প্রাণ যখন জীবন হয়ে ওঠে/ ষষ্ঠ অংশ


২৫১। মহিলারা তাঁদের কূটনৈতিক গুণগুলো বরং রাষ্ট্রীয় কাজে লাগানোর সুযোগ পেলে আমরা আরও কিছুদূর এগিয়ে যেতাম।
২৫৩। নিরহংকার মানুষগুলো যেদিক দিয়ে হেঁটে যায়, তারা যেতে যেতেই সেদিকে অদ্ভুত এক আলো ছড়ায়। অনেকসময় এসব মানুষের মুখে কিছু বলারও প্রয়োজন পড়ে না।
২৫৪। রক্তাক্ত স্মৃতির আধিক্য কখনও কখনও মানুষের অনুভূতিগুলো ভোঁতা করে দেয়। তখন মানুষ চাইলেও অথবা হাজারটা কারণ থাকলেও হাসতে আর পারে না, এমনকী তীব্র কষ্টেও কান্না ভুলে যায়।
২৫৫। অর্থের দাপটে-চলা মানুষগুলোর কাছে থেকে এক ঔদ্ধত্য ছাড়া আর অন্য কিছুই শেখার নেই।
২৫৬। সময় মানুষের ভালো ও মন্দ, উভয় কাজেরই যথাযথ ফল দিয়েই ছাড়ে!
২৫৭। আমরা যখন থেকে বিশ্বাস করতে শুরু করি, জীবনে যা যা পাইনি, সেগুলি পাইনি বলেই জীবনটা এমন সুন্দর, তখন থেকেই আমরা একটা চমৎকার জীবন নিয়ে বাঁচতে শুরু করি।
২৫৮। যারা জানে, তাদের আসলে হারানোর কিছুই নেই, কেননা সব কিছুই তো একদিন ছেড়ে দিয়ে যেতে হবে, তারাই সবসময় নিঃশঙ্ক হয়ে একেবারে সাধারণ একটা জীবনযাপন করে যেতে পারে। নিঃশঙ্ক চিত্তের চাইতে বড়ো বিত্ত আর কী আছে!
২৫৯। যে সম্পর্কগুলোতে পারস্পরিক আস্থা হারিয়ে যায়, সেগুলো আর কিছু দিয়েই বেঁধে রাখা যায় না।
২৬০। কিছু কিছু জায়গায় কেবল শব্দচয়নের উপর ভর করেই অনেক বড়ো ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা যায়।
২৬১। ইদানীং সমস্যাগুলো এমনই, যেগুলো কখনও চলে যায় না, কিন্তু ক্রমেই হালকা ও গা-সওয়া হতে থাকে।
২৬২। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষ বিভিন্নভাবে রিঅ্যাক্ট করে, কিন্তু সাধারণত দুই সময়ে মানুষ আসলে সেগুলোই করে, যা সে সবসময় তার ভেতরে লালন করে: যখন সে রেগে যায়, যখন সে মদ খায়।
২৬৩। মানুষের নিজের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলেই কেবল, সে যা সিদ্ধান্ত নেয়, তা-ই করে ফেলে। এর আগ পর্যন্ত মানুষ যা-কিছু করে, তার বেশিরভাগই করে অন্যের সিদ্ধান্তে।
২৬৪। আমরা অনেক বেশি কিছু সম্পর্কে জানি, কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন অনেক কিছু নিয়েই জানি না, যা নিয়ে আমাদের জানা দরকার, কিংবা যতটুকুও জানি, তা-ই কাজে লাগাতে জানি না। যে জানাটা কাজেই লাগে না, সে জানা দিয়ে কী হয়!
২৬৫। ভয় একপ্রকার অসুখ। যার ভয়ের পরিমাণ যত বেশি, তার অসুখের পরিমাণও তত বেশি।
২৬৬। ম্যাচিউরিটি বয়সের সাথে বাড়ে না, ম্যাচিউরিটি বাড়ে, জীবনে ঠিক কতটুক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তার সংখ্যা ও মাত্রার উপর ভিত্তি করে।
২৬৭। গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারাটাই আর্টের প্রাণ। একটা মিথ্যাকে সত্যের মতো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরতে আরও অনেকগুলো গ্রহণযোগ্য মিথ্যা বানাতে হয়। যে যত নিখুঁত মিথ্যা বানাতে পারে, সে তত বড়ো আর্টিস্ট, কারণ মিথ্যা বলতেই সবচেয়ে বেশি মেধা ও বুদ্ধি খরচ করতে হয়; কিন্তু সত্যের জন্য কখনওই বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। মিথ্যাকে যে সত্যের মতন করে তুলে ধরতে জানে না, তার পক্ষে ভালো আর্টিস্ট হওয়া সম্ভব নয়।
২৬৮। বয়সের ভারে মানুষ যতটা বার্ধক্যে ভোগে, তার দ্বিগুণ বার্ধক্যে ভোগে মানসিক অসাড়তায়।
২৬৯। ‘ভাল্লাগে না!’, কারও কারও ক্ষেত্রে এটা মানসিক রোগ হলেও, অনেকের ক্ষেত্রে এটার মানে হলো, তাদের জীবনে এখনও এমন কেউ আসেনি, যে তাদের প্রতিটি মুহূর্তকে ‘ভাল্লাগছে!’-তে রূপান্তরিত করতে পারে। আমরা অহরহই আশেপাশে এমন লোকজন নিয়ে জীবনটা পার করছি, যাদের প্রায় প্রত্যেকেই খুব বিষণ্ণ ও বিরক্তিকর।
২৭০। দু-জন মানুষ একটা সম্পর্কে জড়িত থাকার পরেও যদি ওদের কারও একা একা লাগে, তাহলে ধরে নিতে হবে, ওরা দু-জন দু-জনের জন্য সঠিক মানুষ নয়।
২৭১। মানুষ সবচেয়ে বেশি একাকিত্ব ও ভালোবাসাহীনতায় ভোগে বৃদ্ধকালে। বৃদ্ধকালেই প্রেম, ভালোবাসা ও সঙ্গের দরকার পড়ে সবচাইতে বেশি। অথচ সমাজের কী অদ্ভুত রীতি, এই বয়সেই মানুষকে একা করে দেওয়া হয়, প্রেম করাকে ভীমরতি হিসেবে ধরা হয়। আমার সাধ্যে থাকলে বৃদ্ধকালে প্রেম করাটাকে উন্মুক্ত করে দিতাম এবং সে প্রেমকে বাধা দেওয়াটাকে দণ্ডনীয় শাস্তি হিসেবে ঘোষণা করতাম।
২৭২। বৃদ্ধকালে প্রেমের রীতি বা নিয়ম থাকলে জগতের কোনও মানুষই বৃদ্ধ হওয়াকে ভয় পেত না, বরং সাদরে গ্রহণ করত। যে জীবনে প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, সে জীবন খুব সুখের কোনও জীবন নয়।
২৭৩। একজন মানুষের সঙ্গে আপনি অনেকগুলো বছর একসঙ্গে থেকে গেছেন, এর মানেই যে আপনাদের দু-জনের ভালোবাসার ভিত মজবুত, তা না-ও হতে পারে। এমনও হতে পারে, আপনাদের দু-জনের মধ্যে সামাজিক, আর্থিক, শারীরিক বিভিন্ন দায়বদ্ধতা ও যোগসূত্র জড়িয়ে গেছে, যা চট করে ভেঙে ফেলা সহজ নয় বলেই আপনাদের এরকম থেকে-যাওয়া।
২৭৪। বেশিরভাগ প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে অপর পক্ষের ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে। ‘সে আমাকে অনেক ভালোবাসে।’ এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে হাজারো একপাক্ষিক প্রেম।
২৭৫। প্রতিদিনই কাছে পেলে ঐশ্বরিয়াকেও কাজের বুয়ার মতো সাধারণ মনে হয়, আর কষ্ট করে কারও সান্নিধ্য লাভ করলে, সে কাজের বুয়া হলেও তাকে ঐশ্বরিয়ার মতো আকর্ষণীয় মনে হবে।
২৭৬। যার পাপবোধ আছে, সে ধার্মিক। যার অপরাধবোধ আছে, সে মানুষ। দুনিয়াভর্তি অহরহ ধার্মিক আছে, তবে মানুষের সংখ্যা খুব নগণ্য। পৃথিবীর অনেক পাপই অপরাধের মধ্যে পড়ে না, এবং অনেক অপরাধই পাপের মধ্যে পড়ে না। তাই শুধুই ধার্মিক হবার চাইতে ধার্মিক মানুষ হওয়া বেশি জরুরি।
২৭৭। যে ব্যক্তি যুদ্ধ করেন, তিনি একপক্ষের কাছে গাজি, প্রতিপক্ষের কাছে যুদ্ধাপরাধী। যদি তিনি যুদ্ধে মারা যান, তবে তিনি একপক্ষের কাছে শহিদ হলেও প্রতিপক্ষের কাছে কেবলই একটা লাশ। স্থান ও পরিস্থিতিভেদে একই ব্যক্তির মর্যাদা ও গুরুত্ব ভিন্ন ভিন্ন।
২৭৮। অর্থহীন শব্দব্যয়ের চেয়ে বরং অর্থপূর্ণ নীরবতাযাপন অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত।
২৭৯। আমাকে আমার মতো করে নিতে পারে না যে, তার ভালোবাসার কোনও মূল্যই আমার কাছে নেই।
২৮০। যে-কোনও সম্পর্কই তৈরির চেয়ে ভাঙাটাই কঠিন। ভাঙতে গেলেই পৃথিবীর সমস্ত মায়া এসে বাধার সৃষ্টি করে। কখনও কখনও ভালোথাকার ইচ্ছেশক্তির চেয়ে মায়ার শক্তি অনেক বড়ো হয়ে দাঁড়ায়, তখনই ঘটে যত বিপত্তি! মানুষ মায়ায় পড়ে প্রতিমুহূর্তেই মরে।
২৮১। পৃথিবীর কোনও আইন, ধর্ম, নিয়ম বা শক্তি দিয়েই মনকে বাঁধা যায় না। বাঁধা যেত যদি, তবে পৃথিবীতে একটাও অসফল মানুষ থাকত না, প্রতিটি মানুষই একেকটি রুটিনমানা রোবট হয়ে যেত!
২৮২। যার কাছে অন্যের গোপনীয়তা রক্ষার দায়িত্ববোধ থাকে না, তার কাছে দামি হিরে-রত্ন রক্ষারও কোনও গুরুত্ব থাকে না। সে একজন ব্যক্তিত্বহীন মানুষ।
২৮৩। যা যা দিয়ে মানুষ অধর্ম করে, সেগুলির মধ্যে ধর্মই সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার। এ দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো বড়ো অধর্মগুলো ধর্মের নামেই ঘটে থাকে। নইলে পৃথিবীতে এত খুনোখুনি থাকত না।
২৮৪। পৃথিবীতে জীবিত-থাকা বেশিরভাগ মানুষই আসলে বেঁচেই নেই! পৃথিবীর মরে-যাওয়া অনেক মানুষই আসলে বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছেন! কেউ বেঁচে থেকে মরে যায়, কেউবা মরে গিয়ে বেঁচে যায়।
২৮৫। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলেই মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে এত কৌতূহলী, নিশ্চিত হয়ে গেলে জীবনটা একদমই স্কুলের রুটিনের মতো বিরক্তিকর হয়ে যেত।
২৮৬। সবাই তার নিজের জায়গায় ঠিক। তাই ঝগড়া, তর্ক না করে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। কাউকে অপরিহার্য ভাবার কিছু নেই। সে আসার আগেও আপনার জীবন কেটেছে, সে না থাকলেও আপনার জীবন ঠিকই কাটবে। সে চলে গেলে খারাপ কাটবে কি ভালো কাটবে, এটা সময়ই বলে দেবে।
২৮৭। আপনি যে যুদ্ধের সৈনিকই কখনও হননি, সে যুদ্ধ নিয়ে না বুঝে সেনাপতির ভঙ্গিতে বাণী ফলাবেন না। যার হারায়, সে-ই বোঝে হারাতে যে কী জ্বালা! বেশিরভাগ লোকই, কোনও একটা বিপদে নিজে না পড়লে, না বুঝেই অন্যকে সে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়।
