স্বস্তিতে বাঁচতে চায় না যারা, তাদেরই সাথে বাঁচা

এক ধরনের মানুষ আছে যারা ঝামেলা আর ঝগড়াঝাঁটি করতে পছন্দ করে। ওরা বেশিদিন ঝগড়া না-করে, ঝামেলা না-বাধিয়ে বাঁচতে পারে না। ওদের চারপাশের মানুষ যদি ওদের সাথে এমন কিছু নাও করে, যার কারণে ঝামেলা তৈরি হতে পারে, তাও ওরা নিজেরাই তেমন কিছুই করে বসে কিংবা তেমন কোনও খারাপ আচরণ করে, যেমন করলে রাগারাগি হয়, ঝগড়া হয়। দরকার হলে ওরা পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করবে, তাও করবেই। ওদের ব্যক্তিগত অভিধানে ‘শান্তিতে বাঁচা’ বা ‘স্বস্তিতে বাঁচা’ বলে কিছু নেই। ওরা একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর ঝামেলা তৈরি করার একটা ইস্যু খোঁজে। ইস্যু না পেলে ইস্যু তৈরি করে, কখনওবা পুরনো কোনও ইস্যুকে উসকে দিয়ে ঝামেলা পাকিয়ে থাকে। কারও মাথা ফাটাতে না-পারলে নিজের মাথা ফাটায়, ঝামেলাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে—এরকমই কিছু একটা করে আরকি! ঝামেলা বড়সড় করতে পারলেই ওদের শান্তি। ওরা বরং স্বস্তিতে থাকতেই অস্বস্তি অনুভব করে। কারও না কারও, একটা যা হোক, ক্ষতি করে তবেই ওরা শান্ত হয়। অন্যকে কষ্ট পেতে দেখলে ওরা আনন্দ পায়। এই আনন্দই ওরা চায়। এর জন্য দরকার হলে নিজের সময় নষ্ট করে, কখনও শ্রম ও অর্থের বিনিময়ে হলেও ওরা অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। ওদের টার্গেট থাকে প্রায়ই এমন সব মানুষ, যারা ওদের চেয়ে সামাজিক, মেধাগত ও আর্থিক অবস্থানে এগিয়ে। কখনওবা, ওদের সমসাময়িক কারও পা টেনে ধরে রাখে, যাতে সে সামনের দিকে এগোতে না পারে। অনেক চেষ্টা করেও বা তেমন চেষ্টা করেনি বলে নিজেরা কোথাও পৌঁছতে পারছে না, তাই অন্যকেও সেখানে পোঁছতে দেবে না, এমন একটা ভাবনা ওদের মাথায় অবিরাম কাজ করে। বড় অবস্থানের সবাইকেই ওরা তেমন কোনও কারণ ছাড়াই ঘৃণা করতে পারে। ওরা যেন ঘৃণাকরার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে! এমনও হয়, ওরা ঘৃণা করার যুক্তি হিসেবে উদ্ভট কিছু কারণ তৈরি করে, এবং সে-ঘৃণাটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিরলসভাবে সময় ব্যয় করতে ভালোবাসে। ওরা লুজার প্রকৃতির মানুষ, ওদের বন্ধুবান্ধবও বেশি। জগতে লুজাররা সব সময়ই দলে ভারী।

