এই তিনটি স্তর—স্থিতি, উদয় ও প্রতিসংহৃতি—প্রকৃতপক্ষে চেতনার এক অভিন্ন লয় বা নৃত্যরূপ প্রকাশ। উদয় মানে চেতনা নিজেকে প্রকাশ করছে—যেমন আমরা “আমি” বলে অনুভব করি, বা কোনো রূপ দেখি; স্থিতি মানে সেই প্রকাশিত অবস্থা কিছুক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে—যেমন কোনো চিন্তা বা অনুভূতি টিকে থাকে; আর প্রতিসংহৃতি মানে সেই চিন্তা, সেই রূপ, সেই অনুভূতি আবার বিলীন হয়ে যাচ্ছে নিজের উৎসে। এই পুরো প্রক্রিয়া এক চেতনার মধ্যেই ঘটছে, যেমন ঢেউ ওঠে, ছড়ায়, তারপর আবার সাগরে মিশে যায়—কিন্তু সাগর কখনও বদলায় না।
ভট্ট কল্লট ও ক্ষেমরাজ উভয়েই বলেন, মুক্তি বা আত্মজ্ঞান মানে এই স্পন্দনকে চিনে ফেলা—অর্থাৎ, উপলব্ধি করা যে, আমার প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি অভিজ্ঞতা আসলে চেতনারই এক আত্মপ্রকাশ। তখন আর “আমি” ও “বিশ্ব” আলাদা থাকে না। তখন মানুষ বুঝতে পারে, সবই এক জীবন্ত চেতনার প্রকাশ—শিবের নিজস্ব নৃত্য।
এই উপলব্ধি কোনো যোগব্যায়াম বা ক্রিয়া নয়, এটি নিজের উৎসে ফিরে যাওয়া, নিজের ভেতরের চেতনা জেগে ওঠা। অভিনবগুপ্ত বলেন, এই জাগরণ হলো “আত্ম-চেতনার প্রত্যাবর্তন”—যেখানে মানুষ হঠাৎ অনুভব করে, “আমি সেই চেতনা, যার প্রতিটি নাড়নেই জগতের উদয় ঘটছে।” তখন তার কাছে জগৎ কোনো বাইরের বাস্তবতা নয়—বরং নিজের অন্তরের স্পন্দনেরই প্রতিফলন।
এইভাবেই স্পন্দসিদ্ধি শেখায়, শিব কোনো দূরের দেবতা নন—তিনি আমাদের প্রতিটি অনুভূতির কেন্দ্রে, প্রতিটি চিন্তার গতি ও প্রতিটি নিশ্বাসের ছন্দে স্পন্দিত। তাঁর নৃত্য চলছে সর্বত্র—নদীর জলে, বৃক্ষের দোলায়, মানুষের মনের ভাবনায়, এমনকি নীরব ধ্যানেও। এই নৃত্যই শিবচেতনার জীবন্ত প্রকাশ—যা একসঙ্গে স্থির, গতিময় ও অদ্বৈত।
স্পন্দসিদ্ধি আমাদের শেখায়—চেতনা কখনও মৃত বা নিষ্ক্রিয় নয়; সে সর্বদা জীবন্ত, আত্ম-সচেতন, ও আনন্দময়। এই চেতনার নিত্য স্পন্দনই শিবের প্রকৃত রূপ—যেখানে কোনো ভেদ নেই, কেবল এক অসীম, স্বাতন্ত্র্যময়, আত্ম-উজ্জ্বল চেতনা—যা নিজের আনন্দেই নাচছে, নিজেই জগৎ, নিজেই মুক্তি, নিজেই পরম সত্য।
কাশ্মীর শৈব দর্শনের গভীরতম তত্ত্বগুলির মধ্যে অন্যতম হলো প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā)—যা শেখায়, মুক্তি কোনো নতুন জ্ঞানের অর্জন নয়, বরং নিজের ভেতরেই নিজের ঈশ্বরীয় স্বরূপকে পুনরায় চিনে ফেলা। “প্রতি + অভি + জ্ঞা”—এই শব্দের অর্থই হলো, আবার সরাসরি জানা বা নিজেকে পুনরায় চেনা। মানুষ আসলে সেই পরম চেতনা, কিন্তু অজ্ঞতার পর্দায় আবৃত হয়ে সে নিজের অসীম সত্তাকে ভুলে গেছে। প্রত্যভিজ্ঞা দর্শনের মূল বক্তব্য হলো—“আমি সর্বদা শিব ছিলাম, আছি, এবং থাকব; কেবল তা ভুলে গেছি। মুক্তি মানে সেই ভোলার স্মৃতি ফিরে পাওয়া।”
এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উৎপলদেব, যিনি ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা গ্রন্থে বলেন—“অহং ইতি প্রাত্যভিজ্ঞানাত মুক্তিঃ”—যখন কেউ নিজের মধ্যে এই ‘আমি’-রূপ চেতনা চিনে ফেলে, তখনই মুক্তি ঘটে। তাঁর শিষ্য অভিনবগুপ্ত পরবর্তীকালে ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-বিমর্শিনী-তে এই তত্ত্বকে সম্পূর্ণ মহাজাগতিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন। তাঁদের মতে, ঈশ্বর বা পরম শিব কোনো দূরের সত্তা নন; তিনি চেতনা নিজেই—যিনি জ্ঞান, কর্ম ও অস্তিত্ব—তিনিই। তিনি চিদানন্দরূপ (cit-ānanda-ghana)—আনন্দময়, আত্ম-সচেতন, স্বয়ংপ্রকাশমান চেতনা।
এই চেতনা স্বতঃসিদ্ধ (svataḥ-siddha)—তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য কোনো বাহ্য কারণ প্রয়োজন নেই; বরং তিনিই সব কিছুর কারণ। যেমন আয়নায় অসংখ্য মুখ প্রতিফলিত হয় কিন্তু সবই এক আয়নারই প্রতিচ্ছবি, তেমনি জগৎও ঈশ্বরচেতনারই প্রতিফলন। অজ্ঞতার (āvaraṇa) ফলে আমরা এই ঐক্যকে ভুলে যাই এবং ভাবি—“আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি ব্যক্তি”—এই সীমাবদ্ধ সত্তাই সত্য। কিন্তু বাস্তবে আমরা কখনোই ঈশ্বরচেতনা থেকে পৃথক নই; আমরা সেই চেতনারই এক সীমিত প্রতিফলন।
প্রত্যভিজ্ঞা দর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে দুটি মৌলিক ধারণা—প্রকাশ (Prakāśa) ও বিমর্শ (Vimarśa)। প্রকাশ হলো চেতনার দীপ্তি, যা সমস্ত কিছু আলোকিত করে, আর বিমর্শ হলো সেই দীপ্তির নিজের প্রতি সচেতনতা—যেখানে চেতনা জানে যে সে জানে। শুধুমাত্র প্রকাশ থাকলে তা জড় আলো, যেমন সূর্য আলো দেয় কিন্তু নিজে জানে না; আর শুধুমাত্র বিমর্শ থাকলে তা অচল, কারণ তাতে কোনো উদ্ভাস নেই। যখন প্রকাশ ও বিমর্শ মিলিত হয়, তখনই জন্ম নেয় জীবন্ত চেতনা—যেখানে দেখা, জানা ও হওয়া—সব এক হয়ে যায়। এই ঐক্যই শিব ও শক্তির সমবেত অবস্থান—śiva-śakti-sāmarasya—যেখানে শিবের নীরব দীপ্তি কালী-রূপে আত্মবিম্বিত হয়ে আনন্দের নৃত্যে মেতে ওঠে।
