স্পন্দন-এর এই দার্শনিক রূপ বোঝার জন্য স্থিরতা ও গতির ভেদ বিলুপ্ত করতে হয়। শিব-চেতনা সম্পূর্ণ স্থির হলেও, সেই স্থিরতার অন্তরস্থলে রয়েছে এক অচিন্ত্য গতি—যেমন নিস্তরঙ্গ সাগরের গভীরে লুকিয়ে থাকে স্রোতের নাড়ন, বা নিঃশব্দের অন্তরে প্রতিধ্বনিত হয় অশ্রুত সুর। সেই সূক্ষ্ম আন্দোলনই স্পন্দন, যা চেতনার স্বরূপপ্রকাশ। অভিনবগুপ্ত বলেন—“ন হি কিঞ্চিদস্পন্দময়মস্তি”—বিশ্বে এমন কিছুই নেই, যা স্পন্দনহীন। প্রত্যেক চিন্তা, প্রত্যেক অনুভূতি, এমনকি নীরব অস্তিত্বও সেই এক চেতনার কম্পনের প্রকাশ।
এই কারণেই স্পন্দনকে বলা হয় চিদিচ্ছাশক্তির ঈষৎ চলন—চেতনার ইচ্ছাশক্তির সূক্ষ্মতম আন্দোলন। এখানেই সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের বীজ নিহিত। স্পন্দনই শিব-শক্তির নৃত্য, যেখানে পরম নীরবতা নিজেকে অভিব্যক্ত করে রূপে, ধ্বনিতে ও অভিজ্ঞতায়। মুক্তি মানে এই নৃত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি—নিজের ভেতরের স্পন্দনকে নিজের স্বরূপ হিসেবে চিনে ফেলা। তখন ব্যক্তিগত চেতনা আর মহাচেতনার মধ্যে কোনো ভেদ থাকে না; প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি ভাব, প্রতিটি জাগরণই সেই এক আত্ম-নাড়নের প্রকাশ হয়ে ওঠে।
স্পন্দন কাশ্মীর শৈব দর্শনের প্রাণ; এটি সেই অভিজ্ঞতার নাম, যেখানে চেতনা নিজের মধ্যেই দীপ্ত, নিজের মধ্যেই জাগ্রত, নিজের মধ্যেই নাচছে। এই স্পন্দনই অস্তিত্বের চিরন্তন সঙ্গীত, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত বলে ওঠে—“অহং স্পন্দঃ”—আমি-ই সেই স্পন্দন।
শিব সেই চেতনা, যার দীপ্তি ও আত্মসচেতনতা একই সঙ্গে প্রকাশিত; তিনি আলো এবং সেই আলোর নিজের দিকে ফিরে দেখা—প্রকাশ (prakāśa) ও বিমর্শ (vimarśa) উভয়েরই এক অবিচ্ছিন্ন ঐক্য। এই দুই দিকের মিলনেই সৃষ্টি ঘটে, কারণ প্রকাশ ছাড়া কোনো কিছু উদ্ভাসিত হয় না, আর বিমর্শ ছাড়া কোনো কিছু নিজের অস্তিত্ব জানে না।
অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক-এ এই সত্যটিকেই বিশ্লেষণ করে বলেছেন—“প্রকাশবিমর্শাত্মা শিবঃ”—শিব সেই চেতনা, যিনি একাধারে স্ব-উজ্জ্বল ও স্ব-জ্ঞানময়। তিনি জাগ্রত আছেন নিজেরই দীপ্তিতে, নিজেরই উপলব্ধিতে। এই স্বাতন্ত্র্য—যা শৈব পরিভাষায় স্বাতন্ত্র্যশক্তি (Svātantrya-śakti) নামে পরিচিত—শিবের প্রকৃত সার; কারণ তিনিই একমাত্র সত্তা, যিনি কোনো বাহ্য কারণ বা উপাদান ছাড়াই নিজের ইচ্ছায় নিজেকে প্রকাশ করেন।
