এক। কিছু কিছু মানুষ ক্ষমা করে দেয় মহত্ত্বের কারণে নয়, প্রতিশোধ নিতে পারে না বলে, কিংবা প্রতিশোধ নেবার ঝক্কিঝামেলা পোহাতে চায় না বলে। দুই। ভোগের শুরুতে মানুষ যা ভোগ করে, একসময় তা-ই মানুষকে ভোগ করতে থাকে। মানুষ যা কিনে আনন্দ পায়, একসময় তা-ই মানুষকে কিনতে থাকে। যে সময়কে আমরা নষ্ট করি, সে সময়ই সময় হলে আমাদের নষ্ট করতে থাকে। তিন। যা-কিছু পয়সা দিয়ে কেনা যায়, তা-কিছু পয়সা দিয়েই ভোগ করা ভালো। বিনা মূল্যের নয় যা, তার মূল্য পরিশোধ না করলে প্রায়ই পরবর্তীতে তার জন্য অতিমূল্য পরিশোধ করতে হয়। চার। যা থেকে সুখ আসে, সময়মতো তা ছেড়ে না দিলে অসময়ে তা নিজেই আমাদের ছেড়ে চলে যায়। সুখের উপকরণ যদি আমরা নিজে না ছাড়ি, বরং সেটিই আমাদের ছেড়ে চলে যায়, তবে তার ফল ভালো হয় না। তাই দেরি হয়ে যাবার আগেই প্রয়োজনীয় দুঃখকে জীবনে জায়গা দিতে জানতে হয়। পাঁচ। যা আমরা আগে কখনও পাইনি, জীবনে তা যদি বিনা শ্রমে আসে, তবে তা গ্রহণ না করলেই ভালো। প্রাপ্য দুঃখ অপ্রাপ্য সুখের চাইতে নিরাপদ। ছয়। মিথ্যে হাসির কল্পনায় কল্পনায় যার দিন কাটে, তার রাত্রি কাটে সত্যি অশ্রুর অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞতায়। সাত। আগুন কতটা দহন করতে পারে, তা তো মোমবাতি নিজেই জানে না, পতঙ্গ জানবে কী করে? রূপ কতটা পুড়িয়ে ছারখার করতে পারে, তা তো নারী নিজেই জানে না, পুরুষ জানবে কী করে? আট। ঘরের সুখ, সন্তানের মায়া, ধনের নিরাপত্তা, স্বামী বা স্ত্রীর সোহাগ, বন্ধুর সাহচর্য, যৌবনের উচ্ছ্বাস কোনোটিকেই ভোগের তালিকা থেকে বাদ না রাখলে জ্ঞানের আনন্দ কী করে মানুষের মধ্যে ঢোকে? নয়। পরের পায়ে দাঁড়ানোর সুখ যাকে একবার মোহাবিষ্ট করে ফেলে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তৃপ্তি সে সহজে পেতে চায় না। দশ। যে ভালোবাসায় শান্তি নেই, সে ভালোবাসাই একসময় চরম বিরক্তির উদ্রেক করে। যে শান্তিতে ভালোবাসা নেই, সে শান্তিও চিরকালই পরমতৃপ্তির খোঁজ দিয়ে যায়। যে শুধুই ভালোবাসতে জানে, শান্তি দিতে জানে না, তার কাছ থেকে সাবধান! পৃথিবীতে বহু মানুষ ভালোবাসা পেয়েও আত্মহত্যা করেছে; কিন্তু শান্তি পেয়েও আত্মহত্যা করেছে, এমন মানুষ এক জনও নেই। এগারো। যা প্রাপ্ত, কিন্তু প্রাপ্য নয়, তার ভার সামলাতে গিয়ে পৃথিবীর অনেক মানুষই ধ্বংস হয়ে গেছে। বারো। মানুষ সে দুঃখের বর্ণনাই মন দিয়ে শোনে, যে দুঃখ একসময় সুখের সন্ধান দিয়েছে। যে দুঃখ কেবল দুঃখই এনেছে, তার বর্ণনা শুনতে কেউ চায় না। তেরো। নিজে কিছু করতে পারার মুরোদ যার যত কম, সে তত বেশি অন্যের কিছু করতে পারা নিয়ে আজেবাজে কথা বলার সময় ও রুচি খুঁজে পায়। চৌদ্দ। কেউ কেউ সমুদ্রের অধিপতি হয়েও জলবিন্দুর মতন নীরব থাকে, আর কেউ কেউ জলবিন্দুর তত্ত্বাবধায়ক হয়েই সমুদ্রের মতন গর্জন করে! পনেরো। তাড়াহুড়োয় ভালোভাবে চিন্তাভাবনা না করে বিয়ে করলে আফসোস করার মতো অফুরন্ত অবসর সারাজীবনই হাতে পাওয়া যায়। ষোলো। পয়সাওয়ালা ছোটোলোকের কাছে হাত পাতার চাইতে বরং অনাহারে মরে যাওয়াও অনেক ভালো। সতেরো। আমরা যেভাবে প্রতিদিনই অন্যের মনরক্ষার জন্য ব্যস্ত সময় কাটাই, তার অর্ধেকও যদি নিজের মনের সঙ্গে ভালো সময় কাটাতাম, তবে আমাদের কষ্টও কমে যেত, আবার হৃদয়ের নির্মল প্রশান্তিতে শরীরে ও মনে খুশিও ছড়িয়ে থাকত। আঠারো। মানুষ একসময় যা যা হাতে পেয়েও অবহেলায় ছেড়ে দেয়, অনেক দিন পর খুব করে কেঁদেও সেগুলি আর খুঁজে পায় না। এর নামই প্রকৃতির বিচার। উনিশ। যা যা কষ্ট আজ তুমি দিচ্ছ, তার প্রতিটিই তুমি সুদে-আসলে ফেরত পাবে। তোমার কাজের হিসেব কোথাও নিশ্চয়ই লেখা হচ্ছে। অপেক্ষা করো। চোখ বোজার আগেই সব চোখে দেখবে! বিশ। কেউ কেউ যা পায়নি বলে অশান্ত হয়ে আছে, কেউ কেউ তা পেয়েছে বলেই অশান্ত হয়ে আছে। পাবার আগে দূর থেকে অনেক কিছুই দেখতে চমৎকার লাগে। একুশ। মানুষ যাকে হারিয়ে যেতে দেয়, কখনও কখনও, তাকে নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। বাইশ। ‘এখন কষ্ট করি, একদিন খুব সুখে থাকব!’ এইসব আমরা এমনভাবে ভাবি যেন আমরা জেনেই বসে আছি, আমাদের আয়ু অনেক দীর্ঘ! তেইশ। কেবলই ভোগের দিকে যার নজর, তার চোখে-মুখে ত্যাগের মহিমা মানায় না। ওরকম কপট লোকের সঙ্গ খুব বিপদজনক। চব্বিশ। কেউ কেউ বন্ধুর অভাবে কাঁদে, আর কেউ কেউ বন্ধুর স্বভাবে কাঁদে। ঝুঁকি দু-দিকেই! এর চাইতে বরং নিজের সঙ্গে বাঁচাই আনন্দের। পঁচিশ। কারও কষ্ট, অপেক্ষার প্রহর কেন ফুরোয় না! কারওবা কষ্ট, অপেক্ষার প্রহর কেন ফুরোল! অপেক্ষা সুখের, না কি অপেক্ষার সমাপ্তি সুখের, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ছাব্বিশ। কোনও কিছু দেবার বেলায়, আমরা তাকেই দিই, যাকে আমাদের দরকার; যার জিনিসটা দরকার, তাকে আমরা তা দিই না। সাতাশ। স্তাবক আর বন্ধু এক নয়। আমরা বেশিরভাগ মানুষই স্তাবককে বন্ধু ভাবি, আর বন্ধুকে নিন্দুক ভাবি। আটাশ। এদেশে ভুল স্বীকার করলে, যে ভুলটা ক্ষমা করে দেবার মতো, সে ভুলের জন্যও ক্ষমা পাওয়া যায় না। উলটো এটা নিয়ে সবাই নিশ্চিত হয়ে যায় যে আপনি ভুল করেছেন, কেননা আপনি নিজেই তা স্বীকার করে নিয়েছেন। উনত্রিশ। মন উপরেও ওঠে, নিচেও নামে। এতে অসুবিধে নেই। গণ্ডগোলটা তখনই