ছোটোবেলায় অনেকেই আমাকে ট্যাপা ডাকত, কেউবা ডাকত পটকা; আর কারও সাথে একটু খুনসুটি লাগলেই চট করে সে আমার পেট গালাতে চাইত। এমনিতে প্লীহার রোগীদের পেটের আকৃতি বেমানান, তার উপর অতটুকুন বয়সেই পরতাম লুঙি। লুঙিটা কোনোমতে আলুথালু করে জড়িয়ে পেটের উপর ছোটোখাটো একটা ঢিবি বানিয়ে রাখতাম। আমার হাত-পা এত বেশি সরু সরু ছিল যে, ওই বেমানান পেট ও তার উপরের ঢিবিটাই আমার অস্তিত্বের স্বরূপ হয়ে থাকত।
বাবার ধারণা ছিল, ঠিকমতো আলো-হাওয়া না লাগলে মস্তিষ্কের বৃদ্ধিলাভে অসুবিধে হয়। আর সেজন্য আমাকে প্রায়ই চুল কামিয়ে মাথার চামড়া বের করে থাকতে হতো। আয়নায় মাঝে মাঝে নিজের চেহারা দেখে কখনও পটকা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।
দৈহিক দিক দিয়ে পটকা বানিয়ে রাখলেও সৃষ্টিকর্তা আমার মগজের মধ্যে সরস কিছুর জোগান দিতে কার্পণ্য করেননি, তাই আমার বুদ্ধিসুদ্ধি ছিল একটু বেশিই। ক্লাসে বরাবরই আমি ফার্স্ট হতাম, কিন্তু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আমার ধারে কাছেও ঘেঁষত না; কেননা আমার ওই একটি মাত্র লুঙি দিয়ে সব সময় ভুরভুর করে গন্ধ বেরুত। আমি প্রায়ই পেছনের খালি একটি বেঞ্চে একাকী বসতাম।
পণ্ডিতমশায় অবশ্য বাকিদের মতো আমাকে হেলা করতেন না। উনি বলতেন, আমার মগজের মধ্যে বুদ্ধি নাকি ঠাসাঠাসি করে গিজগিজ করছে। রীতিমতো আশা ছিল তাঁর আমাকে নিয়ে। আর সেই আশায় বাজি রেখে এই পটকা যেদিন স্টার মার্ক পেয়ে স্কুল ডিঙালো, তখন বিংশ শতাব্দীর বয়স ৯১।
এখন ২০০৯, মাঝখানে ১৮টি বৎসর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ছোটোবেলার সেই প্লীহার রোগীটি হঠাৎ করেই সমাজে সামনের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে!
গেল শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকেই আমার ভাগ্যের দরজা খুলে যায়। তারপর তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে এত উপরে উঠে এসেছি যে, পেছন ফিরতে ভয় হয়, পাছে পা ফসকে আবার নিচে পড়ে না যাই। স্টার মার্ক পেয়ে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হলেও ওই লাইন আমাকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারেনি। ইন্টারমেডিয়েটে বার দুয়েক ফেইল করে এবং বছর দুয়েক লস দিয়ে যখন ভেতরে-বাইরে চরম হতাশায় ভুগছিলাম, তখন একদিন নওয়াবপুর রোডের চিপাগলি পেরিয়ে এক পিরসাহেবের আখড়ায় গিয়ে হাজির হলাম।
অল্পদিনেই পিরবাবার দারুণ ভক্ত হয়ে পড়লাম, তদুপরি পিরবাবার ভুঁড়ি ও ওঁর মাসিক ইনকামের প্রতি লোভ সামলাতে আমার বেশ কষ্ট হতো। উনি রোগী প্রতি এক হাজার টাকা করে হাদিয়া নিতেন এবং দৈনিক গড়ে শ-দুয়েক রোগী বিদায় করতেন। পিরবাবার কাছ থেকে তালিম নিতে বেশ কিছু সময় লেগে গেল।
বছর দুয়েক পর যখন পিরবাবার আখড়া থেকে বিদায় নিলাম, তখন আমি আর সেই প্লীহার রুগিটি নেই, পুরোদস্তুর পিরসাহেব। মুখে দাড়ির আগাগুলো পেট ছুঁই ছুঁই করছে, পায়ের গোড়ালি অবধি কুর্তা। কুর্তার নিচ দিয়ে অল্প একটু ভুঁড়ির আভাস, হাতে গোছা-দুই তসবিহ আর মাথায় খান্দানি চুলের উপর সারাক্ষণের জন্য বড়ো বড়ো আরবি হরফে ‘আল্লাহ’ লেখা একটি গোলগাল টুপি। মিরপুর কালাপানিতে টিলার মতো ছোট্ট ঢিবির মাথায় এক নিমতলার গোড়ায় আমার পিরজীবনের সূচনা।
উদ্দেশ্যহীন হয়ে যখন ওই গছতলায় বসে ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখনই আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে আমার ভাগ্যদ্বার খুলে গেল। দেখলাম, নিমগাছের গা থেকে পানি ঝরছে। (নিমগাছে একধরনের রোগ হলে গা দিয়ে পানি ঝরে।) চোখ বুজে একবার পিরবাবাকে স্মরণ করলাম; পিরবাবার বিরাট ভুঁড়িটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল আর মনে হলো, পিরবাবা যেন বলছেন, বসো! আর নড়িয়ো না, ওইখানেই শিকড় দাবাইয়া দাও!
তারপর শুরু হলো সাধনা। নানা কসরতে মাথা ঝাঁকানো ও মাঝে মাঝে ‘হক মাওলা’ বলে চিৎকার করে ওঠা। অল্প কয়েক দিনেই বেশ কিছু সংখ্যক ভক্ত জুটে গেল! ভক্তরা চারিদিকে ছড়িয়ে দিল, কালাপানিতে এক পিরবাবা এসেছেন আর সেই পিরবাবা যে-গাছের নীচে বসেছেন, সে গাছ ফেঁড়ে আল্লাহর কুদরতের পানি ঝরছে। ওঁর মতো কামেল পির আর হয় না— ওঁর কুদরতি পানি খেলে যে-কোনো রোগ ভালো হয়—এমনকী উনি মরা মানুষও জ্যান্ত করতে পারেন!
এমন ধরনের বিভিন্ন কথা আমার অন্ধ ভক্তরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একাকার করে দিল। তারপর থেকে আমি যে কত রুগির চিকিৎসা করেছি, তার হিসেব নেই। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এসে পানি, তেল ইত্যাদি পড়িয়ে নিয়ে যায়।
ইদানীং ভুঁড়িটা কিছু বেড়েছে বটে, তবে চেহারার জৌলুস অনেকটা কমে গেছে। যার টাকা আছে, তার ভুঁড়িও আছে; যার টাকা নেই, কিন্তু ভুঁড়ি আছে, বুঝতে হবে, তার জ্ঞান-বুদ্ধি নেই। চেহারার জৌলুস কমলেও আমার ভক্ত কমেনি; কিন্তু এসব আমার আর ভালো লাগে না। ভাবছি, গুলশানের বাড়িতে সুইমিংপুলটা কমপ্লিট হলেই এ জীবন ছেড়ে দেবো। তারপর একটা বিয়ে আর একটা সংসার—মাঝখানের এই বছরগুলি শুধুই মধুর স্মৃতি হয়ে থাকবে।