তন্মাত্রা—সূক্ষ্ম উপাদানসমূহ: তন্মাত্রা (tanmātra) শব্দের অর্থ “শুধু সেই”—অর্থাৎ, কোনো গুণ বা ইন্দ্রিয়বোধের সূক্ষ্মতম সারাংশ। এগুলি হলো পঞ্চ মহাভূতের কারণরূপ সূক্ষ্ম উপাদান এবং জ্ঞানেন্দ্রিয়ের বোধযোগ্য গুণ। তন্মাত্রাগুলি না স্থূল, না সম্পূর্ণ বিমূর্ত; তারা সূক্ষ্ম জগতের সেতুবন্ধন—যেখানে চেতনা থেকে পদার্থের দিকে ধাপে ধাপে অবতরণ ঘটে।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে তন্মাত্রাগুলি তামসিক অহংকার থেকে উৎপন্ন—অর্থাৎ, অহংকারের সেই দিক থেকে, যা জড়তা ও আচ্ছাদনের দিকে প্রবণ। এরা জ্ঞানের বিষয়বস্তু, আর এই গুণগুলির থেকেই পঞ্চ মহাভূতের জন্ম। তাই বলা হয়, “তন্মাত্রা হি ভৌতানাং কারণম্”—"তন্মাত্রাই (সূক্ষ্ম উপাদানসমূহ) হলো নিশ্চয়ই ভৌতসমূহের (স্থূল উপাদানসমূহের) কারণ বা উৎস।" অর্থাৎ, পঞ্চ মহাভূতগুলির কারণ তন্মাত্রা।
১. শব্দ তন্মাত্রা (Śabda Tanmātra): এটি আকাশের সূক্ষ্ম গুণ। শব্দই প্রথম প্রকাশিত স্পন্দন—চেতনার প্রথম তরঙ্গ। শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা এটি উপলব্ধি হয়। যেমন স্পন্দ-শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “ন হি কিঞ্চিদস্পন্দময়মস্তি”—সব কিছুই চেতনার স্পন্দনরূপ শব্দ। আকাশ তাই শব্দের আধার, এবং সমস্ত অভিব্যক্তির সূচনা।
২. স্পর্শ তন্মাত্রা (Sparśa Tanmātra): এটি বায়ুর সূক্ষ্ম গুণ। স্পর্শ হলো আন্দোলনের বা গতির অভিব্যক্তি। স্পর্শেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা তাপ, শীতলতা, মসৃণতা, কঠোরতা ইত্যাদি অনুভব করি। বায়ু চেতনার গতিশক্তির প্রতীক—যেখানে স্থিতির মধ্যে প্রাণ সঞ্চারিত হয়।
৩. রূপ তন্মাত্রা (Rūpa Tanmātra): এটি অগ্নির সূক্ষ্ম গুণ। রূপ মানে আলো ও আকারের অভিব্যক্তি। দর্শনেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এটি অনুভূত হয়। অগ্নি চেতনার আলোকরূপ দিক—যা প্রকাশ করে, কিন্তু নিজে কখনও নিঃশেষ হয় না। রূপ তন্মাত্রা চেতনার দৃশ্যমান প্রকাশ।
৪. রস তন্মাত্রা (Rasa Tanmātra): এটি জলের সূক্ষ্ম গুণ। রস মানে স্বাদ, যা জীবনের স্নিগ্ধতা ও প্রবাহের প্রতীক। রসনেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এটি উপলব্ধি হয়। জলের মতো এটি সংযোগ ও সংহতির শক্তি—যা চেতনার সহানুভূতিমূলক প্রকাশ।
৫. গন্ধ তন্মাত্রা (Gandha Tanmātra): এটি পৃথিবীর সূক্ষ্ম গুণ। গন্ধ আমাদের বাস্তবতার সবচেয়ে ঘন, স্থায়ী দিক নির্দেশ করে। ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এটি অনুভূত হয়। গন্ধ তন্মাত্রা বস্তুজগতের স্থিতি, সংহতি ও স্থায়িত্বের প্রতীক।