এই জীবন্ত চেতনার প্রকৃতি হলো স্বাতন্ত্র্য (svātantrya)—অর্থাৎ পরম স্বাধীনতা। ঈশ্বর কোনো বাহ্য নিয়ম বা উদ্দেশ্যের দ্বারা পরিচালিত নন; তাঁর প্রতিটি প্রকাশ আনন্দের খেলা। এই লীলাময় স্বভাবকেই অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (১.৮৭)-এ বলেছেন—“সর্বমিদং শম্ভোরেকতনত্র স্বাতন্ত্র্যলীলানাট্যম্।” অর্থাৎ, সমগ্র জগৎ শম্ভুর স্বাধীন আনন্দনাট্য—চেতনার আত্মনৃত্য। এই প্রকাশ ও প্রত্যাহার, সৃষ্টি ও লয়—সবই ঈশ্বরচেতনার অন্তর্গত ছন্দ।
প্রত্যভিজ্ঞা দর্শনে মুক্তি (mokṣa) মানে কোনো নতুন অবস্থায় পৌঁছানো নয়; বরং নিজের সত্য সত্তার স্মরণ—স্বরূপ-স্মৃতি (svarūpa-smṛti)। যখন সাধক অনুভব করেন—“আমি দেহ নই, মন নই, চিন্তা নই; আমি সেই চেতনা, যার উপস্থিতিতে এগুলো সব ঘটে”—তখন তাঁর সমস্ত সীমাবদ্ধতা লুপ্ত হয়ে যায়। তখন সে জানে, সে কখনোই ঈশ্বর থেকে আলাদা ছিল না; বরং ঈশ্বরই নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রূপে প্রতিফলিত ছিলেন। উৎপলদেব এই অবস্থাকে বলেন—“শিভোহমিতি প্রত্যবমর্শঃ অনুগ্রহঃ”—“আমি শিব”—এই আত্মসচেতনতার জাগরণই অনুগ্রহ, মুক্তি বা করুণা। এখানে “অনুগ্রহ” মানে কোনো বাহ্য কৃপা নয়; এটি চেতনার নিজের প্রতিই করুণা—নিজেকে চিনে ফেলার মুহূর্ত।
অভিনবগুপ্ত এই উপলব্ধিকে ব্যাখ্যা করেন “প্রকাশ-বিমর্শ”-এর ঐক্য হিসেবে। তাঁর মতে, শিবের নীরব দীপ্তি যখন কালী-রূপে আত্মবিম্বিত হয়, তখন চেতনা নিজের মধ্যে নিজেকে জানে—এই জানাই প্রত্যভিজ্ঞা। এই জ্ঞানে “জ্ঞাতা”, “জ্ঞেয়” ও “জ্ঞান”—এই তিনটি মিলিয়ে এক হয়ে যায়। যেমন ঢেউ, ফেনা ও জল এক সমুদ্রেরই তিন নাম—তেমনি জানন, জানা ও জানা-বস্তু সবই সেই এক চেতনার রূপ।
প্রত্যভিজ্ঞা দর্শন তাই এক গভীর অদ্বৈত তত্ত্ব—একটি nondual epistemology of consciousness—যেখানে জ্ঞান মানে নিজেরই স্বরূপকে জানা। মুক্তি মানে সেই চেতনার সম্পূর্ণ জাগরণ, যেখানে সব ভেদ, দ্বন্দ্ব ও সীমা লুপ্ত হয়। তখন আর “আমি” ও “ঈশ্বর”-এর মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকে না; বরং বোঝা যায়—“সবই আমি, সবই সেই।”
এই অবস্থাই প্রত্যভিজ্ঞার পরিণতি—যেখানে মানুষ উপলব্ধি করে যে, চেতনা-ই ঈশ্বর, ঈশ্বর-ই বিশ্ব, আর বিশ্ব-ই নিজের অন্তর্গত প্রতিফলন। চেতনার প্রতিটি নাড়ন, প্রতিটি অনুভূতি, প্রতিটি শ্বাস তখন শিবচেতনার স্পন্দন হয়ে ওঠে। সেই মুহূর্তে জগৎ ও আত্মা, প্রকাশ ও লয়, জানা ও না-জানা—সব এক নৃত্যে মিশে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে একমাত্র চেতনা—অখণ্ড, উজ্জ্বল, স্বাতন্ত্র্যময় পরম শিব, যিনি নিজের ভেতরেই নিজের আনন্দে প্রতিনিয়ত প্রত্যভিজ্ঞার নৃত্য করছেন।
