লোকে প্যাঁচা বা কাককে খাঁচায় আটকে রাখে না, ময়না-টিয়াকে খাঁচায় আটকায়। বাহুশক্তির বলে সৌন্দর্যের হানি ঘটিয়ে সুন্দরকে অসুন্দর করে দেবার মধ্যেই লোকের যত আনন্দ। লোকে তার উপরেই থুতু ছিটিয়ে সুখ অনুভব করে, যার থুতুর ফেনার সমান যোগ্যতাটুকুও লোকের নেই। যারা স্রষ্টার প্রিয়, তাদেরকে স্রষ্টার অপ্রিয় মানুষগুলি ক্রমাগত আঘাত করে যায়। যে-হৃদয় স্বচ্ছ জলের মতো টলটলে, লোকে অমন হৃদয় নোংরা করে আনন্দ পায়। এমন যুক্তিহীন অহেতুক আচরণ মানুষকে কদর্য পৃথিবীর নিষ্ঠুরতাকে সহজভাবে নিতে শেখায়, সেই নিষ্ঠুরতায় বাঁচার দীক্ষা দেয়।
হাসিমুখে নীরবতাকে সঙ্গী করে অযাচিত কষ্ট সহ্য করার মাধ্যমে মানুষ শক্তিশালী হয়। সে পথই শুদ্ধ পথ, যে-পথ মানুষকে নিকষিত করে। অতিচতুরতা বা অতিপাণ্ডিত্য দিয়ে মানুষ জীবনে কিছু করতে পারে না। জীবনে কিছু করতে চাইলে প্রথমেই শুদ্ধ পথের অনুসন্ধান করতে হবে। সংকটময় মুহূর্তে লোকে সৎবুদ্ধি দিতে পারুক না পারুক, অর্থহীন কথার তীর ঠিকই ছুঁড়তে পারে। কথার ওজন যে যত কম বোঝে, সে তত বেশি নির্বোধের মতো কথা বলে। এমন কথায় প্রভাবিত হওয়াটা সহজ। এতে সমস্যা না কমে বরং বাড়তে থাকে। ওই সময় নীরবতা মানুষকে সুবুদ্ধি দিতে পারে। শান্ত হৃদয় অলৌকিকভাবে সংকট থেকে উত্তরণের উপায় বলে দেয়।
প্রচণ্ড কোলাহল, সংঘাত, বিক্ষোভ, কিংবা অরাজকতা যা-ই থাকুক না কেন, নিজেকে শান্ত রেখে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। যতটুকু সম্ভব, সবার সাথে সদ্ভাব রেখে কাউকে আহত না করে সময়টাকে কাটতে দিতে হবে। অন্যদের কথা যতই বিরক্তিকর কিংবা অযৌক্তিক শোনাক না কেন, স্থির হয়ে তা শুনতে হবে। এরপর ঠান্ডা মাথায় বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে, কারও কথারই কোনো প্রত্যুত্তর দেওয়া যাবে না।
নীরব পরিবেশে মনটাকে স্থির করে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে থাকলে আমাদের স্বজ্ঞা বৃদ্ধি পায় এবং এর সাথে আমাদের বুদ্ধিমত্তা ও কাণ্ডজ্ঞান অসীম মাত্রায় কাজ করে। আমাদের মন সকল কষ্ট ও দুর্দশার ভার বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, মনকে আমরা সান্ত্বনা দিই—সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের মন যা, আমরা মূলত তা-ই। আমাদের মনই আমাদের পরিচালিত করে, মন ভেঙে গেলে মন শান্তি খুঁজে বেড়ায়, মনের অদ্ভুত সব রসায়নেই আমরা ভালোবাসি কিংবা ঘৃণা করি। আমাদের অবয়ব আমাদের সম্পর্কে একটা মিথ্যে ধারণা দেয়, লোকে আমাদের দেখলে যা দেখে বলে ভাবে, আসলে আমরা ওরকম নই। লোকে যদি আমাদের মনটা দেখতে পেত, আমাদের মনের ভেতরে কী চলছে তা বুঝতে পারত, তবে আমরা আসলে কী, তা লোকে ধরে ফেলত। মনকে আমরা যেমন করে সাজাই, আমাদের ঠিক তেমন করেই ভাবি, কাজ করি। মনের ক্ষমতাই আমাদের সকল ক্ষমতার পরিমাণ ও প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। যখনই মন ভালোবাসায় পূর্ণ হয়, তখন মনের ক্ষমতা বেড়ে যায়।
আমাদের যা করতে হবে, যদি তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা কাজ করে, তবে তা করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো ক্লান্তি বা একঘেয়েমি কাজ করে না। কাজটাকে বোঝা মনে হয় না, ফলে কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। কাজের প্রতি সততা আর একাগ্রতা থাকে, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজটা এমন আশ্চর্য পূর্ণতায় করা যায় যে, আমরা মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও সেই কাজের জন্য যুগের পর যুগ সবাই আমাদের মনে রাখে।