এই যে এইমাত্র যে-মেয়েটি আমাদের পাশ দিয়ে তীব্র বিলিতি সেন্টের (হয়তোবা মেইড-ইন-জিঞ্জিরা) গন্ধ ছড়িয়ে চলে গেল, তার দিকে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইলাম। ষোড়শী যুবতী, দেহে লাবণ্য, মুখে অকারণে হাসি হাসি ভাব, দেহের প্রতিটি পরতে পরতে যেন আধুনিক কবিতার গতিময় ছন্দ।
আহামরি রূপ! চোখ ফেরানো যায় না। দৃষ্টিটা আস্তে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যখন আর ঘাড় বাঁকাতে পারলুম না, তখন অগত্যা তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে হলো। পাশে দাঁড়ানো বন্ধুটি বিজ্ঞের মতো মন্তব্য ছুড়ল।
: নিশ্চয়ই মেয়েটি অর্থনীতির ছাত্রী।
আমি অবাক হলাম।
: তুই জানলি কী করে? তোর পরিচিতা অথবা ইয়ে-টিয়ে জাতীয় কেউ নাকি রে?
বন্ধুটি সহাস্যে আমার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলে চলল।
: তুই আস্ত একটা গাধা!
আমি বেকুব বনে গেলাম।
: আমি তো প্রায় বিশ-বাইশ বছর যাবৎ মানুষ নামেই পরিচিত। তুই আমাকে এই এ সময় একটা গাধা বানিয়ে ছাড়লি? আসলে ব্যাপারটা কী?
বন্ধুটি স্মিত হেসে উত্তর দিল।
: ওর ব্লাউজের অর্থনীতির নীতি অনুসারে কাটিং দেখেও বুঝিসনি?
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে?
প্রত্যুত্তরে বন্ধু আবারও মুখ খুলল।
: আর-একবার তাকা মেয়েটির দিকে। দ্যাখ্, ওর পোশাকের বিন্যাস। ডানাকাটা ব্লাউজটা ওর দেহের প্রতিটি রেখাকে সুষ্পষ্ট করে তুলেছে। ব্লাউজের গলাটা ‘ভি’ সাইজে কাটা। গলার সামনে এবং পেছনে অন্তত একর-দুই পরিমাণ খালি। ওর ব্লাউজের প্রশস্ততা কমানোর চেষ্টা তোর ডিগ্রি বাগানোর পরিশ্রমের চেয়ে ঢের চিন্তাব্যঞ্জক। আর ব্লাউজের কাপড়ের মোটা-পাতলার কথা বলছিস? মেয়েটি খাসা বাঙালি ঘরের মেয়ে। পাবনা হ্যান্ডলুমের কথা শুনেছিস না? যত পাতলা, তত সস্তা। এদিক থেকেও মেয়েটি বাপের পয়সা বাঁচিয়েছে অনেক। সস্তায় পাবনা হ্যান্ডলুমই সে কিনেছে। পায়ের দিকে তাকা। এভারেস্ট না হলেও কাঞ্চনজঙ্ঘার সমান হবে ওর স্যান্ডেলের হিলটা। অন্ততপক্ষে বছর বিশেক রোকেয়া হল থেকে নিউমার্কেটে নিয়মিত আসা-যাওয়া করার পর ওর স্যান্ডেলটা নষ্ট হতে পারে। কাজেই এতেও ওর স্বভাবের মিতব্যয়িতাই প্রমাণিত হচ্ছে। আর শাড়িটা দেখেছিস? আমার মনে হচ্ছে, বৃটিশ শাসনামলে বুড়োআঙুল-কাটা তাঁতীদের আঙুলগুলো আবার গজিয়েছে, আর তারা আবার তাই সেরকম মসলিন তৈরি করা শুরু করেছে। এবার তাকা ওর চুলের দিকে। হলিউড, বোম্বের ঢেউ এদেশের মহিলা ম্যহফিলেও যে এসে লেগেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হেয়ারড্রেসারের সক্রিয় সহযোগিতায় ওর খোঁপাটা তিব্বতের মালভূমির চেয়েও প্রশস্ত হয়েছে। এইবার ওর মুখের দিকে তাকা। প্রশস্ত কপাল, টানাটানা ভুরু, কাজলকালো দুটি মায়াময় চোখ, আপেলের মতো মসৃন রাঙা গাল, মিষ্টি হাসিমাখা একখানা মুখ, আর তার পরে আদর করে দেখবার মতো একটি চিবুক। গলাটা নিভাঁজ হয়ে নেমে এসে সামনের দিকে কী সুন্দরভাবে বেঁকে গেছে!
আমি সম্মোহিতের মতো শুনছিলাম।
বন্ধুটি আবার বলতে শুরু করল, “ওর শাড়ি পরাটা দেখেছিস? কোমরের শাড়ির আর বুকের ব্লাউজের মধ্যে টেকনাফ-তেঁতুলিয়া মতন তফাত রয়েছে।” তারপর কানের কাছে মুখ এনে এবার আস্তে করে বলল, আর ওর পেছনের দিকে দেখেছিস?
আমার কণ্ঠে ঈষৎ উচ্ছ্বাস।
: হ্যাঁ হ্যাঁ, ওর নিতম্বটা…মানে...
: আরে, থাম্!
বন্ধুটি পথিমধ্যে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে চলল।
: আরও পেছনে দেখেছিস?
: না তো!
...আমি সবিস্ময়ে উত্তর দিই।
...আমি সবিস্ময়ে উত্তর দিই।
বন্ধুটি এবার শুধোল…
: ওর পেছনে একটা ছেলেকে দেখিসনি?
আমি আঁতকে উঠে বললাম…
: ছেলে? ওর ভাই-টাই নয় তো?
জবাব দিল বন্ধুটি।
: দেখে তো মনে হচ্ছে, প্রেমিক-টেমিকই হবে।
আমার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। বিরস মুখে কোনোমতে ঢোক গিলে বললাম: ওহ্!
বন্ধুটি সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল।
: কী রে, অমন চুপসে গেলি কেন?
আমি বিব্রতবোধ করলাম। কোনো জবাব দিলাম না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম, চল, অনেক রাত হয়েছে। কাল আবার সকাল ৮টা থেকে ক্লাস!