কবিতা চলে গেছে।
কবিতার রাস্তায় আমরা দুজন হাঁটিনি, বুঝিনি কখনো।
কবিতা চলে গেছে কবিতার রাস্তায়, নিজস্ব পথ ধরে সোজা হেঁটে গেছে,
একবার ফিরেও তাকায়নি পেছনে।
আমি তাকিয়েছিলাম, গল্পের ঘুপচি গলি হাতড়ে-হাতড়ে।
আমার এই হাত ছেড়ে কবিতা আজ অন্য কারো হাতে, হাতবদলের নিপুণ বুদ্ধিতে জয়ী হাসিতে।
আজ হারিয়ে বুঝি, আমার কবিতায় কেন খেলতো গল্প অন্য কারো,
সে গল্পের শরীরে বাঁধতে নিজেকে আমাকে টেনে উঠিয়েছিল যখন,
আমি গল্প ভুলে সব হারিয়ে কবিতায় ডুবলাম।
জীবনের গল্প কবিতার জীবনে হারাল, সব কবিতা ফুরোলো।
ভালোবাসার হিসেব যতো, সেসব আমার কবিতায় আসে না,
বেহিসেবে জীবন কাটানোয় অভ্যস্ত হয়েছি কবিতার হাত ধরেই।
আমার বোধকে, আমার সমস্ত সত্তাকে সস্তায় কিনে অনেক দামে বেচে আমার সবকটা কবিতাকে গলাটিপে হত্যা করে আজ কবিতা বেশ ভাল আছে।
আমি ভালোবাসার রঙ বুঝতে শিখে, দাম বোঝার সময় পাইনি।
অসময়ে সময় হারিয়ে বুঝি, কবিতারা ভালোবাসা বোঝে না, ভালোবাসার দাম বোঝে,
জীবনের দাম ভুলে দামি জীবনের ব্যক্তিগত সমীকরণে কবিতা বেঁচেছিল, বস্তুত, এখনো আছে।
রমনার এক চিলতে বিকেলে, অভিমানে বলেছিলাম, “দেখো, একদিন,
এই আমিও ভালো না বেসে দারুণ বাঁচতে শিখে যাবো ঠিক-ঠিক! সেদিন আমার আয়নাটা তোমার আয়না হবে।”
ওর মাথার দিব্যিটুকু দিয়ে দিব্যি অভিনয়ে আমায় খুব কাঁদিয়েছিল সে।
ওর উপেক্ষা কিংবা বিরক্তি, এর কোনোটাই গায়ে না মেখে
অসহায় সেই আমি ভাবতাম, “এই ভালোবাসাটাও বয়ে বেড়ায় লোকে?”
কবিতাকে কীকরে ভুলে যেতে হয়, ভুলে থাকতে হয়, কেউ কখনো আমায় শেখায়নি।
কবিতার হাত ধরে আমার কবিতারা আসত, শেখায়নি ওরাও।
কতটা ধাক্কা খেলে সরে যাওয়ার সময় হয়ে যায়, শিখেছি আমি সবকিছু হারিয়ে, পায়ের ছন্দে শেকল বেঁধে।
আমার সাথে এমন ক্ষণের হয়নি দেখা, যে ক্ষণে কবিতা আমার মাথায়, সমস্ত অনুভূতিজুড়ে
স্থির হয়ে ছিল না। একটু জ্বালিয়ে, আধটু কাছে এসে অনেক ভালোবেসে একদিন বেঁচেছিলাম কবিতায়।
এই আমি আছি না নেই, এতে কী এসে যায়?
কবিতা আমাকে জানতে চায়নি কখনোই,
আমিই নিজেকে ওর মতো করে সঙ সাজিয়েছি, ওভাবেই থেকেছি দিনের পর দিন।
কবিতা, আমাদের সময়টা তবে এগোতোই পেছোনোর শপথ নিয়ে? ভাবিনি কখনো!
