কী-একটা কাজে বাইরের ঘরে আসতেই জানালার কাছে শেখরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল কাকলি। সমস্ত শরীরটা জানালায় মেলে বাইরের রাস্তায় তাকিয়ে রয়েছে শেখর। সন্ধের আবছা অন্ধকারে ক্রমশই একটা সিল্যুয়েট হয়ে উঠছে ওর চেহারাটা।
: কী ব্যাপার, এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?
আলোর সুইচে হাত ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করে কাকলি। সমস্ত মুখে বিস্ময় ক্রমশ জমাট বাঁধছে ওর।
: এমনি।
রাস্তার দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই উত্তর দেয় শেখর। ওর এই সংক্ষিপ্ত উত্তরে মোটেই খুশি হতে পারে না সে। ফের জিজ্ঞেস করে।
: কী বললেন, কালাবাবু? ম্যানুস্ক্রিপ্ট পছন্দ হয়েছে?
‘কালোবাবু’ নামটা কানে আসতেই মুখটা তেতো হয়ে ওঠে শেখরের। একরাশ ঘৃণা ঝর্নার মতো বয়ে যায় বুকের ভেতর দিয়ে। কালোবাবুর কাছে সন্ধ্যের মুখেই আজ গিয়েছিল শেখর। কালোবরণ সরকার, নিলম পাবলিশার। বইপাড়ায় তাঁকে একনামে সবাই চেনে। ওর ঝকঝকে দোকানে পুজো আর নববর্ষের আগে রীতিমতো কিউ পড়ে লেখকদের!
এমনিতে সবসময় লোকটার মুখ হাসিতে মাখামাখি থাকে। আতার বিচির মতো পানের রসের ছোপ-খাওয়া দাঁতগুলো পুরু ঠোঁটের খিল খুলে বাইরে অহরহ উঁকি মারে! সেই সময় কালোর অন্য চেহারা। কর্মচারীরা দোকান সামলায় আর কালো দোতলার ঘরে ধপধপে সাদা টেলিফোনটার সামনে সুইংচেয়ারে দোল খায়। সাতটার পর কালোকে আর খুঁজে পায় না কেউ। এ নিয়ে বইপাড়ায় অন্যান্য পাবলিশারের আড্ডার টেবিলে কেচ্ছা গড়ায়, অথচ কালো কালোই থাকে। এহেন কালোর কাছেই আজ অফিস-ফেরতা গিয়েছিল শেখর।
ওই অঞ্চলটায় লোডশেডিং চলছিল তখন। পেতলের একটা আধন্যাংটো পরি দু-হাতে দুটো ঢাউস মোমবাতি নিয়ে কালোর টেবিল আলো করে দাঁড়িয়েছিল। চেয়ারের পেছনে জাতির জনকের ছবির পাশে ফিলিপস ফ্রিজের ক্যালেন্ডারে শর্টস আর কুর্তা পরা মেয়েটার মুখে আলোআঁধারি খেলা করছিল। একটা কাগজে কীসব হিজিবিজি দাগ কাটছিল কালো। শেখরকে দেখে খলখলে থ্যাবড়া মুখটায় হাসির ঢেউ তুলল। খসখসে আঙুলগুলো দিয়ে কাগজটাকে দুমড়ে বেতের বাক্সে ফেলে দিয়ে আরও একটু আয়েস করে গুছিয়ে বসল।
: বলুন, কী খবর?
চোখ নাচিয়ে শেখরকে জিজ্ঞেস করে কালো।
: আমার উপন্যাসটার জন্য এসেছিলাম। কদ্দুর কী করলেন...
চেয়ার টেনে বসতে বসতে কথাটা শেষ করে না শেখর।
: কোনটা? বলুন তো?
গলায় চর্বির থাক রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করে কালো।
: ওই যে, বৃত্তের বাইরে।
চটপট জবাব দেয় শেখর।
: ধুর মশাই, ওটা কোনো উপন্যাস হয়েছে?
ড্রয়ার থেকে সাদা কাগজের মোড়কটা টেনে বের করে কালো। তারপর শেখরের দিকে এগিয়ে দেয়।
: তার মানে?
আরে মশাই, এ লেখা এখন আর চলে না। পাবলিক এখন অন্য জিনিস চায়, বুঝেছেন?
: আমি ঠিক...
