পঁয়ত্রিশ দিন পরে

 
আমার দুঃখ নিয়ে আপনাকে ভাবতে বসতে হবে না।
গায়ের রং সাদা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে আমি জন্মাইনি,
চাইলে আপনি আপনার চুম্বন ফিরিয়ে নিতে পারেন।
কোনও পরিকল্পনা এবং চিন্তাভাবনা ছাড়াই অনেকদূর যেতে হবে।
বেশি ভাবলে পায়ে বেশি শেকল পড়ে।
যারা ভাবে বেশি, তারা যায় কম; যারা যায় বেশি, তারা ভাবে কম।


সূর্য ধীরেধীরে আমার জামায় উষ্ণ হচ্ছে, বাতাস আমার কানে কাঁপছে
এবং মনে করিয়ে দিচ্ছে যে আমি এখনো দিব্যি বেঁচে আছি।
রাস্তার ধারে গাছগুলি সামনের দিকে ঝুঁকে আছে,
পাথরগুলি আমাদের পা ছুঁয়ে সালাম করছে। এইসবই বেঁচেথাকার লক্ষণ।


আমি হাতড়েহাতড়ে আমার পুরানো যন্ত্রটি খুঁজছি,
যা ভেঙে গেছে আর হারিয়ে গেছে অমূল্য ছিলে বলেই।
ওই ভাঙা যন্ত্রটি আমাকে ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দেয়
এবং যখন তা হয়, তখন আমি লিখি।
এমন অনুভূতি সান্ধ্য হাওয়ার মতো মোলায়েম, তারার মতো দূরবর্তী।


গোধূলি আলো আসছে, ঘুরছে, ডাকছে।
ঘূর্ণায়মান ফ্রেম ক্যাপচার করে চলছে……এমন সময়
এক বন্ধুর সাথে দেখা হল, যার সাথে একসাথে
হাজার রাত দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্ন দেখার
রাতের বন্ধুই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে।
নানান অদ্ভুত মুখ দুঃস্বপ্নে আসতো,
আমি আমার মৃতদেহটিকে তাদের নিপুণ হাতে
এক বাদামী ট্রলিতে শ্মশানে যেতে দেখেছি বহুবার।
সে সময় কেউ কাঁদত না, ব্যস্ততা কাঁদতে দেয় না।
এই বন্ধুটি বেকার হয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য।


আমি নদী থেকে সমস্ত মাছ ধরলাম। ফুলের মালা ও
মাছের কাবাব সাজিয়ে রাজকন্যার জন্য প্রতীক্ষায় বসলাম।
দেখলাম, উৎসব এসে গেছে। ঈশ্বর তখন বেড়াতে যাচ্ছিলেন।
সব জায়গায় তীর্থযাত্রীদের ঢল নামতে দেখেছি। শুনতে পেলাম,
হাজার রাত পেরিয়ে ওরা আজকের দিনটার দেখা পেয়েছে, এর
আগে চাবুকের আঘাত সহ্য করতে শিখে নিয়েছে খুব যত্ন করে।
এইতো গতকালকেই সেই কন্যা বাড়ি এলো। প্রেম নয়, ভোগান্তিই!
জীবন ধীরপায়ে আমাকে শান্ত রাতের শক্ত তাঁবুতে আটকে ফেলছে।


মার্বেল ও রত্নপাথর দিয়ে আমাকে একটা ভাস্কর্য তৈরি করতে হয়েছিল।
কলমটা ডুবাতে হয়েছিল, আমার দুরন্ত হৃদয় এক মুহূর্তের জন্যও থেমে যাবে না,
এমন প্রত্যয়ে। আমার কপালে যেসকল চটকদার ভাগ্যলিখন ছিল বলে জেনেছি,
সেসকল কিছুর তোয়াক্কা না করে জীবনের বাহ্যরেখায় নিজের সামর্থ্যকে কিছুটা
ঝালিয়ে নিলাম। মৃদু হাসি এবং বন্ধ ঠোঁট সম্বল করে দুর্দান্ত কিছু গোপনীয় শব্দ
প্রচার করে দিতে হবে। বালিকার অস্থির স্তনযুগলের শক্তিশালী উষ্ণ তরঙ্গটি এক
ভূতুড়ে, শীতল স্ফটিকে লুপ্ত হয়ে আছে, সে অচল সময়ে আমাদের প্রত্যেকের জন্যই
বন্ধুত্বপূর্ণ, এমন আলাপের রৌদ্রে এত বেশি বৃষ্টি হয়েছিল---কেউই নিজের প্রতিমাটি
গড়তে পারেনি, এর আগেই পাথরের হাতুড়ি বেজে ওঠে এবং সবাইকেই এক ধাক্কায়,
এক ঝাপটায় সূক্ষ্ম ময়দার মতো গুঁড়ো করে হাওয়ায় ছড়িয়ে দেয়। পাথরের কাঁপুনিতে
ভাস্কর্যের মার্বেল সংকুচিত হয়ে ভেঙে যাওয়ার আগে বলে যায়,
আরও সাতবার আমি লড়াই করবো!


……এবং, তারপরে দেখুন, সেই ধ্বংসস্তূপে একটি প্রখর রশ্মি জ্বলজ্বল করছে,
এবং একশো খোদাইকরা, বহুমুখী এবং অবরুদ্ধ মার্বেলের শীর্ষে আমার আত্মা
বাঁচতে শুরু করে দেয়, তখন সেটি মামুলি পাথর ভেবে ফেলে দেওয়া যায় না।
তার সৌন্দর্যে আকাশস্থিত স্বর্গের প্রবাহ যেন, এই ঘরের মধ্যে কাঁপছে, মুক্ত ফুলের
ঘ্রাণ ছড়িয়ে হৃদয়ের গভীর অনুরণকের উপর স্থির হয়ে নীরব শব্দের স্পন্দন শুনতে
প্রতীক্ষা করছে, এবং চিরন্তন কণ্ঠের মতো, গল্পগুলির উপসংহার কিংবা নিখুঁত
কোনো রত্নের মতো, মামুলি সে মার্বেলেরই মাঝখানে সুপ্ত আগুনের নীল, বেগুনি এবং
লাল-রঙের শিখার জাঁকজমকের সামনে গুনেগুনে এক হাজার মোমবাতি নিভৃতে জ্বলছে।


প্রিয় পাঠক, সুন্দর কথা বলার জন্য নাকি অনিবার্যভাবেই মহড়ায় অনেক কাঁদতে হয়,
আমি কাঁদতে ভুলে গেছি বলে আমাকে ক্ষমা করুন। উদ্ভট ট্র্যাজেডির জন্য তৈরি
মনোরম দৃশ্যাবলী কিংবা অনন্তকালের এক অনন্তকালীন বৃষ্টিপাত পেছনে ফেলে রেখে
আপনি আমাদের ছোট দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে এসেছেন, পঁয়ত্রিশ দিন কাটল।
মাথা উঁচু করে হাঁটতেহাঁটতে অবাক হয়েযাওয়া, ক্লান্তপ্রাণ এক অন্ধ ভিক্ষুকের মতো কাঁপছি,
যার লাঠিটি অজানা পথে গর্তে পড়েই যাত্রাটি শেষ হয়।……আমি আপনার অ্যাপার্টমেন্টে অযথাই
দিনে চারবার যেতে পারব না, আপনার ডেস্কে নিয়ম করে দুইবেলা কুর্নিশ করাও সম্ভব হয়।
আমি হেরে বাঁচার জন্যই জন্মেছি বোধহয়। এমন মানুষকে আজকাল কেউ আর মানুষ বলে না।