আরেক ধরনের মানুষ আছে, যারা অল্পতেই রেগেমেগে ভাংচুর শুরু করে দেয়, সামান্য একটা বিষয়কে অযথাই টেনে-টেনে বড় করে ফেলে। লাগামহীন অসংগত ভাষা আর কথার রাজ্যে প্রায়ই ভেসে যায় ইচ্ছে করেই। ওরা আসলে দুর্বল চিত্তের মানুষ। নিজের দুর্বলতা ঢাকতে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি শুরু করে। এটা অনেক পুরনো ও অব্যর্থ টেকনিক। সবল মানুষের মুখের চেয়ে মস্তিষ্কের ক্ষমতা সাধারণত বেশি। অতএব, ওদের ওরকম হাঙ্গামা দেখলে সবল মানুষরা চুপ হয়ে যায়, দূরে সরে থাকে। তখন ওই দুর্বল মানুষগুলি ভাবে, এতেই ওদের জয়! এমন সহজলব্ধ সাফল্যকে ধরে রাখতে ওরা পরবর্তী সময়েও এরকম ভাংচুর আর হইচইয়ের রাস্তাই অনুসরণ করে। নগদ লাভের আশায় নিজেদের অথর্ব ও ইতর করে রাখতেও ওদের কোনও আপত্তি নেই। ওরা নিজেদের এমন একটা পর্যায়ে নামিয়ে ফেলতে পারে, সেখানেই থেকে যেতে পারে অনন্তকাল—যা ভাবতেও ঘেন্না হয়। ওদের চ্যাঁচামেচি শুনে বাকিরা চুপ করে আছে, সন্ত্রস্ত আর তটস্থ হয়ে আছে, এটা দেখে ওরা এক ধরনের আনন্দ পায়। যদি এমন কেউ হয় কাছের মানুষ, যাকে ফেলেও দেওয়া যায় না, আবার সহ্যও করা যায় না, তবে এমন পরিস্থিতিতে বাঁচতে হওয়ার চেয়ে বড় অসহায়ত্ব আর হয় না। ওদের প্রতি ক্রোধ ও করুণা জন্মে, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে নীরবে মেনে-নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর কিছু না কিছু ভাংচুর করতে না পারলে ওদের হাত চুলকায় হয়তো! নির্মম বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আমরা কিছু মানুষের হাত ভেঙে দিতে পারি না বলে ওরা ধরেই নেয়, ওদের হাতের শক্তি বুঝি অনেক বেশি! কখনওবা, ওরা ভেবে বসে থাকে, আজ যে-করেই হোক, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করেই ছাড়বে, নয়তো পৃথিবীসুদ্ধ ভেঙেচুরে তছনছ করে দেবে। ওদের এমন ক্রোধের হাত থেকে বাঁচতে সবাই ওদের জিতিয়ে দিয়ে শান্ত রাখে। এটা মেনে নেওয়া যে কী যন্ত্রণার, একমাত্র ভুক্তভোগীই তা জানে। ওরা ভাবে, ওরাই সর্বজ্ঞানী, ওদের সিদ্ধান্তই ঠিক, এবং ওদের সিদ্ধান্তই গোটা পৃথিবীর মানুষ মেনে চলতে বাধ্য! ওরা ‘যত মত, তত পথ’ নীতিতে চলে না। ওদের বিশ্বাস: একটাই মত, একটাই পথ। সে-মত ওদের, সে-পথ ওদের। সবাইকে সে-মতে, সে-পথে চলতেই হবে! যারা চলবে না, ওরা খারাপ, ওদের সব কিছুই ভুল। এই অসুস্থ লোকগুলি যদি দেখে, কেউ একজন তাকে মানছে না, তবে ধরে নেয়, সেটা অবশ্যই ওই লোকটারই ভুল এবং সেই মুহূর্তেই গিয়ে সে অপরাধে তাকে পিটিয়ে আসা দরকার, এমনকী, মেরেও ফেলা যায়! ওরা এরকম করেই ভাবে! ওদের চোখে, একমাত্র ওরাই ঠিক, বাকিরা সবাই ভুল। ওরাই সব বোঝে, বাকিরা ঘাস চিবোয়। অন্য মতের প্রতি বিন্দুমাত্রও সহনশীলতা নেই ওদের!

