এই দুটি অংশ একত্র হলে প্রজ্ঞাপারমিতা (Prajñā + Pāramitā) মানে দাঁড়ায়—“জ্ঞানের চূড়ান্ত পরিপূর্ণতা”, বা “সীমা অতিক্রমী পরম বোধি”। এটি সেই জ্ঞান, যা কোনো দ্বন্দ্ব বা ধারণার দ্বারা আবদ্ধ নয়—যেখানে “আমি” ও “অন্য”, “জ্ঞান” ও “অজ্ঞতা”, “রূপ” ও “শূন্যতা”—সবই এক পরম ঐক্যে মিলেমিশে যায়।
বৌদ্ধ তত্ত্বে প্রজ্ঞাপারমিতা শুধু ধারণা নয়; তিনি এক জীবন্ত দেবী, বোধির জননী—যাঁর থেকেই সব বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের জন্ম। তিনি চেতনার সেই নিখাদ স্তর, যেখানে শূন্যতা ও পূর্ণতা, ভাবনা ও নিঃশব্দতা, জ্ঞান ও করুণা—সব এক হয়ে যায়।
প্রজ্ঞা হলো সত্যকে দেখার অন্তরজ্ঞান, পারমিতা হলো সেই জ্ঞানের চূড়ান্ত পরিণতি, আর প্রজ্ঞাপারমিতা হলো সেই পরম জ্ঞান—যা চিন্তা ও ভাষার সীমা ছাড়িয়ে, অদ্বৈত চেতনার পরিপূর্ণ উপলব্ধিতে নিয়ে যায়।
মহাযান বৌদ্ধ দর্শন বৌদ্ধধর্মের এক গভীর ও দার্শনিক শাখা, যা হীনযান বা থেরবাদ ধারার পরবর্তী বিকাশ। “মহাযান” শব্দের অর্থ “মহান যান” বা “বৃহৎ পথ”—অর্থাৎ এমন এক আধ্যাত্মিক যাত্রা, যা কেবল ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য নয়, বরং সকল প্রাণীর মুক্তির উদ্দেশ্যে পরিচালিত।
“মহাযান” শব্দটি গঠিত হয়েছে দুটি অংশে—মহা (মহান) এবং যান (পথ বা বাহন)। অর্থাৎ “মহাযান” মানে “মহান বাহন”—যে-পথ জীবজগতের সর্বজনীন কল্যাণের বাহক।
মহাযান দর্শনের সূচনা হয় খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে, ভারতের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে। এটি প্রথমে এক সাধনামূলক ও চিন্তাধারাভিত্তিক আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়, পরে একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শন ও আধ্যাত্মিক বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এর প্রধান সূত্রগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে—প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র, লঙ্কাবতার সূত্র, অবতংসক সূত্র, এবং সদ্ধর্মপুণ্ডরীক সূত্র (লোটাস সূত্র)। এই গ্রন্থগুলো বুদ্ধের গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ করে, যেখানে চেতনা, করুণা, শূন্যতা এবং বোধির প্রকৃত অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
১. মূল তত্ত্ব—শূন্যতা (শূন্যতা / Śūnyatā): মহাযান দর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে শূন্যতা ধারণা। এর সবচেয়ে বিশদ বিশ্লেষণ পাওয়া যায় আচার্য নাগার্জুন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মধ্যমক দর্শনে (Madhyamaka Philosophy)।
নাগার্জুন তাঁর মূলমধ্যমককারিকা-এ বলেছেন—“যঃ প্রতীত্যসমুৎপাদঃ শূন্যতাং তাং প্রজানাতি।” অর্থাৎ, “যা-কিছু কারণ-সম্পর্কে উৎপন্ন, সেটিই শূন্য।”
এখানে “শূন্যতা” মানে নৈরাশ্য বা কিছু না থাকা নয়; বরং এর অর্থ—সব সত্তা ও বস্তু পরস্পরনির্ভর, কোনো কিছুরই স্বতন্ত্র, স্থায়ী অস্তিত্ব নেই। এই পরস্পরনির্ভরতা বা আপেক্ষিকতাই শূন্যতা। তাই মহাযান বলে—শূন্যতা মানে চেতনার অসীম সম্ভাবনা, যেখানে সব দ্বৈততা মুছে যায় এবং অদ্বৈত সত্য প্রকাশিত হয়।
২. বোধিসত্ত্ব আদর্শ: মহাযান দর্শনের প্রাণ হলো বোধিসত্ত্ব আদর্শ। হীনযান যেখানে ব্যক্তিগত মুক্তি (অর্হৎত্ব) চায়, মহাযান সেখানে বলে—“যাবৎ প্রাণী যতক্ষণ না মুক্ত, ততক্ষণ আমি নির্বাণে প্রবেশ করব না।”
বোধিসত্ত্ব সেই সাধক, যিনি নিজের মুক্তিকে বিলম্বিত করে সমস্ত জীবের মুক্তির জন্য করুণায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর দুই ডানা—প্রজ্ঞা (জ্ঞান) ও করুণা (সহানুভূতি)। প্রজ্ঞা তাঁকে বাস্তবতার সত্য দেখায়, আর করুণা সেই উপলব্ধিকে কর্মে রূপান্তরিত করে। এই দুই মিলেই জন্ম নেয় প্রজ্ঞাপারমিতা—জ্ঞানের চূড়ান্ত পূর্ণতা, যা মহাযান দর্শনের শীর্ষতত্ত্ব।
৩. দর্শনের তিন প্রধান শাখা:
মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের ভিতর তিনটি প্রধান শাখা বিকশিত হয়েছে—মধ্যমক, যোগাচার, এবং তথাগতগর্ভ। এই তিনটি ধারাই একদিকে একই অদ্বৈত চেতনার উপলব্ধির দিকে অগ্রসর হয়, কিন্তু তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।
মধ্যমক দর্শন (Madhyamaka)-এর প্রবর্তক ছিলেন আচার্য নাগার্জুন, যিনি বুদ্ধের শিক্ষার গভীরতম দার্শনিক বিশ্লেষণ প্রদান করেন। তাঁর মতে, বাস্তবতা কোনো একপেশে সত্য নয়। “আছে” বা “নেই”—এই দুটি চরম অবস্থাই মায়া, কারণ উভয়ই আপেক্ষিক। তিনি বলেন, জগতের সমস্ত কিছুই প্রতীত্যসমুৎপন্ন—অর্থাৎ পরস্পরনির্ভর কারণে উদ্ভূত; তাই কোনো কিছুরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। এই কারণেই তিনি ঘোষণা করেন—“যঃ প্রতীত্যসমুৎপাদঃ শূন্যতাং তাং প্রজানাতি”—যা-কিছু পারস্পরিক নির্ভরতায় জন্মায়, সেটিই শূন্য। এখানেই তিনি স্থাপন করেন “মধ্যপথ” (মধ্যমা প্রতিপদা) বা “মধ্যমক” ধারণা, যা শাশ্বতবাদ (চিরন্তন অস্তিত্বের বিশ্বাস) এবং বিনাশবাদ (সম্পূর্ণ নাশের বিশ্বাস)—এই দুই চরম সীমাকে অতিক্রম করে। নাগার্জুনের দৃষ্টিতে সত্য হলো এমন এক অবস্থান, যেখানে “অস্তিত্ব” ও “অস্তিত্বহীনতা”, “জন্ম” ও “বিনাশ”—সব দ্বন্দ্ব মুছে যায়। বাস্তবতা এখানে কেবল আপেক্ষিক রূপে প্রকাশিত; তার চূড়ান্ত প্রকৃতি অদ্বৈত ও শূন্য, অর্থাৎ “রূপই শূন্যতা, শূন্যতাই রূপ।”