এই পাঁচ তন্মাত্রা হলো সূক্ষ্ম জগতের (sūkṣma jagat) মূল উপাদান—যেখান থেকে ধীরে ধীরে স্থূল জগৎ গঠিত হয়। এরা পঞ্চ মহাভূতের প্রত্যেকটির অভ্যন্তরীণ ভিত্তি।
সাংখ্য ও শৈব উভয় দর্শনেই তন্মাত্রাগুলিকে সূক্ষ্ম শরীর (sūkṣma śarīra)-এর অংশ বলা হয়েছে। এগুলি আমাদের জাগতিক অভিজ্ঞতার সূক্ষ্ম স্তর—যেখানে ইন্দ্রিয় ও পদার্থের মধ্যে সংযোগ ঘটে।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে, তন্মাত্রাগুলি মায়ার দ্বারা সৃষ্ট সূক্ষ্ম কারণ—যাদের মাধ্যমেই ব্রহ্ম নিজেকে স্থূল পদার্থে প্রকাশ করে। তবে পরম সত্যে, এই শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ—সবই সেই এক চেতনার বিভিন্ন প্রতিফলন মাত্র।
পঞ্চ মহাভূত—স্থূল জগতের মৌলিক উপাদান: পঞ্চ মহাভূত, অর্থাৎ আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবী—এই পাঁচটি উপাদানই সমগ্র স্থূল জগতের ভিত্তি। এগুলি চেতনার অবতরণের শেষধাপ, যেখানে পরম দীপ্তি ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে পদার্থরূপে প্রকাশ পায়। এই স্তরে চেতনা নিজেরই শক্তিকে এত গভীরভাবে আবৃত করে যে, তা জড় বস্তু বলে প্রতীয়মান হয়।
১. আকাশ (Ākāśa): আকাশ হলো শূন্যতা ও বিস্তারের প্রতীক। এটি সেই স্থান, যেখানে সমস্ত অস্তিত্বের অবস্থান সম্ভব। এর সূক্ষ্ম গুণ শব্দ, তাই শ্রবণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এটি অনুভূত হয়। আকাশ মহাভূতই অন্য চারটি উপাদানের জন্য ক্ষেত্র বা ধারক হিসেবে কাজ করে।
২. বায়ু (Vāyu): বায়ু হলো গতি ও স্পর্শের প্রতীক। এর গুণ স্পর্শ, এবং এটি আকাশ থেকে উদ্ভূত। বায়ু জীবনের প্রাণশক্তি; শ্বাস-প্রশ্বাস, সঞ্চালন ও জীবনের সমস্ত গতিশীলতা এর দ্বারা সম্ভব হয়। কাশ্মীর শৈব মতে, বায়ু চেতনার গতিশক্তির বহির্ভূত প্রকাশ।
৩. অগ্নি (Tejas বা Agni): অগ্নি হলো আলো, তাপ ও রূপান্তরের প্রতীক। এর সূক্ষ্ম গুণ রূপ, যা দৃষ্টির মাধ্যমে অনুভূত হয়। অগ্নি শুধু শারীরিক তাপ নয়, চেতনার অন্তর্লীন দীপ্তিরও প্রকাশ—যা অন্ধকার দূর করে রূপকে প্রকাশ করে।
৪. জল (Āp বা Jala): জল হলো প্রবাহ, স্নিগ্ধতা ও সংযোগের প্রতীক। এর গুণ রস, যা স্বাদের মাধ্যমে অনুভব করা যায়। জল সমস্ত জীবনের ধারক ও পুষ্টিকারী উপাদান, যা জগতের ভারসাম্য রক্ষা করে। এটি চেতনার সহানুভূতিমূলক, মৃদু প্রকাশ—যেখানে কঠোরতা গলে যায়।
