অরডেট (১৯৫৫)

‘অরডেট’ শব্দটির অর্থ ‘কথা’। যখন কারো জীবনে অন্ধকার নেমে আসে, নৈরাশ্য থেকে মন কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারে না, তখন মনকে আলোর পথে নেয়ার জন্য কারো বিশেষ কোনো কথা ভূমিকা রাখতে পারে। সে কথা প্রাণকে জাগায়, আত্মাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। সে কথায় বিশ্বাস রেখে কাজ করে গেলে মানুষ মানসিক সংকট থেকে মুক্ত হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি প্রয়োজন বিশ্বাস এবং সে অনুযায়ী পথচলা। বিশ্বাস না থাকলে কোনো ধরনের পরিবর্তন সম্ভব নয়। সে কারণে আমরা দেখি, যারা বেশি বোঝে, সবকিছুতেই যুক্তি খুঁজে বেড়ায়, তারা জীবনে বেশিদূর যেতে পারে না। জীবনের ক্রান্তিকালে সঠিক মানুষের দেখা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। সে মানুষটির একটি কথাও জীবনকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। দিনের পর দিন স্থির বিশ্বাসে সে কথাটি হৃদয়ে ধারণ করে নিজেকে ও নিজের অভ্যেসগুলিকে বদলে ফেলে সামনের দিকে এগোলে জীবনে আলো আসবেই। জীবনে যদি কখনো এমন সংকট এসে উপস্থিত হয়, যখন সব দরোজা একএক করে বন্ধ হয়ে যায়, তখন দুইটি জিনিস দরকার। সঠিক মানুষের দেখা পাওয়া। সে মানুষের কথাকে অনেকটা অন্ধের মতো অনুসরণ করা। এ অনুসরণ-প্রক্রিয়াই হচ্ছে প্রার্থনা। প্রার্থনার অর্থ—হৃদয়কে জাগানো, ভেতরের মানুষটার সাথে যোগাযোগ স্থাপন। সে কাজটি সমষ্টিগত নয়, ব্যক্তিগত। এ সিনেমায় বাবা মর্টেন বোরগেন ছেলে অ্যান্ডারসকে বলছেন:

বাবা, যখন সত্যিকারের জরুরি কোনোকিছুর জন্য প্রার্থনা করতে হয়, আমি একাকী প্রার্থনা করতে পছন্দ করি।

চলচ্চিত্র নির্মাতাদের গুরুখ্যাত ড্যানিশ পরিচালক কার্ল থিওডোর ড্রেয়ার ১৯৫৫ সালে নির্মাণ করেন অরডেট। ছবিতে ক্যামেরার নিখুঁত কাজ মুগ্ধ করে দেয়। আলোছায়ার নিপুণ ব্যবহারে নির্মাতা গ্রামীণ জীবনপ্রণালী ও প্রকৃতির নিখুঁত আবহ তৈরি করেছেন। আন্দ্রেই তারকোভস্কির সবচাইতে প্রিয় সিনেমাগুলির একটি ‘অরডেট’। রূপকের মাধ্যমে এ ছবিতে কিছু মেসেজ দেয়া হয়েছে। ড্যানিশ ধর্মযাজক কাজ মুঙ্ক ১৯৩২ সালে একটি নাটক লিখেন, সে নাটকের চিত্ররূপ হচ্ছে ‘অরডেট’। হিটলারের চাইতে যিশু খ্রিস্টের উপর তিনি বেশি আস্থা রাখেন, এ অপরাধে জার্মান নাৎসি বাহিনি তাঁকে হত্যা করে। প্রাতিষ্ঠানিক নয়, বরং ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস কীকরে মিরাকল ঘটিয়ে একটা পরিবারকে চরম সংকটের সময় বাঁচিয়ে দিয়েছে, সে আখ্যানই সিনেমায় নানান প্লটের বিন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। ড্রেয়ার এখানে দুটো পরিবারের কথা বলেছেন, একটি খ্রিস্টান ধর্মের গোঁড়া অনুসারী, পরিবারের কর্তা পিটার পিটারসেন, আরেক পরিবার সংস্কারপন্থী, সে পরিবারের কর্তা মর্টেন বোরগেন। সিনেমায় দেখি, বোরগেন পরিবারের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, ঈশ্বর আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন: নিজেকে পরিপূর্ণ করো, আনন্দ করো, জীবনকে উপভোগ করো, মানুষকে ভালোবাসো। ঈশ্বর জীবনের মতো সুন্দর। অন্যদিকে পিটারের পরিবার বিশ্বাস করে: নিজেকে কষ্ট দেয়ার মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়া সম্ভব। যেখানে যন্ত্রণা নেই, সেখানে মুক্তি নেই। ঈশ্বর মৃত্যুর মতো ধ্রুব। এ সিনেমা দেখেই বুঝে ফেলার মতো সিনেমা নয়। এ সিনেমা বুঝতে হলে সিনেমাটি যা দেখায়নি, কিন্তু বলতে চেয়েছে, তা বোধে নিয়ে আসতে হবে।