দ্বিতীয় ধারা, যোগাচার (Yogācāra) বা চিত্তমাত্রবাদ (Cittamātra), শুরু করেন দুই ভাই আসঙ্গ ও বসুবন্ধু। এই দর্শন বলে, সমগ্র জগৎ আসলে চিত্ত বা চেতনার প্রতিফলন—বাহ্য জগৎ আলাদা কোনো স্বাধীন বাস্তব নয়। আমরা যা দেখি, তা আমাদের মনের প্রতিরূপ; রূপ, শব্দ, স্পর্শ—সবই মানসিক অনুকল্প।
“অনুকল্প” শব্দটি সংস্কৃত “অনু + কল্প” (anu + kalpa) থেকে উদ্ভূত। এখানে “কল্প” ধাতুর অর্থ “কল্পনা করা”, “মানসিকভাবে গঠন করা”, “সৃষ্টি করা” বা “আকৃতি দেওয়া”; আর “অনু” উপসর্গের অর্থ “অনুসারে”, “পরবর্তীভাবে” বা “অবলম্বন করে”। ফলে “অনুকল্প” শব্দের আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায়—“কোনো কিছুর অনুকরণে বা অনুসরণে মানসিকভাবে গঠিত রূপ।”
দার্শনিকভাবে বলতে গেলে, অনুকল্প মানে এমন একটি অবস্থা বা রূপ, যা স্বাধীনভাবে কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নয়, কিন্তু মন সেটিকে কল্পনার দ্বারা গঠন করে। এটি কোনো প্রত্যক্ষ বাস্তব নয়; বরং চেতনার প্রতিরূপ বা মানসিক প্রক্ষেপণ—যেখানে মন বাস্তবতার উপর নিজস্ব আকৃতি আরোপ করে এক “প্রতীয়মান বাস্তবতা” সৃষ্টি করে।
বৌদ্ধ যোগাচার বা চিত্তমাত্রবাদ দর্শনে “অনুকল্প” শব্দটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—আপনি যাকে “জগৎ” বলে উপলব্ধি করেন, তা বাহ্য বাস্তব নয়; বরং আপনার চেতনারই “অনুকল্প”—অর্থাৎ চিত্তের কল্পিত প্রতিফলন। রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ ও রস—এই সমস্ত অভিজ্ঞতাই চেতনার ভেতরে উদ্ভূত, বাইরে স্বাধীনভাবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। যেমন আপনি স্বপ্নে মানুষ, আলো, স্থান ও শব্দ দেখেন, কিন্তু জেগে উঠে বুঝতে পারেন যে সেগুলি আপনার মনেরই সৃষ্টি—ঠিক তেমনি, জাগ্রত অবস্থায় উপলব্ধ জগৎও চেতনার এক প্রক্ষেপণ, এক অনুকল্পিক বাস্তবতা।
একটি সহজ উদাহরণে বোঝানো যায়—ধরা যাক, আপনি দূরে কোনো ছায়া দেখে ভাবলেন, সেটি একজন মানুষ; পরে কাছে গিয়ে দেখলেন, আসলে তা একটি গাছের ডাল। এই ভুল ধারণা বা মানসিক আরোপই “অনুকল্প”—যেখানে মন নিজের পূর্বধারণা, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশার ভিত্তিতে বাস্তবতার উপর এক মানসিক রূপ চাপিয়ে দেয়।
যোগাচার মতে, সমগ্র বিশ্বজগৎই এমন এক অনুকল্পিক বাস্তবতা—যা চিত্তের প্রতিফলন। তাই তারা বলেন, “চিত্তমাত্রমিদং বিশ্বম্”—অর্থাৎ “এই সমগ্র বিশ্ব কেবল চিত্তমাত্র।”
