শৈব কালী: দুই


চিদ্-ইচ্ছা-শক্তি (Cid-Icchā-Śakti) কাশ্মীর শৈব দর্শনের অন্যতম মৌলিক তত্ত্ব, যা “চেতনা” (cit) বা “সংবিত্‌” (saṁvid)-এর অন্তর্নিহিত সৃজনশীল প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে। এটি তিনটি অবিচ্ছেদ্য দিকের সংযোজিত রূপ—চিদ্‌ (Citi), অর্থাৎ শুদ্ধ চেতনা; ইচ্ছা (Icchā), অর্থাৎ সেই চেতনার আত্ম-প্রকাশের অন্তঃপ্রেরণা; এবং শক্তি (Śakti), অর্থাৎ সেই ইচ্ছার কার্যকর রূপ—যার মধ্য দিয়ে চেতনা নিজেকে প্রকাশ করে।

অভিনবগুপ্ত তাঁর ‘স্পন্দ নির্ণয়’ (Spanda Nirṇaya) এবং ‘তন্ত্রালোক’ (Tantraloka–The Light on and of the Tantras)-এ এই ধারণাকে বিশদে উন্মোচন করেছেন। তিনি বলেন—শিবচেতনা নিঃসংশয়ভাবে পরম স্থির, কিন্তু সেই স্থিরতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এক সূক্ষ্ম চলন (calana), এক অন্তর্গত কম্পন বা নাড়ন, যা কোনো বাহ্যিক কারণে নয়, বরং স্বয়ং তাঁর নিজের ইচ্ছাশক্তিতে। এই সূক্ষ্ম চলনই স্পন্দ (Spanda)। তাই অভিনবগুপ্তের সংজ্ঞায়—“স্পন্দঃ নাম স্বপ্রত্যবমর্শলক্ষণঃ চিদিচ্ছাশক্তির ঈষৎ চলনঃ।” (স্পন্দ নির্ণয়, কারিকা ১.১) "স্পন্দঃ নাম (স্পন্দ হলো) স্ব-প্রত্যবমর্শ-লক্ষণঃ (স্ব-প্রত্যবমর্শ যার লক্ষণ বা চিহ্ন), চিৎ-ইচ্ছা-শক্তির (চিৎ বা চেতনা-রূপী ইচ্ছা-শক্তির) ঈষৎ চলনঃ (সামান্য বা সূক্ষ্ম স্পন্দন বা আন্দোলন)।" অর্থাৎ—স্পন্দ হলো চেতনা-রূপী ইচ্ছাশক্তির সেই সূক্ষ্ম স্পন্দন, যা আত্ম-সচেতনতা বা স্ব-প্রত্যবমর্শের দ্বারা চিহ্নিত। এই সংজ্ঞাটি ‘স্পন্দ দর্শন’-এর মূলভাব ধারণ করে এবং এটি তিনটি মূল ধারণাকে একত্রিত করে:

১. স্পন্দ (Spanda): স্পন্দ-এর আক্ষরিক অর্থ হলো কম্পন, স্পন্দন, বা সূক্ষ্ম আন্দোলন। তবে এটি জাগতিক বা যান্ত্রিক কম্পন নয়। এটি হলো পরম শিব-এর (Parama Śiva, চূড়ান্ত বাস্তবতা) অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও সৃষ্টির ইচ্ছারূপে একটি অভ্যন্তরীণ, সূক্ষ্ম আলোড়ন। এটি এমন একটি গতি, যা নিশ্চলতা-কে লঙ্ঘন করে না।

২. চিৎ-ইচ্ছা-শক্তি (Cidicchā Śakti): এই স্পন্দনটি হলো চিৎ (Cit, চেতনা)-এর ইচ্ছাশক্তি (icchā śakti)-এরই প্রকাশ। এটি পরম চেতনার সেই গতিশীল ক্ষমতা, যা বিশ্ব-সৃষ্টির দিকে প্রথম পদক্ষেপ নিতে চায়। এই শক্তির চলনই স্পন্দ।

৩. স্ব-প্রত্যবমর্শ-লক্ষণ (Svapratyavamarśa-lakṣaṇa): এটি স্পন্দ-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রত্যবমর্শ মানে প্রতিফলন বা স্ব-সচেতনতা (self-awareness)। স্ব-প্রত্যবমর্শ হলো পরম চেতনার নিজের স্ব-রূপ বা অহং ('I-ness') সম্পর্কে সচেতনতা।