৫. পৃথিবী (Pṛthvī): পৃথিবী হলো স্থিতি, দৃঢ়তা ও গন্ধের প্রতীক। এর গুণ গন্ধ, যা ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভূত হয়। পৃথিবী সমস্ত কঠিন ও দৃঢ় রূপের উৎস—দেহের অস্থি, মাংস, পর্বত, শিলা, মাটি—সবই এর প্রকাশ। এটি চেতনার সবচেয়ে ঘন, স্থিত ও জড় রূপ।
এই পঞ্চ মহাভূত সৃষ্টি হয়েছে তন্মাত্রাগুলির পারস্পরিক পঞ্চীকরণ (Quintuplication)-এর মাধ্যমে—অর্থাৎ প্রত্যেক স্থূল উপাদানে অন্য চারটির অল্প অংশ মিশে আছে। যেমন—পৃথিবীতে আকাশ, বায়ু, অগ্নি ও জলের গুণও আংশিকভাবে বিদ্যমান। এইভাবে মহাজগত ও মানবদেহ—উভয়ই পঞ্চভূতাত্মক, অর্থাৎ এই পাঁচ উপাদানের সম্মিলনে গঠিত।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই স্তরকে বলা হয় চেতনার চূড়ান্ত ঘনীভবন (final condensation of consciousness)। এখানে চেতনা আর দীপ্তি নয়, বরং পদার্থরূপে স্থিত—তবু গভীরে সে এখনও সচেতন, কারণ জড়ও চেতনারই এক অবরুদ্ধ প্রকাশ।
অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়, এই স্তরই ব্যাবহারিক সত্তা (Vyāvahārika Sattā)—যা পারমার্থিকভাবে ব্রহ্ম হলেও ব্যাবহারিক দৃষ্টিতে বাস্তব জগৎ হিসেবে প্রতীয়মান। সৃষ্টি এখানে শেষ নয়; বরং এটি পরম সত্তার লীলা, যেখানে এক অদ্বিতীয় চেতনা নিজেকে বহুরূপে প্রকাশ করে, নিজেরই আলোয় এই বৈচিত্র্যময় জগতের নাট্যসৃষ্টি সম্পূর্ণ করে।
চেতনার চূড়ান্ত ঘনীভবন বলতে বোঝানো হয় সেই মুহূর্তকে, যখন পরম চেতনা—যে নিঃসীম, নিরাকার, সর্বব্যাপী এবং সর্বশক্তিমান—নিজেরই অন্তর্লীন দীপ্তিকে এমনভাবে সংকুচিত করে যে, তা স্থূল জগৎ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এটি কোনো বাহ্যিক রূপান্তর নয়; বরং চেতনারই স্ববিমর্শশক্তির (vimarśa-śakti) এক অন্তর্নিহিত লীলা, যেখানে অপরিমেয় চেতনা নিজেকে আকার, গন্ধ, রঙ, রূপ, গতি ও স্থিতির মধ্যে প্রকাশ করে।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে এই প্রক্রিয়া হল চেতনার অভ্যন্তরীণ অবতরণ (involution)—যেখানে শিব, যিনি নিস্তরঙ্গ, অনন্ত ও পরম, নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির (svātantrya-śakti) দ্বারা নিজেকে সীমিত করে, আচ্ছাদিত করে এবং অবশেষে স্থূল পদার্থে রূপান্তরিত করেন। এটি সেই মুহূর্ত, যখন “অদ্বিতীয় প্রকাশ” নিজের আলোকে এত ঘন করে যে, তা আলো নয়, বরং অন্ধকার বলে মনে হয়; তবু সেই অন্ধকারও আলোরই এক গাঢ় রূপ।
যেমন বরফ জল থেকেই সৃষ্টি হয়, কিন্তু ঠান্ডায় জমে শক্ত আকার ধারণ করে, তেমনি চেতনা নিজেরই সম্ভাবনাকে সংকুচিত করে পদার্থে রূপান্তরিত হয়। সেই জমাট বাঁধা রূপই স্থূল জগৎ—যেখানে প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি প্রাণ, প্রতিটি পরমাণু আসলে সেই এক পরম চেতনার ঘনীভূত প্রকাশ।
