শৈব কালী: এক-শো চৌদ্দ



ফ্রান্সিসকো ভারেলার কর্ম-সঞ্জাত বোধ বা দেহভিত্তিক উপলব্ধি (enactive cognition) ঠিক এটিই জোর দিয়ে বলে—জগৎ আমাদের মাথার ভেতর তৈরি কোনো প্রস্তুত “ছবি” নয়, আবার মনের বাইরে পড়ে থাকা কোনো “তথ্য-পাথর”ও নয়; বরং দেহ-মস্তিষ্ক-পরিবেশের পারস্পরিক ক্রিয়ার ভেতরেই জগৎ “নির্মিত-হয়ে-উঠে” (enacted) থাকে। শৈব তত্ত্বে এই একই অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ পায় বাক্যে—“চিত্‌ই বিশ্বং ভবতি”: চেতনা নিজেই বিশ্বে পরিণত হয়। অর্থাৎ, যাকে আমরা “বিশ্ব” বলি, সেটি চেতনার স্ব-প্রকাশ ও স্ব-বিমর্শের ধারাবাহিক রূপায়ণ।

ভারেলার মতে, enactive cognition মানে হলো—“জানার মানে—করায় থাকা—করার মধ্যে নিজে থাকা।” অর্থাৎ, চেতনা বা জ্ঞান কোনো নিষ্ক্রিয় চিন্তার প্রক্রিয়া নয়; বরং জীবন্ত প্রাণী যখন ইন্দ্রিয় (sensation) এবং চালনা (motor action)—এই দুইয়ের পারস্পরিক যোগসূত্রে পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে, তখনই অভিজ্ঞতা বা অর্থ তৈরি হয়। সহজভাবে বললে, আমরা কেবল চোখে দেখা বা মনে ভাবার মাধ্যমে জগৎকে জানি না—আমরা কাজ করতে করতে, অনুভব করতে করতে জগৎকে জানি এবং গড়ে তুলি।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের ক্রমপন্থা (Krama) একই ধারণা অন্য ভাষায় বলে। সেখানে বলা হয়েছে—চেতনা (চিত্‌) স্থির আলো নয়, বরং এক জীবন্ত নৃত্য; যেখানে প্রকাশ (প্রকাশমান দিক বা আলোক) এবং বিমর্শ (নিজেকে চিনে নেওয়ার ক্ষমতা) একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে এক স্পন্দন (Spanda) সৃষ্টি করে। এই স্পন্দ থেকেই জগৎ ধাপে ধাপে উন্মোচিত হয়—স্থিতি (নিঃস্তব্ধ সচেতনতা), উত্থান (সৃজনশীল গতি) এবং বিলয় (অহং-এর বিলয় বা অতিক্রম)।

দুই দৃষ্টিই মূলত একই কথাই বলে—অভিজ্ঞতা কোনো স্থির বা প্রস্তুত জিনিস নয়। এটি প্রতিমুহূর্তে গড়ে ওঠে, বদলে যায়, আবার নতুনভাবে তৈরি হয়। যেমন আমরা হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা “পাই”—রাস্তাটা আগে থেকেই তৈরি নয়; আমাদের হাঁটার ছন্দেই পথের ধারাবাহিকতা জন্ম নেয়। হাঁটা থেমে গেলে পথও যেন বদলে যায় বা মিলিয়ে যায়। তেমনি, চেতনা ও জগতের সম্পর্কও এক ক্রমাগত উন্মোচনের ছন্দ—যেখানে জানা, করা, অনুভব করা—সব এক জীবন্ত প্রক্রিয়া।

এই মিলন আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় আধুনিক মনোবিজ্ঞানের “4E-cognition” ধারণায়, যেখানে বলা হয়—চেতনা বা জ্ঞান কেবল মাথার ভেতর নয়, বরং দেহ, পরিবেশ, ক্রিয়া ও উপকরণের সঙ্গে মিলিত এক জীবন্ত প্রক্রিয়া।