শেখর বুঝে উঠতে পারে না ব্যাপারটা।
: এটা কী লিখেছেন, আঁ? না আছে সেক্স, না আছে ভায়োলেন্স। অন্তত দু-চারটে বেডরুম সিন…
মিটমিট করে হাসে কালো। ওর এক-একটা হাসি এক-একটা থাপ্পড়ের মতো লাগে শেখরের।
: কিন্তু, আমি তো যতটা সম্ভব…
বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে শেখর।
: ধ্যৎ, ও কিন্তু হয়নি। আরও ন্যাচারাল করুন। প্রণীতাকে মনীশের কাছে আরও সারেন্ডার করান। বাংলোয় ওরা দু-জন দু-জনকে…আকাশে মেঘ, প্রচণ্ড বৃষ্টি, নির্জনতা, একটা ডাক…
জিভ দিয়ে চুক করে শব্দ করে কালো। অনেক দিন আগে চিড়িয়াখানায় একটা ভালুককে জিভ চাটতে দেখেছিল শেখর। অবিকল সেই রকম। কালোর দিকে তাকায়। দু-চোখে খাবলে খাওয়ার দৃষ্টি। সে সামনের দিকে হঠাৎ ঝুঁকে আসে। ফিসফিস করে বলল।
: একটা কাজ করুন না, শেখরবাবু। ইলেকশন সামনে। বামপন্থিদের কাছা খুলে লিখুন কিছু। শেখরের নির্বাক মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে ফের বলে চলে কালো।
: ওই মনীশকে এক শ্রমিক নেতা বানিয়ে দিন।
পুলিশের তাড়া খেয়ে প্রণীতা, মানে ওই বেশ্যার ঘরে…
: কিন্তু আমি যে…
শেখর কিছু বলার চেষ্টা করে।
: আঃ, যা বলি শুনুন!
কালো আরও নিচে গলা নামায়।
: দিল্লি থেকে স্পেশাল মেসেজ এসেছে। যে করেই হোক, বামপন্থিদের হারাতেই হবে। ওদের ভাবমূর্তি নষ্ট করা দরকার আগে, আর সেটা পারেন আপনারা। আমি তো বলেছি, এ-ই দেবো।
তর্জনী আর মধ্যমা একত্র করে দেখায় কালো। বিকট শব্দ করে রূপপুর লোকালটা হাউজিংয়ের পিছনে রেলব্রিজ কাঁপিয়ে ছুটে যায়। ঘুরে দাঁড়ায় শেখর। কাকলি সেভাবেই দাঁড়িয়ে।
: দুপুরের দিকে অনীক ঠাকুরপো এসেছিল। শেয়ালদায় ওদের কী প্রোগ্রাম আছে কাল, তা-ই বলতে। নির্বাচনী প্রচার অভিযান। নাটক, গান, বক্তৃতা…
: ওসব শুনতে যেতে হবে না। বামপন্থিদের ব্যাপার। ইলেকশনের আগে আই-ওয়াশিং। তা ছাড়া কাল লেখাটা একটু কারেকশন করব। তোমাকে দরকার।
: কিন্তু অনীক ঠাকুরপো যে বলল…
: আমি রাজনীতি করি না, কলি। ফালতু ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ?
থমকে দাঁড়ায় কাকলি। ওর নির্বাক দৃষ্টি বিঁধে যায় শেখরের বুকে। একধরনের অস্বস্তি বোধ করে সে। ঘামে ভিজে শার্টের কলারটা এঁটে বসেছে গলায়। রিনি রিনি ঘাম বুক, পিঠ টপকে বড়ো বড়ো ফোঁটায় মিলেমিশে ঝুপঝাপ ঝরে পড়ছে গেঞ্জির ভেতর। হাঁ করে বড়ো বড়ো শ্বাস টানল শেখর। কাকলি সেভাবেই দাঁড়িয়ে। বড়ো বড়ো চোখ মেলে কী যেন খুঁজছে শেখরের মুখে। পরিস্থিতির পালটানোর জন্য এগিয়ে গিয়ে বুক-কেইসের মাথাটা হাতড়ায়। আঙুলের ধাক্কায় চারমিনারের প্যাকেটটা ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তি ডিঙিয়ে মাটিতে পড়ে। ঝুঁকে তুলতে গিয়ে আকাশের দিকে চোখ চলে যায়।
পাশের এক ব্লকে ধীরাজদের ছাদে অ্যান্টেনার পটভূমিতে একটুকরো পাঁশুটে মেঘ বড়ো হচ্ছে ক্রমশ। উলটো দিকের ফ্ল্যাটে খাঁচায় বন্দি টিয়েটা বিকট স্বরে ডাকতে থাকে আর ডানা ঝাপটায়, জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে আরও ভালো করে দেখে শেখর। ব্যালকনির গ্রিলের বেড়া বেয়ে কালো রঙের বেড়ালটা উঠে আসছে।
