যের দিকে হাঁটার পথ হারিয়ে ফেলা, লক্ষ্যটিকে পরিস্থিতির অনুকূলে আনতে না পারা---এই তিনটি জিনিস মানুষকে একেবারে অসহায় ও অথর্ব করে দিতে পারে। অনেকেই পথে পথে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় ততদিন পর্যন্ত, যতদিন তারা এমন কোনও রাস্তার খোঁজ না পাচ্ছে, যে রাস্তায় হাঁটলে তাদের মনে হবে, ‘হ্যাঁ, এই রাস্তাটিই তো আমার জন্য সঠিক রাস্তা!’ সব রাস্তা সবার জন্য নয়। কোনও রাস্তাই ভুল নয়, তবে প্রতিটি রাস্তাই কারও-না-কারও জন্য নিশ্চয়ই ভুল। ‘ভুল রাস্তা’ কথাটির মানে নির্দিষ্ট কারও জন্য কিংবা নির্দিষ্ট কোনও সময় বা পরিস্থিতির জন্য ভুল রাস্তা। যে রাস্তায় চলে কেউ তার লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, সে রাস্তা কিছুতেই তার জন্য ভুল রাস্তা নয়। মানুষের নিয়ত ও নিয়তিই তার রাস্তা নির্ধারণ করে দেয়। রাস্তার সঠিকটা ব্যাপারটাই আপেক্ষিক, তাই অন্য কারও রাস্তাকে ভুল হিসেবে রায় দিয়ে দেওয়াটা অনেক বড়ো মূর্খতা। যে কাজটি করতে পারলে নিজের ভাগ্য খুলে যায়, সে কাজটির ভাবনা মাথাতে আসে না বলে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থাকতে হয় অনেক মানুষকেই। আমি এমনও দেখেছি, আন্তরিক চেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রম খরচ করেও আশানুরূপ কোনও ফলাফল না পাওয়ার কারণে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ে, একসময় জীবনের প্রতিই বীতস্পৃহ হয়ে যায়। যে দিনটি আমার নয়, সে দিনটিতে নিজের সমস্ত চেষ্টা ও শ্রম ঢেলে দিলেও সে রাতটি তবু বিষণ্ণতায়ই কাটে। বড়ো লক্ষ্যের দিকে ছুটে ছোটো অর্জন করার চাইতে ছোটো লক্ষ্যের দিকে হেঁটে বড়ো অর্জন করা অনেক ভালো। যোগ্যতার নয়, নিয়তের জোরেই যাপিত জীবনের সৌন্দর্য বাড়ে। মানুষ বাঁচে মূলত নিয়ত ও নিয়তির অপূর্ব এক মিথস্ক্রিয়ায়। যাঁদের নিয়তিতে বিশ্বাস নেই, তাঁরাও নিয়তির বাইরে যেতে পারেন না। আপনার চেষ্টায় কোনও কমতি নেই, আপনার সদিচ্ছায় কোনও ঘাটতি নেই, আপনার ইচ্ছেশক্তিতে কোনও ফাঁকি নেই---এত কিছুর পরেও আপনি কিছুতেই সেই সুযোগটা পাচ্ছেন না, কিংবা সেই সুযোগটা আপনাকে দেওয়া হচ্ছেই না, কিংবা সেই সুযোগটা আপনার চোখের সামনে থেকেও অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে আপনি নিজেকে প্রমাণ করতে পারতেন। এরকমও হতে দেখেছি, নিজেকে প্রমাণ করতে সফল হওয়ার পরেও অনেকে সমস্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে থাকে আর হতেই থাকে। পরিস্থিতি অনুকূলে আসে না কিছুতেই, এমনকী শত চেষ্টার পরেও! এমন ক্ষেত্রে পরিশ্রম করার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ থাকে না। যদি কখনও জীবনে এমন একটিও সুযোগ আসে, যখন আপনি আপনার পরিশ্রমের যথার্থ পুরস্কার পাচ্ছেন, তখন সে সুযোগটিই হচ্ছে পরিশ্রম করতে পারার সুযোগ। সেসময় নিজের সমস্ত আলস্য, অজুহাত ও ইগোকে (অহম্সত্তাকে) ঝেড়ে ফেলে সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করাটাই সুবিবেচকের