Embodied (দেহভিত্তিক): জ্ঞান কেবল মস্তিষ্কে থাকে না—পুরো দেহই জানার অংশ। আমাদের অনুভব, ভঙ্গি, শ্বাস, হৃদস্পন্দন—সব মিলিয়ে চিন্তা তৈরি হয়। শৈব দর্শনও বলে—দেহ কোনো বাধা নয়; দেহই শক্তির আসন, চেতনার মন্দির। স্পন্দ বা জীবন্ত কম্পন এখানেই ধরা পড়ে।

Embedded (পরিবেশনির্ভর): আমরা শূন্যে নেই; আমাদের চিন্তা–বোধ সব সময় পরিবেশে প্রোথিত। প্রেক্ষাপট বদলালে ভাবনাও বদলে যায়। শৈব দর্শনের কুল ধারণাও তাই বলে—সব কিছু এক মহাজাগতিক জালের মতো জড়িয়ে আছে, যেখানে কিছুই আলাদা নয়।

Enactive (ক্রিয়াশীল): আমরা করে করে জানতে পারি—কাজ করার মাধ্যমেই অর্থ গঠিত হয়। শুধু ভাবনা নয়, ক্রিয়াই জ্ঞানের ভিত্তি। শৈব তত্ত্বের বিমর্শ এটাই বোঝায়—চেতনা নিজের ক্রিয়ায় নিজেকেই চিনে ফেলে।

Extended (বিস্তৃত): চিন্তা আমাদের শরীরের বাইরে পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়—ভাষা, যন্ত্র, প্রযুক্তি, বা প্রতীক (symbol) দিয়ে। যেমন তন্ত্রে মন্ত্র, যন্ত্র, মণ্ডল—সবই চেতনার বাহ্যিক বিস্তার; এগুলোর মাধ্যমে চেতনা নিজের গভীরতাকে প্রকাশ করে।

সব মিলিয়ে, 4E-cognition আর শৈব দর্শন—দুটোই শেখায়, চেতনা কোনো বন্ধ ঘরে বন্দি নয়; এটি দেহ, ক্রিয়া, পরিবেশ ও উপকরণের সঙ্গে মিলে এক অবিরাম প্রবাহমান জ্ঞানপ্রক্রিয়া।

আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান বলে—আমাদের মস্তিষ্ক কেবল বাইরের জগতের তথ্য নিয়ে কাজ করে না, বরং নিজেই সবসময় ভবিষ্যদ্বাণী করে—“জগৎ কেমন হতে পারে।” মানে, এটি একরকম “পূর্বাভাস মেশিন।”

মস্তিষ্ক আগে থেকেই একরকম মানসিক মানচিত্র বা মডেল তৈরি করে রাখে—যেখানে সে ধারণা করে, পৃথিবী কেমন দেখতে, কীভাবে আচরণ করে, কী ঘটতে পারে। তারপর ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বাস্তব তথ্য এলে, সেই তথ্যকে নিজের মডেলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। যদি দুটো না মেলে, তখন সে বুঝতে পারে, কোথাও ভুল হয়েছে—এই ভুলকেই বলে prediction error বা “পূর্বাভাসের ত্রুটি।”

এরপর মস্তিষ্ক সেই ভুল ঠিক করতে নিজের মডেল বা ধারণাকে বদলে ফেলে, যাতে বাস্তবের সঙ্গে মেলে। আবার নতুন তথ্য আসে, আবার মিলিয়ে দেখে—এইভাবেই একটানা চলে “জানা ও সংশোধনের” চক্র।

অর্থাৎ, মস্তিষ্কের কাজ শুধু দেখা বা শোনা নয়—বরং “কী দেখতে বা শুনতে চলেছি” তারই এক অবিরাম অনুমান আর সংশোধন। তাই জ্ঞান আসলে একপ্রকার চলমান সাধনা: ধারণা করা, যাচাই করা, ভুল দেখা, সংশোধন করা—এই অবিরাম চক্রেই আমাদের জানা আরও স্পষ্ট ও গভীর হয়।