স্পন্দ হলো শিবের সেই অভ্যন্তরীণ স্পন্দন, যা সৃষ্টি করার আগে 'আমি এই বিশ্ব সৃষ্টি করব'—এই রূপের আত্ম-সচেতনতা প্রকাশ করে। এই জ্ঞান বা স্বীকৃতিই (Pratyabhijñā) স্পন্দকে চিহ্নিত করে। এটি পরম চেতনার সেই সূক্ষ্ম, আভ্যন্তরীণ স্পন্দন, যা তার পরম স্বাধীনতা এবং আত্ম-সচেতনতার মাধ্যমে মহাজাগতিক কার্যকলাপের সূচনা করে। এটি নিছক আন্দোলন নয়, বরং সৃষ্টির দিকে চেতনার প্রথম ঝলক। এ হচ্ছে সেই চেতনা, যার স্বরূপই নিজের প্রতি সচেতনতা, আর যার ইচ্ছাশক্তি অতি সূক্ষ্মভাবে আন্দোলিত।

এখানে চিদ্‌ (Cid) হলো সেই সর্বব্যাপী আত্মজ্যোতি—স্বয়ং-উজ্জ্বল চেতনা, যা কিছু জানে বা অনুভব করে, তার পেছনে যা চিরসচেতন সাক্ষীস্বরূপ উপস্থিত। এটি কোনো বস্তুর মতো নয়; এটি সেই চেতনার মর্মযৌগ, যা সব উপলব্ধির ভিত্তি।

ইচ্ছা (Icchā) সেই চেতনার প্রথম গতি বা আকাঙ্ক্ষা—যেখানে নিস্তরঙ্গ স্বরূপের মধ্যে এক সৃজনতাড়না জেগে ওঠে। এই ইচ্ছা কোনো কামনা নয়, বরং এক স্ব-প্রকাশ-ইচ্ছা—চেতনার নিজের মধ্যে নিজের দীপ্তি অনুভব করার স্বাভাবিক প্রবণতা। অভিনবগুপ্ত বলেন, তদীয়া ইচ্ছাশক্তি-এব সর্বস্য কারণম্। (তদীয়া (তাঁহার): এখানে পরমেশ্বর (শিব) বা পরম শক্তি (দেবী)-কে নির্দেশ করা হচ্ছে। ইচ্ছাশক্তি (Icchā Śakti): পরম সত্তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি। এব (ই): কেবল বা নিশ্চিতভাবে এই অর্থকে জোর দেয়। সর্বস্য (সকলের): সমগ্র মহাবিশ্বের বা সৃষ্টির। কারণম্ (কারণ): মূল উৎস বা কারণ।) অর্থাৎ, তাঁর (পরমেশ্বরের) ইচ্ছাশক্তিই (ইচ্ছা শক্তি) সকলের (সর্বস্য) কারণ (কারণম্)।

এই ইচ্ছা যখন নিজেকে কার্যকর করে, তখন সেটিই হয়ে ওঠে শক্তি (Śakti)—যা চেতনার সৃজন, স্থিতি, সংহার, গোপন ও অনুগ্রহ—এই পাঁচটি চিরন্তন ক্রিয়ায় প্রকাশিত হয়। শক্তিই চেতনার গতিশীল দিক; তিনি সেই পরম শক্তি, যিনি নিস্তব্ধ শিবচেতনার মধ্যেই নৃত্য করেন, নিজের স্পন্দনে মহাবিশ্বের রূপ ধারণ করেন। এই উক্তিটি মূলত কাশ্মীর শৈবদর্শন-এর (Pratyabhijñā এবং Spanda শাখা)-এর একটি কেন্দ্রীয় নীতিকে প্রকাশ করে। এই দর্শনের মূল কথা হলো:

১. পরম সত্তা: চূড়ান্ত বাস্তবতা হলেন শিব। তিনি হলেন বিশুদ্ধ চেতনা (চিৎ) এবং পরম স্বাধীনতা (স্বাতন্ত্র্য) দ্বারা পরিপূর্ণ।

