আমি হাঁটতে শুরু করেছিলাম---সবাই যেমনটা করে আর কি! সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে হাঁটুতে ভর করে চলে গেছি ওই সামনের দিকে... মাটির ঘ্রাণ নিয়েছি, শান্ত হাওয়ায় জড়িয়েছি এ দুটি চোখ, বৃষ্টি ঝরেছে, ভেজা বাতাসে নিয়েছি শিহরন এই সারামুখে! কত কত বাহু আমায় রেখেছে আগলে ভীষণ, আর কত জোড়া চোখ পাহারায় ছিল আমায় ঘিরে--- তা গুনেও আমি আজ বলতে পারি না। কত ঝড়ে কত পাহাড় ভেঙেছে...তবুও আমার হয়নি কিছুই! আমার ভেতরে ঘর বাঁধে যেন অমৃত-আত্মা, আমি রাতের আকাশ দেখি, নৈঃশব্দ্যের কোমল চাদরে আরামে ঘুমোই, দিনের রোদ্দুর আদর করে আমায় জাগায়, আর বলে, সুপ্রভাত! ভালো আছ তো? কত ভালোবাসায়, আহা, কত আদরে ঝলমলে সব দিন কেটে যায়! বৃষ্টির ঘ্রাণ মিষ্টি দারুণ! কী মাদকতা! কী আকুলতা! বর্ষার জল পায়ের পাতায় নরম ঠোঁটে চুমু খেয়ে যায়, পেঁজাতুলোর মতন মেঘের শরীর, সেই মেঘের দেশে সূর্য ওঠে, মেঘভেজা রোদে চোখটা ভেজে, রাত ভেঙে যায়...কত রঙ-বেরঙের কলিরা ফোটে! হঠাৎ দেখি, পৃথিবী কেমন বদলেই গেল! সেই বাহুগুলি, সে চোখগুলি কোথায় যেন হারিয়েই গেল! পৃথিবীর তৃষা আচমকাতেই বেড়ে গেল খুব...হারিয়ে দিশা! মনে হলো, আজ বদলে যাওয়ার সময় এসেছে! বলল সবাই, বড়ো হয়ে গেছ! নিজের ভালোটা এবার নিজেই করো! আমি বললাম, উড়ে যাব আমি ওই দূরেতে, শুধু এক জোড়া ডানা প্রয়োজন! বদলে যাও, বদলে যাও! এই এখুনিই! আগের তুমি নেইকো তুমি! আমি যেন এক ফ্রেমের ভেতরে আটকে গেছি সময়-দেয়ালে! বৃষ্টি হঠাৎ নোনতা হলো, অতীত হলো ভিন্ন, পুরনো হাওয়া ধারালো হলো, গল্প হলো তীক্ষ্ণ! বর্ষার জল আগুন হয়ে ছুটল দারুণ, পোড়াল দু-পা, মেঘের রোদ নামাল আঁধার, ঘামের স্রোত---শিউরে এ গা! ওই বাহুর সাগর, চোখের সাগর লাগবে না আর--- একা একাই হাঁটব, দেখো! দিকের হিসেব বুঝে রুখব একাই যন্ত্রণা সবই! নিজের পথটা চিনব নিজেই, নিজের ছকটা বাঁধব নিজেই, ওই দূরে যাব নিজের বাহুতে, ওই আলো ছোঁব নিজের খুশিতে। রাতগুলি আজ ক্লান্ত ভীষণ, আলো এসে যায়, পাখি আসে না, সুপ্রভাত’রা পালিয়ে গেছে, হাত বাড়ালেও কেউ ধরে না, কাটে একেকটা দিন বিষণ্ণতায়, কিংবা হাসিতে---যেমন বানাই দিনগুলিকে! কতশত বছর কেটে গেছে হায় বুঝেছি যখন, সময়ের চুরি কত সুন্দর, কত সত্য, কত নির্মম! সুখ কি কষ্ট---সময় হলেই---সবই নষ্ট! সময় শেখায়...জীবনটাকে হয় দেখতে---অন্ধ হয়ে; হয় শুনতে---বধির হয়ে! কত বিভ্রমে সময় ক্ষয়েছে, কত অলীকে সত্য মরেছে---আমারই সাথে! শৈশব গেছে---সাথে মুগ্ধতা, বাস্তবতায় জীবন চিনেছি, শত বন্ধনে একলা হয়েছি। জীবনের পথ একলা ভীষণ, হাত বাড়ালে---মানুষের বেশে অমানুষই আসে, বৃষ্টিটা আর হয় না মধুর আগের মতো, পুরনো হাওয়াটা জাগায় না আশা দুঃখে তত। পথের ধারেতে দাঁড়িয়ে আমি বুঝি না কিছুতেই, চলে হাওয়া কোন দিকে। কত শীত এল, চলেও গেল, রেখে গেল ছাপ...এই হৃদয়ে। আশা নিয়ে বুকে, প্রতীক্ষাতে, দাঁড়িয়ে রয়েছি এই নিরালাতে। কেউ পাশে নেই যারা ছিল আগে, এক স্মৃতি থাকে, আর কেউ না---অনেক দামেই বুঝছি শেষে! আমি চলে গেলে, সব চলে যায়, আমি থেকে গেলে, সব থেকে যায়, আমার মৃত্যু---আমারই মৃত্যু---আর কিছু নয়...কখনও কারুরই! আশা বড়ো ভারি, বইতে কষ্ট... তবু বাঁচার মানে আশা বয়ে চলা---আমি জীবনটাকে জেনেছি এটুকই!