এই বৈজ্ঞানিক বিন্যাসের সঙ্গে কাশ্মীর শৈবদর্শনের ‘ক্রম’ (Krama) তত্ত্ব আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখায়, তবে তা আরও গভীর অস্তিত্বগত স্তরে। এখানে চেতনা (চিত্) প্রথমে সম্ভাবনা হিসেবে নিজেকে ধারণ করে—অদ্বৈত, অচঞ্চল, প্রভাময়। সেই সম্ভাবনা থেকে ধীরে ধীরে রূপের উন্মোচন ঘটে—এটাই উত্থান; উন্মোচিত রূপে স্থায়ী বোধের ছাপ পড়ে—এটাই স্থিতি; এবং শেষত সেই ছাপ নিজ সম্ভাবনায় গুটিয়ে যায়—এটাই বিলয়। সৃষ্টি-স্থিতি-লয় কোনো বিচ্ছিন্ন তিন ঘটনা নয়; তারা একটানা শ্বাসের দুই দিক ও তার নিঃশ্বাস—প্রকাশে জগৎ জ্বলে ওঠে, স্থিতিতে অর্থ পায়, বিলয়ে অর্থ নিজের উৎসে ফিরে মিশে যায়।

বিজ্ঞান আর দর্শনের ভাষায় এখানে বলা হচ্ছে—আমাদের জানার প্রক্রিয়া দুই দিক থেকে একসাথে কাজ করে।

প্রথম দিকটি “উপর থেকে নিচে” (top-down): অর্থাৎ আমাদের মস্তিষ্ক বা চেতনা আগেই এক ধারণা বা মডেল তৈরি করে রাখে—জগৎ কেমন, কী ঘটতে পারে ইত্যাদি। এই দিকটা শিবের মতো—নির্মল, নীরব, আলোয় ভরা। তিনি নিজে কিছু করেন না, কিন্তু তাঁর উপস্থিতিই সম্ভাবনাকে রূপ নেওয়ার দিশা দেয়।

দ্বিতীয় দিকটি “নিচ থেকে উপরে” (bottom-up): অর্থাৎ ইন্দ্রিয় থেকে আসা বাস্তব তথ্য—চোখে দেখা, কানে শোনা, স্পর্শ ইত্যাদি—এইসব আসলে শক্তির তরঙ্গ। শক্তি এখানে সেই সক্রিয় স্পন্দন, যিনি স্থির চেতনার আলোয় নাচ আনেন, রূপ ও গন্ধ ও শব্দকে জাগিয়ে তোলেন।

যখন এই দুই দিক—শিবের নীরব আলো আর শক্তির চলমান স্পন্দন—একত্র হয়, তখনই আমাদের অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। এটি শুধু বাইরের বস্তু দেখা নয়, আবার শুধু মনের কল্পনাও নয়; বরং এই দুইয়ের মিলন।

যেমন নদীর জল নিজের ঢেউয়ে নিজের পথ গড়ে তোলে, তেমনি চেতনা নিজেই জানার মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। এই অভিজ্ঞতাই ‘প্রকাশ-বিমর্শ’—যেখানে ‘প্রকাশ’ মানে চেতনার দীপ্তি, আর ‘বিমর্শ’ মানে সেই দীপ্তির নিজের প্রতি সচেতনতা—“আমি এভাবেই দেখছি” এই বোধের জাগরণ।

এই দৃষ্টিতে শৈব ‘ক্রম-চেতনা’কে বলা যায় সর্বোচ্চ স্ব-মডেল—নিজের স্পন্দনে যে জগৎ, ভাষা, ভাবনা ও অনুভবের সমগ্র নাট্যগৃহ নির্মাণ করে, আবার সেই নির্মিতির মধ্য দিয়েই প্রতি মুহূর্তে নিজ সম্ভাবনাকে চিনে নেয়। পূর্বাভাস-প্রক্রিয়ার ভাষ্যকে তাই কেবল স্নায়ুবিজ্ঞানের তত্ত্ব বললে কম বলা হয়; এটি শিব-শক্তির অদ্বৈত নৃত্যেরই একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক ছায়াপ্রতিচ্ছবি—যেখানে চেতনা, জগৎ ও জ্ঞান পরস্পরকে জন্ম দেয়, শোধন করে, আর শেষত এক সমাহিত ঐক্যে—প্রকাশের অতীতে, বিমর্শের অন্তরে—নিশ্চল দীপ্তিতে বিলীন হয়ে যায়।