অনুকল্প মানে—মানসিকভাবে গঠিত বা কল্পিত রূপ, যা বাহ্যিকভাবে স্বাধীন বাস্তব নয়, কিন্তু চেতনার প্রতিফলনে বাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়। যোগাচার দর্শনের আলোকে, আমরা যে জগৎকে দেখি ও অনুভব করি, তা আসলে চেতনারই অনুকল্প—মনের এক স্বপ্নসদৃশ প্রতিরূপ, যেখানে দর্শক, দর্শন ও দৃশ্য—সবই চেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিধ্বনি মাত্র।
এ দৃষ্টিতে “বাহ্যবস্তু” কোনো পরম সত্য নয়; বরং চেতনার প্রক্ষেপণ। তাই একে বলা হয় চিত্তমাত্রবাদ, অর্থাৎ “চিত্তই একমাত্র বাস্তব।” যোগাচার মতে, মনই সৃষ্টিকর্তা, মনই অনুভবকারী, এবং মনই শেষপর্যন্ত মুক্তির ক্ষেত্র। কিন্তু এই “মন” কোনো সীমিত মানসিক ক্রিয়া নয়; এটি আলয়বিজ্ঞান—এক গভীর, সর্বব্যাপী চেতনার স্রোত, যেখানে সমস্ত অভিজ্ঞতার বীজ নিহিত। যখন এই আলয়বিজ্ঞান সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হয়, তখনই প্রকাশিত হয় “বুদ্ধচেতনা”—অদ্বৈত জাগরণ।
আলয়বিজ্ঞান (Ālayavijñāna) মহাযান বৌদ্ধ যোগাচার দর্শনের অন্যতম গভীর তত্ত্ব। এটি এমন এক সূক্ষ্ম চেতনার স্তর, যা ব্যাখ্যা করে—কীভাবে আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, কর্মফল ও প্রবৃত্তি চেতনার অন্তর্গত ভাণ্ডারে সঞ্চিত থাকে এবং কীভাবে সেগুলি সময়ে সময়ে জাগ্রত হয়ে নতুন অভিজ্ঞতা ও জীবনের ঘটনাকে গঠন করে।
শব্দটি গঠিত হয়েছে দুটি অংশে—আলয় (Ālaya) ও বিজ্ঞান (Vijñāna)। “আলয়” মানে আশ্রয়, নিবাস বা ভাণ্ডার; আর “বিজ্ঞান” মানে চেতনা, উপলব্ধি বা জ্ঞানের প্রবাহ। ফলে “আলয়বিজ্ঞান”-এর আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায়: চেতনার আশ্রয় বা চেতনার ভাণ্ডার—অর্থাৎ সেই অন্তর্লীন স্তর, যেখানে সমস্ত মানসিক বীজ (bīja) বা অভিজ্ঞতার ছাপ সংরক্ষিত থাকে।
যোগাচার মতে, মানুষের চেতনা একক নয়, বরং এটি বহুস্তরীয়। আমরা সাধারণত যে-চেতনা অনুভব করি—দেখা, শোনা, চিন্তা করা, কামনা করা—তা কেবল উপরের তরঙ্গ; এর গভীরে প্রবাহিত হয় আলয়বিজ্ঞান, এক অবিরাম ও অচেতন চেতনার স্রোত। এই স্তরে আমাদের অতীত কর্ম, চিন্তা, অনুভূতি, প্রবৃত্তি ও স্মৃতির ছাপ বীজরূপে জমা থাকে। এই বীজগুলোই (কর্মবীজ) সুযোগ পেলে জাগ্রত হয় এবং নতুন অভিজ্ঞতা বা ঘটনার রূপ নেয়।
এই কারণেই আলয়বিজ্ঞানকে বলা হয় সর্ববীজকোশ—অর্থাৎ “সমস্ত বীজের ভাণ্ডার”। এখানে “বীজ” বলতে বোঝানো হয় শুধু নৈতিক কর্মফল নয়, বরং আমাদের চিন্তা, অনুভূতি, অভ্যাস ও প্রবৃত্তির সূক্ষ্ম ছাপও। যেমন একটি বীজ মাটিতে লুকিয়ে থেকে সঠিক পরিবেশে অঙ্কুরিত হয়, তেমনি এই মানসিক বীজসমূহও সুযোগ পেলে জাগ্রত হয় এবং আমাদের জীবনে নতুন চিন্তা, প্রবৃত্তি ও কর্ম হিসেবে প্রকাশিত হয়।