২. ইচ্ছাশক্তি: এই চেতনা স্থবির নয়, এটি সর্বদা গতিশীল। সৃষ্টির মূলে রয়েছে তাঁর ইচ্ছাশক্তি (Icchā Śakti)। জগৎ কোনো বাহ্যিক উপাদান বা অন্য কোনো শক্তির কারণে সৃষ্টি হয়নি, বরং পরম শিবের নিজস্ব ইচ্ছার স্বাধীন স্ফূরণ-এর ফল।

৩. সৃষ্টির ক্রম: কাশ্মীর শৈবমতে, সৃষ্টি তিনটি প্রধান শক্তির মাধ্যমে ঘটে—ইচ্ছাশক্তি (Icchā Śakti): সৃষ্টির প্রথম সঙ্কল্প বা সংকল্প। এটিই মূল কারণ। জ্ঞানশক্তি (Jñāna Śakti): সৃষ্টব্য জগতের রূপরেখা বা জ্ঞানগত ধারণাকে মূর্ত করা। ক্রিয়াশক্তি (Kriyā Śakti): বাস্তবে সেই ইচ্ছা ও জ্ঞানকে প্রকাশ বা রূপায়ণ করা।

এই বাক্যটি ঘোষণা করে যে, মহাবিশ্বের সমগ্র বৈচিত্র্য ও প্রকাশের পিছনে অন্য কোনো উপাদানের ভূমিকা নেই, শুধুমাত্র পরম চেতনার ঐশ্বরিক ইচ্ছাশক্তিই হলো একমাত্র কার্যকারণ। তাই চিদ্‌, ইচ্ছা ও শক্তি—এই তিনটি আসলে এক বাস্তবতার তিন রূপ। চিদ্‌ হলো আলো, ইচ্ছা সেই আলোর স্বপ্রকাশের তাড়না, আর শক্তি সেই আলোর ক্রিয়াশীলতা। এগুলি আলাদা নয়; একে অপরের মধ্যে পরিণত হয়ে ওঠে। যখন চেতনা নিজের সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে, তখন তিনি ইচ্ছা; যখন সেই ইচ্ছা কার্যকর হয়, তখন শক্তি; আর যখন শক্তি নিজের উৎসে ফিরে যায়, তখন আবার চিদ্‌—এভাবে এক চিরন্তন চক্র সম্পূর্ণ হয়।

এই চিদ্-ইচ্ছা-শক্তি তত্ত্বের গভীর তাৎপর্য এই যে, এটি বাস্তবতার মধ্যে কোনো নিষ্ক্রিয়তা রাখে না। চেতনা নিস্তরঙ্গ হলেও, তা এক জীবন্ত স্থিরতা—যার মধ্যে প্রতিক্ষণ অন্তর্গত নাড়ন বা কম্পন জাগে। এখানেই কাশ্মীর শৈব দর্শনের অদ্বৈতবোধ বেদান্ত থেকে পৃথক—বেদান্ত যেখানে চেতনার স্থির, নিরাকার দিকটিকে প্রধান করে, শৈবদর্শন সেখানে সেই চেতনার স্পন্দমান, সৃষ্টিশীল দিক—ইচ্ছাশক্তি-কেই মহাবিশ্বের মূল বলে ঘোষণা করে।

চিদ্-ইচ্ছা-শক্তি কেবল কোনো তাত্ত্বিক গঠন নয়; এটি চেতনার অন্তর্গত অভিজ্ঞতা—যেখানে উপলব্ধি হয়, আমি যে জ্ঞানী (knower), আমি যে জানি (knowing) এবং আমি যা জানি (known)—সবই একই পরম চেতনার স্পন্দিত ঐক্য। এই উপলব্ধিই “স্পন্দসিদ্ধি”—চেতনার স্বপ্রকাশমান স্বাধীনতার উপলব্ধি—যেখানে প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি ভাব, প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে ওঠে চিদ্‌-ইচ্ছা-শক্তির জীবন্ত অভিব্যক্তি।

