লক্ষ্মণজুর ব্যাখ্যায়, মহাকালী হলেন সেই শক্তি, যিনি এক ভ্রূকুটি-মাত্রায় মহাবিশ্বের সকল রূপ-রেখাকে ভেঙে দেন, সময়-স্থানকে নিজের প্রকৃতিতে হজম করে ফেলেন। তিনি বলেন—“এখানে কোনো অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নেই; কিছুই জন্মায় না, কিছুই মরে না।” এই কথার অর্থ, সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেলে চেতনা দেখে—সকল পরিবর্তন আসলে নিত্য চেতনার এক খেলা; সৃষ্টি-লয়, জন্ম-মৃত্যু সবই একই অনন্ত সত্তার ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ।
মহাকালের প্রভু হিসেবে শিব সেই লীলার মাঝে আনন্দে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি কালীকে প্রতিহত করেন না, বরং তাঁর নৃত্যের মধ্যেই নিজের আনন্দ প্রকাশ করেন। তাই এখানে “কালী শিবের উপর নাচছেন” মানে কোনো জয়-পরাজয় নয়, বরং চেতনার নিজস্ব পূর্ণতা, যেখানে স্থিরতা ও গতি, নীরবতা ও শব্দ, পুরুষ ও প্রকৃতি—সব এক অনন্ত সমতলে মিলেমিশে আছে।
এইভাবে কালী একই সঙ্গে শক্তি ও জীবাত্মা—তিনি মহাশক্তি হিসেবে পরমচেতনার গতি, আর জীবাত্মা হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে সেই গতির ক্ষুদ্র প্রতিফলন। কাশ্মীর শৈবমতে, সাধক যখন অন্তরে গভীরভাবে প্রবেশ করে নিজের শক্তির পথ ধরে চলে, তখন সে দেখে—যে-বাধাগুলো তাকে বেঁধে রেখেছিল, সেগুলো আসলে শিব-চেতনারই ভিন্ন রূপ। তাই সেই পথ শেষপর্যন্ত শিবের দিকেই নিয়ে যায়; কারণ শক্তি ছাড়া শিব নেই, আর শিব ছাড়া শক্তিও নয়।
শিব ও কালী হলেন এক চেতনা-বাস্তবতার দুই পরিপূরক মেরু। শিব হলেন বিশুদ্ধ, নিরাকার আত্মন—চেতনার আলোকস্বরূপ, আর কালী হলেন সেই আলোর প্রতিফলিত গতি—যিনি নিজেরেই “আমি” বলে অনুভব করেন। এই ঐক্যই প্রকাশ করে যে, কর্তা ও কর্ম, জানার শক্তি ও জানা বস্তু, দর্শক ও দৃশ্যমান—সবই অবিচ্ছেদ্য এক চেতনা। আমাদের প্রতিটি উপলব্ধি, চিন্তা, অনুভূতি, কর্ম আসলে শিব-চেতনারই স্পন্দন—যেখানে দৃষ্টা ও দৃশ্য, শক্তি ও শিব, এক অবিচ্ছিন্ন পরম ঐক্যে নৃত্যরত।
কাশ্মীর শৈব দর্শনে কালীর ত্রিগুণাত্মক গতিশীলতা—স্থিতি, উত্থান, বিলয়—চেতনার চিরন্তন ছন্দের প্রতীক। এই তিনটি শব্দের মধ্যেই কালীশক্তির সম্পূর্ণ নৃত্য নিহিত আছে। শৈবতত্ত্বের দৃষ্টিতে জগৎ বা অভিজ্ঞতা কোনো স্থির বস্তু নয়; বরং এক অবিরাম প্রক্রিয়া—স্থির হওয়া, উদ্ভাসিত হওয়া এবং নিজের উৎসে ফিরে গিয়ে মিলিয়ে যাওয়া। এই ধারাবাহিক তিন গতি হলো চেতনার নিজস্ব স্পন্দনের তিন দিক—যেখানে শিব ও শক্তি, স্থিরতা ও গতি, আলো ও প্রতিফলন একই প্রবাহে একাকার।