উদাহরণ ১—ফ্লো স্টেট (Flow State): ধরুন, আপনি পিয়ানো বাজাচ্ছেন। আঙুল, চোখ, কান—সব একসঙ্গে এমনভাবে কাজ করছে যে, “আমি বাজাচ্ছি”, এই ভাবটাও হারিয়ে যায়। কর্তা আর কর্ম আলাদা থাকে না, যেন সংগীতই আপনাকে বাজাচ্ছে। নিউরোসায়েন্সে একে বলে সাময়িক সম্মুখ-মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয়তা (transient hypofrontality)—মানে, আত্মমনিটরিং বা “আমি করছি” ভাব কমে যায়, আর দেহ-ইন্দ্রিয়ের সমন্বয় বাড়ে। শৈব দর্শনে একে বলা যায় উত্থান বা স্পন্দ—চেতনার আনন্দময় গতি, যেখানে আলো হারায় না, কিন্তু ক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবাহিত হয়।

উদাহরণ ২—উন্মুক্ত পর্যবেক্ষণ ধ্যান: এখানে আপনি শুধু লক্ষ্য করছেন—শ্বাস উঠছে-নামছে, শব্দ আসছে-যাচ্ছে, ভাবনা ভেসে আসছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। কিছু ধরার চেষ্টা নেই, শুধু দেখা। তখন মস্তিষ্কের বিশ্রামকালীন কার্যকলাপ চক্র (Default Mode Network) শান্ত হয়ে যায়, “আমি-কেন্দ্রিক” চিন্তা থেমে যায়। এই অবস্থাকে বলা যায় স্থিতি—অন্তর্নিহিত স্থির সচেতনতা, যেখানে চেতনা নিজের নীরব দীপ্তিতে স্থিত।

উদাহরণ ৩—অহং অতিক্রম (Ego Dissolution): গভীর ধ্যানের সময় বা তীব্র সৌন্দর্য-অভিজ্ঞতায় অনেক সময় মনে হয় “আমি” আর “বিশ্ব”-এর আলাদা সীমানা নেই। সব একসঙ্গে মিশে যায়, শুধু এক অসীম শান্তি থাকে। নিউরোলজিক্যাল দিক থেকে একে বলে সামগ্রিক সমতালে কার্যকলাপ (global synchrony)—মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ একসঙ্গে ছন্দবদ্ধ হয়। শৈব ভাষায় এটি বিলয়—চেতনার সীমা গলে অসীমে স্থিত হওয়া। এটি কোনো ধ্বংস নয়, বরং পূর্ণ মিলন—যেখানে ব্যক্তি ও বিশ্ব একাত্ম হয়ে যায়।

ভারেলার ভাষায় স্ব-উৎপাদন বা স্ব-পরিচালনা (autopoiesis) মানে—জীবন নিজেরই উৎপাদন-রক্ষণ-পুনর্গঠনের এক চলমান কৌশল। একটি কোষকে ধরুন: ঝিল্লি যেন তার স্বাক্ষর; এই সীমানা তাকে পৃথক করে, আবার এই সীমানাই বহির্জগতের সঙ্গে পুষ্টি, শক্তি, তথ্যের আদান-প্রদানের দরজা। সীমানা তাই দেয়াল নয়, বুদ্ধিমান ছাঁকনি—যা বেছে বেছে প্রবেশ ঘটায়, বেছে বেছে বহিষ্কার করে, আর সেই বাছাই-ছাঁটাইয়ের মাধ্যমেই “আমি কে”, এই সংগতি বজায় থাকে।

