প্রিয় কল্কির বাপ,
আজ তোমাকে চিঠি লিখতে কী যে ভীষণ ইচ্ছে করছে... কত কথা যে বলতে মন চাইছে... বোঝাই কী করে!
আফসোস, সময় থাকতে চাঁদের শরীর ছোঁয়া একজন হতে পারলাম না!
আজ না মাথার ভেতরটা কেমন শিরশির করছে! বায়ান্ন বছরের জমা সব স্মৃতি ঘূর্ণি পাকিয়ে উপরে উঠে আসতে চাইছে!
তবে সবটা আজ লিখব না, বুঝলে! একটুকরোই তো মোটে খাতার জমিন!
যখন আমাদের বিয়ে হয়, আমি তখন তেরো বছরের কিশোরী, আর তোমার একুশ। গরিব ঘরের রোগা, কালো এক বালিকাকে কী দেখে পছন্দ করলে আজও জানতে পারিনি!
একদিন রাতে আদর করতে করতে বলেছিলে, রোগা হও আর কালো হও, ওই বয়সে শরীরে একটা আলাদা চটক ছিল, তা দেখেই মজেছি! শুনতে বড়ো ভালো লেগেছিল। সেই শিহরন ভোলার নয়।
তোমার আয় বলতে গোরুর ছোট্ট একটা খামার! তাতে আবার বাবা-মা, চার জন ভাই-বোন, দাদী আর ফুফুকে নিয়ে তোমার বিরাট সংসার!
বাসররাতেই বলেছিলে, "এই সংসারের সবকটা মানুষকে বুক দিয়ে আগলে রাখবে। আমার বড়ো টানাটানির সংসার বটে, তবে আদর-সোহাগের একটুও কমতি নেই।" তখন থেকেই বুঝেছি, তুমি মানুষটার চোখে এত মায়া কেন!
দিন যায়, রাত যায়, বছরে ঘুরে কিশোরী থেকে যেন একলাফে আমি মেয়েমানুষে রূপান্তরিত হই! গায়েগতরে খাটতে থাকি খামারে আর সংসারে! এক এক করে তোমার বাবা-মা, ভাই-বোন আমাদের ছেড়ে যেতে থাকে আর এক এক করে আমাদের সন্তানেরা পৃথিবীতে আসে... আসা-যাওয়ার হিসেবটা দেখলে মনে হয়, কেমন জানি গোল গোল! পড়ালেখা করতে পারিনি, তবে হিসেবের হাতটা পাকা হলো কীভাবে যেন!
এই আসা-যাওয়ার প্যাটার্ন দেখে মনে হতো, কেউ বুঝি দাবার ছকে গুটির চাল দিচ্ছে!
কল্কি, সাবু, হাবু, রাঙা, আর সবশেষে আবু এল আমাদের সংসার ভরে! তুমি দিন দিন আরও আদরে-আহ্লাদে কেমন ঘন হয়ে উঠলে! দেখে বুক ভরে যেত।
এত সুখ যে পিঁপড়ের ভয়ে না মাটিতে রাখি, বেড়ালের ভয়ে না শিকেয় রাখি... আমার হলো এই মরণদশা! পিঠেপিঠি ছেলে-মেয়ে'রা বড়ো হতে থাকল আর সংসারে অভাব যেন চার হাত-পায়ে হামলে পড়ল!
দিনরাত গাধার মতো ঘানি টানতে টানতে তোমার শরীরেও ভাঙন ধরল, চোখের সামনে তোমাকে একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে দেখলাম রোজ!
ছেলে-মেয়ে কেউই স্কুলের গণ্ডি পেরুতে পারল না। ওদেরও দোষ দিই না; আমাদের না আছে টাকার জোর, না আছে মেধার জোর। আল্লাহ কিছু কিছু মানুষকে কেবল দীর্ঘশ্বাসে হাবুডুবু খাওয়ার জন্যই পৃথিবীতে পাঠায়! পৃথিবীর তাদেরকে দরকার হয় না, পৃথিবীকেও কিছু দেবার তাদের থাকে না। তারা শুধু দু-বেলা খেতে-পরতেই জন্মায়।
আল্লাহ আমাদেরও সেই দলেই ভিড়িয়েছে গো!