পরের দিন অফিসে গেল না শেখর। সকাল সকাল ‘বৃত্তের বাইরে’-র ম্যানুস্ক্রিপ্টখানা নিয়ে বুকে বালিশ চেপে উপুড় হয়ে পড়ল বিছানায়। কালো বলেছে, লেখাটা পালটানো দরকার। তা ছাড়া মোটা ঠোঁটের ফাঁকে খসখসে গলায় আর যা যা বলেছিল সে, মাথার ভেতর যেন গেঁথে আছে শেখরের। কথাগুলো বলার সময় কালোর মুখটা কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল তার। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল মোমবাতির আলোয়। কষে জমে ওঠা থুতু মাঝে মাঝে সাপটে নিচ্ছিল কালো।
জানালার বাইরে দৃষ্টি ছুড়ে দেয় শেখর। রান্নাঘর থেকে কাকলির টুকিটাকি কাজের শব্দ ভেসে আসছে। শেখরকে লেখায় সাহায্য করতেই তাড়াতাড়ি হাতের কাজ সারছে সে। উপন্যাসটা আজ শেষ করতেই হবে। যা থাকে কপালে। হয় এসপার, নয় ওসপার।
: কলি, তাড়াতাড়ি! লেখাটা বেশ বড়ো কিন্তু।
বিছানায় পড়ে থেকেই কাকলিকে ডাক দেয় শেখর। এপাশ-ওপাশ হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটারটা বের করে। সিগারেট ধরিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ে। ধোঁয়াটা পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরে ওঠে। তারপর বাতাসের টানে বাইরে বেরিয়ে যায়। রান্নাঘরে দরজা টানার শব্দ হয়। পর্দা ঠেলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢোকে কাকলি।
: রান্নাবান্না কমপ্লিট?
বিছানার একধারে সরে গিয়ে কাকলিকে বসার জায়গা করে দিতে দিতে শেখর বলে।
: এ বেলাতেই সব সেরে রাখলাম। বিকেলে যেতে হবে তো আবার।
নির্বিকার কাকলি শেখরের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে।
: কোথায়?
পাণ্ডুলিপির পাতা ওলটায় শেখর।
: বাঃ, অনীক ঠাকুরপো যেতে বলল না? আজ ওদের প্রোগ্রাম আছে শেয়ালদায়। এরকম নাকি রোজ হবে। কোনোদিন রাসবিহারী, কোনোদিন চৌরঙ্গী, এরকম আর কি!
শেখরের পিঠ ডিঙিয়ে কোলের ওপর একটা বালিশ টেনে নেয় কাকলি। শেখর কোনো কথা বলে না, শুধু পাতা ওলটানোর খসখস শব্দ।
: কী করতে হবে বলো।
: উপন্যাসটার কটা পোর্শন একটু চেইঞ্জ করতে হবে। মানে, নতুন করে লিখব কিছুটা।
কাকলির দিকে পাণ্ডুলিপিটা ঠেলে দিতে দিতে শেখর বলে। ক্রাউন সাইজের কাগজের পিঠটায় চোখ বুলোয় কাকলি।
: ওঃ, সেই লেখাটা! নৈহাটি থাকার সময় যেটা লিখেছিলে?
মাথা নাড়ে শেখর।
: হ্যাঁ, সেটাই। কালোবাবু কটা জায়গা মার্ক করে দিয়েছেন। ওগুলোই পালটাতে হবে।
আঙুল দিয়ে লাল ক্রসচিহ্ন-দেওয়া অংশগুলো দেখায় সে। দু-একবার চোখ বুলিয়েই পাণ্ডুলিপিটা বন্ধ করে কাকলি।
: এ আবার পালটাবে কী? ঠিকই তো আছে।
: না, না, মানে কালোবাবু বলছিলেন, ওই মনীশ আর প্রণীতার পোর্শনটা আর একটু ডিটেইল-এ...
হঠাৎ চোখের সামনে কালোকেই যেন দেখতে পায় শেখর। থ্যাবড়া নাক, কুৎকুতে চোখ, চোখের গভীরে থইথই করছে হামলে খাওয়ার দৃষ্টি। উলটো দিকের ব্যালকনিতে বসে কালো বেড়ালটা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে শেখরকে। চোখ ঘুরিয়ে নেয় সে। কাকলি একভাবে তাকিয়ে আছে। মুখের দিকে। ব্যাপারটা যেন বুঝতে চাইছে সে।
: কী রকম ডিটেইল?
: এই রকম, মানে...
: কী রকম বলো না!
: এই আর কি!
: তার মানে?
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে শেখর।
: ও তোমায় বলা যাবে না।
: বলা যাবে না কেন?