দ্বিতীয় পরিবারের বড় ভাই মিক্কেল বোরগেন নাস্তিক। তার কথায়, এমন-কী বিশ্বাসেও তার কোনো বিশ্বাস নেই! তার স্ত্রী ইঙ্গার তৃতীয় সন্তানসম্ভবা। ইঙ্গার হাসিখুশি, ঘরের সবকিছু সামলে রাখে, পরিবারের সবার সাথেই তার খুব ভাল সম্পর্ক। তাকে ঘিরেই পরিবারের যতো উচ্ছলতা। আরেক ভাই অ্যান্ডারস পিটারের মেয়ে অ্যানিকে ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়। পিটার পেশায় দর্জি। তিনি এ বিয়েতে রাজি নন, তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে চান তাঁদেরই মতো গোঁড়া খ্রিস্টান পরিবারে। ওদিকে অ্যান্ডারসের বাবাকে বিয়ের ব্যাপারে রাজি করানোর জন্য বিভিন্ন কৌশলে চেষ্টা করেও ইঙ্গার ব্যর্থ হয়। মজার ব্যাপার, যখন মর্টেন শুনলেন তাঁর ছেলেকে পিটার প্রত্যাখ্যান করেছেন, তখন ব্যাপারটা তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত করে এবং তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ছেলেকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে পিটারের বাড়িতে ছোটেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তৃতীয় ভাইটির নাম জোহানেস। সে বিশ্বাস করে, তার মাধ্যমে যিশু খ্রিস্টের পুনরুত্থান ঘটেছে, সে-ই যিশু। পরিবারের সবার ধারণা, ড্যানিশ দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ সোরেন কিয়ের্কেগার্ড পড়েপড়ে সে ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত, কিয়ের্কেগার্ড মনে করেন, প্রচলিত ধর্ম, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সত্যিকারের ব্যক্তিসত্তাকে নির্ধারণ করতে পারে না। সবাই যে করছে, তা-ই করার অর্থই হল অন্ধত্ব। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধর্মের প্রকৃত অস্তিত্ব গ্রন্থে নয়, প্রতিষ্ঠানে নয়, বরং নিজের বিশ্বাসে, হৃদয়ে। মিক্কেলের মেয়ে ম্যারেন জোহানেসের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে। জোহানেস মিক্কেলের স্ত্রী ইঙ্গারকে মৃত্যু থেকে জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসে কেবল অসীম বিশ্বাসের জোরে। বিশ্বাস অনেকেরই মধ্যে ছিল, কিন্তু বিশ্বাসের জোরে কিছু চাইতে পারার মতো অবিচলতা জোহানেস বাদে কারো মধ্যেই ছিল না।