আমার সকল বুদ্ধু বিশ্বস্ত অনুভূতিকে আমার অভিমান আর তোমার অপমানের আগুন যুগপৎ পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।
অনেকটা সময় পেরিয়ে দেখি, একই বিন্দুতে ঘুরছি ভীষণ।
এক সাগর অনুভূতির প্রবল স্রোতের খেলায় ভেসে হারিয়ে যাওয়াই নিয়তি মেনে এখনো বেঁচে আছি।
ইগোরা সব ওই দূরে পালিয়ে বেড়ায় আমায় একলা রেখে। আমার লজ্জার পাহাড় নির্লজ্জতার পর্বতে পৌঁছে মুখ বাঁকায়,
হৃদয়ে জমে থাকে আরো উঁচু ভালোবাসার দামি স্তূপ, যা অর্থহীন হয়ে আছে তোমার মিথ্যে স্মৃতিতে।
পার হয়ে যাওয়া প্রতি সেকেন্ডকে ছুঁতে গিয়ে হঠাৎ স্বপ্নে ভাবি, যা গেছে, অসময়ে সময়ের সকল দাবিকে মিটিয়ে,
তা ফিরে আসুক আমার সকল শূন্যতার তীব্র ঝড়কে থামিয়ে, যে ঝড় আমায় জাপটে ঝাপটে ছিটকে ফেলে হাসে।
অভিমানে কেটে যাওয়া কয়েক মুহূর্ত শতাব্দীর চাইতেও দামি, দীর্ঘ, নিরন্তর---
আমাকে অসহায় করে দিয়ে কী নিখুঁত পাশ কাটায়! আমি নির্বাক তাকিয়ে থাকি।
আমার যা গেছে, তা আর কখনো ফিরবে না জেনেই গেছে, এমন সত্য যখন সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে,
আমার প্রহরগুলো একে-একে থমকে যায়। এমন এক বিধ্বস্ত মানুষের কোনো দাম থাকে না পৃথিবীর কোনো কবিতার কাছে!
জানি সবই। জ্বলবোই যখন, তখন আর নেভার আশায় মরে কে? এ আগুন নিভলে পরে জীবনটাই যদি নেভে,
আগুন নিয়েই বাঁচবো নাহয়। হাঁটতে শিখে যাওয়ার দায় ঠেকাতে পারে না পায়ের দগদগে ক্ষত।
আজো প্রতীক্ষায় আছি। আর ফিরবে না জেনেও এমন নিরর্থক প্রতীক্ষায় নেশা চাপে মরণের,
চিরমুক্তির নেশায় সবাইকে দায়মুক্ত করে দিয়ে এগিয়ে যাবো নির্ভার নিশ্চিন্ত নিরুদ্বিগ্ন,
এমন ভাবতেই মন ভেবে বসে, মুক্ত হবো সত্যিই এই মুক্তিতেই?
আমার ভালোবাসা মিথ্যে, সমস্ত অনুভূতি মিথ্যে, প্রতিদিনের, সবকটা মুহূর্তের অশ্রু মিথ্যে।
মিথ্যেই যদি না হতো সব, আমার অনুভূতি ছুঁয়ে তা মুছে নেয়ার দায়ে কেউ সরবে কেন?
যে ভালোবাসা মিথ্যে, এমন ভালোবাসায় ভর করে, কীকরে কবিতা থেকে যেত আমার পাশে?
আমার সকল অনুভবে যে সত্য মিশে একাকার হয়ে আছে, সে সত্য মিথ্যে করে জীবনের বড়
সত্যটা চলে গেছে। আজ সে সত্যের অস্তিত্বের অনর্থক কল্পনায় মিশে থেকে যাওয়ার কী মানে?
প্রতি মুহূর্তেই, রাজ্যের মিথ্যে অনুভূতিরা আমায় বড় অস্থির করে রাখে। অস্থির আলোয় স্নান করি।
এই অস্থিরতা, এই কষ্ট সবই মিথ্যে জেনে চোখের অবাধ্য জলটা সবকিছু ঝাপসা করে দেয়ার আগেই
কান্নার দামটা মৃত্যুতে মিটিয়ে দেবো। অপেক্ষার ক্ষণগুলি শেষ হয়ে এলে
সুখের স্বপ্নছোঁয়া দিনগুলি আরেক জীবনে ঠিক খুঁজে নেবো, এমন স্বপ্নে
কষ্ট পুষে অশ্রু মুছে পথশেষের পথটা স্পষ্ট দেখি জীবনের চাইতেও ধ্রুব প্রত্যয়ে।
কবিতার হাত ধরে এলাম কবিতায়।
এসে দেখি,
থাকার অভিনয়ে কবিতা চলে গেছে।
আসার অভিনয়ে গল্প চলে গেছে।
অন্য জীবনের খোঁজে জীবন অন্য হয়ে গেছে।