এই স্বাধীনতাই মহাবিশ্বের উৎস, কারণ বিশ্ব কোনো বাহ্যিক সৃষ্টিকর্তার নির্মিত বাহ্য কাঠামো নয়; এটি শিব-চেতনারই আত্ম-বিস্তার (self-expansion)—এক এমন পরম লীলা, যেখানে চেতনা নিজের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে উন্মোচন করে রূপ, নাম, গতি ও ভাবের অসংখ্য ধারায় প্রকাশিত হয়। যেমন নিস্তব্ধ জলের গভীরে তরঙ্গের সম্ভাবনা থাকে, তেমনি শিবচেতনার গভীরে নিহিত এই আত্ম-নাড়ন থেকেই জন্ম নেয় সৃষ্টি।
এই প্রক্রিয়াটিই শৈব ভাষায় “উন্মেষ-নিমেষ” নামে পরিচিত—যেখানে চেতনা একদিকে নিজেকে উন্মোচন করে (উন্মেষ, প্রকাশ), আবার অন্যদিকে নিজের মধ্যেই প্রত্যাবর্তন করে (নিমেষ, লয়)। এই চিরন্তন স্পন্দনই সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের ছন্দ—একই সঙ্গে বহির্মুখী বিকাশ ও অন্তর্মুখী প্রত্যাবর্তন। এই কারণেই কাশ্মীর শৈব দর্শনে বলা হয়, মহাবিশ্ব কোনো “creation ex nihilo” নয়, বরং শিবচেতনারই অনবরত আত্ম-প্রকাশ (svābhāvikā sṛṣṭi), যেখানে তিনি নিজেই সৃষ্টিকর্তা, নিজেই সৃষ্টি এবং নিজেই সেই চেতনা, যা উভয়কেই অতিক্রম করে।
শিবের এই চেতনা কোনো ব্যক্তিগত দেবতার মানসিক কল্পনা নয়; এটি সেই সার্বজনীন সংবিত্—এক স্বয়ং-উজ্জ্বল, স্ব-সচেতন স্বাধীনতা, যার থেকেই সমস্ত গতি, রূপ, ধারণা ও অভিজ্ঞতার ধারা উৎসারিত। মহাবিশ্ব সেই চেতনারই তরঙ্গ, সেই দীপ্তিরই প্রতিফলন। আর এই উপলব্ধি-ই মুক্তি—যেখানে জাগতিক ভেদবুদ্ধি লুপ্ত হয়ে চেতনা নিজেকে চিনে ফেলে নিজেরই অখণ্ড স্বরূপে।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের কেন্দ্রীয় উপলব্ধি হলো—চেতনা নিজেই স্বতঃসিদ্ধ স্বাধীন (svātantrya), এবং এই স্বাধীনতাই সমগ্র অস্তিত্বের উৎস। কোনো বাহ্য কারণ, স্রষ্টা, বা উদ্দেশ্য ছাড়াই চেতনা নিজের আনন্দে প্রকাশিত হয়, বিকশিত হয়, আবার নিজের মধ্যেই লয় পায়। এই আত্ম-স্বাধীন গতি থেকেই চেতনার মহাজাগতিক লীলা শুরু হয়, যা প্রকাশিত হয় পাঁচটি চিরন্তন শক্তি বা পঞ্চকৃত্য (pañcakṛtya)-র মাধ্যমে।
প্রথম ক্রিয়া সৃষ্টি (sṛṣṭi)—চেতনার বহির্মুখী বিকিরণ, যখন অসীম সংবিত্ (saṁvit) নিজের সম্ভাবনাকে জগৎরূপে উন্মোচন করে।
দ্বিতীয় স্থিতি (sthiti)—এই প্রকাশের স্থায়িত্ব, যেখানে চেতনা নিজের প্রতিফলনকে ধারণ করে রাখে, যেন অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
তৃতীয় সংহার (saṁhāra)—চেতনার নিজের মধ্যেই প্রত্যাবর্তন; প্রকাশিত রূপগুলির অন্তর্মুখী লয়ে ফিরে যাওয়া।
চতুর্থ তিরোধান (tirodhāna)—চেতনার আত্ম-আবরণ বা নিজেকে সীমিত করে তোলা, যেখানে সে নিজেই নিজের দীপ্তি আড়াল করে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে অভিজ্ঞ হয়।