কাজ। এমন সুযোগ বার বার আসে না। অনেকে অপেক্ষা করে থাকে, তা-ও পায় না এরকম একটিও সুযোগ। পরিশ্রম করার সময় মন দিয়ে পরিশ্রম করাই ভালো। যাঁরা এই সুযোগ হেলায় হারায়, তাঁদের জীবনে দুঃখ অনিবার্য। মানুষ অধিক শ্রমে মরে না, শ্রমের সুযোগের অভাবেই মরে। শ্রমের ক্লান্তিই সৌভাগ্যের উৎসস্থল। পৃথিবীর ইতিহাস মূলত এমন কিছু মানুষের ইতিহাস, যারা পরিশ্রম করতে পারার সুযোগকে কাজে লাগাতে পেরেছে। দুই। বিভিন্ন পণ্ডিতের বিচারে, বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ১০০টি আধ্যাত্মিক গ্রন্থের একটি ‘দ্য গসপেল অব শ্রীরামকৃষ্ণ’। বাংলা ভাষায় রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদটি করেন বিশিষ্ট লেখক ও দার্শনিক স্বামী নিখিলানন্দ। এই অনুবাদের মুখবন্ধ লিখেছেন ইংরেজ লেখক ও দার্শনিক অ্যালডাস হাক্সলি, সম্পাদনা করেছেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের পৃথিবীখ্যাত অধ্যাপক জোসেফ ক্যাম্পবেল ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের মেয়ে মার্গারেট উড্রো উইলসন। এই গ্রন্থে দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে অদ্ভুত রকমের সহজবোধ্য ভাষায় কথোপকথনের ছলে গল্পের মধ্য দিয়ে। মনের ক্লান্তি দূর করতে ও নানান সংশয়ের উত্তর পেতে এই বইটি অনেকের ক্ষেত্রেই অব্যর্থ! স্বামী বিবেকানন্দের দেওয়া কয়েকটি বক্তৃতার সংকলন ‘দেববাণী’ যাঁদের পড়া আছে, তাঁরা জানেন, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার ভাবসমুদ্রে অবগাহন করতে চাইলে বইটি কতটা বন্ধুর মতো ভূমিকা রাখে! অত উঁচু মানের দর্শন/বেদান্ত-আলোচনা খুব বেশি নেই বলেই জানি। ১৮৯৫ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে আগস্ট মাসের প্রথম দিক পর্যন্ত থাউজেন্ড আইল্যান্ড পার্কে কয়েক জন নির্বাচিত শিষ্যের সামনে বিবেকানন্দ কয়েকটি বক্তৃতা দেন। সারা এলেন ওয়াল্ডো সেগুলির কিছু লিখে রেখেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা বইয়ের চতুর্থ খণ্ডে বক্তৃতাগুলি সংকলিত হয়েছে। উপনিষদ বা বেদান্ত নিয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে, তাঁরা স্বামী জুষ্টানন্দ অনূদিত উপনিষদগুলির পাতা উলটে দেখতে পারেন। অতটা সহজ উপস্থাপনে বেদান্তের এমন হৃদয়গ্রাহী আলোচনা কমই আছে। বেদান্তের উপর ইউটিউবে স্বামী সর্বপ্রিয়ানন্দর লেকচারগুলি শুনলে সারামনে একধরনের প্রশান্তি ছড়িয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। বেদান্ত অনুভব করতে ওগুলির চাইতে ভালো লেকচার আমি আর কোথাও পাইনি। ১২টি লেকচারের মাধ্যমে তিনি দৃগ্-দৃশ্য-বিবেক যতটা সহজে বুঝিয়েছেন, অতটা সহজে বেদান্তের এই মৌলিক গ্রন্থটির নির্যাস বোঝা যে যায়, সেটিই আমার মাথায় কখনও আসেনি। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ২ খণ্ডে প্রকাশিত স্বামী লোকেশ্বরানন্দর ‘উপনিষদ’ পড়লে আরও কিছু গভীর নির্জন পথের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। বেদান্তের পথ বরাবরই নির্জন পথ। আমি যেভাবে বই পড়ি, তা একটু বলি। কোনও বই পড়তে গিয়ে যদি দেখি, সেটি পড়তে আমার ভালো লাগছে না, আমি যা চাই তা সেখানে নেই, তবে আমি তখুনিই বইটি পড়া বন্ধ করে দিই। বইয়ের পাতা ওলটালে বোঝা যায়, বইটি আমার মনের বা রুচির সাথে যায় কি যায় না। কোনও বই কিনলে সেটি পড়তেই হবে, এমনটা আমি মনে করি না। ১০০টি বই কিনলে হয়তো ১০টি পড়া হবে। ১০০টি বই না কিনলে কোন ১০টি বই আমার মনের মতো, তা কি জানতে পারতাম? বইকেনার মজাটা এখানেই! জানিয়ে রাখি, নির্দিষ্ট কোনও ধর্মের প্রতি টান বা অনুরাগ থেকে কখনওই কোনও বই আমি পড়ি না। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, আধ্যাত্মিকতা, মনস্তাত্ত্বিক ভ্রমণ ইত্যাদি যেখানে নেই, সেখানে আমিও নেই। পাঠের সাথে ধর্মাচরণের সম্পর্ক নেই বলেই আমি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করি। অবিশ্বাস্য রকমের কম দামে দর্শন, আধ্যাত্মিকতা, মনস্তাত্ত্বিক নানান বিশ্লেষণসমৃদ্ধ বই ছাপানোর জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ: উদ্বোধন কার্যালয় গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অব কালচার শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম, পন্ডিচেরী আমার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে এঁদের ভীষণ চমৎকার কিছু বই রাখতে আমি ভালোবাসি। আমার সংগ্রহে-থাকা কিছু বইয়ের ছবি আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। এতে হয়তো কেউ কেউ উপকৃত হবেন। ভালো কথা, কিছু দিন আগে রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অব কালচার হতে প্রকাশিত বেদগ্রন্থমালা-র আরও ৭টি পর্ব সংগ্রহ করতে পেরেছি, ছবিতে দেখতে পারেন। আমার জানামতে, প্রকাশিতব্য ৬০টি পর্বের মধ্যে, ওঁরা এখন অবধি ৩৬টি পর্ব প্রকাশ করেছেন, যেগুলির সবকটিই আমার সংগ্রহে আছে। ভাবনা: আটশো বত্রিশ ……………………………………………………… এক। যারা অবুঝ বলে---কষ্ট হয়, তারা বুঝতে শুরু করলে---কেন জানি না আরও বেশি কষ্ট হয়! দুই। আমি তো কখনও তোমাকে পেতে চাইনি। তবু তোমাকে পাইনি বলে এমন কাঁদছি কেন? আমরা খুব সম্ভবত শুধুই জয়ী হতে চেয়েছিলাম, সুখী হতে চাইনি। তাই এ জীবনে জয়টাই এল, সুখ আর এল না। মানুষ জয়ী হবার আশায় সুখের সাথে বোঝাপড়া করে। পরে জয়ী হয়ে যাবার পর জয়ের সাথে বোঝাপড়া করতে চায়, কিন্তু আর পারে না। সবাই ভালোবাসা চায় না, অনেকেই চায় শুধুই একটি সামাজিক পরিচয়। একসময় সেই পরিচয়টা পায় হয়তো, তবে ভালোবাসাটা হারিয়ে ফেলে। তখন সে খুব চেষ্টা করেও বুঝতে পারে না, আসলে সে কী চেয়েছিল! আফসোসের বুননে, সমস্ত পরিচয় থাকবার পরেও, মানুষ পরিচয়হীন হয়ে বাঁচে। তিন। যখন অপরিচিত কেউ এসে আমাকে বলে, 'আমি আপনাকে পছন্দ করি না।', তখন আমার তাকে বলতে মন চায়, 'বলেন কী! আপনি আমাকে পছন্দ করেন না! কী সব্বোনাশ! তাহলে এতদিন বেঁচে থেকে আমার কী লাভ হলো! এখন আমার কী হবে! আমি কি এখুনিই আপনার সম্মানে আধগ্লাস পানিতে