আরেকটি অতি-ভয়াবহ জিনিস হচ্ছে সন্দেহ, সব সময় ছোটো-বড় সব বিষয়েই নিরর্থক সন্দেহ করে কেউ-কেউ। অন্যকে সন্দেহ করে বেঁচে-থাকাই ওদের একমাত্র কাজ। ওরা সারাক্ষণই লোকের খুঁত খুঁজতে থাকে, দড়ি দেখলেও সাপ ভাবে, কাউকে ঘুমাতে দেখলে মৃত ভাবে। কেউ গলা পরিষ্কার করতে কাশলেও ভাবে, নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনও না কোনও কারণ আছে। ওদের দিকে তাকাতেও লোকে ভয় করে, কী না কী ভেবে বসে! ওদের সামনে সবাই অনেকটা ভয়েই থাকে, স্বাভাবিক হয়ে থাকতে পারে না। ওদের সাথে সহজভাবে চলা সম্ভব নয়। প্রায়ই অভিনয় করে চলতে হয়, অস্বস্তি নিয়েই বাঁচতে হয়, একেবারেই নির্দোষ কাজটিও সাবলীল মনে করা যায় না। ওদের সাথে চললে অহেতুকই নিজের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি হয়ে যায়। ওরা একজনের সম্পর্কে অন্যজনকে নেতিবাচকভাবে বলে। যদি কেউ ওদের সন্দেহের তালিকায় থাকে, তবে তার সম্পর্কে ভালো কথা বলে যারা, তাদের ওরা পছন্দ করে না। ওদের মতোই খুঁত খুঁজে-খুঁজে ও সন্দেহ করে বাঁচে যারা, তাদের সাথেই ওদের বন্ধুত্ব সবচাইতে বেশি। এই ধরনের মানুষ ভেবেই নেয়, পৃথিবীসুদ্ধ সবাই সুযোগ পেলেই চরিত্রহীন। শুধু সে নিজেই চরিত্রবান, নিজের সব কিছুই ভালো। এ পৃথিবীতে মাত্র একটুকরাই নিখুঁত মানুষ তৈরি করা হয়েছে, সে-মানুষটি সে নিজে। অবিশ্বাস্য রকমের দুর্ব্যবহার করতে জানে ওরা। ওরা কখনওই নিজেদের পিঠের দাগটা দেখে না, কেবল অন্যের পিঠের দাগ খুঁজে বেড়ায়। ওরা ভাবে, বিভিন্ন উপায়ে অন্যকে ধোঁকা দেওয়া যায়, এবং ওরা নিজেরা বাদে পৃথিবীর সবাই-ই ধোঁকাবাজ কিসিমের। অবশ্য, অন্যকে ধোঁকা দেওয়ার সে-উপায়গুলি কেবল ওরাই ভালো জানে! ওরা মানুষকে জোর করে বেঁধে রাখতে পছন্দ করে। ওরা মানতেই চায় না যে, কাউকে আসলে জোর করে বেঁধে রাখা যায় না। যদি যায়ও, তার পক্ষে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ হয়ে বেঁচে-থাকা সম্ভব নয়। এমনি করে কাউকে দিনের পর দিন অস্বস্তি ও কষ্ট নিয়ে বাঁচতে বাধ্য করা এক ধরনের পাপ। এই পাপে ওদের কোনও আপত্তিই নেই! চোখের শাসনে, মুখের বাজে কথায়, উদ্ধত আচরণে, যে-কোনও উপায়ে ঝামেলা বাধিয়ে বা লোক জড়ো করে অন্যকে অপদস্থ করতে ওরা ওস্তাদ। ভদ্র ও নির্ঝঞ্ঝাট গোছের লোকজনই ওদের খপ্পরে বেশি পড়ে। মানসম্মানের ভয়ে, ঝামেলা এড়াতে ওদের কাছে সবাই কাবু হয়ে থাকে। ওদের সাথে কথাবলার সময়, যা নিয়ে মিথ্যেবলার কিছুই নেই, তা নিয়েও মুখে মিথ্যে চলে আসে, অনেক বাড়তি ও এলোমেলো কথা ঠোঁটে খেলা করে। তখন ওদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। এ এক ভয়ংকর রোগ—রোগী ও রোগীর আশেপাশের সবাই এ রোগের যন্ত্রণাভোগ করে! ওরা হয়তো ভাবে, বেঁধে-রাখাই নিয়ম অথবা এভাবেই মানুষ ভালো থাকে। এবং বেঁধে রাখার জন্য যেখানে-যেখানে কলকাঠি নাড়া দরকার, যে-সকল কৌশল খাটাতে হয়, টার্গেটকে যতটা মানসিক নির্যাতন করতে হয়, এবং আরও যা-যা করতে হয়, তার সব কিছুই ওরা করে থাকে। এর জন্য যতটা নিচে নামতে হয়, ততটা বা তার চেয়ে বেশি নামতেও ওরা তৈরি থাকে। প্রয়োজনে অন্যদের ব্যাপারে বানিয়ে-বানিয়ে মিথ্যে বলতে ও তা ছড়াতে ওদের বিবেকে একটুও বাধে না। কিছু মানুষ সন্দেহ করে বাঁচে ও কিছু মানুষকে সন্দেহ সহ্য করে বাঁচতে হয়। দুই ধরনের মানুষই সত্যি খুব দুঃখী। প্রায় সময়ই ওদের মরে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কিছু পিছুটানের কারণে ওরা মরতেও পারে না!