: আরে, মনীশ আর প্রণিতার ওই পোর্শনটায় ছিল ওরা স্কুটারে কলকাতার বাইরে বেরিয়ে বৃষ্টিতে আটকে যায়। শেষে একটা ডাকবাংলোয় রাত কাটাতে বাধ্য হয়।
: হ্যাঁ, প্রথমে তো তা-ই ছিল। তাতে কী?
: কালোবাবু চাইছেন, একটা অ্যাডিশন। মানে, ওরা অবিবাহিত, যুবক-যুবতী। একটা নির্জন ডাকবাংলো, বৃষ্টি, আলো নেই, মিটমিট করে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে, তার মধ্যে ওদের আর-একটু ক্লোজ...
কথাটা অসমাপ্ত রেখেই কাকলির মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয় শেখর। বালিশের তলা হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে।
ফের ধরায় একটা। ওর ইঙ্গিতটা বুঝতে একটুও ভুল হয় না কাকলির।
: বুঝলাম ব্যাপারটা। তা কী করতে বলছ আমায়?
পাণ্ডুলিপির তাড়াটা শেখরের সামনে ফেলে কথাগুলো ধীরে ধীরে শেষ করে কাকলি।
: মোটামুটি পালটাতে হবে লেখাটা। আবার কালোবাবু তো অন্য গাইডলাইনও দিয়ে বসলেন।
: কীরকম?
কাকলি যেন যন্ত্রচালিতের মতো বলে কথাগুলো। সিগারেটে টান দিয়ে শেখর বলতে থাকল।
: উনি চাইছেন, মনীশকে এক বামপন্থি শ্রমিক সংগঠনের নেতা বানিয়ে দিতে। পুলিশের তাড়া খেয়ে সে রেড-লাইট এরিয়ায় ঢুকে পড়ে। শেষে প্রণীতা নামের এক বারবণিতার ঘরে…
কাকলি কোনো কথা বলে না। ধীরে ধীরে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ফরসা পিঠের সামান্য অনাবৃত বাঁকানো অংশে ছুঁয়ে থাকা এলো-খোঁপা ফ্যানের হাওয়ায় থিরথির করে কাঁপছে।
: এতে ওঁর লাভ?
: ইলেকশন সামনে। বামপন্থিদের বিরুদ্ধে যে-কোনো ব্যবস্থা নেবার জন্য নাকি গোপন নির্দেশ এসেছে।
: তাই বুঝি এমন ধারা লেখার গাইডলাইন!
জানালা থেকে মুখ না সরিয়েই বলে কাকলি। ওর তীব্র শ্লেষ যেন একদলা থুতুর মতো আছড়ে পড়ে শেখরের চোখে-মুখে।
: আমার কী, বলো! আমার তো পয়সা পাওয়া নিয়ে কথা।
: কত দেবেন কালোবাবু?
জানালায় পিঠ দিয়ে শেখরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথাগুলো ছুঁড়ে দেয় কাকলি।
: বলেছেন তো হাজার বিশেক।
: অ্যাতো! তোমার কালোবাবু যদি আমায় কিনতে চান, কত দাম হাঁকবে তুমি?
কাকলির কথাগুলো ওকে এলোপাথাড়ি থাপ্পড় কষায় যেন। একমুহূর্তে বাজপড়া তালগাছের মতো জ্বলতে জ্বলতে থমকে যায় শেখর। হাউজিং কাঁপিয়ে গুমগুম শব্দে আর-একটা ট্রেন বেরিয়ে যায়। দমকা হাওয়ায় নাকের ভেতর ঝাপটা মারে ট্যানারির দম-বন্ধ-করা গন্ধ।
খাঁচায় বন্দি টিয়েটা ডানা ঝাপটায়। বেড়ালটা এগিয়ে আসছে। এধার-ওধার দুলতে থাকে লোহার খাঁচাটা।
দুটো বাজতেই বেরিয়ে পড়ল শেখর। হাতের ফোলিওর ব্যাগে একটা মোটা খামের ভেতর পাণ্ডুলিপিটা। একটা কাঁটার মতো খচখচ করছে কাকলির কথাগুলো। অনবরত! বড্ড সেন্টিমেন্টাল মেয়েটা। অথচ এই কাকলির অদম্য উৎসাহেই একদিন কলম ধরেছিল সে। তার লেখার প্রথম পাঠিকা এই কাকলিই, অনেক ভুলত্রুটি সে শুধরেও দিয়েছে। এই সামান্য ঘটনাতেই এত বিচলিত হয়ে পড়ল। কাকলি যখন কথাটা বলল, ওর মুখের দিকে তাকাতে সাহস করেনি সে। কেমন যেন ভয় লেগেছিল ওকে।