স্পন্দসিদ্ধি (Spandasiddhi) কাশ্মীর শৈব দর্শনের এক মৌলিক ও জীবন্ত ব্যাখ্যা, যেখানে চেতনার প্রাণশক্তিকে “স্পন্দ” নামে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর রচয়িতা ভট্ট কল্লট (Bhaṭṭa Kallaṭa), যিনি ভাসুগুপ্ত (Vasugupta)-র শিষ্য ছিলেন। ভাসুগুপ্ত শিবসূত্র (Śiva-sūtra)-র মাধ্যমে কাশ্মীর শৈব অদ্বৈতবাদের মূল সূত্রগুলি প্রকাশ করেন, আর কল্লট সেই সূত্রের জীবন্ত অন্তরপ্রাণকে উন্মোচন করেন তাঁর স্পন্দকারিকা (Spanda-kārikā) ও পরবর্তী ব্যাখ্যাগ্রন্থ স্পন্দসিদ্ধি-তে।

‘স্পন্দ’ (Spanda) শব্দের অর্থ “নাড়ন” বা “কম্পন”, কিন্তু এখানে তা কোনো বাহ্যিক গতি নয়। এটি চেতনার অন্তর্গত জীবন্ততা—এক আত্ম-সচেতন আন্দোলন, যা স্থিরতায়ও গতি, আর নীরবতায়ও ধ্বনি। শিব, যিনি চেতনা, তিনি নিস্তব্ধ অথচ চিরজাগ্রত; তাঁর মধ্যেই এই আত্ম-স্পন্দন চিরকাল প্রবাহিত। স্পন্দ মানে চেতনার সেই অন্তঃকম্পন, যা কোনো বস্তুর প্রতি নয়, বরং নিজের প্রতিই সচেতন।

ভট্ট কল্লট বলেন, শিবই এই স্পন্দন; তিনি নিস্পন্দ নন। তাঁর স্থির দীপ্তি (prakāśa) ও আত্মসচেতন প্রতিফলন (vimarśa)—এই দুই মিলেই চেতনা জীবন্ত হয়ে ওঠে, আর এই মিলনের নামই “স্পন্দ।” চেতনা কেবল আলো নয়, এটি আত্ম-উজ্জ্বল আলো—যা নিজেকেই জানে, নিজেরই প্রতিফলন অনুভব করে। এইভাবে শিব নিজেই নিজের স্পন্দনের মাধ্যমে জগৎ সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় সম্পাদন করেন।

স্পন্দকারিকা বলে—“যত্র যত্র মনঃ স্থিতম্‌, তত্র তত্র সমাধয়ঃ”— (যত্র যত্র (Yatra yatra): যেখানে যেখানেই; মনঃ (manaḥ): মন; স্থিতম্‌ (sthitam): স্থিত হয়/থাকে; তত্র তত্র (tatra tatra): সেখানেই সেখানেই; সমাধয়ঃ (samādhayaḥ): সমাধি (বহুবচন)) অর্থাৎ, "যেখানেই মন স্থির হয়, সেখানেই সমাধির উপলব্ধি ঘটে।" প্রতিটি মানসিক গতি, চিন্তা বা অনুভূতিই চেতনার স্পন্দন; যদি সেই স্পন্দনের উৎসে ফিরে যাওয়া যায়, তবে তার মধ্যেই পরম চেতনার উপলব্ধি ঘটে। এই উপলব্ধি কোনো কর্ম নয়, বরং নিজের সচেতনতার মধ্যেই স্থিত হওয়া।

এই শ্লোকটি স্পন্দ দর্শন-এর একটি অভিনব শিক্ষাকে তুলে ধরে। এটি সাধারণ যোগের ধারণাকে অতিক্রম করে, যেখানে সমাধির জন্য দীর্ঘকাল এক নির্দিষ্ট স্থানে এক বস্তুর উপর মনকে স্থির করার প্রয়োজন হয়।

১. সর্বত্র পরমেশ্বরের স্বীকৃতি: মন যখন কোনো নির্দিষ্ট পবিত্র স্থানে বা ধ্যানের বস্তুতে স্থির হয়, তখনই সমাধি হয়। স্পন্দ-এর শিক্ষা—যেহেতু পরম চেতনা (Śiva) বা স্পন্দ শক্তি (Spanda Śakti) সর্বব্যাপী (omnipresent) এবং সমস্ত বস্তুর অন্তর্নিহিত, তাই মন যখনই জাগতিক কোনো বস্তুতে (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) স্থির হয়, তখন তাৎক্ষণিকভাবেই সেই বস্তুর অন্তর্নিহিত চৈতন্যকে স্পর্শ করে।