এই তিনটি অভ্যাসই যখন মাত্রার বাইরে চলে যায়, তখন আর একে স্বাভাবিক বলা চলে না। তখন এটি হয়ে যায় ফোবিয়া অথবা রোগ। যে-কোনও মাত্রাতিরিক্ত জিনিসই ফোবিয়া। যখন কোনও কিছু ফোবিয়ার পর্যায়ে চলে যায়, তখন এর নিরাময় হওয়া দরকার। সে-জন্য তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ (কাউন্সেলিং) প্রয়োজন। আমি যতটা বুঝতে পারি, একজন সুস্থ আর একজন অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনও একসাথে মিলিয়ে চলতে পারে না। যদি চলতেই হয়, সেক্ষেত্রে অসুস্থ মানুষটির চিকিৎসা করা দরকার, নয়তো সুস্থ মানুষটির অসুস্থ হয়ে যেতে হবে। একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ চাইলেও পৃথিবীর সব অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকে এড়িয়ে চলতে পারে না। সমাজের, অভ্যাসের, সংস্কারের, পরিবারের, সম্পর্কের চাপে আর দায়ে আটকা পড়ে, যত কষ্টই হোক, কোনওভাবেই কেবলই নিজের পছন্দে—আমি কার-কার সাথে চলব না—তা ঠিক করা যায় না। অগত্যা নিজের অস্তিত্বের প্রতি ক্ষোভ আর ধিক্কার জিইয়ে রেখে বাঁচতে হয়। এছাড়া আর উপায়ই-বা কী! দুজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ অথবা দুজন অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ একসাথে থাকতে পারে, কিন্তু একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ আর একজন অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনও একসাথে থাকতে পারে কি? এটা সম্ভব আদৌ? তবু অনেক জীবনই এমন অবস্থার মধ্যেও টিকে থাকে কোনওমতে। সমাজের সামনে চক্ষুলজ্জার কারণে হোক; পারিবারিক ঝামেলা এড়াতে হোক; কোনও একটা বন্ধন বা অভ্যাস ভেঙে ফেললে তখন কী হবে, এমন কোনও ভাবনা থেকে ‘অনিশ্চয়তা ঠেকাতে’ হোক; কিংবা চলছে, চলুক না, দেখাই যাক না…কী হয়, এমন কোনও আয়েশ বা আলসেমির ফলে হোক—অনেক সম্পর্কই এভাবে টিকে আছে। এক পক্ষ কষ্ট পেয়েই যাচ্ছে, আর এক পক্ষ কষ্ট দিয়েই যাচ্ছে। সবাই দেখছে, ওরা হাসছে, ওরা ভালো আছে। আসলে ওরা ভালো নেই। এটা ওরা কারও সাথে শেয়ার করতেও পারে না, ফলে কষ্ট আর চাপাকান্না আরও বাড়তে থাকে। ওদের মধ্যকার সম্পর্কটা সুস্থ নয়, ওটা টিকে আছে স্রেফ কিছু অভ্যাস, কিছু যাপন, কিছু ভয়ের কারণে। পাশাপাশি থেকে যে দূরত্বটা ওরা তৈরি করে রেখেছে, তা ওদের ভালো থাকতে দিচ্ছে না। এটা ক্যানসারের মতো, দিনের পর দিন বেড়েই চলে। এ ক্যানসারের কোনও কেমোথেরাপি হয় না, কেননা এর প্রতিকারের জন্য কেউ খুব একটা চেষ্টাই করে না। পাছে জানাজানি হয়, আরও কিছু ঝামেলা তৈরি হয়, নতুন জীবন না-জানি কেমন নয়—এরকম হাজারো সংশয় ও পিছুটানের কারণে দুজন মানুষ একটা অস্বস্তিকর সম্পর্ককে বয়ে নিয়ে মৃত্যুর দিকে পরস্পরের হাত ধরে হাঁটতে থাকে।

Content Protection by DMCA.com