ড্রেয়ার এখানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস, এই দুইয়ের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। স্থানীয় ধর্মযাজকও ধরে নিয়েছিলেন জোহানেস ইঙ্গারকে মৃত্যু থেকে ফেরাতে যা করছে, তা স্রেফ পাগলামি। তাঁর মধ্যে যে ধর্মবিশ্বাস কাজ করছিল, সেটা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক। অপরদিকে ম্যারেন ও জোহানেসের মধ্যে যা কাজ করছিল, তা ছিল ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস, সে বিশ্বাস সমষ্টিগত বিশ্বাসের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। জোহানেস ছিল অন্যদের চোখে পাগল, কারণ তার ভাবনা ও কাজ অন্যদের অভিজ্ঞতা ও ধারণার বাইরে। এ পৃথিবীতেও যারা মিরাকল ঘটায়, তাদের সবাই প্রাথমিক পর্যায়ে পাগলই বলে। সাধারণ মানুষ যা দেখতে পায় না, ভাবতে পারে না, তা কিছুই হয়তো ওইসব পাগলদের কাছে সহজ, স্বাভাবিক। আমরা বেশিরভাগ মানুষই প্রার্থনা করতে হয় বলেই প্রার্থনা করি, প্রায়ই সেখানে গভীর বিশ্বাস থাকে না। ফিল্মমেকার ড্রেয়ার তাঁর চরিত্র মর্টেন বোরগেনকে বলাচ্ছেন:

এখানে দোষটা ঈশ্বরের ছিল না, বরং আমার ছিল। যদি আমি মনে বিশ্বাস রেখে প্রার্থনা করতাম, তবে মিরাকল ঘটত। আমি তা না করে কেবল প্রার্থনা করার জন্যই প্রার্থনা করেছিলাম। যখন একজন পিতা তার সন্তানের জন্য বিশ্বাস থেকে প্রার্থনা করতে পারে না—তখন মিরাকল ঘটে না।

সিনেমাটি ধীর গতির। দেখার সময় শেষ দৃশ্য আসার আগ পর্যন্ত তেমন কোনো উত্তেজনা তৈরি হয় না। শেষ ১০ মিনিটের দৃশ্য বিশ্ব চলচ্চিত্রের অমূল্য সম্পদ। এ সিনেমায় দুই ধরনের মানুষের কথা বলা হয়েছে। এক। যারা অভিজ্ঞতায় নয়, বরং পুঁথিতে বাস করে। তারা নিজেদের কিংবা অন্যদের জীবন বদলাতে পারে না। দুই। যারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে নিজেদের ও অন্যদের জীবন বদলে দিতে পারে। সিনেমায় দেখানো হয়েছে, শুধু বিশ্বাস করাটাই যথেষ্ট হয়, সে বিশ্বাসকে কাজে লাগানোই আসল কাজ। বিশ্বাস থেকে কিছু চাইলে পাওয়া যায়। সংশয় নিয়ে মানুষ বেশিদূর যেতে পারে না। কেবল চাইতে পারে না বলেই কত লোক জীবনের প্রকৃত ঐশ্বর্যের খোঁজ কখনোই পায় না। সিনেমায় কিছু মেসেজ আছে। বড় ভাই মিক্কেলের স্ত্রী ইঙ্গারকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনার সময় জোহানেস প্রথম চেষ্টায় ব্যর্থ হয়। “আমি ইঙ্গারকে বাঁচিয়ে তুলব।” প্রথমবার এমন ঔদ্ধত্য দেখিয়ে কোনো কাজ হল না। দ্বিতীয়বার যখন জোহানেস বলল, “আমি ইঙ্গারকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করবো।” তখন ঈশ্বর জোহানেসের নিরহংকার মানসিকতায় খুশি হলেন এবং ইঙ্গারকে জীবন ফিরিয়ে দিলেন। ড্রেয়ার এই জায়গায় রূপকের আশ্রয়ে জীবনে অহংকারের অসারতার কথা বলেছেন। স্ত্রী ইঙ্গারের দিকে তাকিয়ে মিক্কেল যখন বলে, আমি ওর শরীরকেও ভালোবাসি, তখন ভালোবাসায় আত্মা ও দেহ, দুইয়ের অনিবার্যতার কথা প্রকাশ পায়। ড্রেয়ার এ সিনেমায় মৃত্যুকে দেখিয়েছেন সাদা রঙে, জীবনকে দেখিয়েছেন কালো রঙে। কেন? মিক্কেল যখন ভাই জোহানেসকে জিজ্ঞেস করে, “সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে থেকেও একটা মানুষ কীভাবে পাগলের মতো কথা বলে?” তখন উত্তর আসে, “তুমিও সে পথেই যাচ্ছ।” কালো রং হচ্ছে সকল রঙের অনুপস্থিতি, অপরদিকে সাদা রং হচ্ছে সকল রঙের উপস্থিতি। জীবন যখন সব রঙের দেখা পেয়ে পরিপূর্ণ হয়, তখন মানুষ কালো থেকে সাদার পথেই যাত্রা করে। ‘অরডেট’ জীবনের সে রহস্যের কথা বলে, যে রহস্যের সন্ধান আমাদের অর্জিত সকল জ্ঞান মিলেও দিতে পারে না। এ সিনেমায় যে পুনরুত্থান দেখানো হয়েছে, তা মূলত অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা, অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের পথে চলা, মৃত্যু সরিয়ে জীবনের আহ্বান। এ মৃত্যু আত্মার মৃত্যু, চেতনার বিনাশ।