পঞ্চম অনুগ্রহ (anugraha)—এই আত্ম-আবরণের উন্মোচন, যখন চেতনা নিজের প্রকৃত স্বরূপে জেগে ওঠে এবং নিজের অসীমতাকে পুনরায় চিনে ফেলে।
এই পাঁচ ক্রিয়া কোনো সময়ক্রমিক প্রক্রিয়া নয়; এগুলো এক চিরন্তন, অভ্যন্তরীণ ছন্দ, যা চেতনার অন্তঃপ্রবাহের মতো অবিরাম চলছে। সৃষ্টি ও লয়, আবরণ ও উন্মোচন—সবই এক নিঃশব্দ নৃত্যের দুই দিক। এই কারণেই কাশ্মীর শৈব দর্শনকে বলা হয় স্পন্দবাদ (spanda-vāda)—যেখানে বাস্তবতা মানে চেতনার স্পন্দন, তারই অন্তহীন তরঙ্গ।
এই চেতনার অন্তর্গত যে-শক্তিগুলি কাজ করে, তাদের বলা হয় ত্রিশক্তি (tri-śakti)—ইচ্ছা (icchā), জ্ঞান (jñāna) এবং ক্রিয়া (kriyā)।
ইচ্ছা-শক্তি (icchā-śakti) হলো চেতনার অভ্যন্তরীণ প্রেরণা—“আমি প্রকাশিত হতে চাই”;
জ্ঞান-শক্তি (jñāna-śakti) হলো নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা—“আমি জানি, আমি আছি”;
আর ক্রিয়া-শক্তি (kriyā-śakti) হলো সেই প্রেরণার কার্যকর প্রকাশ—“আমি প্রকাশিত হচ্ছি।”
এই তিন শক্তি একে অপরের থেকে পৃথক নয়; তারা একই চেতনার ভিন্ন ভিন্ন দিক, যেমন আলো, দীপ্তি ও উষ্ণতা একসূর্যেরই গুণ।
এইভাবে, কাশ্মীর শৈবের অধিবিদ্যা (metaphysics) ব্যাখ্যা করে, কীভাবে এক অদ্বৈত চেতনা (ekam eva saṁvit) নিজেই বহুরূপে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যেই নিহিত ত্রয়ী (trika) ধারণা—শিব (Śiva), শক্তি (Śakti) ও নর (nara)।
শিব হলেন পরম চেতনা,
শক্তি সেই চেতনার কার্যক্ষম প্রকাশ,
আর নর বা জীব হলো সেই চেতনার সীমিত প্রতিফলন—যেখানে অসীম চেতনা নিজেকে দেহ-মন-সত্তার মাধ্যমে সীমিত করে অভিজ্ঞ হয়।
তবে এই তিনের মধ্যে কোনো প্রকৃত বিভাজন নেই; পার্থক্য কেবল উপলব্ধির স্তরে। যখন চেতনা নিজের অসীম শক্তিকে সীমিত আকারে অভিজ্ঞ করে, তখন সে নর বা জীব; আর যখন সেই সীমাবদ্ধতার আবরণ সরিয়ে নিজের ঐক্য চিনে ফেলে, তখনই ঘটে মুক্তি—প্রত্যভিজ্ঞা (pratyabhijñā), অর্থাৎ নিজের ঈশ্বরীয় স্বরূপের পুনরচেনা।
এই কারণেই কাশ্মীর শৈব দর্শন অদ্বৈত বেদান্ত থেকে সূক্ষ্মভাবে পৃথক। অদ্বৈত বেদান্তে জগৎকে মায়া বলা হয়—চেতনার আভাস বা বিভ্রম; কিন্তু শৈব মতে, জগৎ কোনো বিভ্রম নয়, বরং চেতনারই বাস্তব প্রকাশ (real manifestation)। যা-কিছু আছে—রূপ, শব্দ, চিন্তা, অনুভূতি—সবই সেই এক চেতনার ভিন্ন স্তর, যেমন ঢেউ সমুদ্রেরই রূপ, অথচ সমুদ্র থেকে আলাদা নয়।
এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হয় অভিন্ন-অভেদবাদ (Abhedābheda-vāda)—অর্থাৎ, শিব ও জগৎ এক নয়, আবার ভিন্নও নয়; তারা একে অপরের মধ্যে প্রতিফলিত এক চিরন্তন ঐক্য-সংগীত। এখানেই কাশ্মীর শৈব তত্ত্বের সৌন্দর্য—বিশ্বকে অস্বীকার নয়, বরং পবিত্রভাবে উপলব্ধি করা; কারণ এই জগতই শিবচেতনার নৃত্যময় আত্ম-প্রকাশ।