২৮৮। যদি আপনি কাউকে একইসঙ্গে ভালোবাসেন এবং তার শান্তি নষ্ট করেন, তবে সে একসময়, আপনার ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করলেও, আপনাকে ঘৃণা করতে শুরু করে দেবে। বেশিরভাগ মানুষই এই কারণে ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলে। প্রেমিকার অমন ভালোবাসার চাইতে পতিতার শান্তিও অনেক ভালো।
২৮৯। অন্যান্য গুণ কম থাকার সত্যটাকে অনেকেই সতীত্বের অহংকারে ঢেকে ফেলতে যায়। বোধবুদ্ধি কম থাকার সত্যটাকে অনেকেই সার্টিফিকেটের অহংকারে ঢেকে ফেলতে চায়। আপনার সতীত্ব ও আপনার সার্টিফিকেট নিয়ে যাদের কোনও আগ্রহ, মাথাব্যথা বা লাভ নেই, তাদের সঙ্গে কথা বলার সময়, দুটোকেই পকেটে বা ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখবেন। যার কাছে যে জিনিসের আলাদা কোনও দাম নেই, তার কাছে সে জিনিস দেখিয়ে আলাদা কোনও দাম পাবেন না।
২৯০। যে আপনাকে ভালোবাসে না, আপনি যদি তাকে ভালোও বাসেন, তবুও তার কাছে আপনার রাগ দেখিয়ে কী লাভ? যে যাকে ভালোবাসে না, সে তার রাগ দেখলে বরং বিরক্তই হয়।
২৯১। ক্ষুধার্ত পেটে সব ডাল-ভাতেরই স্বাদ একই, ক্ষুধার্ত পেট কখনও জিজ্ঞেস করে না, এই ডাল-ভাত কোত্থেকে এল? যে পেট ক্ষুধার্ত নয়, সে পেটই ডাল-ভাতের উৎস নিয়ে ঘাঁটে বেশি।
২৯২। যে পেটে যত বেশি টাকা রয়, সে পেটে তত কম ভাত সয়।
২৯৩। যে পথে চলতে গেলে বার বার বাধা আসে, কেবল সে পথে চললেই যে গন্তব্যে পৌঁছা যাবে, এমন কিছুতেই নয়। সহজ পথ মানেই কিন্তু ভুল পথ নয়। মানুষ অনেকসময় সেই পথকেই সহজ ভেবে নেয়, যে পথে চলতে তার ভালো লাগে। কার জন্য যে কোন পথ, তা পথে না নামলে ঠিক বোঝা যায় না।
২৯৪। মন যা ছেড়ে দিতে বলে, তা মস্তিষ্ক ধরে রাখতে যতই বলুক না কেন, তা ছেড়ে দিলেই শেষপর্যন্ত কল্যাণ হয়।
২৯৫। মানুষ নিজে যা করতে পারেনি বা চায়নি, তা অন্য কেউ করতে পারলে যদি তার মেজাজ খারাপ হয়, তাহলে তখন ধরে নিতে হবে যে ওই কাজটি করার মতো যোগ্যতাই তার নেই।
২৯৬। মূর্খরা কোনও একটা বিষয় নিয়ে নিশ্চিতভাবে না জেনেও তা নিয়ে এমনভাবে কথা বলে যেন তারা নিজের চোখেই তা ঘটতে দেখেছে!
২৯৭। যে আপনার একই ভুলের জন্য বার বার শাস্তি দেয়, কিংবা একই ভুলের কথা আপনাকে বার বার মনে করিয়ে দিয়ে কোনও সুবিধা নিতে চায়, তার সঙ্গ খুবই যন্ত্রণাদায়ক।
২৯৮। গোলাপের কাঁটা যাকে কখনও রক্তাক্ত করেছে, সে বলে, ‘কাঁটাতে গোলাপ থাকে।’; আর যাকে রক্তাক্ত করেনি, সে বলে, ‘গোলাপে কাঁটা থাকে।’ সাপের কামড় যে খায়নি, সে বলে, ‘সাপ দেখতে দড়ির মতন।’; আর যে খেয়েছে, সে বলে, ‘দড়ি দেখতে সাপের মতন।’ একেক মানুষ, একেক অভিজ্ঞতা, একেক মত।
২৯৯। যে মা তার সন্তানকে বাবা সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে, সে নিশ্চয়ই ছোটোবেলা থেকে মায়ের মুখে বাবার নিন্দা শুনে শুনে বড়ো হয়েছে!
৩০০। নিজে ভোগ করতে পারলে অনেক মুখই বন্ধ হয়ে যেত!