অভিনবগুপ্তের স্পন্দ-নির্ণয় দর্শনে “স্পন্দ” শব্দটি কেবল কোনো নাড়াচাড়া বা গতি নয়; এটি চেতনার জীবন্ত হৃদস্পন্দন—একইসঙ্গে নীরব ও সজীব, স্থির কিন্তু তবুও চির-গতিশীল। তিনি বলেন, যদি চেতনা একেবারে নিস্পন্দ হতো, অর্থাৎ কোনো অন্তর্লীন গতি বা আত্মপ্রত্যাবর্তন না থাকত, তবে সেটি জড় বস্তু হতো। কিন্তু চেতনা জড় নয়, কারণ সে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করে, নিজের উপস্থিতিকে জানে। এই জানাটাই স্পন্দ তথা চেতনার নিজের মধ্যে প্রতিফলনের শক্তি। তাই শিব কোনো “স্থবির ঈশ্বর” নন, বরং “চলনাচলনাত্মা”—যিনি একইসঙ্গে নীরব ও নৃত্যময়, স্থির কিন্তু প্রকম্পিত, এক আত্ম-সচেতন নৃত্যরত স্থিরতা।
এই “স্পন্দ” কেবল কোনো শারীরিক কম্পন নয়, বরং চেতনার “স্বপ্রত্যবমর্শ” (self-reflexivity)—অর্থাৎ, চেতনা যখন নিজের দিকেই ফিরে তাকায়, নিজের উপস্থিতি অনুভব করে, তখনই তা “স্পন্দন” নামে অভিজ্ঞ হয়। অভিনবগুপ্ত বলেন—“ন হি কিঞ্চিদস্পন্দময়মস্তি” (স্পন্দ-নির্ণয়, ১.৮)—এই বিশ্বে এমন কিছুই নেই, যা স্পন্দহীন; প্রতিটি অস্তিত্ব, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি অভিজ্ঞতা এই অন্তর্লীন চেতনার স্পন্দনের প্রকাশমাত্র।
তাঁর মতে, জগৎ কোনো চেতনা-বহির্ভূত বাস্তবতা নয়; বরং চেতনারই আত্মপ্রকাশ, যা কখনো “উন্মেষ” তথা “বহির্মুখী সৃজনশক্তি”-রূপে প্রকাশিত হয়, আবার কখনো “নিমেষ” তথা “অন্তর্মুখী লয়” বা “প্রত্যাহার”-রূপে পরিণত হয়। যেমন চোখের পলক ফেলার মতো, চেতনা কখনো জগতের দিকে খুলে যায়, আবার নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়। এই “উন্মেষ-নিমেষ” চিরন্তন ছন্দই সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারের মূল ছন্দ।
অভিনবগুপ্ত ব্যাখ্যা করেন, এই স্পন্দই শিবচেতনার প্রাণ—তাঁরই ভেতর দিয়ে পাঁচটি ঐশ্বরিক ক্রিয়া (pañcakṛtya)—সৃষ্টি (sṛṣṭi), স্থিতি (sthiti), সংহৃতি (saṃhāra), তিরোভাব (tirobhāva) ও অনুগ্রহ (anugraha)—নিরন্তর প্রবাহিত হয়। এগুলি আলাদা কোনো প্রক্রিয়া নয়; সবই এক চেতনার অন্তর্লীন আত্মগতি, যা একমুহূর্তে প্রকাশ করে, আরেক মুহূর্তে নিজের মধ্যে ফিরিয়ে নেয়।