স্থিতি মানে সেই ভিত্তিগত স্থির সচেতনতা, যেখানে চেতনা নিজের দীপ্তিতে শান্তভাবে বিশ্রাম নিচ্ছে। এটি “ধারক” বা ভিত্তি—যার উপর সমস্ত অভিজ্ঞতা ঘটে। এটি শিবের প্রতীক—অচল, নিরাকার, কিন্তু সর্বব্যাপী। মানুষের ক্ষেত্রে এটি হলো সেই অন্তর্গত “সাক্ষীভাব”—যেখানে আমরা নিঃশব্দে দেখি, কিন্তু বিচার করি না; চেতনা কেবল উপস্থিত থাকে। এই অবস্থাতেই দেহ ও মনের মধ্যে “শিবের ভিত্তি” অনুভব করা যায়—স্থিরতার আলো।
উত্থান মানে সেই মুহূর্ত, যখন স্থির চেতনা নিজেরই আনন্দে নড়ে ওঠে—প্রকাশ পায় গতি, অনুভূতি, চিন্তা, সৃজনশক্তি। এটি কালীশক্তির নৃত্য, যেখানে আলোর স্থিতি তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়। চেতনা কাজের, অনুভবের বা ভাবনার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, আর সেই প্রবাহেই সৃষ্টি ও অভিজ্ঞতা জন্ম নেয়। তাই উত্থান হলো “বিমর্শ”-এর প্রতিচ্ছবি—চেতনা নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনতে শুরু করে।
বিলয় হলো সেই চূড়ান্ত গতি, যেখানে সকল অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, চিন্তা আবার নিজের উৎসে মিশে যায়। এটি কেবল ধ্বংস নয়, বরং পরম মিলন—যেখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞাত, দর্শক ও দৃশ্য, শক্তি ও শিব এক হয়ে যায়। অহং বা “আমি কর্তা” ভাব বিলীন হয়, আর চেতনা নিজের অসীম প্রকৃতিতে বিশ্রাম নেয়। বিলয় তাই “ছেড়ে দেওয়া”র মুহূর্ত—যখন জানা আর জানার মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকে না, কেবল একাত্মতা।
এই তিন দিক—স্থিতি, উত্থান, বিলয়—শুধু মানসিক অভিজ্ঞতার নয়, বরং মহাজাগতিক চক্রেরও মূল কাঠামো। মহানয়প্রকাশ (একটি ক্রমশাস্ত্র) এই সত্যটি স্পষ্টভাবে বলে: “যেমন মহাবিশ্বের উত্থান অনিবার্য, তেমনি এর স্থিতি ও বিলয়ও একজনের নিজস্ব অপরিহার্য প্রকৃতির প্রতিফলন।” মূল সংস্কৃত শ্লোকটি—“স্থিতিনাশৌ স্বভাবস্য স্বরূপো চ বিলপনম্”—অর্থাৎ, “স্থিতি ও বিলয় আসলে নিজের স্বভাবেরই প্রকাশ।” অর্থাৎ, জগৎ সৃষ্টি ও লয় কোনো বাহিরের ঘটনা নয়; শিবের নিজস্ব আত্মাই সেই স্থিতি ও বিলয়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করছে।
মানুষের অভিজ্ঞতায়ও এই তিন স্তর স্পষ্ট দেখা যায়: যখন মন শান্ত ও কেন্দ্রীভূত—সেটি স্থিতি; যখন আমরা কাজ, চিন্তা বা অনুভবের প্রবাহে আছি—সেটি উত্থান; আর যখন আমরা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করি—সেটি বিলয়। একে বলা যায়, প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা চেতনার এই তিন গতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
