মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে বেঁচেথাকার কষ্ট তুমি বুঝবে না,
তুমি তো বিশ্বাস করে মরে বেঁচেই গেছো!
ওরা বিশ্বাস ভেঙে কেমন হাসিমুখে বেঁচে থাকে!
বিশ্বাস ভাঙতে জানতে হয়, সবাই তা পারে না।
যাওয়ার সময় বলেছিলে, অন্তত অবিশ্বাসটুকু যত্নে রেখো। পারিনি।
এ শহর ছেড়ে যেতে পারি না তাই আমাকে বিশ্বাস করেই বাঁচতে হয়।
এ শহরে আজ খুঁড়িয়ে ওড়ে মনকেমনের মেঘ,
প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন মানুষটির পক্ষেও সবচাইতে সহজ সংলাপটি পর্যন্ত মনে রাখা দায়!
আমার কলম কিংবা কণ্ঠ একটিও শব্দ প্রসব করে না আর।
যে ইচ্ছেটি লেগে থাকে সব স্টেশনের গায়ে,
সে ইচ্ছের স্বাধীনতা আজ এমনিই পেয়ে বসে।
ইচ্ছে কিছু ঝুলে থাকে কম্পার্টমেন্টের চেইনগুলি ধরে---অযথা টানবে তো পেনাল্টি!
একই যুদ্ধ অনন্তকাল চললে সেটা আর যুদ্ধ থাকে না।
তবু চলে। না ছাড়ার যুদ্ধ, না হারাবার যুদ্ধ.........
অথচ সবই যায়, সবাই যায়........
আমি জীবন দেখে যুদ্ধ ভাবি, যুদ্ধ দেখে জীবন ভাবি।
এ পুরনো সৈকত ফেরাতে জানে না।
এরই মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে একএকটি স্টেশন।
সদ্য বয়ঃপ্রাপ্ত সৈনিকের মর্মান্তিক জীবন দেখি।
আজ ওদের রেজিমেন্টে লালে মিশে গেছে নীল,
তাই রংচেনা বড় মুশকিল।
আমাদের চেতনা তবু প্রস্তুতির তাড়া দেয়, নাড়া নেয়।
আহা, আস্ত ইতিহাসকে উপড়ে এনে কেউ যেন একটা ছবি আঁকলেন!
আমরা তখন খুশি হয়ে উঠি, তালি বাজাই!
এবার বুঝি আলাদা করে আলাদা মানুষ চেনা যাবে!
গত শতকে চলতে শুরুকরা থামাট্রেনটি আবারও যখন একইভাবে এসে থামে আগের জায়গাতেই,
আমাদের মন তখন ঘুমভেঙে চোখ মেলে তাকায়।
আমরা হুড়মুড় করে উঠে পড়ি, অমনিই
সে ট্রেন আমাদের নিয়ে চলে সাকির ধূসর বৈঠক থেকে কৃষকের স্নিগ্ধ জমিতে।
আমরা দেখি, অচেনা সব মানুষের শরীরে সৈনিকের কড়া পোশাক।
ওরা সীমান্তের প্রহরী যে! প্রহরায় নামলে পোশাক লাগে---একটু কড়া!
শোনা যায়, তোমার কল্পলোক নাকি দিব্যলোকের কিনারা ঘেঁষে?
জানি, আমার জানতে নেই; আমি জানবোও না।
তোমার ধোঁয়াশার মত হাত, পেঁজাতুলোর মত ওড়া চোখ,
আমার ভুলতে নেই, আমি ভুলবো না।
আজও সোফিয়া লরেনের সানফ্লাওয়ার-এর রঙ লেগে থাকে আমার হাতে,
আমি তাই ছবি লিখে বাঁচি। একটা সময় পর অবন ঠাকুরের ভূত মানুষ হয়ে যায়!
আমরা যারা জীবনের ভার ফেলে এখনও পালাতে পারিনি,
সবাই কি জীবিত? জীবিত মানে কেবলই জ্যান্ত?
ওই চড়ুইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখো, জীবন বুঝবে।
কিংবা নিদেনপক্ষে সদ্যপ্রয়াত তারুণ্যের দোলনায় ছেড়েআসা
শঙ্খসুনীলের মার্গারিটের চোখে চোখ রেখে হিসেব করে বলো।
ওকে নিয়ে বরাবরই লিখতে চেয়েছি,
কিন্তু কবেই বা পেরেছি কিছু লিখতে!
জানালার স্বচ্ছ কাঁচের শার্সির ওপারে যে মেয়েটি
সম্পূর্ণ বরফমাখা এক শহরের মৃত চোখে জ্যান্ত স্বপ্ন এঁকে দিত,
সেও কেন মাত্র আটাশেই হারিয়ে যাবে?
একরাশ খিদের কবিতা দেখে যে ভীতু অক্ষম ঈশ্বর বাতাসের আড়ালে লুকিয়ে
ভাবেন, কোথাও কিচ্ছুটি হচ্ছে না, জগতের সকল প্রাণী মঙ্গললাভ করুক নিজেদেরই নিয়মে,
তাঁর কাছে এর উত্তর চেয়ো না।
যত প্রবোধই মানো না কেন, দিনের শেষে অন্ধ রাজা অন্ধই থেকে যায়!
সুনীল কোনও আকাশে আজও মার্গারিট হাসে।
সুনীলও কী খেদে হেসে ফেলে নীল দুঃসময়ে.........মার্গারিটের যে বেঁচেথাকার কথা ছিল!
শঙ্খ আজও ভেবে পায় না, ছবি আর টুকরোটুকরো লেখারা কি তবে মেঘ হয়েই আসে এদেশে!
এখানে কেন! এখনও কেন! এভাবে কেন!
চৈত্রের দাবদাহ আর টের পাওয়া যায় না অতো,
বরফের কুচি শুভ্রকণা হাওয়ায় মেঘ সরিয়ে গড়িয়ে পড়ে নানান জীবনে---
নিখোঁজ অল্পবয়েসি অবুঝ ছেলেদের জীবনে বা শুকনো স্টেশনের সেই পাহারাদার লোকটির জীবনে!
খাবার হাতছানি দেয় পেটকে, তবু শরীর থামে, পা মেলায় সাথে,
অবশেষে মিলায় একে অপরের পরে গভীর কী এক তৃপ্তিতে!
তবে যদি মনতরী ডাক পায় অচিনঘাটের অধীর পাটনির হাতছানির,
তখন কি পারে মিলতে একে অপরেতে?
জীবনের কত গল্প বহু বছরের জন্য মনে গেঁথে যায়, হাঁটু ভাঙে, যেমনি---
খিদে থাকেই, আকাশে মেঘ থাকেই, উঠোনে রোদ থাকেই, কষ্ট থাকেই।
জীবন যেন কিছু ই-প্রত্যয়ে আটকে গেছে!
পাখিরা খড়কুটো ঠোঁটে গাছে বাসা বাঁধবে,
কেউবা ভেড়ার মাংস কব্জি ডুবিয়ে খাবে,
হুইস্কির গ্লাসে লেবুর ফালি ভাসবে---তাতে স্পর্শ এসে বিঁধবে গোলাপি কোনও অভিমানী জিভের,
যে জিভ আরেক জিভের দেখা পায়নি বহু শতাব্দী হল!
চারদিকের ঝিরিঝিরি লোনা আলোর ঝালরে কাগুজে ভাঁজে শিল্পিত ছুরির বিস্ময় আর খুনে মাখনের সুগন্ধি একেবারে মাখামাখি যেন!
সে রেস্তরাঁর বাইরে বড় একটা ডাস্টবিন রাখা আছে।
তার গা ঘেঁষে কিছু মোজার্ট লাল হয়ে আছে, কিছু পিকাসো নীল হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।
রেস্তরাঁর লাগোয়া রাস্তাটার ওই সাইডে ম্যাপল গাছদের ছায়ায় যে ছোট্ট বাড়িটা,
সেই বাড়ির একটা ঘরে বসে হেমন্তের শেষ দিনটায় কবি অ্যাটউড্ লিখে ফেলেছিলেন,
বাঁচতে হলে ভালোবাসাই যথেষ্ট!
.........আমরা কখনও অতোটা নিশ্চিত নির্ভার হতে পারিনি।
আমাদের ভালোবাসা বরাবরই বড্ড গোলমেলে। অতো গোলমেলে মাল গলায় ঝুলিয়ে নিশ্চিন্তে বাঁচা যায় কি?
আমরা কবি নই। আমরা ভাবি ক্ষিধের কথাও।
ধনী দেশগুলোয় হররোজ বাড়তি খাবার বাইরের ডাস্টবিন ভরায়,
রাতের শেষ বাসটার আলো নেভার পর ওখানে একটা কাড়াকাড়ি চলে সমাজতন্ত্রের কিছু জারজ সন্তানের।
কে আগে নিতে পারবে টাটকা পার্মেজ্যানের অপেক্ষাকৃত তাজা স্যান্ডউইচটি!
ক্ষিধে মার্ক্সইজম বোঝে না। সে বড্ড বেয়াড়া, সব জায়গায়ই বিশ্রীভাবে থাবা বসায়.........
বড়লোকদের দেশে আমাদের মতন কিছু ছোটলোকও থাকে কিনা!
ডাস্টবিনকে অন্নের দেবতা বানিয়ে জীবন কেটে যায় অনেক মানুষের; হয়ত কষ্টেই, তবু কাটে তো!
ওদের ধর্ম নেই, খিদে আছে। ওদের ঈশ্বর নেই, ডাস্টবিন আছে।
ধর্মবার এলে সেইসব সুখী দেশের অনেক মানুষের জামা, সোয়েটারও মিলে যায়---গির্জায়।
আমাদের ছোট শহরের দুঃখী মানুষগুলো কখনও আকাশঢাকা বাড়ির মাথায় ম্যাজিকওয়ান্ড দেখেনি,
এদের ঘরে দিনের আগেই রাত নেমে যায়, হাঁড়ির তলায় ভাতের বদলে জল পোড়ে।
ছেলেটার সাথে মেয়েটাও নির্ঘুম খেটেখেটে অকালেই কেমন বুড়ো হয়ে যায়!
আমাদের কোনও রবিন হুড নেই, আমাদের কেবল ডাকাত আছে।
আমাদের খিদে কেবলই একরোখা হয়ে বাড়ে।
ফুরফুরে কোনও দিনের আলোতেও আমরা কোনও সংলাপ মনে রাখতে পারি না।
আমাদের অভিধানে সুখের জন্য আর একটাও শব্দ অবশিষ্ট নেই!
সাদা আলোর মাঝে অথর্ব কিছু কালো অক্ষর কলঙ্কের মত জ্বলে,
যে তালার এখনও চাবি হয়নি, সে দুর্লভ চাবিওয়ালা কোনও শুনশান রাস্তায় রাখালের বাঁশির পথ ধরে ছুটছেই তো ছুটছে!
পাহাড়ি হাওয়ায় উড়ছে যখন সুর, সাইডটেবিলের সুরায় আঙুলের ডগা ভিজিয়ে নিচ্ছে প্রমিজিং কোনও আণ্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ডের গিটারিস্ট,
তখন কিছু নরোম আঙুলের সারি প্রতীক্ষায় থাকে কবে ওদের যাদুতে একরত্তি কর্ড হতে বেপরোয়া সব শব্দ বেরোবে ক্রমাগত, যেমনি ঝর্ণা ঝরায় জলের শিশু......
কোথাও রূপকথা ছুঁয়ে হাওয়ার হাল্কা রথটা ফাঁকিটাকি মেরে ঠিক উড়ে যায়,
ঘুমন্ত শিশু নিয়ে পরিচারিকা উড়ে যায় যেমন; আর উদাসীন গৃহকর্ত্রী অসময়ে বিবশ হয়ে যায়।
কে বলে চারপাশের এই চলমান শহরই আসলে সেই থিয়েটার নয়, যেখানে
উড়ন্ত সব পরিসর ক্রমেই ঢুকে পরে স্থবির এক অস্তিত্বে; ওতে সুর আছে, হয়তবা মৃদু স্বরও,
আর যা আছে, তা ভাবনার বিষয়; অবশ্য, ভাবলে তবেই!
ঘুমোলে টের পাই, এমন প্রাণোচ্ছল জীবনলেখ্যর সাথে সকল আলেখ্য যেন প্রতি তুলনায় বিপরীত হাওয়ায় ভেসে যায়.........
জাগতেই দেখি, কোথাও কোনও প্রাণের স্পন্দন নেই যেন.........তবে এ শহরে কি আজ হরতাল!
ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলি! ভাবি, একটিই তো রাত, উপোস করেও দিব্যি কেটে যাবে! বৃথাই তাকে নিয়ে এতো শংকা কীসের?
কী জানি! সময়ই হয়ত উত্তর দেবে।