একটি সহজ উদাহরণে এটি বোঝা যায়। যেমন গভীর হ্রদের তলায় অসংখ্য কণিকা স্তিমিত অবস্থায় জমে থাকে, তেমনি আলয়বিজ্ঞান আমাদের চেতনার গভীরে সমস্ত অভিজ্ঞতার কণিকাগুলো সঞ্চিত রাখে। কোনো ইন্দ্রিয়সংযোগ বা মানসিক উদ্দীপনা ঘটলেই সেই সঞ্চিত বীজ উপরে উঠে এসে নতুন চিন্তা বা অভিজ্ঞতার রূপ ধারণ করে।
তবে যোগাচার স্পষ্টভাবে বলে যে, আলয়বিজ্ঞান কোনো স্থায়ী আত্মা নয়। এটি কোনো “চিরন্তন সত্তা” নয়, বরং এক প্রবাহমান প্রক্রিয়া—এক ধারাবাহিক মানসিক গতি, যেখানে প্রতিক্ষণ নতুন বীজ জন্ম নিচ্ছে এবং পুরনো বীজ ফল দিচ্ছে। তাই আলয়বিজ্ঞানকে বলা যায় চেতনার প্রবহমাণ ভিত্তি—একধরনের “অচেতন ধারাবাহিকতা” বা “stream of consciousness”, যা ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব ও কর্মফলের ধারাবাহিকতা ব্যাখ্যা করে, অথচ “আত্মা” ধারণা ছাড়াই।
এই তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করে কেন কর্মফল এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে গিয়ে প্রকাশিত হতে পারে। কারণ কোনো আত্মা না থাকলেও সেই কর্মবীজ আলয়বিজ্ঞানে সংরক্ষিত থাকে এবং সময় এলে তা ফল দেয়।
মুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, যখন সাধক ধ্যান ও প্রজ্ঞার দ্বারা নিজের আলয়বিজ্ঞান সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ করে ফেলেন—অর্থাৎ অজ্ঞানের ও ক্লেশের সব বীজ নিঃশেষ করেন—তখন সেই আলয়বিজ্ঞান রূপান্তরিত হয় মহাজ্ঞান বা বোধিচেতনা-তে। তখন আর কোনো অবশিষ্ট বীজ থাকে না, যা নতুন জন্ম বা দুঃখের কারণ হতে পারে। এই অবস্থাকেই বলা হয় বুদ্ধত্ব বা চূড়ান্ত নির্বাণ।
আলয়বিজ্ঞান হলো—
১. চেতনার গভীরতম ভাণ্ডার, যেখানে সমস্ত অভিজ্ঞতা, কর্মফল ও স্মৃতি বীজরূপে সঞ্চিত থাকে।
২. এটি কোনো স্থায়ী আত্মা নয়, বরং এক প্রবহমাণ চেতনার ধারা।
৩. এখান থেকেই আমাদের মানসিক গঠন, প্রবৃত্তি ও কর্মের জন্ম হয়।
৪. যখন এই স্তর সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হয়, তখনই চেতনা মুক্ত ও জাগ্রত হয়ে বুদ্ধত্ব লাভ করে।
আলয়বিজ্ঞান যোগাচার দর্শনের এমন এক তত্ত্ব, যা চেতনার গভীর, অবচেতন প্রবাহকে ব্যাখ্যা করে—যেখানে প্রতিটি চিন্তা, অনুভূতি ও কর্ম একেকটি বীজের মতো ভবিষ্যতের অভিজ্ঞতার ভিত্তি রচনা করে। এটি কেবল দর্শন নয়, বরং এক সূক্ষ্ম মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, যার সঙ্গে পরবর্তী পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞানের “unconscious mind”-এর ধারণারও বিস্ময়কর সাদৃশ্য দেখা যায়।