ডুবে একদৌড়ে আত্মহত্যা করে ফেলব? ভালো কথা, পানি কি মিনারেল ওয়াটারই হতে হবে? না কি ফুটানো হলেও অসুবিধা নাই?' আপনাকে যে লোকটা চেনেই না, তার ওয়ালে গিয়ে বা তার অগোচরে যে ওসব বলে বলে তিড়িংবিড়িং করেন, আপনার লজ্জাও নাই, ভাই? বেকার মানুষ, এত্ত বিজি! টাকা পান এসব করে? যাকে পছন্দ করেন না, তার ওয়ালে গিয়ে নাচানাচি করার কী আছে? যাকে সহ্য করতে পারেন না, তার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকার কী আছে? আপনি কাউকে পছন্দ না করলে কি তার হিন্দিকুন্তল কয়েকটা পেকে যাবে? You don't like me? Oh I see! So what...then? Do I even care? Why are you so cute, babu! Ummmah...!! চার। আপনি যাঁকে পেতে চাইছেন, তাঁকে অন্য কেউ পেয়ে হয়তো খুব দুঃখে আছেন। যিনি আপনাকে পেতে চাইছেন, তিনি হয়তো জানেন না, আপনাকে পেয়ে কেউ একজন খুব দুঃখে আছেন। কাউকে পেয়ে যাবার আগে দূর থেকে দেখে অনেক কিছুই মনে হয়। পেয়ে না গেলে কিছুতেই বোঝা যায় না, কোনটা সুখের আর কোনটা দুঃখের। মানুষ চেনার অব্যর্থ রাস্তা যে কয়েকটা আছে, সেগুলির মধ্যে দুইটা হচ্ছে: টাকা ধার দেওয়া, বিয়ে করা। টাকা ধার দেওয়ার আগ পর্যন্ত অনেক শয়তানকেই ফেরেশতা মনে হয়। যাকে বিয়ে করতে পারলেন না, তাকে দেখতে সবসময়ই দারুণ সুন্দর লাগে। অপরীক্ষিত মানুষ সম্পর্কে আমরা যা-কিছুই জানি, তার সবই অনুমাননির্ভর, অতএব তা ভ্রান্ত হবার সম্ভাবনা (আশঙ্কা) অনেক বেশি। এক ভুক্তভোগীই জানে কোন মধু মিষ্টি কেমন!! পাঁচ। আমি সাধারণত দুটো বিষয় নিয়ে কথা শুনতে ও বলতে প্রস্তুত থাকি না: আমার ব্যক্তিগত বিষয় আমার অফিসের বিষয় কেন? আপনার সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। আপনি আমার বন্ধুও নন, কলিগও নন, এমনকী পরিচিতও নন। আপনি আমার বাড়িতে কখনও আসেননি, আমি আপনার বাড়িতে কখনও যাইনি। এই দুইটি ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা বা আশঙ্কা নেই বললেই চলে। তাই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার একটুও আগ্রহ নেই এবং নিশ্চিতভাবেই কখনও থাকবেও না, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারেও আপনার আগ্রহের একটিও কারণ আমি দেখি না। স্বাভাবিকভাবেই আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আপনার মন্তব্য, প্রশ্ন, পরামর্শ আমাকে বিরক্ত ও বিব্রত করে। আপনি কে, আমি তো সেটাই জানি না, জানবার ন্যূনতম ইচ্ছেও তৈরি হয় না। আপনার অত কৌতূহল কীসের? যিনি আপনাকে চেনেন না, তাঁকে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা যায় না। মনে কৌতূহল এলেও সেটি গিলে খেয়ে ফেলতে হয়। এই সহজ জিনিসটা বুঝতে রকেট-সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। আমার পেশাগত জীবন বিবেচনায় আনলে আপনার সাথে আমার যোগাযোগই হওয়ার কথা নয়! আপনি কে? আমার সম্মানিত স্টেকহোল্ডার? আমার শ্রদ্ধেয় কলিগ? এঁদের কেউই তো আপনি নন! তবে আমাদের মধ্যে তো কোনও সম্পর্কই নেই! না, ভুল