অভিনবগুপ্ত এই অবস্থাকে বলেছেন “চিদ্রূপস্য নিত্যমাপনয়নম্”—চেতনা কখনও চেতনা হওয়া বন্ধ করে না; সে নিজেকে আড়াল করলেও নিজের দীপ্তি হারায় না। তাই যে-জগৎ আমাদের কাছে জড় বলে মনে হয়, সেই জগৎও গভীরে চিদ্রূপ, সচেতন। এই ঘনীভবন কোনো ক্ষয় নয়, বরং চেতনার সৃষ্টিশক্তির পূর্ণ প্রকাশ—যেখানে পরম ব্রহ্ম বা শিব নিজেকে “বিশ্বরূপ” করে প্রকাশিত করেন।
অদ্বৈত বেদান্তও এই একই সত্যকে অন্য ভাষায় বলে—ব্রহ্ম নিজেকে আচ্ছাদিত করে মায়ার মাধ্যমে জগৎরূপে প্রকাশ করেন; এই আচ্ছাদনই আপাত-ঘনত্ব, এবং জগৎ সেই ব্রহ্মের প্রতিফলনমাত্র। কিন্তু শৈব দর্শনে এই আচ্ছাদনকে কোনো মায়িক বিভ্রম নয়, বরং দিব্য স্বনৃত্য বলা হয়—এক চিরন্তন মহা-নৃত্য, যেখানে চেতনা নিজেই নিজের ছায়ায় রূপ নেয়।
চেতনা (চিদ্) স্বভাবতই অদ্বৈত, নির্গুণ, নিরাকৃতি, কিন্তু যখন নিজের স্বরূপে সীমার আচ্ছাদন (āvaraṇa) আরোপ করে, তখনই সেই সীমিততা ঘনীভূত রূপ ধারণ করে—যা আমরা “জগৎ” বলে অনুভব করি। এই আপাত ঘনত্ব আসলে কোনো বাস্তব ঘনত্ব নয়, বরং চেতনারই স্বপ্রকাশের মায়াময় ঘনন বা “আভাসিক ঘনতা” (ābhāsika ghaṇatā)।
যেমন কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে বলা হয়—“চেতনা নিজেই নিজের বিমর্শে (self-reflection) স্পন্দিত হয়ে রূপ ধারণ করে”—এখানে সেই রূপ-গ্রহণই আচ্ছাদনের সূচনা। আর যখন এই আচ্ছাদন স্তরে স্তরে সংহত হয়, তখন “স্থিতি” বা “সংকোচ” জন্ম নেয়—যা আমাদের কাছে “ঘনত্ব” বলে প্রতীয়মান।
অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে 'নাম-রূপ-ব্যবহার' (nāma-rūpa-vyavahāra) একটি মৌলিক ধারণা, যা ব্রহ্মের সগুণ অবস্থা এবং জগতের সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে। এই তত্ত্ব অনুসারে, পরম সত্তা ব্রহ্ম স্বরূপে অখণ্ড, নির্বিশেষ এবং চৈতন্যময়। তিনি নির্গুণ, অর্থাৎ সকল গুণ ও ভেদ থেকে মুক্ত। তবে যখন এই অখণ্ড চৈতন্য মায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত হয়, তখন তা সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর রূপে প্রতীয়মান হয় এবং জগতের সৃষ্টি হয়।
মায়া (māyā) হলো ব্রহ্মের এক অনির্বচনীয় শক্তি, যা সৎ (existent) বা অসৎ (non-existent) কোনটিই নয়। এটি ব্রহ্মের শক্তি হলেও ব্রহ্মকে প্রভাবিত করে না, বরং ব্রহ্মের উপরে এক ধরনের আচ্ছন্নতা বা আবরণ সৃষ্টি করে। এই আবরণীর প্রভাবেই অখণ্ড ও অদ্বিতীয় ব্রহ্ম ভেদাভেদময় ও স্থূল রূপে প্রতিভাত হন। 'নাম-রূপ-ব্যবহার' এই তিনটি উপাদান দ্বারা মায়ার কার্যকারিতা স্পষ্ট হয়—