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আলিপুর-সল্টলেকের মিনিতে উঠে পড়েছিল শেখর। নীলরতনের সামনে রাস্তা বাঁক নিতেই টুক করে নেমেও পড়ল। তারপর ফ্লাইওভারের নিচে ঘন ভিড় সাঁতরে একসময় পৌঁছে গেল কালো সরকারের পাবলিশিংয়ের একতলায়। কাউন্টার পেরিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে মেয়েলি গলার খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পেল। একটু ইতস্তত করে ভারী পর্দাটানা ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াল শেখর। পর্দাটা ফাঁক করে দেখল একটু। বাজারে খোলা মাংসের পসরা সাজানো কসাইয়ের দোকানের মতো বিচ্ছিরি শরীর-দেখানো পোশাক-পরা হিলহিলে এক মহিলা। ওকে ঠিক মহিলা না ভেবে মেয়েছেলেই ভাবা উচিত শেখরের। কালোর চেয়ারের হাতলের ওপর বসে আছে।
সামনের প্লেটে রাখা কাজুবাদাম। কালোর একটা হাত খেলে বেড়াচ্ছে ওর কোমরের মাংসে। মেয়েটার সাথে খুনসুটি করছে ও। চড়া সেন্টের গন্ধ সমস্ত ঘরে ছড়িয়ে আছে। বোধ হয় ওই মেয়েছেলেটার শরীর থেকেই আসছে গন্ধটা। কোনোরকম ভূমিকা না করেই ঘরে ঢুকে পড়ল শেখর। ওকে দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না ওদের। হাতলের ওপরই বসে রইল বেহায়া মেয়েটা। শেখরকে দেখে সোজা হয়ে বসল কালো।
: এনেছেন?
: হ্যাঁ।
ফোলিওর চেইন খুলে খামটা কালোর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে শেখর বলল। প্রায় লুফে নেবার মতো খামটা খুলে ঝুঁকে পড়ে কালো। ওর কালো থ্যাবড়া মুখটার দিকে একভাবে তাকিয়ে প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে শেখর। মেয়েছেলেটা বিশ্রীভাবে চোখের কোণ দিয়ে দেখছে তাকে।
: কী করলেন মশাই বলুন তো? ধ্যুস্!
সমস্ত বান্ডিলটা মুড়ে শেখরের দিকে ঠেলে দেয় কালো।
: কিস্সু হয়নি। সেদিন যা বললাম ভালো লাগল না, শেখরবাবু? অ্যাঁ?
চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে কালো।
শেখরের ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত তাড়না জমা হচ্ছিল এতক্ষণ ধরে। আর স্থির থাকতে পারে না সে। বার বার ভেসে ওঠে কাকলির মুখ, ক-গাছি কুন্তলের পাহারায় ঘেরা নীরব ভর্ৎসনায় উপচে-পড়া দুটো চোখ। কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায় সবকিছু। ঘেন্নায় রি-রি করে শরীরটা।
: আপনি পেয়েছেন কী বলুন তো? আর কত নোংরা করব লেখাটা?
চটপট বান্ডিলটা দুমড়ে ব্যাগে ভরে ফেলে শেখর। তারপর দ্রুত বেরিয়ে আসে। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে শুনতে পায় ওই মেয়েছেলেটা আর কালো সরকারের বিশ্রী একটানা হাসি।
রাস্তায় বেরিয়ে ফুসফুস ভরে বাতাস টানে শেখর। মুখ অন্ধকার, সন্ধে নামছে বইপাড়ায়। চলতে চলতে টের পায়, ব্যাগের ভেতর দুমড়ে-রাখা কাগজের তাড়াটা এধার-ওধার গড়াচ্ছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ব্যাগ থেকে বের করে সেটা। চারধারটা দেখে নেয় একবার। তারপর ক-পা পিছিয়ে এসে এইমাত্র বেরিয়ে আসা মুখখোলা ম্যানহোলের অন্ধকারে ছুঁড়ে দেয় নতুন সংযোজিত পাতাগুলো। সেই মুহূর্তে তার সমস্ত শরীরটা পালকের মতো হালকা মনে হয়। কবজি উলটে ঘড়ি দেখে। সাড়ে ছ-টা। তার মানে কাকলি নিশ্চয়ই এতক্ষণে শেয়ালদায় অনীকদের প্রচারাভিযানে পৌঁছে গেছে। বড়ো বড়ো পা ফেলে ট্রামলাইন ডিঙিয়ে শেয়ালদার দিকে হাঁটতে থাকে শেখর।