হলো, আছে। কোথায় আছে? ফেইসবুকে, ইউটিউবে। কীভাবে আছে? আমার লেখার পড়ে, বক্তৃতা শুনে, কাজ দেখে আপনি আমাকে চেনেন। এর বাইরে আর কোনও পরিচয় আমাদের মধ্যে নেই। বিসিএস, অফিস, সরকারি চাকরি ইত্যাদি নিয়ে আপনার অহেতুক, অযাচিত, অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য দেখলে খুবই বিরক্ত লাগে। যিনি আপনার অস্তিত্ব সম্পর্কেই জানেন না, তাঁকে এসব প্রশ্ন করা যায় কি? আমি কখনও এমন কিছু পোস্ট করি কি যা দেখে আমাকে ওরকম প্রশ্ন বা মন্তব্য করা চলে? আমি যা লিখি বা পোস্ট করি, কেবল তা নিয়েই কথা বলাটাই হলো সাধারণ ভদ্রতা। প্রেমের কবিতার নিচেও যদি বিসিএস, চাকরি, ক্যাডার, ইংরেজি-অঙ্ক-গাইডবই, অফিস ইত্যাদি শব্দ লিখে কমেন্ট করেন, তখন বিরক্তি আসেই! ওইসময়, আপনি কারও উপর বিরক্ত হলে যা করতেন, আমিও তা-ই করি। আমাদের এই জীবনে প্রয়োজনীয় মানুষ তেমন নেই বললেই চলে! মানুষের ভিড়ে একাকী একটা জীবন আমাদের! সবাইকে খুশি রাখতে চাওয়ার মানেই হলো, নিজের জীবনকে যন্ত্রণার মহাসমুদ্রে ডুবিয়ে রাখা। যে আমাকে বিরক্ত ও বিব্রত করে, সে খুশি হলেই আমার কী আর অখুশি হলেই-বা আমার কী! আমি তো আর ইলেকশনে দাঁড়াব না, তাই না? সুন্দরভাবে বাঁচতে সবাইকেই লাগে না। বেঁচে থাকবার মন্ত্র একটাই: The fewer people you add, the more pain you remove. ছয়। পাপ হবে, এই ভয়ে এই জীবনে যত পাপের সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছি দিনের পর দিন, দিনশেষে তত পুণ্য তো আমলনামায় জমা হলো না! জমা হয়নি, তা জানলাম কী করে? জমা হবেই যদি, তবে জীবনটা এমন কেন হলো? এখন ভাবি, হয়তো সেইসব ছিল কেবলই সাহস কিংবা সুযোগের অভাব, পাপের ভয় নয়। এমনও হতে পারে, সেই জীবনের পুণ্যজয়ের চাইতে এই জীবনের পুণ্যক্ষয়ের দৌড়টা হিসেবে দীর্ঘ। সাত। যার নিজের গুণ যত কম, সে তত বেশি অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায়। আমি এখন পর্যন্ত একজনও গুণী মানুষকে অন্যের খুঁত খুঁজে খুঁজে সময় কাটাতে দেখলাম না। ওদের অত সময় নেই, ওদের সমস্ত সময় কাটে নিজের গুণের চর্চা করে। আট। যে মানুষটি 'তুমি চা একদমই ভালো বানাতে পারো না!' বলেও সানন্দে সাগ্রহে সাদরে আপনার হাতের দুই-তিন কাপ চা ফুঁক ফুঁক করে গিলে খেয়ে নেয়, সে আপনাকে ভালোবাসি মুখে না বললেও আসলে ভালোবাসে। 'তোমার জন্য আমার গোটা জীবনটাই বরবাদ হয়ে গেল!' বলে বলে যে মানুষটি প্রতিদিন অভিযোগ ছুড়েও আপনাকে ছেড়ে যায় না, সে আপনাকে 'ভালোবাসি'টা মুখে না বললেও আসলে ভালোবাসে। তুমুল ঝগড়া শেষে তিন সহস্র পঁচিশতম ব্রেকআপের পরও যে মানুষটি ফোন করে আপনি ঠিকমতো বাসায় পৌঁছেছেন কি না নিশ্চিত হয়ে নেয়, সে আপনাকে ভালোবাসি মুখে না বললেও মন থেকে ভালোবাসে। আপনার জন্মদিন কিংবা অ্যানিভার্সারি ভুলে-যাওয়া বোকাসোকা ভুলোমনা মানুষটি মনে করে হঠাৎ হঠাৎ কাঁচুমাচু মুখে আপনার প্রিয় ফুচকা কিংবা চটপটির প্যাকেটটা, নিদেনপক্ষে একটা ক্যান্ডি হাতে ধরিয়ে দেয়, সে আপনাকে ভালোবাসি মুখে না জানালেও আদতে ভালোবাসে। আপনার ফিরতে রাত হলে যে মানুষটি অস্থির হয়ে ওঠে, মুখের দিকে চেয়েই যে আপনার মন খারাপের কারণ ঠিক বুঝে যায়, আপনার শব্দহীন হাসির নীরবতায় লুকিয়ে-থাকা বিষণ্ণতার সুতীব্র চিৎকারটি যে শুনতে পায়, সে আপনাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে। আমি তোমাকে ভালোবাসি!...এমন করে বলে ফেলতে পারা যে কী কঠিন, যে সত্যিই ভালোবাসে, একমাত্র সে-ই টের পায়! প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা বিষয়টিই আপেক্ষিক। একেকটা মানুষ একেক রকমে ভালোবাসে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্নভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করে, গ্রহণ করে। বুকের ভেতর একরাশ ঘৃণা বা নিঃস্পৃহতা জমিয়ে রেখেও 'ভালোবাসি' বলা যায়। আবার বুকভর্তি ভালোবাসা-প্রেম নিয়েও 'ঘৃণা করি' বলা যায়, কিছুই না বলে চুপ করেও থাকা যায়। এ এক আশ্চর্য রহস্য! এ এক অমীমাংসিত চক্র! শব্দে বা বর্ণে ভালোবাসা ব্যাপারটি কখনওই বোঝানো যায় না বলেই বোধ হয় প্রায়ই 'তোকে ছেড়ে গেলাম!'-বলা মানুষটি যে আদতে কোনও দিনই ছেড়ে যাবে না, এটা আমরা ঠিক বুঝে যাই। আবার 'তোকে কোনও দিনই ছেড়ে যাব না!'-বলা মানুষটি যে দুদিন পরেই ঠিক ছেড়ে যাবে, তা-ও আমরা অবচেতনে ঠিকই বুঝে যাই। মানুষ সবই বুঝতে পারে, তবু ভুল করেও বুঝতে চায় না। মানুষ সবই ভাবতে পারে, তবু ভাববার সাহসটুকু পায় না। ভাবনা: আটশো তেত্রিশ ……………………………………………………… এক। রবীন্দ্রনাথকে যিনি রবীন্দ্রনাথ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, তাঁর অনূদিত গ্রন্থ বিশেষ ভাবনার দাবি রাখে। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা (বড়ো ভাই) জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদে যে কয়েকটি মহামূল্যবান রত্ন আমরা পেয়েছি, সেগুলির মধ্যে মারাঠি ভাষায় রচিত বাল গঙ্গাধর তিলকের 'গীতারহস্য' অন্যতম। যাঁরা দর্শনের তন্নিষ্ঠ পাঠক, তাঁরা গীতার এই ভাষ্যটি হাতের কাছে রাখতে পারেন। গীতার দার্শনিক (ভক্তিরসসমৃদ্ধ নয়) ভাষ্য নিয়ে রচিত আমার সংগ্রহের অন্যান্য গ্রন্থ নিয়ে লিখবার ইচ্ছে রইল। আমি প্রথম যে বইটি পড়ে আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনের পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলাম, তা হচ্ছে শ্রীঅরবিন্দের 'দিব্য-জীবন'। মূল বইটি ইংরেজিতে লেখা, দ্য লাইফ ডিভাইন। আমার এক মেসোমশাই আমাকে বইটি উপহার দিয়েছিলেন। অত উঁচুমানের ইংরেজিতে লেখা বই ইন্টারে পড়ুয়া আমার পক্ষে পড়াটা খুব কঠিন ছিল। পরে আমি অনুবাদ সংগ্রহ করে বইটি পড়ি। সত্যি বলতে কী, অনুবাদটিও পড়া ও বোঝা খুব শক্ত কাজ। বাঙালির ইতিহাসে ঋষি শ্রীঅরবিন্দের সমতুল্য পণ্ডিত কমই আছেন। মন চাইলে ইন্টারনেটে তাঁকে নিয়ে পড়তে পারেন, পড়বার উপহার হিসেবে বিস্ময় ও আনন্দ পাবেন। তাঁর পন্ডিচেরী আশ্রম থেকে প্রকাশিত প্রায় সব বই-ই আমার সংগ্রহে আছে। সেগুলি নিয়ে সময় করে কখনও লিখব। আমার পছন্দের আরও দুইটি সারস্বত