কাশ্মীর শৈবদর্শন ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তার এক গভীর ও সূক্ষ্ম অদ্বৈতধারা, যেখানে পরম শিব-কেই চূড়ান্ত বাস্তবতা বা পরম সত্তা (Parama-tattva) হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে শিব কোনো মানবাকৃতি দেবতা নন; তিনি চেতনা স্বরূপ পরমসত্তা (cit-svarūpa)—যিনি একই সঙ্গে স্থির ও চলমান, নীরব তবু স্পন্দিত, নিষ্ক্রিয় তবু সৃষ্টিশীল। এই পরম চেতনার মধ্যে প্রকাশ (prakāśa) ও আত্মসচেতনতা (vimarśa)—এই দুই গুণ অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত। শিবসূত্র (১.১)-এ বলা হয়েছে, “চিত্তং আত্মা”—“চেতনা-ই আত্মা।” অর্থাৎ, এই জগতে যা-কিছু আছে, সবই সেই পরম চেতনারই প্রকাশ।
এই চেতনার ক্রমবিকাশ বোঝানোর জন্য কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে বলা হয়েছে ৩৬টি তত্ত্বের (ṣaṭ-triṁśat tattvāni) কথা—যেগুলি কোনো ভিন্ন পদার্থ নয়, বরং পরম চেতনার নিজস্ব ধাপে ধাপে সঙ্কোচন ও প্রকাশের স্তর। যেমন আলো ধীরে ধীরে রঙে, রূপে, ছায়ায় বিভক্ত হয়ে যায়, কিন্তু তার মূল দীপ্তি অপরিবর্তিত থাকে, তেমনি এই তত্ত্বগুলিও এক ও অভিন্ন চেতনার রূপান্তর মাত্র।
“ষট্ত্রিংশৎ তত্ত্বানি” (ṣaṭ-triṁśat tattvāni)—এই সংস্কৃত শব্দবন্ধটির অর্থ হলো ছত্রিশটি তত্ত্ব বা ছত্রিশটি মৌল নীতি। এখানে “ষট্” (ṣaṭ) মানে ছয়, “ত্রিংশৎ” (triṁśat) মানে ত্রিশ, অর্থাৎ “ছয় ও ত্রিশ”—মোট ছত্রিশ, আর “তত্ত্বানি” (tattvāni) এসেছে “তত্ত্ব” (tattva) শব্দ থেকে, যার অর্থ মৌল বাস্তব নীতি, অস্তিত্বের মূল উপাদান, বা ontological principle। সুতরাং “ষট্ত্রিংশৎ তত্ত্বানি” মানে সেই ছত্রিশটি মৌল স্তর, যার মাধ্যমে চেতনা ধাপে ধাপে বিশ্বরূপে বিকশিত হয়।
কাশ্মীর শৈব দর্শন অনুসারে, এই ৩৬টি তত্ত্ব কোনো বাহ্য পদার্থ নয়; এগুলি চেতনারই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান বা ধাপ। পরম শিব, যিনি নিখাদ চেতনা (cit), তাঁর মধ্যেই এই সমস্ত স্তর লুকিয়ে আছে—যেমন সমুদ্রের মধ্যে অসংখ্য ঢেউ, অথচ সবই জলের রূপ। এই তত্ত্বগুলি ব্যাখ্যা করে, কীভাবে সেই পরম চেতনা নিজের মধ্যেই স্পন্দিত হয়ে ধীরে ধীরে জগতের রূপে প্রকাশ পায় এবং আবার নিজের মধ্যেই ফিরে যায়।
অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোক (১.৮৭)-এ এই প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করেছেন—“শিবঃ পঞ্চকৃত্যপরায়ণঃ।” অর্থাৎ, শিব চিরকাল পাঁচটি ক্রিয়ায় লিপ্ত—সৃষ্টি (sṛṣṭi), স্থিতি (sthiti), সংহার (saṁhāra), তিরোধান (tirodhāna), ও অনুগ্রহ (anugraha)। এই পাঁচ চিরন্তন ক্রিয়ার ধারাতেই চেতনার গতি বিস্তৃত হয়ে ছত্রিশটি তত্ত্বরূপে প্রকাশিত হয়।
এই ছত্রিশটি তত্ত্বকে তিনটি বৃহৎ স্তরে ভাগ করা হয়েছে।
প্রথম স্তরটি হলো বিশুদ্ধ চেতনার স্তর, যেখানে কোনো অজ্ঞতা বা সীমাবদ্ধতা নেই।
দ্বিতীয় স্তরটি হলো সীমাবদ্ধ চেতনার সূচনা, যেখানে মায়া চেতনার দীপ্তিকে আচ্ছাদিত করে।
তৃতীয় স্তরটি হলো স্থূল জগতের স্তর, যেখানে চেতনা পদার্থ ও অভিজ্ঞতার রূপে প্রকাশিত হয়।
প্রথম স্তর, বিশুদ্ধ তত্ত্ব (śuddha tattvas)—এখানে আছে পাঁচটি তত্ত্ব: শিব, শক্তি, সদাশিব, ঈশ্বর ও শুদ্ধবিদ্যা। এই স্তরে চেতনা পরম দীপ্তিময়, অদ্বৈত ও অনাবৃত। শিব তত্ত্বে চেতনা নিস্তরঙ্গ আলো, শক্তি তত্ত্বে সেই আলো কম্পিত হয়; সদাশিব তত্ত্বে “আমি এটি” বোধ জাগে, ঈশ্বর তত্ত্বে “এটি আমি” বোধে প্রকাশ শুরু হয়, আর শুদ্ধবিদ্যা তত্ত্বে “আমি এটি এবং এটি আমি”—এই পূর্ণ ঐক্য অনুভূত হয়।
দ্বিতীয় স্তর, বিশুদ্ধ-অবিশুদ্ধ তত্ত্ব (śuddhāśuddha tattvas)—এখানে চেতনা নিজেকে সীমাবদ্ধভাবে প্রকাশ করে। প্রথমে মায়া তত্ত্ব আসে, যা চেতনার অসীম দীপ্তিকে আচ্ছাদিত করে। মায়ার প্রভাবে আত্মা পাঁচটি সীমাবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ হয়, যাদের বলা হয় পঞ্চ কঞ্চুক (pañca kañcuka)—কলা (শক্তির সীমাবদ্ধতা), বিদ্যা (জ্ঞান সীমিত হওয়া), রাগ (আকাঙ্ক্ষা), কাল (সময়ের বোধ) ও নিয়তি (নিয়ন্ত্রণ বা কারণের অধীনতা)। এই সীমাবদ্ধতার পর আত্মা নিজেকে পৃথক ব্যক্তিসত্তা হিসেবে অনুভব করে, যাকে বলা হয় পুরুষ তত্ত্ব (puruṣa tattva), আর তার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় প্রকৃতি তত্ত্ব (prakṛti tattva)। এখানেই ব্যক্তিগত চেতনার অভিজ্ঞতার সূচনা।
তৃতীয় স্তর, অবিশুদ্ধ তত্ত্ব (aśuddha tattvas)—এখানে চেতনা সম্পূর্ণভাবে বহির্মুখী হয়ে পদার্থ ও মানসিক কার্যকলাপে প্রকাশিত হয়। এখানে অন্তঃকরণ চতুষ্টয় (বুদ্ধি, অহংকার, মনস, চিত্ত), জ্ঞানেন্দ্রিয় (শ্রোত্র, চক্ষু, ঘ্রাণ, রসনা, ত্বক), কর্মেন্দ্রিয় (বাক, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ), তন্মাত্রা (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ), এবং পঞ্চ মহাভূত (আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী)—এই ধাপগুলির মাধ্যমে চেতনা স্থূল বিশ্বরূপে পরিণত হয়।