গল্পটি ভালোবাসার, সহমর্মিতার, পারিবারিক বন্ধনের, একাগ্রতার এবং বিশ্বাসের গল্প। ডাক্তার ইঙ্গারকে সুস্থ অবস্থায় রেখে যান, এর কিছু সময় পরেই ইঙ্গার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। স্থানীয় যাজক তখন মৃতের জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই ভেবে পরিবারের সবাই মিলে একটা কক্ষে বসে থাকেন। তখন প্রচলিত বিজ্ঞান ও ধর্মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জোহানেস একাগ্র বিশ্বাসে ইঙ্গারকে জীবনের পথে ডাকে, তার সে প্রার্থনা পূর্ণ হয়। এখানে রূপকের আড়ালে মূলত মিরাকলের জয় দেখানো হয়েছে। এ মিরাকলকে কোনো যুক্তি কিংবা প্রচলিত জ্ঞান বা প্রথার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় না। যা কিছু আপাত বিচারে অসম্ভব, তেমন অনেক কিছুই এ পৃথিবীতে ঘটে যায়, সেসব ঘটনা বিজ্ঞান ও ধর্ম সংক্রান্ত কোনো কনসেপ্টেই পড়ে না। ফিল্মের এক ধরনের শক্তি আছে। একটা ভাল ফিল্ম আমাদের যা অনুভব করায়, তা হয়তো পাতার পর পাতা লিখেও বোঝানো সম্ভব নয়। তবে সেক্ষেত্রে সিনেমাদেখার সময় সকল প্রকারের সংস্কারমুক্ত হয়ে সিনেমা দেখতে বসতে হবে। কারণ ফিল্মে যা কিছু ঘটে, তার সব কিছুই যে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার সাথে মিলবে, তেমন নয়। আবার এমনও হতে পারে, ফিল্মের মেসেজটি কোনো রূপকের আড়ালে নিহিত আছে, যা মোটা দাগে বুঝে ফেলা অসম্ভব। সিনেমা আমার মনের মতো হবে না, আমাকেই সিনেমার মতো করে ভাবতে শিখতে হবে, এর নামই সিনেমাদেখা। কোথায় কী ঘটে চলেছে, তার কতটুকুই-বা আমরা জানি? না জেনেই কোনোকিছুকে ভুল ধরে নিয়ে উড়িয়ে দেয়ার বদভ্যাস নিয়ে ভাল সিনেমা উপভোগ করা যায় না।