গ্রন্থের নাম এইসাথে জানাতে ইচ্ছে করছে: পরমহংস যোগানন্দের যোগী কথামৃত, মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত। দু-শো সাতাশ জন গীতিকারের (সংক্ষিপ্ত পরিচিতি-সমেত) লেখা, পাঁচ হাজার ছ-শো তেষট্টিটি গানের সংগ্রহ "বাঙালীর গান" (১৯০৫) গ্রন্থের জন্য বিখ্যাত সুপণ্ডিত দুর্গাদাস লাহিড়ীর কাছে বাঙালি আরেকটি কারণে ঋণী। তিনি আজ থেকে প্রায় এক-শো বছর আগে উনচল্লিশ খণ্ডে চতুর্বেদের মূলভাষ্য, অনুবাদ ও ব্যাখ্যা (১৬ খণ্ডে ঋগ্বেদ, ২ খণ্ডে শুক্ল যজুর্বেদ, ৭ খণ্ডে কৃষ্ণ যজুর্বেদ, ৯ খণ্ডে সামবেদ এবং ৫ খণ্ডে সমগ্র বেদের নির্যাস জ্ঞানবাদ) লিখেছিলেন। সেই অক্ষয় কীর্তি আজ দুষ্প্রাপ্য, ভারতের কিছু প্রাচীন লাইব্রেরিতে বিক্ষিপ্তভাবে তা পাওয়া যায়। তাঁর এই অমূল্য কাজটি সংক্ষিপ্ত আকারে অক্ষয় লাইব্রেরী প্রকাশ করেছে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তাঁর ছোটোগল্প ও গান। বিশেষত, আমাদের মনের উপর তাঁর গানের যে অসীম ক্ষমতা, তা সর্বজনবিদিত। মিউজিক থেরাপিতে রবীন্দ্রসংগীতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কোন গানটি তিনি কোন প্রেক্ষাপটে কী ভাবনা মাথায় রেখে লিখেছিলেন, বিভিন্ন গানের সুর ও স্বরলিপির নির্মাণ কীভাবে হলো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষকদের আগ্রহের শেষ নেই। প্রবীর গুহ ঠাকুরতার 'রবীন্দ্রসঙ্গীত মহাকোষ' রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কালানুক্রমিকভাবে বিশদে জানবার ও বুঝবার এক আকরগ্রন্থ। আমার লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে যা গবেষণাধর্মী বই আছে, সেগুলির মধ্যে কলেবরে এটিই সবচেয়ে বড়ো। দুই। মানুষ কী অদ্ভুত! সে ভাবে, সে কাঁদছে ভালোবাসার জন্য, অথচ সে আসলে কাঁদছে মায়ার জন্য। হ্যাঁ, কখনও কখনও মানুষ ভালোবাসায় নয়, প্রেমেও নয়, বরং মায়ায় পড়ে কাঁদে। যে মানুষটি জীবনের সবচাইতে বড়ো ক্ষতটি হৃদয়ে গভীরভাবে লেপটে দিয়ে চলে গেল, সে মানুষটির কথা মনে পড়লে কখনওবা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, দুচোখ ফেটে জল আসে। ভরদুপুরে তার কথা মনে পড়লে বুকের মধ্য থেকে হু হু করে মোচড় দিয়ে কান্না আসে। কোথায় যেন পুড়ে ছারখার হয়ে যায়, আর হতেই থাকে। মস্তিষ্ক প্রশ্ন করে, মানুষটি এখন আমার কে হয়? মন উত্তর দেয়, মানুষটি এখনও আমার জীবন হয়! চলে-যাওয়া মানুষটি আঘাত দিয়েছে, এই ভাবনাটি যতটা কষ্ট দেয়, তার চেয়ে শতগুণে বেশি কষ্ট দেয়, এই মানুষটিই একসময় আমার সামান্য ব্যথাতেও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠত, এই অবিনশ্বর স্মৃতিটি। এই মানুষটিই একটা সময় বড্ড আদুরে গলায় গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত। যে মানুষটি মুখের উপর ফোনকলটা কেটে দিয়ে তৃতীয় কোনও নতুন কণ্ঠে হৃদয় ভেজাচ্ছে, সে মানুষটিই এককালে আমার কণ্ঠ না শুনে কিছুতেই ঘুমাতে পারত না। সময় কত কিছুই বদলে দেয়! আমরা মানুষটির জন্য নয়, বরং মানুষটির সাথে