ছেলেমেয়েদের শখআহ্লাদ কিছুই তো পূরণ করতে পারিনি কখনও। তারা যে যার নিজের নিয়মে চলতে লাগল। ভালোবাসার শেষ 'ভালো' রেশটুকুও রইল না বাকি এই সংসারে। কল্কিটা যা একটু বাপ-মা ন্যাওটা ছিল। হাবুটা একটু ঢ্যামনামো করত বটে, তবে বেশি ঘেঁষত না।
কেমন করে দিন গেল চোখের সামনে, পাকাহাতেও হিসেব রাখতে পারিনি।
ছেলেদের বিয়ে হলো, সংসার হলো।
আমাদের রক্তের ছোট্ট ছোট্ট বুদবুদ প্রাণ নিয়ে ফিরে এল হাবু, সাবু, আর রাঙার ছেলে-মেয়ে'দের মাঝে! ওদের যত কাছাকাছি হতে চাইলাম, হাবু, সাবু আর আমাদের রাঙা তত দূরে সরতে লাগল! দেখলাম, চলছে আবার গোল গোল অদ্ভুত সেই খেলা!
কল্কিটাকে বিয়ে দিলাম, মেয়েটা আমার তামাক সেজেই দিনাতিপাত করে গেল সারাটা জীবন! তারপর একদিন কালসন্ধে; তুমি বললে, কতদিন পান খেতে দেখি না তোমাকে, রজু... একটু পান সেজে খাও দেখি! বড়ো ভালো লাগে দেখতে!
সেই ভূতে-পাওয়া সন্ধ্যায় তোমার চোখ দেখে বুকটা ধড়াস করে উঠল!
এত ঘন, এত কালো হয়ে আসছিল তোমার চারপাশে... এত বীভৎস ঝিঁঝিঁ ডাকছিল চারপাশে!
তারপর যেন এককোটি বছর কেটে গেছে... ধীরে, সন্তপর্ণে। তুমি ঘাম হয়ে ঝরে গেলে আমার জীবন থেকে; সেই যে কালসন্ধে!
মজার ব্যাপার কী শুনবে, তুমি যে রাতে আমাকে বিদায় জানালে, তার দু-দিনের ভোরে বাকি তেতাল্লিশ দিন বন্ধক রেখে, আমি সাদাথান গায়ে জড়িয়ে, দুধের গ্যালন নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ বিক্রি করে এলাম!
হাবুটা সময় পায়নি, ভ্যান নিয়ে বেরিয়েছিল নাকি; সাবু দুপুরে একটু ঘুমায় বুঝলে; রাঙা শ্বশুরবাড়িতে, মেয়েটার ইচ্ছে হলো, মাকে নাকি দেখবে! আর কল্কি! জামাইটা আসতে দিল না গো, মরাবাড়িতে নাকি যেতে নেই! দু-দিন ধরে বিশ-পঁচিশ সের দুধ পড়ে পড়ে নষ্ট হলো, তুমি যে নেই, বেচতে গেলে না! কাজে এত ঢিলেমি দিলে হয়, বলো!
পঁয়তাল্লিশ দিনের শোকনিবাস তো আর পেটে সইবে না।
তেতাল্লিশ দিন বন্ধক রেখে, আমিই বেচে এলাম... বেঁচে ছিলাম যে!
সম্পর্কের বাঁধন আজ পলকা দড়ি, যা বাইতে পারে না কবরপাড়ের একটাও সিঁড়ি!
থাক, সেসব পুরোনো কাসুন্দি, অত ঘেঁটে কী হবে! তুমি বরং সাদা জমিনে আলের পাশে বসো, আমিও আসছি।
ইতি আমি গো... তোমার রজু!