২. জাগতিক অভিজ্ঞতাকে মুক্তির পথে ব্যবহার: এই শিক্ষা যোগীকে শেখায় যে, জাগতিক অভিজ্ঞতাগুলো মুক্তির পথে প্রতিবন্ধক নয়, বরং উপায়। দৈনন্দিন জীবনে যখনই মন কোনো চিন্তা, শব্দ, বা ইন্দ্রিয়জ অনুভূতির উপর স্থির হয়, তখন সেই স্থিরতা-র মুহূর্তটিতে মনের গতি থামে। তাৎক্ষণিক সমাধি—সেই স্থিরতার বা স্পন্দহীনতার মুহূর্তেই মনের স্বভাবগত চাঞ্চল্য (Vṛtti) সামান্য সময়ের জন্য বিলীন হয়ে যায়। এই ক্ষণস্থায়ী বিরতি-টিই হলো স্পন্দ বা পরম চেতনার ঝলক—যা সমাধি-রই একটি ক্ষুদ্র রূপ।

৩. সর্বাবস্থায় মুক্তি: এই শ্লোকটি যোগীর জন্য সর্বাবস্থায় মুক্তি (Jīvanmukti) লাভের পথ খুলে দেয়। এর মাধ্যমে সাধক উপলব্ধি করেন যে, সমস্ত মননশীলতা বা চেতনার ক্রিয়া, তা সে সাধারণ চিন্তাই হোক বা গভীর ধ্যান—সব কিছুর মূলে রয়েছে সেই এক, অবিচ্ছিন্ন স্পন্দ বা পরম চৈতন্য। তাই পৃথকভাবে 'সমাধি লাভ' করার প্রয়োজন নেই, কারণ সমস্ত অবস্থাই চৈতন্যময়। এই উপলব্ধির মাধ্যমে, মন (manas) নিজেই মুক্তির পথ বা দ্বার হয়ে ওঠে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে জীবন্মুক্তি এমন এক চেতনা-অবস্থা, যেখানে মানুষ জীবিত অবস্থাতেই মুক্তির অভিজ্ঞতা লাভ করে—অর্থাৎ, শরীর, মন, ইন্দ্রিয়, চিন্তা ও ক্রিয়ার মধ্য দিয়েও তার অন্তর্লীন স্বরূপ শিবচেতনার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত থাকে। এখানে মুক্তি কোনো ভবিষ্যৎ অবস্থা নয়, কোনো মৃত্যুর পর প্রাপ্ত ফল নয়; এটি বর্তমানেই উপলব্ধ এক সত্য, যেখানে ব্যক্তি উপলব্ধি করে—“আমি-ই সেই চেতনা, যা সমস্ত জগতের উৎস।” শৈব আচার্য ভাসুগুপ্ত, কল্লট ও অভিনবগুপ্ত সবাই একমত যে, মুক্তি মানে কোনো স্থানান্তর নয়, বরং স্বরূপে প্রত্যাবর্তন—চেতনা নিজের উৎসে ফিরে আসে, নিজের অখণ্ড দীপ্তিতে জেগে ওঠে।

‘শিবসূত্র’-এর প্রথম সূত্র “চৈতন্যম্‌ আত্মা”—এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর উক্তিই কাশ্মীর শৈব দর্শনের সমস্ত অধিবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করে। এখানে বলা হয়েছে, আত্মা (Ātman) কোনো জড় বা ব্যক্তিগত সত্তা নয়, বরং চেতনা (Caitanya) নিজেই। অর্থাৎ, যা-কিছু বিদ্যমান, যা জানে, দেখে, অনুভব করে—সবই চেতনারই প্রকাশ। এই উক্তি দ্বারা ভাসুগুপ্ত ঘোষণা করতে চেয়েছেন যে, মুক্তি বা ঈশ্বর উপলব্ধি কোনো বাহ্য অভিজ্ঞতার বিষয় নয়; এটি নিজের চেতনার অন্তর্নিহিত স্বরূপকে চিনে নেওয়া—নিজের মধ্যেই সেই শিবচেতনার জাগরণ।