বাধে, যখন উপরে ওঠার প্রয়োজনের সময় মন নিচে নামে এবং নিচে নামার প্রয়োজনের সময় মন উপরে ওঠে। ত্রিশ। মানুষ অন্যকে জানার জন্য যতটা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তার অর্ধেকও যদি নিজেকে জানতে চাইত, তবে এমন একটা জায়গায় নিজেকে নিয়ে যেতে পারত যে, তাকে জানতে চায়, এমন অনেকেই থাকত। একত্রিশ। সুস্থতার চাইতে বড়ো সম্পদ আর নেই। অসুস্থতার চাইতে বড়ো অসহায়ত্ব আর নেই। অসুস্থ হলেই বোঝা যায়, যাদের আমরা কাছের ভাবি, তারা আদৌ কতটা কাছের! অসুস্থতার চাইতে দারিদ্র্যও ভালো। বত্রিশ। জলের অভাবে তেষ্টায় মরে যে ঘরের লোকজন, সে ঘরেই আগুন লাগলে দেখি আগুন নেভানোর জলের অভাব হয় না! তেত্রিশ। যদি জীবনে এমন সময় এসে কখনও উপস্থিত হয়, যখন প্রতিষ্ঠা চলে যায় বা কমে যায়, অর্থসম্পদ নষ্ট হয়, স্তাবকের দল কেটে পড়ে, বন্ধুর সংখ্যা গুনতে একহাতের আঙুলই যথেষ্ট, নিজের পরিবারেই কদর ধীরে ধীরে হারাতে থাকে, তখনও যে মানুষ জীবনকে চিনতে পারে না, সে-ই যথার্থ অপদার্থ। চৌত্রিশ। যে মানুষের আনন্দের ও বিষাদের উৎস একেক দিন একেক রকমের হয়, তার ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হয়। পঁয়ত্রিশ। কাউকে পছন্দ করে না বিধায় তার ভালো কথাও যার কানে বিষের মতো লাগে, তার পক্ষে জীবনে বেশিদূর যাওয়া খুব কঠিন। ছত্রিশ। ঘর দেখে কখনও ঘরের মানুষ চেনা যায় না। ঘরের মানুষ দেখেও কখনও ঘর চেনা যায় না। সাইত্রিশ। যা-কিছু হারাবার ভয়ে আমরা সুখের সঙ্গে প্রতিনিয়তই ঝগড়া করে চলেছি, এক বার তার মায়া ত্যাগ করতে পারলে সুখের সঙ্গে বন্ধুত্বটা পাকাপোক্ত হয়ে যায়। হারাবার ভয় নেই যার, তার আবার দুঃখ কীসের? আটত্রিশ। যে তোমাকে একসময় খারাপ ভাবত, সে তোমাকে এখন ভালো ভাবলেও তার কাছ থেকে সাবধান থেকো, কেননা সে আবারও সেকেন্ডের মধ্যে আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারে। উনচল্লিশ। অশান্তি উৎপাদন করা একধরনের বদভ্যাস। যার মধ্যে এটা আছে, সে শত ভালোবাসলেও তার সঙ্গ পরিত্যাজ্য, কেননা ভালোবাসার চাইতে শান্তি বড়ো। বাঁচতে ভালোবাসা ততটা জরুরি নয়, যতটা শান্তি জরুরি। চল্লিশ। কোনও কিছু না জানলে চুপ থাকাই ভালো। না জেনে কথা বলাটা খুব বাজে একটা স্বভাব। এমন স্বভাব যাদের আছে, তারা ক্রমেই লোকের কাছে সম্মান হারায়। লোকে না জানলে অসম্মান করে না, কিন্তু না জেনেও জানার ভান করলে অসম্মান করে। একচল্লিশ। কাউকে লভ্যাংশের আশাতেও ধার না দেওয়াই ভালো। আর ধার দিলে ঠিক সে পরিমাণ টাকাই ধার দেওয়া ভালো, যা ফেরত না পেলেও তেমন গায়ে লাগবে না। ধারের টাকা ফেরত না পেলে তখন যতটা