অভিনবগুপ্ত এই ধারণাকে ব্যাখ্যা করতে আয়না ও প্রতিফলনের রূপক ব্যবহার করেন—চেতনা হলো সেই নিস্তরঙ্গ আয়না, আর জগৎ তারই অন্তর্গত প্রতিফলন। যেমন আয়না ও প্রতিচ্ছবির মধ্যে কোনো বাস্তব ভেদ নেই, তেমনি শিব ও জগতের মধ্যেও কোনো দ্বৈততা নেই। আয়না স্থির, কিন্তু তাতে প্রতিফলন ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়—এটাই “চলনাচলনাত্মা”-র রহস্য। শিব নিস্তরঙ্গ, কিন্তু তাঁর আত্মবিমর্শনের আনন্দে অসংখ্য রূপ ও ধ্বনি প্রকাশিত হয়।
এই অর্থে, “স্পন্দ” হলো সেই আদ্যচেতনার শ্বাস-প্রশ্বাস—যেখানে নীরবতা ও নৃত্য, বিশ্রাম ও প্রকাশ, স্থিতি ও সৃজন একসঙ্গে ঘটে। অভিনবগুপ্ত বলেন—এই চেতনা কখনও সত্যিকার অর্থে স্থির নয়; সে চিরন্তন আত্ম-চলনে বিরাজমান, এবং সেই চলনই আনন্দের প্রতিফলন। তাই স্পন্দ কোনো “কর্ম” নয়—এটি চেতনার স্বভাব, তার প্রাণের ছন্দ।
“চলনাচলনাত্মা (calana-acalana-ātmā)”—এই শব্দটি কাশ্মীর শৈব দর্শনের এক অসাধারণ দার্শনিক প্রতীক, যা শিবচেতনার দ্বৈতাতীত প্রকৃতি প্রকাশ করে। এর আক্ষরিক অর্থ—যিনি একইসঙ্গে চলমান (calana) এবং অচল (acalana); অর্থাৎ, যাঁর মধ্যে স্থিরতা ও গতি একাকার হয়ে আছে। অভিনবগুপ্ত ও ক্ষেমরাজ দু-জনেই এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন শিবচেতনার সেই গভীর স্বরূপ বোঝাতে, যেখানে নীরবতা ও নৃত্য, স্থিতি ও স্পন্দন—দুটিই একে অপরের পরিপূরক, পৃথক নয়।
অভিনবগুপ্ত বলেন, যদি চেতনা নিস্পন্দ ও সম্পূর্ণ স্থবির হতো, তবে তা জড় বস্তু ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ স্থবিরতা মানেই প্রাণহীনতা। আবার, যদি চেতনা কেবল চলমান হতো—অর্থাৎ, কখনও বিশ্রাম না নিত—তবে তা অস্থির, চিরপরিবর্তনশীল, এবং অপরিণত হয়ে পড়ত। শিবচেতনা এই দুই সীমার বাইরে—তিনি এমন এক স্থির গতি বা নৃত্যরত নীরবতা, যেখানে গতি আছে, কিন্তু সেই গতি নিজেই স্থিত; নৃত্য আছে, কিন্তু সেই নৃত্যই ধ্যানের গভীরতা।
অভিনবগুপ্ত এই চেতনার প্রকৃতিকে স্পন্দ নির্ণয়-এ ব্যাখ্যা করেন এভাবে—চেতনা নিজের অস্তিত্বে বিশ্রাম নিচ্ছে, অথচ সেই বিশ্রামই এক অন্তর্গত কম্পন। তাঁর ভাষায়, “ন হি কিঞ্চিদস্পন্দময়মস্তি”—এই বিশ্বে এমন কিছুই নেই, যা স্পন্দহীন। অর্থাৎ, প্রতিটি জীব, প্রতিটি ভাব, প্রতিটি ক্ষণ—সব কিছুর অন্তর্গত কেন্দ্রে এই “চলনাচলনাত্মা” চেতনা কাজ করছে।
একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যায়—সমুদ্র যখন শান্ত থাকে, বাইরে থেকে মনে হয় স্থির; কিন্তু গভীরে তার তরঙ্গ চলমান। আবার, সেই তরঙ্গ কখনোই সমুদ্র থেকে আলাদা নয়। সমুদ্রের স্থিরতা ও তরঙ্গের গতি একে অপরের বিপরীত নয়—বরং একই জলরাশির দুই প্রকাশ। ঠিক তেমনই, শিবচেতনা একইসঙ্গে স্থির ও গতি-ময়।