দার্শনিকভাবে এটি সেই শৈব-ক্রমতত্ত্বের প্রতিফলন, যেখানে এক অবিভেদ্য চেতনা—অবিভেদ্য শিব—নিজেকে সীমিত করে সংকুচিত শিব (saṅkucita Śiva)-এ পরিণত হন, এবং সেখান থেকে আবার স্পন্দ (বিশ্বজনীন স্পন্দন) ও বিমর্শ (আত্ম-প্রতিফলন)-এর মাধ্যমে নিজেকে জগৎ হিসেবে প্রকাশ করেন। সৃষ্টির এই “উত্থান-স্থিতি-বিলয়” তাই কোনো বাহ্যিক ঘটনাক্রম নয়; এটি চেতনার নিজের আনন্দময় স্পন্দনের প্রকাশ।
এভাবেই কালীর ত্রিগুণাত্মক গতি—স্থিতি, উত্থান ও বিলয়—হলো সেই শাশ্বত চেতনা-নৃত্যের ছন্দ, যেখানে বিশ্ব প্রতিক্ষণে জন্মায়, টিকে থাকে এবং নিজের উৎসে ফিরে যায়—কিন্তু কখনোই চেতনা থেকে আলাদা হয় না।
আধুনিক চেতনা-বিজ্ঞান ও কাশ্মীর শৈব দর্শনের মধ্যে এক গভীর সমান্তরালতা দেখা যায়—বিশেষত যখন স্থিতি, উত্থান, বিলয় এই তিনটি চেতনা-গতি আধুনিক মস্তিষ্ক-বিজ্ঞানের কাঠামোর সঙ্গে মেলানো হয়। এখানে স্থিতি—অর্থাৎ চেতনার ভিত্তিস্থাপন বা স্থির দীপ্তি—আধুনিক গবেষণায় যে “বিশুদ্ধ চেতনা” (pure consciousness) বা “জাগ্রত কিন্তু বিশ্রামপূর্ণ সচেতনতা” (wakeful resting awareness) বলে বর্ণিত, তারই এক দার্শনিক সমতুল্য।
এই অবস্থায় মন স্থির কিন্তু জাগ্রত—চিন্তা নেই, তবু উপস্থিতি অটুট। ধ্যানচর্চার ভাষায় এটি সেই অবস্থা, যখন মন কোনো ভাবনা বা বস্তুতে জড়ায় না, কেবল নিজের স্বচ্ছ উপস্থিতিতে স্থির থাকে। মাইন্ডফুলনেস-এর চর্চায় যেমন বলা হয়—“নীরবে জানা, কিন্তু প্রতিক্রিয়া না দেওয়া”—এই মনোভাবই স্থিতির আধুনিক প্রতিধ্বনি।
বিজ্ঞানী কার্ল ফ্রিস্টন তাঁর ফ্রি এনার্জি প্রিন্সিপল (FEP)-এ চেতনার যে মৌলিক কাজের ব্যাখ্যা দেন, সেটিও এই “স্থিতি”-র সঙ্গে আশ্চর্য মিল দেখায়। ফ্রিস্টনের মতে, জীব বা মস্তিষ্ক সর্বদা তার free energy—অর্থাৎ পূর্বাভাস ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য (prediction error)—কমিয়ে আনে, যাতে অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য বজায় থাকে। অন্যভাবে বললে, এটি এমন এক প্রাকৃতিক প্রবণতা, যার উদ্দেশ্য হলো নিজেকে ন্যূনতম প্রচেষ্টায় স্থিতিশীল রাখা। এই প্রক্রিয়াই আসলে চেতনার এক গভীর অন্তর্নিহিত বুদ্ধি—একধরনের “স্থিতির আকর্ষণকেন্দ্র” (stable attractor)—যা সব পরিবর্তনের মাঝেও নিজেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখে।