জীবিত সত্তা ঠিক এমনই: ভেতরকার রাসায়নিক/স্নায়বিক নেটওয়ার্ক নিজেকে টিকিয়ে রেখে আবার নিজেদের নিয়ম বদলায়, নতুন গঠন আনে, পরিবেশের চাপ বা সম্ভাবনা দেখে নিজেকে রূপায়িত করে—এমন এক স্ব-প্রসুৎ, স্ব-নিয়ন্ত্রক নৃত্য। এ কারণেই ভারেলা বলেছিলেন, জানা মানেই করা—সক্রিয় সৃষ্টি/গঠন (enaction), কারণ এই স্ব-উৎপাদনশীল দেহ/মস্তিষ্ক পৃথিবীর সঙ্গে নাচতে নাচতেই “জগৎ” বানায়, আর সেই বানানো জগতেই আবার নিজেকে পড়ে ও বোঝে।

শৈব-তত্ত্বে এই বোধটি বিমর্শ-শক্তি নামে অনুরণিত হয়। চিত্‌ প্রথমে নিঃশব্দ আলোক—প্রকাশ—যেখানে সম্ভাবনা অপরিমেয়। কিন্তু শুধু আলো থাকলে জগৎ হয় না; আলোকে নিজেকে “দেখতে” হয়—এই আত্ম-অন্বেষণই বিমর্শ: “আমি এভাবেই দেখি, এভাবে জানি।” এই আত্ম-বোধের স্পর্শে আলোতে তরঙ্গ ওঠে—স্পন্দ—আর সেই স্পন্দে রূপ, ধ্বনি, সময়, অর্থ, সম্পর্ক উদ্ভাসিত হয়।

এখানেই autopoiesis-এর সঙ্গে শৈব ভাষার সংযোগ: যেমন একটি জীব নিজের সীমা রেখে সীমা ভাঙে—ঝিল্লি টিকে থাকে, আবার নিজেকে নিত্য নবায়ন করে—তেমনি চেতনা আত্মজ্ঞান দিয়ে নিজের পরিচয় ধরে রাখে, আবার স্পন্দে সেই পরিচয়কে অতিক্রম করে নতুন রূপে খেলায় নামে। সীমানা তাই নিছক বেঁধে রাখা নয়; সীমানা হচ্ছে প্রকাশের ব্যাকরণ—যার ভেতরে বিমর্শ শব্দ বসায়, আর স্পন্দ ছন্দ দেয়। ফলত “জগৎ” কোনো স্থির বস্তু নয়, বরং সম্পর্ক-উদ্ভূত এক চলমান রচনা—এইমাত্র যে-অর্থ ছিল, পরক্ষণেই নতুন প্রেক্ষিতে তা পাল্টে যায়; ঠিক যেমন ক্রম-এর ধারাবাহিক উন্মোচনে উত্থান-স্থিতি-বিলয় একটানা শ্বাসের মতো চলতে থাকে।

কগনিটিভ সায়েন্স বলে—চেতনা কোনো এক জায়গায় বন্দি নয়; এটি শরীর, মস্তিষ্ক ও পরিবেশ—এই তিনের মিলিত ক্রিয়া।

প্রথমে enaction, মানে আমরা কাজের মাধ্যমে জগৎ তৈরি করি—দেখে, ছুঁয়ে, করে।

দ্বিতীয়ত prediction, মানে আমরা সব সময় ভবিষ্যৎ অনুমান করি—“এরপর কী ঘটবে” ভেবে নিজের প্রতিক্রিয়া তৈরি রাখি।

তৃতীয়ত regulation, মানে আমরা নিজের ভেতরের অনুভূতি আর বাইরের পরিবর্তনের মধ্যে ভারসাম্য রাখি।

এই তিন প্রক্রিয়া মিলেই জীবনের মূল কৌশল—নিজের ছন্দ বজায় রেখে, বাইরের জগতের সঙ্গে তাল মেলানো।

শৈব ক্রমদর্শন একই কথাকে আরও কাব্যময় ভাষায় বলে: চেতনা এক অবিরাম “প্রকাশ-বিমর্শ-স্পন্দ।” অর্থাৎ, চেতনা আলোয় নিজেকে প্রকাশ করে, সেই আলো নিজের দিকে ফিরে তাকায় (বিমর্শ), আর সেই আত্ম-দৃষ্টির কম্পনেই বিশ্ব সৃষ্টি হয় (স্পন্দ)।