জড়িয়ে-থাকা স্মৃতিগুলির মায়ায় আটকে থাকি বলেই যন্ত্রণায় এমন করে সারাক্ষণ কাতরাই। হৃদয়টা শুধুই পোড়ে আর পুড়তেই থাকে। কোথাও থেকে তার প্রিয় গানটি ভেসে এলে মন কেঁদে ওঠে, যে গানটি একসময় তার অপূর্ব বেসুরো গলায় শোনার জন্য আমি প্রতীক্ষায় থাকতাম। তার প্রিয় রং, পছন্দের কবিতা, কিংবা তার প্রিয় কোনও টঙের দোকান দেখেও ভীষণ মনকেমন করে। সেইসব মনকেমনের মুহূর্তে ঠোঁট কামড়ে জেগে ওঠে চাপাকান্না, কখনও চোখের তারায় নাচে মৃদুহাসি। একসময় আমরা মানুষকে নয়, স্মৃতিকে ঘৃণা করতে শিখে যাই। হ্যাঁ, একটা-না-একটা সময় তার সাথে বসে-থাকা সেই টঙের দোকান, তার হাত ধরে হেঁটে-যাওয়া সেই রাস্তা, এমনকি তার সাথে ঘোরা সেই হুডতোলা রিকশাটাকেও আমরা ঘৃণা করতে শিখে যাই। ছেড়ে-যাওয়া মানুষটিকে নয়, বরং ফেলে-আসা সময়টাকেই বড্ড প্রতারক মনে হয়। তবু সেইসময়ের ভালোবাসার মানুষটির জন্য আমৃত্যুই মনের কোথায় যেন নাম-না-জানা কিছু একটা থেকে যায়। সেই কিছু একটা আমাদের প্রতিনিয়তই বাঁধতে থাকে---ভালোবাসায়, ক্ষমায়, প্রার্থনায়। ভালোবাসা একসময় মরে যায়, থেকে যায় কেবলই একধরনের অভ্যস্ততা। সেই স্মৃতিমথিত অভ্যস্ততা আমাদের কলজের প্রতিটি ইঞ্চি চিবিয়ে খায়, গিলে খায়। সেখান থেকে পালাতে চাইলে মনে হয়, আমার মধ্য থেকেই আমি পালাই কী করে! শরীরে অসুখ হলে চিকিৎসায় বাঁচা যায়, কিন্তু অন্তর পুড়ে গেলে বাঁচার আর কোনও পথই খোলা থাকে না। আমাদের শরীরে, মনে এই স্মৃতিই জমতে থাকে উইয়ের ঢিবির মতো। সে উইপোকা আমাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খায়, শরীরের মৃত্যুর বহু আগেই মনের মৃত্যু ঘটে যায়। আমরা এই মৃত মনটা নিয়ে জীবনকে টেনে হিঁচড়ে বাঁচিয়ে রাখি। মনে রাখতে পারা, এই গুণটি স্কুলের পরীক্ষার জন্য যতটা সমাদৃত, জীবনের পরীক্ষার জন্য ততোধিক আত্মঘাতী। স্মৃতির কোনও ইরেজার হয় না। যদি হতো, তবে দেখা যেত, এই পৃথিবীতে এমন অসংখ্য মানুষ স্বস্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারত, যারা নিজের হাতেই খুন হয়েছে এই স্মৃতির দহন থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে। মানুষটি এখন অন্য কারও হয়ে গেছে, এই সত্যটা একসময় গা-সওয়া হয়ে যায়। সওয়া যায় না কেবল সেই স্মৃতিটাই যে---এই মানুষটি, হ্যাঁ, এই মানুষটিই একদিন আমার ছিল...আগাগোড়া শুধু আমারই ছিল! এই পৃথিবীতে আসলে কেউ কারও হয় না। এই বোধটা যখন আসে, তখন সত্যিই অনেক দেরি হয়ে যায়। কারও লাশও আমাদের ততটা কষ্ট দেয় না, যতটা কষ্ট দেয় তার সাথে কাটানো প্রিয় হন্তারক স্মৃতিগুলি। এইজন্যই বোধ হয় ছেড়ে-যাওয়া মানুষটি ফিরে এলেও বার বারই শূন্যহাতে ফিরিয়ে দিই, যদিও এর পরমুহূর্তেই দেখি, কার জন্য জানি ঘড়ির কাঁটাটি থেমে থাকতে চায়, জ্যোৎস্না দেখলে চোখ ভিজে ওঠে, বৃষ্টি ছুঁলে ঠোঁট কাঁপতে থাকে...হায়, কার জন্য যেন প্রতিদিনই একবার করে মরে যাই! মানুষটাকে নিতে পারি না, অথচ মানুষটারই স্মৃতিটাকে ছাড়তে পারি না---এর নামই বেঁচে-থাকা।