দার্শনিক ইভান থম্পসন তাঁর সক্রিয়তাভিত্তিক জ্ঞানতত্ত্ব বাসক্রিয় জ্ঞানতত্ত্ব (Enactive Cognition)-এ বলেন, চেতনা কোনো স্থির বস্তুর মতো নয়, বরং ক্রিয়ার মধ্যেই গঠিত এক জীবন্ত প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই ক্রিয়ার মধ্যেও থাকে এক “আকর্ষণকেন্দ্র”—যে স্থির বিন্দু থেকে চেতনার ক্রিয়া শুরু হয় এবং আবার সেখানেই ফিরে আসে। এই ব্যাখ্যা কাশ্মীর শৈব দর্শনের স্থিতি ধারণার সঙ্গে একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণ—চেতনা নিজস্ব কেন্দ্রে স্থিত থেকে নিজেরই তরঙ্গময় উত্থান ও বিলয়ের মধ্য দিয়ে জগৎ প্রকাশ করে।
মস্তিষ্কবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, স্থিতি-অবস্থা সম্ভবত সেই স্নায়ুকোষীয় মৌলিক সাম্যাবস্থা (Baseline Neural Homeostasis), যেখানে মস্তিষ্ক খুব কম শক্তি ব্যয় করে সর্বাধিক ভারসাম্য রক্ষা করে। অর্থাৎ, চিন্তা বা কাজের অতিরিক্ত চাপ নেই, তবু এক অন্তর্নিহিত সজাগতা বজায় থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, ধ্যানের সময় দেখা যায়—Default Mode Network (যা সাধারণত আত্ম-কেন্দ্রিক চিন্তা ও স্মৃতিচারণের সঙ্গে যুক্ত) নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে; sensory-motor বা ইন্দ্রিয়-চালনা সম্পর্কিত অংশগুলিও শান্ত থাকে; কিন্তু তবু চেতনা নিঃশব্দ অথচ সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় থাকে।
এই অবস্থাকেই বলা হয় “বিশ্রামপূর্ণ সতর্কতা” বা “বিশুদ্ধ চেতনা” (restful awareness / pure consciousness)—যেখানে মন ও দেহ দুই-ই বিশ্রাম নিচ্ছে, কিন্তু চেতনা এক নিস্তব্ধ দীপ্তিতে সক্রিয় ও উপস্থিত।
অভিজ্ঞতার দিক থেকে এটি এমন এক অবস্থা—যখন ধ্যানী নীরবে বসে আছেন, মন চিন্তাহীন কিন্তু সম্পূর্ণ জাগ্রত। চোখ খোলা থাকতে পারে, তবু দৃষ্টি নয়; ভাবনা আসতে পারে, কিন্তু সে সাড়া দেয় না। মন কেবল জানছে, কিন্তু কিছু আঁকড়ে ধরছে না—এটাই সেই “সাক্ষীচেতনা” (witness consciousness)।
শৈব দর্শনের স্থিতি ও আধুনিক চেতনা-বিজ্ঞানের নিশ্চিন্ত সজাগতা (restful alertness) মূলত একই চেতনা-ছন্দের দুই ভাষা। একটিতে এটি আত্ম-প্রকাশের দার্শনিক রূপ, অন্যটিতে নিউরোফিজিওলজিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক বর্ণনা। উভয়েই জোর দেয় এমন এক ভিত্তিগত সচেতনতার ওপর, যেখানে জানা মানে থাকা, আর থাকা মানেই জানা।
এভাবে, “স্থিতি” কেবল ধ্যানমূলক বিশ্রাম নয়; এটি চেতনার গভীর আত্মসংবৃত ভারসাম্য—যেখানে মস্তিষ্ক, মন, শরীর এবং পরিবেশ এক অন্তঃসামঞ্জস্যে মিলেমিশে যায়। ঠিক যেমন শান্ত হ্রদের জলে আকাশের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, তেমনি স্থিতির এই বিশুদ্ধ চেতনা জগতের প্রতিটি রূপকে ধারণ করে, কিন্তু নিজে অচঞ্চল ও দীপ্ত থাকে।