মানসিক দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা, লভ্যাংশের অর্থ যতটা সুখ দিত, তার চাইতে অনেক বেশি কষ্ট দেয়। সবচাইতে বড়ো কথা, লভ্যাংশের টাকাটা তো একা ভোগ করা হয় না, পরিবারের সবাইকে নিয়েই ভোগ করা হয়। অথচ তার জন্য সমস্ত মানসিক কষ্ট একা নিজেকেই পেতে হয়। লোকে ধার নেবার সময় ফকির সাজে, আর ধার ফেরত দেবার বেলায় ফকির, এমনকী চোরও সাজায়! বিয়াল্লিশ। বিনা মূল্যে পৃথিবীতে যা পাওয়া যায়, তা নিতান্তই মূল্যহীন, এমনকী তার জন্য একসময় চরম মূল্যও দিতে হতে পারে! মূল্য পরিশোধ করার ইচ্ছে বা মানসিক প্রস্তুতি নেই যার জন্য, তা পাবার আশা ত্যাগ করাই ভালো। যা নিজে চেষ্টা করে অর্থমূল্য ছাড়াই পাওয়া যায়, তার জন্যও তো সাধনা করতে হয়। এ জগতে সাধনার চেয়ে দামি কিছু আর কীই-বা আছে? তেতাল্লিশ। যে মূর্খ ব্যক্তিকে তুমি ভালোবাসো, তার তুলনায়, যে জ্ঞানী ব্যক্তিকে তুমি ঘৃণা করো, তার সাহচর্যই উত্তম। ব্যক্তি ঘৃণ্য হতে পারে, কিন্তু ব্যক্তির অর্জিত জ্ঞান কখনও ঘৃণ্য হয় না। খাঁটি দুধ ভাঙা পাত্রে থাকলেও খাঁটি, জলমেশানো দুধ স্বর্ণের পাত্রে থাকলেও জলটা সরে তা খাঁটি হয়ে যায় না। দুধ খুঁজতে গিয়ে ভাঙা পাত্র দেখে ফিরে এসো না, দামি পাত্র দেখে ঝাঁপিয়ে পোড়ো না। চোখ থাকুক দুধের দিকে, পাত্রের দিকে নয়। চুয়াল্লিশ। মূর্খের মুখের তত্ত্বালোচনা শোনার চাইতে জ্ঞানীর মুখের স্বাভাবিক কথাবার্তা শোনাও ভালো। বাজে স্যারের লেকচার শোনার চাইতে বরং ভালো স্যারের গল্প শোনাই ভালো। পঁয়তাল্লিশ। ভুল মানুষের সঙ্গের চাইতে নিঃসঙ্গতা হাজার গুণে ভালো। ভুল কারও সঙ্গে গল্প করার চাইতে নিজের সঙ্গে নিজে গল্প করা অনেক বেশি স্বস্তির। ছেচল্লিশ। রান্নাটা কেমন হয়েছে, এটার চাইতে, যার কাছে, রান্নাটা কে করেছে, সেটা জরুরি, তার কাছ থেকে রান্নার স্বাদ ও মান সম্পর্কে সুবিচার আশা করাটা বোকামি। সাতচল্লিশ। যে ব্যক্তি দড়িতে সাপ কল্পনা করে করে বাঁচে, সে একদিন দড়ির কামড়েই মারা যায়। অন্য দিকে, যে ব্যক্তি সাপ দেখলেও দড়ি ভাবে, তাকে সাপ আর নতুন করে মারতে পারে না, কেননা সে অনেক আগে থেকেই মৃত! আটচল্লিশ। নিজের সুখের সমীকরণটা নিজেকেই মেলাতে হয়। ওটা পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের হাতে পড়লে, তখন না থাকে সমীকরণ, না থাকে সুখ! উনপঞ্চাশ। আলোতে যাবার প্রথম ধাপটি হচ্ছে, অন্ধকারে আছি, এটা মেনে নেওয়া। পঞ্চাশ। জ্ঞানীদের বলার সুযোগ দিলে ওঁরা চুপ করে থাকেন, যদি বলার মতো ভালো কিছু না থাকে। মূর্খদের বলার সুযোগ দিলে ওরা বলতে থাকে, যদি বলার মতো যে-কোনও কিছুই থাকে।