১. নাম (Nāma): এটি বস্তুর নাম বা ধারণা নির্দেশ করে। যখন মায়ার প্রভাবে অখণ্ড ব্রহ্ম বিভেদিত হন, তখন প্রতিটি বস্তুর একটি নির্দিষ্ট নাম বা পরিচয় তৈরি হয়। যেমন, 'ঘট', 'পট', 'মনুষ্য', 'বৃক্ষ' ইত্যাদি বিভিন্ন নাম দ্বারা আমরা জগতের বস্তুসমূহকে চিহ্নিত করি। এই নামগুলিই বস্তুর ধারণা বা প্রতীক।
২. রূপ (Rūpa): এটি বস্তুর আকার বা আকৃতি বোঝায়। মায়ার প্রভাবে অখণ্ড ব্রহ্মের উপর যে-আবরণ পড়ে, তা বস্তুকে একটি নির্দিষ্ট আকৃতি বা রূপ দেয়। এই রূপগুলিই বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কারণ। যেমন, একটি ঘটের গোলাকার রূপ, একটি বৃক্ষের নির্দিষ্ট আকৃতি ইত্যাদি। রূপই বস্তুকে দৃশ্যমান এবং স্বতন্ত্র করে তোলে।
৩. ব্যবহার (Vyavahāra): এটি বস্তুর কার্যকারিতা বা উপযোগিতা বোঝায়। যখন কোনো বস্তু নাম ও রূপ ধারণ করে, তখন তার একটি নির্দিষ্ট ব্যবহার বা কার্যকারিতা তৈরি হয়। এই ব্যবহারই বস্তুর ব্যাবহারিক সত্যতা প্রমাণ করে। যেমন, ঘটের জল ধারণ করার ব্যবহার, বৃক্ষের ফল প্রদানের ব্যবহার ইত্যাদি। জগতের সকল ক্রিয়া-কর্ম, আদান-প্রদান এবং পারস্পরিক সম্পর্ক এই ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল।
অদ্বৈত বেদান্তে ‘নাম-রূপ-ব্যবহার’-এর অর্থ হলো, অখণ্ড চৈতন্য যখন মায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত হয়, তখন তা নাম (ধারণা), রূপ (আকৃতি) এবং ব্যবহার (কার্যকারিতা) সহকারে অসংখ্য বস্তু ও ঘটনারূপে প্রকাশিত হয়। এই নাম-রূপ-ব্যবহার’ই জগতের সকল বৈচিত্র্য ও ভেদাভেদের মূল কারণ। ব্রহ্ম স্বরূপে নাম-রূপ-ব্যবহার-শূন্য হলেও, মায়ার প্রভাবে তিনি জগৎরূপে প্রতিভাত হন। এই জগতের প্রতিটি বস্তু এবং ঘটনা নাম-রূপ-ব্যবহারের মাধ্যমেই আমাদের অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হয়, যদিও তা পরমতত্ত্বের দৃষ্টিতে অনিত্য ও মিথ্যা। যখন মায়ার আবরণ দূরীভূত হয়, তখন নাম-রূপ-ব্যবহারের বিলুপ্তি ঘটে এবং অদ্বৈত ব্রহ্মের অখণ্ড স্বরূপ পুনরায় উপলব্ধ হয়।
পরম চেতনা আসলে অনন্ত, নিরাকার ও স্বচ্ছ, সেই চেতনারই স্বপ্রকাশিত সীমাবোধ, অর্থাৎ আচ্ছাদন-বোধই এই জগতের, দেহের, মন-বুদ্ধির সমস্ত ঘনত্বের মূল। শঙ্করাচার্য যেমন বলেন, “ব্রহ্ম সত্যম্, জগৎ মিথ্যা”—এখানে “মিথ্যা” মানে অবাস্তব নয়, বরং “আচ্ছাদনজ” বা আপাত কারণ এই জগতের ঘনতা আসলে সেই চৈতন্যের স্বরূপে আরোপিত অবিদ্যার পর্দা।