উত্থান বা সম্প্রসারণ হলো চেতনার সেই মুহূর্ত, যখন স্থির সচেতনতা নিজের আনন্দে গতি পায়, নিজের দীপ্তিকে ছড়িয়ে দেয়, সৃষ্টির প্রবাহে নেমে আসে। এটি চেতনার উচ্ছ্বসিত তরঙ্গ—যেখানে জানা কেবল স্থির প্রতিফলন নয়, বরং জীবন্ত ক্রিয়া। আধুনিক মনোবিজ্ঞানী মিহালি চিক্সজেন্টমিহালি এই উত্থানের মানসিক প্রতিরূপকে “প্রবাহ অবস্থা (Flow State)” নামে চিহ্নিত করেছেন।
এই প্রবাহ অবস্থা এমন এক অভিজ্ঞতা, যেখানে মানুষ সম্পূর্ণভাবে কোনো কাজে ডুবে যায়—মনোযোগ এত নিবিষ্ট হয় যে, আত্মসচেতনতা ম্লান হয়ে যায়, সময়ের বোধ হারিয়ে যায়, আর “আমি” এবং “কর্ম” এক হয়ে যায়। কেউ যখন নিখুঁতভাবে পিয়ানো বাজাচ্ছে, নৃত্য করছে, ছবি আঁকছে বা গবেষণায় নিমগ্ন—তখন এই উত্থানের ছন্দ সক্রিয় হয়। চিক্সজেন্টমিহালি বলেছেন, “প্রবাহ এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি সম্পূর্ণ সতেজ মনোযোগ, সম্পূর্ণ সম্পৃক্ততা এবং গভীর উপভোগের অনুভূতিতে মগ্ন থাকে।”
কাশ্মীর শৈব দর্শনের ভাষায় এই অবস্থা হলো উত্থান—চেতনার স্পন্দন যখন নিজের আনন্দে সৃষ্টিতে প্রবাহিত হয়। এখানে চেতনা নিছক পর্যবেক্ষক নয়; সে নিজেই সৃষ্টির গতি। এই উত্থানের মধ্যেই প্রকাশিত হয় কালীর সৃষ্টিশীল ও ধারক শক্তি—সৃষ্টিকালী, রক্তাকালী, সংহারকালী—এই তিন শক্তি চেতনার ক্রমবিকাশের তিন দিক: সৃষ্টি, প্রকাশ এবং রূপান্তর। যেমন একজন শিল্পী যখন সৃষ্টিতে ডুবে যায়, তখন তিনি নিজে আর আলাদা থাকেন না; সৃষ্টি, স্রষ্টা, ও সৃষ্টির প্রক্রিয়া—সব একাকার হয়ে যায়। এই একত্রীকরণই কালীর নৃত্য—চেতনার উত্থানরূপ স্পন্দন।
এই অবস্থায় কাজ কোনো পরিশ্রম নয়; বরং চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দপ্রকাশ। “আমি করছি” এই অহংবোধ বিলীন হয়, কেবল থাকে করা হচ্ছে—এক স্বতঃসিদ্ধ লয়। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানেও দেখা যায়, এই অবস্থায় prefrontal cortex—যেখানে আত্মমনিটরিং ও বিচারবোধ থাকে—তার কার্যকলাপ কমে যায় (transient hypofrontality)। ফলে আত্মসচেতনতার পর্দা সরলে চেতনা মুক্তভাবে প্রবাহিত হতে পারে।
এই উত্থান মানসিক ও শারীরিক দুই স্তরেই কামুক প্রাণশক্তির (libidinal vitality) এক রূপ—এক রকম জীবন্ত নৃত্য যেখানে শক্তি কেবল টিকে থাকে না, নিজেকে রূপান্তরিত করে। যেমন নদী নিজের গতিতে বাঁক নেয়, তেমনি চেতনা নিজের সৃজনশীল প্রবাহে রূপ, অর্থ, অনুভূতি, ও অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে।